আমার পুতুল বর লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম) পর্ব: ৫৬ (শেষ পর্ব )

আমার পুতুল বর
লেখিকা: আরশি জান্নাত (ছদ্মনাম)
পর্ব: ৫৬ (শেষ পর্ব )

একদিকে আরশির বিয়ের তোড়জোড় চলছে তো আরেকদিকে শোক দিবস পালিত হচ্ছে। আরশি আজ ভীষণ খুশি কিন্তু মিহি একদমই খুশি নয়। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এমন একটা খারাপ খবর শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না মিহি। খবরটা হলো মাইশা এসেছে। শুধু এসেছে যে তা না রেহানের সাথে নাকি একদম চিপকে আছে। আশেপাশের মানুষতো ওকে রেহানের গার্লফ্রেন্ড ভাবছে। এইতো কিছুক্ষন আগে ফারহানা এসে জিজ্ঞেস করছিলো, “রেহান ভাইয়ার যে গার্লফ্রেণ্ড আছে তোমরা আগে বলোনি তো! ইশ রেহান ভাইকে ভালো লেগেছিলো কিন্তু উনিও বুকড। কিন্তু যাই হক গার্লফ্রেন্ডটা কিন্তু দেখতে সেই!! ভাইয়ার সাথে ভীষণ মানিয়েছে। ভাইয়াকে তো কলিজা বলে ও ডাকছিলো আহা কি প্রেম!” মিহির সারা শরীর রাগে জ্বলছে। এতোদিন ওর সাথে ঘুরে ফিরে, পজেসিভনেস দেখিয়ে এখন কিনা অন্য একজন কে গার্লফ্রেন্ড বানাচ্ছে! বজ্জাত লোক।।
মিহি তখন থেকে মুখ ভার করে আরশির ঘরে বসে আছে। পার্লার এর থেকে একটু পরে লোক আসবে আরশি কে সাজাতে তাই সুজানা আগেই আরশি কে খাইয়ে দিচ্ছে। এই ঘরে আপাতত সুজানা, নিধি, রোজ, ন্যান্সি আর মিহিই আছে। ওরা আরশি কে এটা ওটা বলে লজ্জায় ফেলছে। বিশেষ করে বাসর রাতের কথা তুলছে আর এমন এমন কথা বলছে যা শুনে আরশি লজ্জায় মরে যাচ্ছে। আরশির লজ্জা পাওয়া দেখে ওরা জোরে জোরে হাসছে।

মাহির এপাশ থেকে ওপাশে ছোটাছুটি করছে। গেস্টদের অ্যাটেন্ড করছে। রেহানের সাথে অ্যারেঞ্জমেন্ট নিয়ে কথা বলছিলো তখনই ওর সামনে হুট করে মাইশা চলে এলো। মাহির একটু হকচকিয়ে গিয়ে ও নিজেকে সামলে নিলো। রেহান ভ্রু কুঁচকে মাইশার দিকে তাকিয়ে আছে। সুজানা, মিহি , নিধি, রোজ আর ন্যান্সি এদিকেই আসছিলো দেখতে যে সূর্য রেডি কিনা কিন্তু মাইশা কে রেহানের পাশে দেখেই মিহি থেমে গেলো। ওর থামা দেখে বাকিরা ও থামলো। মিহির দৃষ্টি অনুসরণ করে ওরাও তাকালো। মাইশা কে দেব দেব করে মাহিরে দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুজানার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। কটমট করে ওদের দিকে তাকিয়ে বির বির করে বললো,,
— এই মেয়ে মনে হচ্ছে আমার মাহির কে চোঁখ দিয়েই গিলে খাবে, অসহ্য!
সুজানা দ্রুত পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেলো। বাকিরা ও ওর পিছু পিছু গেলো।
মাইশা হাসি হাসি মুখ করে বললো,,,
— কেমন আছেন মাহির ভা~ই? ( টেনে টেনে ) আপনাকে ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে আজকে মাশআল্লাহ!
