চুপকথা পর্ব- ২৭

0
1424

#চুপকথা-২৭
Zannatul Eva

কথাটা একটু জোরেই বললাম যাতে তিয়াস শুনতে পায়। এই কথা শোনার পর তিয়াস যে বেশ ভয় পেয়ে যাবে সেটা আমি জানতাম। কিন্তু পরবর্তী কথাটা শোনার পর ও আরও অনেক বড় একটা ধাক্কা খাবে। সেটা কিভাবে সামলাবে আমি জানিনা। কিন্তু ও তো এটাই চেয়েছিলো। আমাকে ওর কাছ থেকে সারাজীবনের জন্য দূরে সরিয়ে দিতে। তাই এখন সেটাই হবে।

পিয়াস একবার তিয়াসের দিকে তাকালো। তারপর মলিন স্বরে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। তোমার উত্তরটা আমার কাছে ঠিক ক্লিয়ার না।

আমি বললাম, দেখুন প্রেমটেম করার জন্য আমার এতো সময় নেই। আমি ডিরেক্ট বিয়েতে যেতে চাইছি। মানে যদি হয় তাহলে একবারে বিয়েটাই হবে। আগে কোনো সম্পর্ক হবে না আমাদের মধ্যে। আমি বোধহয় এবার বোঝাতে পেরেছি।

পিয়াসের চোখে মুখে খুশির ছাপ স্পষ্ট বোঝা গেল। ও বলল, কিন্তু বিয়ে হওয়া পর্যন্ত আমরা তো একে অপরের সাথে কথা বলতেই পারি।

আমি তিয়াসের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর বললাম, কথা হবে কিন্তু সবটাই জরুরি কথা। আমি প্রথমেই বলেছি যে, আমাদের মধ্যে আগে থেকে কোনো প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হবে না। যা হবে সবটা বিয়ের পর। নো ফোনালাপ নো প্রেমালাপ। আমার এই শর্তটা মানতে পারলেই আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। আর নয়তো চললাম………

পিয়াস কাচুমাচু হয়ে বলল, এই না না না আমি সেটা বলিনি। আমি রাজি। তুমি যা বলেছো তাই হবে। সরি আমি তোমাকে তুমি করেই বলছি। বিয়ের আগে তুমি করে বলতে পারবো তো? মানে এটায় কোনো প্রবলেম নেই তো?

আমি আড় চোখে তিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি করে বলতে পারেন। ইনফ্যাক্ট আমরা দুজনই দুজনকে তুমি করে বলবো। শুধু শর্ত একটাই, নো ফোনালাপ নো প্রেমালাপ। ডিরেক্ট বিয়ে।

তাহলে আমি ছোট বাবা আর ছোট মা কে গিয়ে তোমার কথা বলি? দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের বিয়েটা ফাইনাল করুক।

পরিবারের মধ্যেও একটা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। আংকেল মানে তোমার ছোট বাবা হয়তো রাজি হবেন না। আর আমি তোমার পরিবারের কাউকে দুঃখ দিয়ে তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। সো তুমি যদি সবাইকে রাজি করিয়ে আমাকে বিয়ে করতে পারো তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।

পিয়াস বলল, ডান। তুমি যা চাও তাই হবে। আর বাসায় কেউ রাজি না হলে ভাই তো আছেই। ভাই সবটা ম্যানেজ করে ফেলবে।

আমি তিয়াশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, হ্যাঁ তোমার ভাই ওটাই পারবে। অন্যের প্রেম পোস্ট অফিসের পিওনগিরি করতে।
দেখবি আর জলবি, লুচির মতো ফুলবি। আমাকে কষ্ট দেয়া! দেখো এবার আমি ঠিক কতদূর যেতে পারি৷ এটাই তো চেয়েছিলে তুমি। এবার আমিও দেখতে চাই তুমি কী করে সবটা এতো সহজে মেনে নাও। তোমারই চোখের সামনে আমি তোমার ভাইয়ের বউ হয়ে যাব। এটা মানতে পারবে তো তুমি!

তিয়াস খুব স্বাভাবিক আছে৷ এটা দেখে আমার আরও রাগ হচ্ছে। আমি পিয়াসকে বললাম, এবার উঠতে হবে আমাকে। অফিস যেতে হবে।

পিয়াস হাত নাড়িয়ে হাসি মুখে আমাকে বাই বলল।____________________
তিয়াস.
বাড়িতে ফেরার পর থেকে পিয়াস ভীষণ টেনশন করছে। কিভাবে বাবা-মা কে বলবে কুহুর কথা তা ভাবছে। মা কে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে বাবা। বাবাই মানবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে কুহু আর পিয়াসের বিয়ের কথা বলার দায়িত্ব পড়েছে আমার ঘাড়ে। ভেতর থেকে আমার কোনো কথাই আসছে না মুখে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। অথচ আমার এমনটা হওয়ার কথা নয়। কারণ আমি নিজেই চেয়েছি কুহুকে রাজি করাতে। তাহলে এখন কেন কষ্ট পাচ্ছি? নিজের ভাইয়ের জন্য এটুকু করতে না পারলে কেমন ভাই আমি! নিজের কথা ভাবলে তো চলবে না। আমাকে এখন পিয়াসের কথা ভাবতে হবে। যে করেই হোক বাবাকে রাজি করাতেই হবে৷

বাবা বসার ঘরে বসে আছে। কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। আমি গুটিগুটি পায়ে বাবার পাশে এসে বসলাম। বাবা গম্ভীর গলায় বলল, কিছু বলবে?

