আমার পুতুল বর লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম) বোনাস পর্ব

আমার পুতুল বর
লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম)
বোনাস পর্ব

নদীর পাড়ে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে মাহির আর রেহান। মাহির পকেটে হাত গুজে অসীমের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোনো গভীর ভাবনায় মগ্ন। অপরদিকে রেহান ভাবলেশহীন। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পরে মাহিরই প্রথমে কথা বলা শুরু করলো,,
— মিহি কে ভালোবাসো?
রেহান একটু ও চমকালো না। যেনো আগে থেকেই জানতো তাকে এই প্রশ্ন টা করা হবে। তাই নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে বললো,,
— হ্যা।
— কবে থেকে?
— প্রথম দিন থেকে। লাভ এট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে..
মাহির অবাক হলো। — কিন্তু এটা কি করে সম্ভব! তোমরা তো সেই প্রথম থেকে ঝগড়া করে আসছো কখনই তো তোমাদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসার মতো কিছুই দেখিনি। বিগত একমাস যাবৎ তোমাদের মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি আমি। বিকালে ঘুরতে বের হওয়া, রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা বলা, হুট হাট বাসার নিচে তোমার উপস্থিতি সবটাই আমার নজরে পড়েছে। যার রেশ ধরেই জানতে চাইলাম মিহি কে ভালোবাসো কি না। কিন্তু তুমি তো বলছো অনেক আগে থেকেই ভালোবাসো!
রেহান হালকা হেসে বললো,,
— প্রথম দিনই মিহি কে দেখে আমার এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিলো। ওর চোখ বড় বড় করে কথা বলা, রেগে নাক ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকা, প্রাণখোলা হাসি সবটাই আমার হৃদয় কাঁপিয়ে তুলতো। আমি লাভ এট ফার্স্ট সাইটে বিলিভ করতাম না তাই জোর করেই অনুভূতি গুলোকে মাটি চাপা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পেরে উঠিনি। মনের কাছে বরাবরের মতো মস্তিষ্ক পরাজিত হয়েছে। ইচ্ছে করেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করতাম যাতে মিহি নিজে এসে আমার সাথে কথা বলে হোক না সেটা ঝগড়া তাতে কি আসে যায়! মাঝে মাঝে খারাপ লাগতো এটা ভেবে যে আমার ভালোবাসাটা এক তরফা। মিহির মনে আমার জন্য কোনো প্রকার অনুভূতি নেই। কিন্তু আমার এই ভাবনা সেদিন ভুল প্রমাণিত হলো যেদিন মিহি প্রথমবারের মতো আমাকে মাইশার সাথে দেখে জেলাস ফিল করেছিলো। সেদিন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশী হয়েছিলাম। মিহি ও আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। কিন্তু ওর এই পছন্দ করার বিষয়টা আমাদের ঝগড়ার মাঝে চাপা পড়ে যেত। যা ইদানিং আবার মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। মিহির প্রতিটা আচরণ আমার চোঁখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে ও আমাকে ভালোবাসে।
— তুমি যে ওকে ভালোবাসো সেটা ওকে কবে বলবে?
— আপনার বোনটা বড্ড বোকা মাহির ভাই। এইযে আমি প্রতিনিয়ত ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছি যে আমি ওকে কতটা ভালোবাসি কিন্তু ও তাও ভেবে চলেছে যে আমি হয়তো ওকে ভালোবাসি না এর জন্য ও নিজের মনের কথাটা আমার কাছে প্রকাশ করতে পারছে না।
বলুনতো কি করি ওকে নিয়ে!! ও নিজে থেকে যে ওর মনের কথা বলতে পারবে না তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমাকেই কিছু একটা করতে হবে।
— সোজা ভালোবাসি কথাটা বলে দিলেই তো হয়।
— কিন্তু আমার যে সোজা কোনো জিনিস পছন্দ নয়।
— মানে! তাহলে কি করবে তুমি?
রেহান কিছু বললো না। বাঁকা হেসে নদীর স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে রইলো।