মাহির অপ্রস্তুত হয়ে গেলো তাও ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো,,
— ধন্যবাদ মাইশা, তোমাকে ও সুন্দর লাগছে।
মাইশা যেনো লজ্জা পেলো এমন ভাব করলো। সুজানা মাহিরের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর পিছনে বাকিরা। মাহির বা রেহান ওদের খেয়াল করে নি। মাইশা হঠাৎ বললো,,, “আরে মাহির ভাই আপনার স্যুটে ময়লা লেগেছে ” বলে হাত বাড়িয়ে পরিষ্কার করে দিতে যাবে ওমনি খপ করে রেহান ওর হাত ধরে ফেললো। এদিকে মিহি আর সুজানা লুচির মতো ফুলছে। ওদের দুজনকে দেখে নিধি, রোজ আর ন্যান্সি মুখ টিপে হাসছে। রেহান মাইশা কে চোঁখ রাঙিয়ে বললো,,
— হাত আর মুখ বেশি চলে তোর। একদম চুপ করে থাক। মাহির ভাইয়ের হবু বউ এর সামনে তুই তাকে টাচ করতে যাচ্ছিলি, বুদ্ধি কি সব হাটে বেচে দিয়ে এসেছিস?
সুজানা কে দেখে মাইশার মুখ চুপসে গেলো। কাচুমাচু হয়ে রেহানের সাথে লেগে দাড়ালো। কারণ সুজানা ওর দিকে রাগি চোখে তাঁকিয়ে আছে। সুজানা মাইশার ওমন চুপসে যাওয়া মুখ দেখে ঠোটেঁ মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে মাহিরের পাশে এসে ওর এক বাহু জড়িয়ে ধরে বললো,,
— আমার তোমার সাথে আলাদা ভাবে কথা বলার আছে চলোনা ওই দিক টায় যাই।
মাহির ভুত দেখার মতো করে সুজানার দিকে তাকিয়ে আছে।
— তু,, তুই আমাকে তুমি বললি?
সুজানা কিছু না বলে মুচকি হেসে ওকে টেনে নিয়ে গেলো। এবারে মিহি রেহান আর মাইশার দিকে তাকালো। দুজনে “দো জিসাম এক জান” এমন ভাবে চিপকে দাড়িয়ে আছে। মিহির এমনিতেই সকাল থেকে মেজাজ খারাপ তার উপর এদের এইভাবে দেখে ওর শরীর জ্বলছে। পারছে না সহ্য করতে। লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে রেহানের থেকে মাইশা কে সরিয়ে দিলো। ওদের মাঝে দাড়িয়ে থমথমে মুখে মাইশা কে বললো,,
— আপু তুমি একটু ওদের সাথে সূর্য ভাইয়ার ঘরে গিয়ে দেখো ভাইয়া রেডি হলো কিনা!
মাইশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিহি ওকে থামিয়ে দিলো। বললো,,
— তোমার এখানে কোনো কাজ আছে বলেতো মনে হচ্ছে না আর অভ্র, নাহিদ ভাই আর উনি ( রেহানের দিকে ইশারা করে ) এখন ব্যস্ত। একা একা বোর হওয়ার চেয়ে ওদের সাথে যাওয়াটা বেটার।
রেহান বাকা হেসে মিহি কে দেখছে। মেয়েটা ভীষণ জেলাস ফিল করছে ইভেন আগের মতো ওকে আর রেহান ভাই বলেও সম্বোধন করছে না।
মাইশা আর কিছু বললো না নিধিদের সাথে চলে গেলো।
_________________

— আহ আহ কি করলাম মারছিস কেনো? একটু আগেই তো কি সুইটলি কথা বলছিলি!!
— মারবো না আবার! খুব সুন্দর লাগছে মাইশা কে তাইনা? এই যে আমি, তোর হবু বউ তোর জন্য এতো সুন্দর করে সাজলাম কই তুইতো আমাকে দেখে কিছু বললি না..(অভিমানি গলায় )
মাহির সুজানার কথা শুনে হেসে ফেললো। সুজানার কোমর জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো। সুজানা চমকে উঠলো। মাহিরের দিকে তাকিয়ে দেখলো মুচকি হাসছে ও। মাহির সুজানার নাকে চুমু দিয়ে বললো,,
— তোকে সাজলে সুন্দর লাগছে বলতে হবে কেনো আমায়? আমার চোখে তো তুই সবসময়, সব রূপেই সুন্দরী।
সুজানা লজ্জামাখা হাসি দিয়ে মাহিরের বুকে মুখ গুজলো। মাহির ও হাসলো।
_____________________
মিহি রেহানের হাতে হঠাৎ করে কামড় বসিয়ে দিলো। রেহান অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। মিহি যে এমন কিছু করবে তা ওর ধারণার বাইরে ছিলো। কামড় দিয়ে মিহি হুট করে কেঁদে দিলো। রেহান হকচকিয়ে গেলো। মিহির গাল দু হাত রেখে বললো,,
— এই মিহি কি হলো কাদঁছো কেনো?