আমি নিচু স্বরে বললাম, হ্যাঁ। খুব জরুরি কথা ছিল তোমার সাথে।

বাবা কাজ রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, জরুরি কথা! কী এমন জরুরি কথা? বলো, শুনছি।

আমি সাতপাঁচ না ভেবেই বললাম, কথাটা পিয়াসকে নিয়ে।

বাবা বলল, পিয়াস! পিয়াস আবার কী করেছে?

বাবা পিয়াস কুহুকে ভালোবাসে। ওকে বিয়ে করতে চায়।

বাবা কিছুক্ষণ চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। এখনের এই শান্ত পরিবেশটা যে একটু পরেই হুলুস্থুল পরিবেশে পরিনত হবে সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না আমার।

পিয়াস ওদিকটায় আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। বাবা রাগি স্বরে পিয়াসকে ডেকে বলল, এসব আমি কী শুনছি? তুমি নাকি জাহিদের শালিকে বিয়ে করতে চাও?

পিয়াস মাথা নিচু করে বলল, আসলে ছোট বাবা না মানে আমি কুহুকে ভালোবাসি। ও খুব ভালো মেয়ে। তুমি প্লিজ রাজি হয়ে যাও।

তিয়াসের আগে তোমার বিয়ে নিয়ে ভাববো এটা কী করে ভাবলে তুমি? তাও আবার ওরকম মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়েকে পছন্দ করেছো। নিজেদের ক্লাস নিয়ে কোনোদিন ভাববে না তোমরা তাই না!! জিহাদ পাগলামি করেছে। এখন তুমিও আবার শুরু করেছো। আমার কথার যেহেতু কোনো মূল্যই নেই তোমাদের কাছে তাহলে তোমাদের যা ইচ্ছে তোমরা করো গিয়ে। কিন্তু পরে কোনো কিছুর জন্য আমাকে আর পাবে না বলে দিলাম।

পিয়াস ভয়ে ভয়ে বলল, তাহলে তুমি রাজি। এটাই ধরে নিবো তো?

বাবা রাগি স্বরে বলল, আমার মত অমতে তোমাদের কিছু যাবে আসবে বলে মনে হয় না। কারণ আগের বারও তোমাদের যা ইচ্ছে হয়েছে তোমরা তাই করেছো। আমাকে এসবে জড়িয়ো না। আমি তোমাদের ভালো মন্দ কোনো কিছুতেই থাকবো না। আমার অনেক কাজ আছে। তোমাদের যা মন চায় করো।

মা পাশ থেকে আমাদের অভয় দিয়ে বলল, এখন চুপ করে যেতে। পিয়াস ভেতরে চলে গেল।

আমি আড়াল থেকে মায়ের কথা গুলো শুনলাম।

মা বাবাকে বলল, কাল আমরা কুহুকে আংটি পরাতে যাব। আমি চাই বাড়ির সবাই মিলে যেন সেখানে যাওয়া হয়। ছেলে-মেয়েদের সুখ সবকিছুর আগে। আমার কথা আমি বললাম। বাকিটা এবার যার যার ইচ্ছে।

ঘরে গিয়ে পিয়াসকে বললাম, কংগ্রাচুলেশনস ভাই।

পিয়াস বলল, হঠাৎ! কী হয়েছে?

কাল তোদের এনগেজমেন্ট হবে। মানে তোর আর কুহুর।

পিয়াস অবাক হয়ে বলল, কী বলছো ভাই! ছোট বাবা রাজি হয়ে গেছে?

মা বলে দিয়েছে। বাবা আর ঝামেলা করবে বলে মনে হচ্ছে না।

আই কান্ট বিলিভ দিস ব্রো! এটা সত্যি! মিস কাদাবতী সারাজীবনের জন্য আমার হয়ে যাবে?

এবার তাহলে বিয়ের শপিংয়ের লিস্ট করা যাক!

শপিংয়ের লিস্ট! এটার জন্য ভাবির হেল্প লাগবে। ওয়েট ভাবিকে ডেকে নিয়ে আসছি।

এতো সব কিছুর মধ্যে নিজেকে পিয়াসের সামনে স্বাভাবিক রাখলেও ভেতর থেকে আমি যেন ধীরে ধীরে ভীষণ ভেঙ্গে পড়ছি। চোখের সামনে আমার মায়াবতী আমার নিজেরই ভাইয়ের বউ হয়ে যাবে। নিজের অনুভূতির কথা গুলো হয়তো আর কখনোই কুহুকে বলা হবে না। তবুও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো। পিয়াসকে আমি খুব ভালোবাসি। ওর মনে কষ্ট দিয়ে আমি কখনোই সুখে থাকতে পারতাম না। মনে করবো এটাই আমার ভবিতব্য।
_______________________

এসব আমি কী শুনছি কুহু! তুই নাকি পিয়াসকে!!

