‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১৯||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
অঙ্কিতের কথা শুনে আমি আর কোয়েল পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখলাম আদিত্য এক হাতে পকেটে গুঁজে আরেকহাতে ফোন ঘাটতে ঘাটতে আসছেন আর ওনার পকেটে গোঁজা হাতের বাহু জড়িয়ে জিয়া হাসতে হাসতে এদিকেই আসছে। জিয়া নিজের মতো কথা বলছে হেসে হেসে আর আদিত্য মাঝে মধ্যে হেসে ওর দিকে তাকাচ্ছেন। এসব দেখে আমি কোয়েলের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলাম অর্থাৎ একে মেনে নিতে বলছিলি তুই আমায়।
‘কি ব্যাপার তোরা এখানে কি করছিস কোয়েল?’
‘আমরা এখানে কি করছি না করছি জেনে তোর কি কোনো কাজ আছে?’
কোয়েলের কথায় জিয়া হেসে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
‘একদমই না। আমি আমার পার্টনারকে এতদিন পর পেলাম আমার কাছে, আমার মতো করে। আমার আর কোনো কিছুর দরকারই নেই। মৌমিতা তো খুব কষ্ট পাচ্ছিলো আদিত্যের না আসায় তাই একটু দেখা করাতে এলাম ওর সাথে।’
আমি জিয়ার কথার কোনো উত্তর দিতে যাবো এমন সময় সৌভিকদা বললো,
‘বাট যাকে দেখা করাতে এনেছিস সে তো চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না মৌমিতার দিকে।’
জিয়া আর সৌভিকদার কথায় সবাই হাসতে থাকলো ওদের দলের। আমি শুধু একবার আদিত্যের দিকে একবার তাকালাম তিনি তখনও একভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। জিয়া আবার বললো,
‘আসলে কি বল তো? দেখতে ভালো লাগবে তারপর তো আদি ওকে দেখবে। আদি কেন, কোনো ছেলেই এমন বেহেনজিদের দেখতে চাইবে না। চল, চল।’
ওরা চলে যেতেই আমিও চলে এলাম ওই জায়গা থেকে। পিছন থেকে কোয়েল ডাকলেও সাড়া দিলাম না। তাই কোয়েল আমার সামনে এসে আমার পথ আটকে দাঁড়ালো।
‘কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাস না?’
‘ভালো লাগছে না। যেতে দে।’
‘এভাবে মাথা গরম করিস না মৌ। পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা কর, আদিত্যদা…
‘আমি আর কোনো কিছু শুনতে চাই না ওনার সম্পর্কে। প্লিজ।’
আমি কোয়েলের কাছে হাত জোড় করে কথাটা বলতেই কোয়েল চুপ করে গেলো।
‘ক্লাসে যাবি না?’
‘নাহ তুই যা। আমার একদম ইচ্ছা নেই।’
‘হস্টেল ফিরে যাবি নাকি তাহলে?’
‘নাহ, লাইব্রেরি যাচ্ছি। তোর ক্লাস শেষ হলে একসাথে যাবো। আমাকে একটু নোটসটা দিয়ে দিস। আমি আসলাম।’
কোয়েলকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে এলাম। সত্যি কিছুই ভালো লাগছে না। এভাবেও মানুষ পরিবর্তন হতে পারে? যেই আদিত্য কিছুদিন আগেও আমাকে জিয়ার থেকে আগলে রাখছিলো আজ সেই আদিত্যই মুখ বুজে সবটা মেনে নিলেন। মাঝে মাঝে হাসি পায় নিজের কপালের উপর, আমি জানো সবার হাসির খোরাক হয়ে উঠেছি। মনে মনে ঠিক করেছিলাম কোয়েলের কথাগুলো ভেবে দেখবো। উনি যদি সত্যি সবটা ঠিক করতে চায় তাহলে ওনাকে আর আমাদের এই সম্পর্কটাকে একবার সুযোগ দেবো। কিন্তু এখন তো আর এসবের প্রশ্নই আসে না।
৩৪.
কোয়েল ক্লাস শেষ করেই লাইব্রেরির দিকে আসছে তা মাথা তুলতেই দেখতে পেলাম। এদিক ওদিক তাকিয়েই বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছি বই পড়ার থেকে। মন বসছে না কিছুতেই। কোয়েল এসে আমার পাশে বসলে আমি বললাম,
‘হস্টেল যাবি তো?’
‘উমম…নাহ।’
‘তো? কোথায় যাবি?’
‘চল তো আগে তারপর বলবো।’
‘মানে টা কি..??
আমি কথা শেষ করার আগেই কোয়েল আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলতে শুরু করলো। না জানি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বেশ অনেক্ষন হাঁটার পর দেখলাম কোয়েল শপিং মলে ঢুকছে।
‘এখন আবার কি কিনবি?’