মিহি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
রেহান অস্থির হয়ে বললো,,
— আরে বলোই না কান্না করছো কেনো? প্লীজ বলো।
— কি করবো আমি কান্না পাচ্ছে তো আমার।
— কেনো কান্না পাচ্ছে?
— আপনি আমায় ধোঁকা দিয়েছেন।
— আ, আমি কি? ধোঁকা দিয়েছি তোমায় কখন?
— দিয়েছেন ই তো।
— কিভাবে?
— আপনি সবাইকে কেনো বলেছেন মাইশা আপনারা গার্লফ্রন্ড?
— আমি কখন বললাম?
— না বললে সবাই বলাবলি করছিলো কেনো? আর ওকেই যদি গার্লফ্রেন্ড বানাবেন তবে মাঝে কয়দিন আমার সাথে ঘুরে বেড়ানো, কেয়ার দেখানো, রাত জেগে কথা বলা ওসব কি ছিলো শুনি?
— আরে মাইশা আমার গার্লফ্রেন্ড নয়। আর এজন্য তুমি কাদছিলে? কিন্তু তোমার কান্না করার কি আছে বুঝলাম না!
— এ্য এ্য এ্য ওমা কান্না করবো না? নিজের ক্রাশের গার্লফ্রেন্ড আছে শুনলে কার না খারাপ লাগবে?
— ওয়েট ওয়েট ক্রাশ! কে তোমার ক্রাশ আমি? এটা কবে হলো?
— আপনি আমার ক্রাশ! কেনো বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? না হলে আমার কিছু করার নেই। এটাই সত্যি। ( চোখ মুছে )
রেহান মিহির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। মুখটা গম্ভীর করে বললো,,
— আমি কি ভাবছি জানো! ( মিহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ) ভাবছি মাহির ভাইয়ের হবু বউয়ের শ্বশুরের কাছে তার মেয়েকে বিয়ে করার ব্যাপারে বলবো। তুমি কি বলো?
— অ্যা, কি! বিয়ে করবেন? কাকে?
রেহান মুচকি হেসে চলে গেলো।
— আরে! কি বললেন, কাকে যেনো বিয়ে করবেন বললেন। মাহির ভাইয়ের হবু বউয়ের শ্বশুরের মেয়ে!!
কথাগুলো নিজের মনে আওরতেই মিহি স্তব্ধ হয়ে গেলো।।
— কি কি বললেন উনি? এটা কি ছিলো, উনি কি আমাকে প্রপোজ করলেন? এটা কে কি আদৌ প্রপোজ করা বলে?
মিহি বোকার মতো তাকিয়ে রইলো।
________________________

কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য কে স্টেজে বসানো হলো। হলুদের দিনের মতো এবারে বর বউয়ের জন্য আলাদা আলাদা স্টেজ করা হয়নি বরং এক স্টেজেই ওদেরকে বসানো হবে। মাঝে সাদা ওড়না পর্দার মতো করে দেওয়া। যাতে কেউ কারো মুখ না দেখতে পারে। বর বউয়ের মুখ একেবারে বাসর ঘরে গিয়েই দেখতে পারবে তার আগে নয়। এই কারনে সূর্য মুখটা ফুলিয়ে রেখেছে। রিক ওকে টিজ করছে সূর্য ওর দিকে রাগি চোঁখে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে ওর পিছনে তাকিয়ে চুপ করে গেলো। আরিয়া আর অহনা মিলে আরশি কে নিয়ে আসছে। আরশি সাদা-গোল্ডেন মিক্স করা লেহেঙ্গা পড়েছে। মাথায় ইয়া বড়ো ঘোমটা দেওয়া। যার জন্য মুখটা দেখা যাচ্ছে না। গোলায় ভারি ভারি গহনা। হাত ভর্তি চুড়ি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আরশির গেট আপ ঠিক একদম ওর পুতুল বউয়ের মতো। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর গেট আপ ও পুতুল বরের মতো। এটা তো আগে খেয়ালই করে নি সূর্য। ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। অহনা আর আরিয়া আরশি কে সূর্যের পাশে বসিয়ে দিলো। আরশি মাথা নুইয়ে রেখেছে। হাতে হাত ঘসছে। সূর্য আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বুঝলো ও নার্ভাস ফিল করছে। সূর্যের ভীষণ ইচ্ছে করছিলো আরশির হাত ধরে বলতে, “চিন্তার কিছু নেই আমি আছিতো তোমার সাথে”। কিন্তু সেই উপায়টা ও নেই। ওদের মাঝে দেয়াল হয়ে দাড়িয়েছে এই পাতলা পর্দাটা।
সূর্য একটু ভেবে পাশে বসে থাকা রিকের কানে কানে কিছু একটা বললো। রিক উঠে গিয়ে সুজানা কে এনে আরশির পাশে বসিয়ে দিলো। সুজানা আরশি কে জড়িয়ে ধরে বললো,,
— আমার মিরর কুইন বুঝি নার্ভাস ফিল করছে?