বড় আপার কথার প্রতিত্তোরে বললাম, ঠিক শুনেছিস আপা।

তাহলে তিয়াস?

তিয়াস আমাকে ভালোবাসে না। ও চায় আমি যেন ওর ভাইকে মেনে নিই।

আর তুই? তুই কী চাস?

আমি যা চাই তাই তো করছি।

পিয়াস বলেছে আমাকে সবটা। এই জন্যই তো তোকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছি। কাল সবাই যাবে আমাদের বাড়িতে। তোকে আংটি পরাতে। কিন্তু তুই কি সত্যিই পিয়াসকে?

সত্যি মিথ্যে আমি জানিনা। তিয়াস যা চায় আমিও সেটাই চাই ব্যাস।

তোরা কী করছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। যা ইচ্ছে কর। কিন্তু এর জন্য যেন পরে পস্তাতে না হয়। যা করবি ভেবেচিন্তে করবি।
________________

কুহু.
তুমি এলে না কেন এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠানে?

তিয়াস বলল, আমার কাজ ছিল।

কাজ ছিল নাকি সত্যিটা মেনে নেয়ার সৎ সাহস নেই তাই মুখ লুকিয়ে ছিলে।

কী যা-তা বলছো! আমার যাওয়া না যাওয়ায় কী আসে যায়! ওখানে আমি ইম্পর্ট্যান্ট নই। পিয়াস ছিল, বাড়ির বাকি সবাই ছিল তাতেই এনাফ। আমাকে নিয়ে টানাটানি করছো কেন?

তুমি খুশি তো?

হ্যাঁ, অনেক খুশি। আমার ভাই খুশি মানেই আমার খুশি৷

তোমার আমাকে কিছুই বলার নেই?

হ্যাঁ।

বলো কী বলবে।

কংগ্রাচুলেশনস ফর ইউর নিউ লাইফ।

একথা বলেই তিয়াস ফোন কেটে দিলো।
_______________

তিয়াস.
মা বলেছে ভাবিকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে। আর যাওয়ার পথে কুহুকে পিক করে নিস। সব কেনাকাটা কুহুকে সাথে নিয়ে করবি

পিয়াস বলল, ভাই শপিংয়ের ব্যাপারে আমার একটুও আইডিয়া নেই৷ আমি বরং বিয়ের ইনভিটিশনের দিকটা দেখে নিচ্ছি। ইমভিটিশন কার্ডের ডিজাইনটা একদম আলাদা করবে ভাবছি। এটা বেস্ট হতে হবে। শপিংয়ের দিকটা ভাবি সামলে নেবে। তুমি বরং ওদেরকে নিয়ে চলে যাও। আমি একটু পরেই বেরিয়ে পড়বো।

কিন্তু ভাই……..

পিয়াস আর কেনো কথা না বলেই চলে গেল। বাধ্য হয়ে আমাকেই কুহুদের শপিংয়ে নিয়ে যেতে হলো।

শপিং করার এক পর্যায় পিয়াস ফোন করে বলল, ও কাছেই আছে। যাওয়ার সময় আমাদের সাথেই ফিরবে। আমি বললাম, ঠিক আছে তুই চলে যায়। শপিং অলমোস্ট হয়ে গেছে।

এরমধ্যে কুহু অনেকবার আমাকে কিছু বলতে চেয়েছে। কিন্তু আমি শুনতে চাই নি। শোনার চেষ্টা করিনি। ওর চোখের ভাষায় কিছু ছিল। আমি পড়ার চেষ্টা করিনি। কখনো কখনো আমাদের অনেক কিছু বুঝেও না বোঝার অভিনয় করতে হয়।

এরমধ্যেই পিয়াস আবার ফোন করে বলল, আমার আসতে আরেকটু দেরি হবে। তুমি বরং ততোক্ষণে কুহুকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসো। তারপর আমাকে পিক করো।

কুহুকে আর ভাবিকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলাম। বিয়ে উপলক্ষে ভাবি এখন এখনেই থাকবে।

যাওয়ার পথে পিয়াসকে নিয়ে বাসায় ফিরে গেলাম। ভেতরে এসে পিয়াস বলল, ফোনটা আবার গাড়িতে ফেলে এসেছি। আজকাল সব কিছু ভুলে যাচ্ছি। বিয়ের টেনশনে নাকি মানুষ এরকম অনেক ভুলভাল কাজ করে বসে। যাই ফোনটা নিয়ে আসি।
_________________

আরে গাড়ির মধ্যে এই ডায়েরিটা কোথা থেকে এলো! কার ডায়েরি এটা?

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here