‘ওই কিছু মেক-আপ আর ড্রেস কিনতে হবে। চল।’
আমিও আর বাঁধা দিলাম না এমনিতেও মন ভালো নেই। হস্টেলে গিয়ে শুধু বসে থাকলে সেই একই ভাবনাগুলো ঘোরাঘুরি করবে আর শান্তি পাবো না। তার থেকে কেনাকাটা করলে হয়তো একটু শান্তি পাওয়া যাবে। শপিং মলে ঢুকে ড্রেস যেখানে পাওয়া যায় সেই ফ্লোরে চলে গেলাম। ড্রেস দেখতে দেখতে হঠাৎ কোয়েল বলে উঠলো,
‘আচ্ছা অঙ্কিত কেন কিছু বললোনা তখন?’
আমি কোয়েলের কথা শুনে তাচ্ছিল্য হেসে বললাম,
‘যার বলা উচিত সেই যখন কিছু বলেনি তখন অঙ্কিত কি বলবে বল তো?’
‘সত্যি কি তাই? আগের দিন তো বললো।’
‘আগের দিনের ঘটনার সাথে আজকের দিনের ঘটনার অনেক তফাৎ আছে কোয়েল। বেকার আদিত্যকে ভালো ভাবার জন্য অন্য সত্যিগুলোর মধ্যে মিথ্যে খোঁজা বন্ধ কর।’
আমি অন্য পাশে চলে এলাম কথাটা বলে। বিষয়টা একটু হলেও ভাবাচ্ছে এখন আমাকে কিন্তু অঙ্কিত বলতোই বা কি?
‘কম সে কম জিয়াকে থামতে তো বলতে পারতো অঙ্কিত? ও আর আদিত্যদার পজিশন কিছু কম না একে অপরের থেকে। একটা মানুষ হুট করে কি করে এতটা বদলে যেতে পারে? কিছুদিন আগেই তোর এতটা খেয়াল রাখছিলো আর আজ পাত্তাই দিলো না? এটাই ভাবাচ্ছে আমাকে দ্যাট সেট।’
কোয়েল আমার পাশে এসে কথাটা বললে আমি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এই একই কথা তো আমাকেও ভাবাচ্ছে। এতটা বদল?
‘ছাড়, এসব নিয়ে ভেবে কাজ নেই। ওই দেখ ওদিকে কি সুন্দর একটা লেডিস জ্যাকেট। চল।’
আমি আর কোয়েল ড্রেস কিনে নিলাম অনেকগুলো। এতেই হাত ভর্তি হয়ে গেছে, এই মেয়ে নাকি এখনও জুতো, মেক-আপ কিনবে। এতকিছু নিয়ে বাড়ি ফিরবো কি করে এটা ভাবলেই আমার হাড়-হিম হয়ে যাচ্ছে।
‘এই কোয়েল, চল আজকে আর দরকার নেই আবার কালকে আসবো।’
‘চুপ করবি তুই?’
কোয়েল রেগে ধমক দিলে আমি আমতা আমতা করে বললাম,
‘এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি নাকি এতগুলো ব্যাগ নিয়ে? কতগুলো বল তো? দু-হাতে শুধু ব্যাগ আর ব্যাগ।’
__’আমি থাকতে ম্যাডামদের আর কোনো কষ্ট করতে হবে না।’
আমি পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম অঙ্কিত। ওকে দেখে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তুমি এখানে কি করে?’
অঙ্কিত আমার কথার উত্তর দেবে তার আগেই কোয়েল নিজের হাতের জিনিসগুলো ওর হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো,
‘আমি ডেকেছি। না এবার চটপট তোর ব্যাগগুলো দে ওকে।’
অঙ্কিতের কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে হাসি পেয়ে গেলো। কিন্তু কোয়েলের দিকে তাকাতেই ওর রাগী মুখ দেখে চুপচাপ অঙ্কিতের হাতে দিয়ে দিলাম ব্যাগগুলো।
‘বাপ রে, পুরো শপিংমলটা কিনে ফেলেছো তো?’
‘কি বললে?’
‘ককিছু না। আমি আসি হ্যাঁ।’
অঙ্কিত কোয়েলের ভয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়লো। আমি সেই দেখে কোয়েলের দিকে তাকাতেই হেসে দিলো কোয়েল। আমিও হেসে দিলাম ওর সাথে সাথে।
‘ইশ, বেচারাটার মুখটা দেখেছিলি?’
‘আজকে চুপ করে থাকার শাস্তি। ভালো হয়েছে। এখন চল, ভিতরে চল।’
আমি কোয়েলের কথা অনুযায়ী সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম স্পা পার্লর। আমি কোয়েলের হাত ধরে সঙ্গে সঙ্গে বাঁধা দিয়ে বললাম,
‘তুই পাগল হয়ে গেছিস? আমরা এখানে কেন যাবো?’