আরশি মাথা দুলালো।
— এতো নার্ভাস ফিল করার কি আছে! আমরা বা ভাই কেউই তো তোর অচেনা নই। তো এতো নার্ভাস হতে হবে না। আমরা আছিতো।
আরশি মুচকি হাসলো যদিও ঘোমটার জন্য দেখা গেলো না কিন্তু সুজানা ঠিক বুঝতে পারলো। আরশির মাথায় চুমু দিয়ে ওর পাশে বসে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুরাজ জামান, আফিফ হাসান আরো কয়েকজন মিলে কাজী নিয়ে স্টেজের কাছে এলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে সূর্য-আরশির বিয়েটা হয়ে গেলো। কবুল বলার সময় সূর্য-আরশি দুজনেই ওদের আগেরবারের বিয়ে হওয়ার মুহুর্ত টা মনে করছিলো। কবুল বলার পরপরই আরশির চোঁখ বেয়ে দু ফোঁটা সুখের জল গড়িয়ে পড়লো। অবশেষে ওর পুতুল বর ওর হলো। এই দিনটার জন্যে ও কতো অপেক্ষা করেছে, কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছে, কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছে। কিন্তু আজ আরশির সব কষ্টের সমাপ্তি পুরোপুরিভাবে হলো। আজ এই মুহূর্ত থেকে ও সূর্যের বউ, সত্যিকারের বউ, সূর্যের ভালোবাসা ও।

আরিয়া এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। আফিফ হাসান ওদের কাছে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,,
— কেঁদো না আরু। মেয়ে আমাদের দূরে কোথাও যাচ্ছে না। আমাদের সাথেই থাকছে তো শুধু শুধু কেঁদে ভাসাচ্ছো কেনো!
আরিয়া আরশি কে ছেড়ে আফিফ হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন,,
— এই মেয়ের মা আমি না তুমি? নয়মাস গর্ভে আমি ধারণ করেছি। যতই মেয়ে কাছে থাকুক বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মেয়ের উপর বাবা মায়ের আর আগের মতো অধিকার থাকে না। জানোনা?
— কে বলেছে খালামনি? অন্যদের টা জানিনা কিন্তু তোমার মেয়ে তোমাদেরই থাকবে। সবটা আগের মতোই থাকবে। ওর ওপর আগে যেমন তোমাদের অধিকার ছিলো এখনও তেমনি আছে কেনো শুধু শুধু এসব ভাবছো।
— ঠিক তাই আরু।আমাদের কি তোর বাংলা সিনেমার দজ্জাল শ্বশুর-শাশুড়ি মনে হয়?
— আর আমাকে কি কুটনি ননাস মনে হয় তোমার?