আরশি ফ্রেশ হয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আজ থেকে ছয় বছর আগে ও বউ সেজেছিলো, সূর্যের বউ। কিন্তু তখন ওর মাঝে কোনো অনুভূতি ছিলো না। এতো ভালোলাগা ছিলো না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ও প্রথমবার বিয়ে করছে। সব কিছু কেমন নতুন মনে হচ্ছে। সবকিছুর মাঝে কেমন ভালোলাগা কাজ করছে। ভাবনার মাঝেই হঠাৎ আরশি কেপে উঠলো। উহু এমনি এমনি কেপে উঠে নি সে! তার ভালোবাসার মানুষটার ছোঁয়া যে সবসময় ই তার শরীরে শিহরন জাগায় এখনও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। আরশি ইচ্ছে করেই দরজা খোলা রেখেছিলো। কারণ ও জানতো সূর্য ঘুমানোর আগে ওর সাথে দেখা করতে ঠিক আসবে। হলো ও তাই। সূর্য আরশি কে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে। সূর্য ফিসফিস করে বললো,,
— সবাই আমার বউটাকে হলুদ ছোঁয়ালো তাহলে আমি কেনো বাদ যাবো! আমিও তোমাকে হলুদ ছোঁয়াবো।

আরশি সূর্যের কথা শুনে ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বর নিজের বউকে হলুদ ছোঁয়াবে? কি বলছেন উনি? আর কি বললেন হলুদ ছোঁয়াবেন কিন্তু এখন হলুদ কোথা থেকে পাবেন উনি?
সূর্য আরশি কে নিজের দিকে ফেরালো। ওর দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হেসে ট্রাউজার পকেট থেকে পলিথিনে প্যাঁচানো কিছু একটা বের করলো। পলিথিন টা ভালোভাবে খুলতেই আরশির চোখ ছানাবড়া। এ তো হলুদ! ওনার কাছে এলো কি করে??
— আপনি হলুদ কোথায় পেলেন?
— আমাকে হলুদ লাগানোর সময় আলাদাভাবে সরিয়ে রেখেছিলাম পরে তোমাকে লাগাবো বলে।
— অ্যা! ক,,কিন্তু আমিতো ফ্রেশ হয়ে গেছি এখন কি করে লাগাবেন?
— দরকার পড়লে আবার ফ্রেশ হবা কিন্তু হলুদ তো আমি তোমাকে লাগাবোই।
সূর্য হাতে হলুদ নিয়ে নিজের গালে আগে লাগলো। তারপর আরশির কাছে এগিয়ে গিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের গাল ওর গলায় ঘষে দিলো। আরশি কেপে উঠে সরে যেতে নিলেই সূর্য আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। আরশির গলার দু’পাশে একইভাবে হলুদ লাগিয়ে মাথা তুলে তাকালো। আরশি নিভু নিভু চোঁখে ওকে দেখছে। সূর্য আরশির কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আরশি সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। তখনি দরজার বাইরে থেকে কেউ ফিসফিস করে বললো,
— আর কতক্ষন ভেতরে থাকবি সূর্য? আজকেই কি সব রোম্যান্স করে ফেলবি নাকি? বাসর রাতের জন্য ও তো কিছু বাঁচিয়ে রাখ। ঐ ব্যাটা বেরো!!
সূর্য চোয়াল শক্ত করে দরজার দিকে তাকালো। মনে মনে ইচ্ছামতো গালি দিলো রিক কে। আরশি লজ্জায় মরে যাচ্ছে। এতক্ষণ রিক ভাইয়া দরজায় পাহারা দিচ্ছিলেন!! আর কি সব বলছেন, ছি ছি ছি! মান সম্মান আর কিচ্ছু রইলো না। আরশি নিজেকে সূর্যের থেকে ছাড়িয়ে ওর এক হাত ধরে সোজা রুম থেকে বাইরে বের করে দিয়ে মুখের ওপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। সূর্য হা হয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। রিক ও কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে হো হো করে হেসে উঠলো। ওর হাসির শব্দ পেয়ে সূর্য ওর দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো। রিক হাসি বন্ধ করে ঢোক গিলে বললো,,
— আমাকে রোজি ডাকছিলো এতক্ষণ পাহারা দিচ্ছিলাম বলে যেতে পারিনি। এখন যাই!
রিক দৌড় দিতেই সূর্য ও ওর পিছনে ছুটলো।