‘স্পা পার্লরে মেয়েরা কেন আসে বইন?’
‘আরে বাবা আমার কাছে এতো টাকা নেই। এখানে কত খরচ জানিস?’
‘চুপ করবি তুই? টাকা নিয়ে ভাবতে হবে না চল তুই।’
‘আরে না না। আমি একদম যাবো না।’
‘তুই যাবি না তোর ঘাড় যাবে, চল।’
কোয়েল আমাকে জোর করে, একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে ভিতরে নিয়ে গেলো আমাকে। কতবার পালানোর চেষ্টা করলাম পালাতে পারলাম না। কি যে নার্ভাস লাগছে আমার, কত টাকা বিল হবে এই ভেবেই আমার আত্মারাম খাঁচা হয়ে যাচ্ছে।
স্পা শেষে ওখান থেকে বেরিয়ে এলে কোয়েল আমাকে বললো,
‘চল, চুল কাটবো। খুব একটা দেরী হয়নি।’
আমি না বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছি কোয়েলের দিকে। স্পা পার্লরে দেখতেও পেলাম না কিভাবে পে করলো। এখন আবার বলছে চুল কাটবে?
‘কি রে? এরকম হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।’
আমাকে টেনে টেনে কোয়েল নিয়ে গেলে আমি কিছুই বুঝলাম না। চুল কাটার পর, চুলে স্পা করে কোয়েল আমার সাথে বেরিয়ে এলো।
‘পে করলি না?’
কোয়েল হাসলো আমার প্রশ্নের উত্তরে আর হঠাৎ করে চোখের সামনে একটা ক্রেডিট কার্ড ধরলো। তারপর সেটা নামিয়ে নিয়ে বললো,
‘মেক-আপ আর জুতো কিনে ডিরেক্ট একটা রেস্টুরেন্টে যাবো দ্যান হস্টেল। ভাগ্যিস আজকে ভার্সিটি থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে ছিলাম লাঞ্চের পর পরই।’
‘কিন্তু এটা কার ক্রেডিট কার্ড?’
‘রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি, আর কিছু? আর একটা প্রশ্ন করলে এইখান থেকে ধাক্কা মাইরা ফেলায় দিমু। হুহ!’
কোয়েল আগে আগে হেঁটে গেলে আমি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। কি আজব মেয়েরে বাবা! কিন্তু ও আমার জন্য এতো কিছু কেন করছে? যে কোনো দিন অন্য কাওর সাথে তেমন মেশেনি সে আজ আমার জন্য এতো করছে? কেন?
‘কি রে ব্যাঙ! চল না। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো?’
আমি আর কথা না বাড়িয়ে কোয়েলের সাথে এগোলাম। কোয়েলের কথা মতো মেক-আপ, কসমেটিকস, জুতো কিনে, মল থেকে বেরিয়ে রেস্টুরেন্টে চলে গেলাম। ডিনার সেরে হস্টেলে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ বই পড়ার পর হঠাৎ শাশুড়ি মায়ের ফোন এলো।
‘হ্যাঁ, মা বলুন।’
‘কেমন আছিস? সব ঠিক আছে তো?’
‘হ..হ্যাঁ সব ঠ..ঠিক আছে। আপনারা কেমন আছেন? শরীর ভালো আছে তো?’
‘আমরা ঠিক আছি। তা তুই তো ওখানে গিয়ে আমাদের ভুলেই গেছিস। একটুও কি মনে পরে না আমাদের বুড়ো-বুড়ির কথা?’
‘আরে না না। তেমন কিছু না মা।’
‘তেমন কিছু যখন না তাহলে প্রথম পরীক্ষার আগে আগে আমাদের এখানে একবার চলে এসো বউমা। আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না, কালকেই তুমি এখানে আসছো। রাখলাম, শুভ রাত্রি।’
মায়ের কাছ থেকে বাবা ফোন নিয়ে আমাকে এটুকু বলেই ফোন রেখে দিলেন। আর আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কালকের মধ্যে কিভাবে যাবো কলকাতা? এভাবে হুট করে?
‘ঘুমিয়ে পর এক্ষুনি। সকালে তাড়াতাড়ি উঠে বেরিয়ে পড়বি।’
কোয়েলের কথা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ব্যাগ গোছানো হয়নি তো।’
‘আমি গুছিয়ে দিচ্ছি তুই যা, ঘুমা।’
কোয়েলের কথা মতো ঘুমোতে চলে গেলাম। ও সবই জানে আমার কি জিনিস লাগবে না লাগবে যেমন আমি জানি ওর বিষয়ে। তাই আর চিন্তা না করে ঘুমোতে চলে গেলাম।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]
আইডি- কোয়েল ব্যানার্জী