আরিয়া ওদের কথা শুনে হেসে উঠলো। সূর্য আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে মাহির, রেহান, রিক, অভ্র গলা খাঁকারি দিলো। অভ্র দাত কেলিয়ে সূর্যের কানে কানে বললো,,
— সূর্য ভাইয়া এখানেই কি সব দেখে ফেলবেন নাকি? বাসর ঘরে দেখার জন্য ও কিছু বাকি রাখুন।
সূর্য রাগি চোখে তাকাতেই অভ্র হালকা কেশে মাহিরের পাশে চলে গেলো। এটা দেখে বাকিরা ফিক করে হেসে দিলো।

রাত ৮:৩০ মিনিট ,,

আরশি ফুল দিয়ে সাজানো খাটে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। বাইরে থেকে হই-হুল্লোরের আওয়াজ আসছে। নিশ্চয়ই সূর্যকে টাকা দেওয়ার জন্য আটকেছে। আরশির লজ্জা লাগছে। এখনো সূর্য ওর সামনে আসে নি তার পর ও লজ্জা পাচ্ছে। একটু পরেই সূর্য ঘরে এলো। কিছুক্ষন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর খাটের কাছে এগিয়ে আসতেই আরশি সালাম দিলো। সূর্য আরশির পাশে বসে ধীরে ধীরে ওর ঘোমটা তুলে দিলো। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরশির দিকে। ওর কল্পনার থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে আরশি কে। দুজনের কেউই কোনো কথা বলছে না। সূর্য আরশির কপালে চুমু দিয়ে বললো,,
— ফ্রেশ হয়ে লেহেঙ্গা টা পালটে নাও। নামাজ পরতে হবে তো।
আরশি মাথা নাড়িয়ে একটা সবুজ শাড়ি নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ওর পরে সূর্য ফ্রেশ হলো। অতঃপর দুজনে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নিলো। আরশি খাটের এক পাশে গিয়ে বসলো। সূর্য আলমারি থেকে একটা লাগেজ বের করলো। আরশি সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ভাবছে, “এখন লাগেজ বের করছেন কেনো? কাপড় তো সব আলমারিতে রাখাই আছে।” মুখে কিছু বললো না। সূর্য লাগেজ এক পাশে রেখে হাতে ঘড়ি পরে নিলো। চেয়ারে বসে জুতো পড়তেই আরশি ওর সামনে এসে দাড়ালো। সূর্য আরশির দিকে তাকাতেই দেখলো ওর চোখ জোড়া ছলছল করছে। সূর্য উঠে দাড়ালো। আরশি কন্নামাখা গলায় বললো,,
— আজকের দিনে আমাকে কোথায় যাচ্ছেন আপনি? এই লাগেজ বের করেছেন কেনো? আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন কোনো কারনে? রাগলে রাগবেন তাই বলে কি ছেড়ে চলে যাবেন নাকি?
আরশি ফুপিয়ে কাদতে লাগলো। সূর্য আরশির কান্না দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে।
— আরে তুমি কাদঁছো কেনো? আমি তোমার উপর রাগ করেছি কখন বললাম?
— তাহলে কই যান?
— ঘুরতে..
— আজকে আমাদের বাসর রাত আর আপনি আমাকে রেখে ঘুরতে যাচ্ছেন?
— তোমাকে রেখে কে বললো? আমিতো তোমাকে নিয়েই যাবো। নাহলে বাসর আর হানিমুন কার সাথে করবো?
— মানে?
— ওহহো! বুঝলে না?
আরশি মাথা নাড়িয়ে বললো,, না বুঝি নি।
সূর্য ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,, তাহলে এখন আর বুঝে কাজ নেই। পরে বুঝিয়ে দেবো। এখন চলো।

সূর্য আরশির হাত ধরে দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। আশে পাশে কেউ নেই। কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে, নয়তো কেউ উঠোনে আড্ডা দিচ্ছে। সূর্য আরশি কে নিয়ে বাড়ির পিছনের রাস্তায় এলো। আরশি চুপ চাপ সূর্যের সাথে যাচ্ছে। সূর্য ঠিক কি করতে চাইছে ওর মাথায় ঢুকছে না। রাস্তার মোড়ে আসতেই একটা জিপ গাড়ি দেখতে পেলো। সামনের মানুষগুলো কে দেখে আরশি অবাক হয়ে গেলো। কারণ জিপের কাছে রেহান-মিহি, অভ্র-নিধি, সুজানা-মাহির , রিক রোজ আর ন্যান্সি দাড়িয়ে আছে। নাহিদ আর মাইশা বিয়ের পরেই চলে গেছিলো। সূর্য এগিয়ে গিয়ে লাগেজ পিছনে রেখে দিলো। আরশি সবার দিকে তাকিয়ে দেখলো ওরা বিয়ের সময় পরা ড্রেস চেঞ্জ করে নরমাল ড্রেস পরে নিয়েছে। আরশি কে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওরা হেসে ফেললো। মিহি বললো,,
— ভাইরে ভাই জীবনে প্রথম এমন কাহিনী দেখছি। বাসর রাতে বর বউ নিজেরা তো বেড়াতে যাচ্ছেই সাথে সাঙ্গ পাঙ্গদের ও নিয়ে যাচ্ছে। তোদের বাসর হানিমুন কোনোটাই আমরা ঠিক মতো হতে দিবোনা দেখে নিস।
সূর্য হেসে বললো,,
— চেষ্টা করতেই পারো শালিকা। কিন্তু সফল তোমরা হবে না। সেই গ্যারেন্টি আমি তোমাদের দিচ্ছি।
আরশি বিরক্ত হয়ে বললো,,
— তোমরা কি নিজেরাই কথা বলবে? আরে বাবা আমাকে কেউ একটু বুঝিয়ে বলবে যে এখানে হচ্ছেটা কি ?