বাড়ির পিছনের রাস্তায় অভ্র অস্থির ভাবে পায়চারী করছে। এই জায়গাটা রাত আটটার পরেই একদম নিরিবিলি হয়ে যায়। তাই এখানে এখন ও একাই আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিধি সেখানে উপস্থিত হলো। অভ্র কে অস্থির দেখে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,,
— কি হয়েছে অভ্র? এমন করছেন কেনো? হঠাৎ এভাবে আর্জেন্টিল দেখা করতে বললেন যে?
অভ্র নিধির দিকে তাকিয়ে হুট করে জড়িয়ে ধরলো। নিধি অভ্রর আকস্মিক কর্মকাণ্ডে চমকে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। অভ্রর পিঠে হাত রেখে বললো,,
— কি হয়েছে বলুন আমাকে, না বললে বুঝবো কিভাবে কি সমস্যা?
অভ্র নিজেকে শান্ত করে নিধির হাত ধরে বললো,,
— আমাকে বিয়ে করবে নিধি?
নিধি নিজের কানে বিশ্বাস করতে পারছে না। অভ্র মাত্র কি বললো? বিয়ে করার কথা বললো!
— এই নিধি বলোনা বিয়ে করবে আমায়?
নিধি অভ্রর দিকে তাকালো। চোখ মুখে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গলার আওয়াজ কেমন ভাঙ্গা ভাঙ্গা শোনাচ্ছে। এই মুহূর্তে ওকে ভীষন অসহায় মনে হচ্ছে।
নিধি কোনোমতে নিজেকে সামলে বললো,,
— হঠাৎ এ কথা কেনো বলছেন অভ্র?
— এটা আমার প্রশ্ন উত্তর নয় নিধি, আমার প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।
নিধি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,,
— এসব নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো। আপনাকে দেখে টায়ার্ড মনে হচ্ছে চলুন রেস্ট নিবেন।
নিধি সামনে এগোনোর জন্য পা বাড়াতেই অভ্র ওর হাত ধরে ফেললো। নিধির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,,
— এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভাববে না নিধি। উত্তর দাও বিয়ে করবে আমায়?
নিধি অভ্রর চোখে চোখ রেখে বললো,,
— আমি তোমাকে ভালোবাসি অভ্র। আর ভালোবাসার মানুষকে একান্ত নিজের করে কে না পেতে চায়? আগে আমাকে বলুন আপনি হঠাৎ বিয়ের কথা বলছেন কেনো?
অভ্র নিধি কে রাস্তার পাশের বেঞ্চ টাতে বসিয়ে ওর কোলে মাথা রাখলো। নিধির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে লাগলো,,
— তোমাকে সূর্য ভাইয়ার কাজিন ফারহান পছন্দ করেছে। ওর মাকে তোমার ব্যাপারে বললে উনি ও তোমাকে দেখে পছন্দ করে ফেলেন। তোমার মায়ের কাছে গিয়ে তোমার আর ফারহানের বিয়ের প্রস্তাব দেন। ছেলে নিউরোলজিস্ট, আচার-ব্যবহার ও খুব ভালো। বদ অভ্যাস বলতে দিনে দু-একটা সিগারেট খায়। এছাড়া বাকিসব ঠিকঠাক। তোমার মার ও ছেলেকে মনে ধরেছে। আন্টি ফারহানের মা কে বলেছেন এই ব্যাপারে তোমার বাবার সাথে আজকেই কথা বলবেন। মাহির ভাইয়ের সাথে তোমার বিয়েটা ক্যানসেল হয়ে গেছে কিন্তু এটা ক্যানসেল হওয়ার কোনো চান্স নেই। তোমার বাবা ঠিক রাজি হয়ে যাবে। আমি তোমাকে হারাতে পারবো না নিধি। কিছু একটা করে এই বিয়েটা না হতে দিলেও এমন সম্বন্ধ আরো আসতে থাকবে কটা আটকাতে পারবো? না তোমাকে নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে রাজি নই। তাই খুব শীঘ্রই বিয়ে করবো তোমায়। একান্তই নিজের করে নেবো। তোমার নামের পাশে আমার নাম জুড়ে গেলে আর কেউ তোমাকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। কেউ না। কাওকে আমাদের মাঝে আসতে দেবোনা আমি।

নিধি অভ্রর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর জন্য অভ্র এতোটা পাগলামি করছে। ওর বিশ্বাস ই হচ্ছে না। এটাও সম্ভব! আজ নিধির মনে হচ্ছে ও অভ্রকে যতটা ভালোবাসে তার থেকে অনেক বেশি ভালো অভ্র ওকে বাসে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here