সুজানা এগিয়ে এসে বললো,,,
— আমি বলছি। তোর বর প্ল্যান করেছে তোদের বাসর আর হানিমুন এক সাথেই হবে কিন্তু এখানে নয়, নীলগিরিতে। আমাদের কে ও সাথে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু রিক, রোজ আর ন্যান্সি যাবেনা কারণ কালকে বিকালে ওদের ফ্লাইট। আমরা এখন সবাই নীলগিরির উদ্দেশ্যে রওনা দিবো বুঝেছিস!!!
আরশি চোখ বড় বড় করে সূর্যের দিকে তাকালো। কেমন আজগুবি চিন্তা ধারা এই লোকের। এমন টা কেউ করে? বাড়ির সবাই জানতে পারলে কি ভাববে?
সূর্য যেনো আরশির মনের কথা বুঝতে পারলো তাই ওকে আশ্বস্ত করে বললো,,
— বাড়ির লোকদের নিয়ে একদম চিন্তা করোনা। সবটা ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে। সবাই জলদি উঠে পরো কেউ দেখে ফেলবে।
ওরা রিকদের বিদায় জানিয়ে রওনা হলো। নিস্তব্দ, নিরিবিলি রাস্তায় সূর্যদের গাড়ি ছুটে চলেছে। মিহি কৌতূহলী হয়ে সূর্য কে জিজ্ঞেস করলো,,,
— ভাইয়া আপনারা দুজন একা না গিয়ে আমাদের কে ও কেনো নিচ্ছেন?
— কমন রিজন..
— কমন রিজন? কি সেটা?
— দীর্ঘ অপেক্ষার পর ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়া।
আরশির দিকে তাকিয়ে, “আমাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাওয়ার পিছনে তোমাদের ও অবদান রয়েছে। তোমরা যদি হেল্প না করতে তাহলে বোধয় আমি আমার মনের কথাটা আরশি কে এতো জলদি বলতে পারতাম না। নিজের মাঝেই চেপে রাখতাম। সো যারা আমার ভালোবাসার মানুষটার কাছাকাছি আমাকে এনে দিলো, তাদেরকে তাদের ভালোবাসার মানুষটার সাথে একান্ত সময় কাটানোর সুযোগ তো আমি করেই দিতে পারি। কি বলো?”
মিহি কিছু বললো না হেসে রেহানের দিকে তাকালো। রেহান ওকেই দেখছিলো। সুজানা মাহিরের হাত ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে মুচকি হাসলো। অভ্র নিধির দিকে তাকিয়ে আছে। নিধি মাথা নামিয়ে রেখেছে। আসলে নিজের ভাইয়ের সামনে লজ্জা পাচ্ছে নিধি। অভ্র ওকে দেখে হেসে দিলো। আশে পাশে কে আছে সেদিকে নজর না দিয়ে নিধিকে নিজের বুকে টেনে আনলো। নিধি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা না করে আরো নিবিড় ভাবে আকড়ে ধরলো অভ্র কে।
গাড়ী ড্রাইভ করতে করতে সূর্য আরশির এক হাত টেনে এনে চুমু খেলো। আরশি মিষ্টি হেসে সূর্যের দিকে তাঁকিয়ে আছে। সূর্য ড্রাইভ করতে করতে বললো,,
— ভালোবাসি পুতুল বউ।
আরশি সাথে সাথে উত্তর দিলো,
— আমিও ভালোবাসি আমার পুতুল বর কে।
পিছনের মানুষগুলো ওদের কথায় নিরবে প্রশান্তির হাসি হাসলো।

_______________ সমাপ্ত ________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here