তোমার প্রেমে পড়েছি পর্ব-১৯

0
2575

#তোমার_প্রেমে_পড়েছি
#পর্ব_১৯
#Rimy_Islam

সত্যিই কি চলছে নমনীর মনে! এখনই না জানলে তার স্বস্তি নেই।

সন্ধ্যালগ্ন। নমনীর চুল খোলা। সেই খোলা চুলে বাতাস যেন ছন্দ এঁকে দিয়েছে। যার প্রমাণ বইতে তারা মুক্ত আবহে ভেসে চলেছে। নমনী লাগাম ছাড়া চুলগুলো বেঁধে নিয়ে নেত্র’র পানে তাকিয়ে রইলো। উপহারস্বরূপ দিলো ছোট্ট একটা হাসি। নেত্র অবাক হলো না। আজ যে ওদের কারোর অবাক হওয়া বারণ। ভালোবাসার প্রকাশ যখন হয় নিরবে, তখন হতে হয় না বিস্মিত। হতে হয় উৎসুক। এ সত্যটা তারা জানে বোধ হয়।
— নেত্র! – নমনীর আহ্বানে এবার খানিক অবাক হয় নেত্র। কণ্ঠে তার স্নিগ্ধতা ঝরে পড়ছে। নেত্র বললো,
— শুনছি তো।
— প্রেমে পড়েছি। ভীষণ অপ্রস্তুতভাবে প্রেম নামক আবেগটা আমার জীবনে এসে গেল। এখন সামলাবো কি করে বুঝতে পারছি না।

নেত্র ছাদের রেলিংয়ে হেলে বসতে বসতে বললো,
— প্রেম? এতদিনে প্রেমে পড়লে তাহলে? আমি তো ভেবেই নিয়েছি তোমার সাথে সারাজীবন প্রেম- প্রেম খেলাতেই পেরিয়ে যাবে। তোমার মন গলবে না।

নেত্র’র কথায় বিন্দুমাত্র নড়ন ঘটলো না নমনীর। সে দু’হাত বাতাসে মেলে মাথা পেছন দিকে হেলে বললো,
— প্রেমে পড়েছি নেত্র। তোমার প্রেমে পড়েছি। আমাকে তোমার জেলে বন্দী করেই ছাড়লে। বাঁচতে দিলে না।
— সত্যি! – খুশিতে চকচক করছে নেত্র’র চোখ দুটো।
যেন বিশ্বাস করা বড় কঠিন। যে মানুষটার ভালবাসা প্রকাশের অপেক্ষা সে এতদিন যাবত করে আসছে। সে নিজে যখন আজ তেমন করেই মনের কথাগুলো বলছে, তবুও যেন মানতে অসুবিধা হচ্ছে নেত্র’র। ঘুম ঘেরা কোনো এক সুখকর স্বপ্ন মনে হচ্ছে। যে স্বপ্নের রেশ কাটেনি এখনো।
নমনী জোর গলায় বললো,
— এক, দুই, তিন, চার….. এভাবে অগণিত সত্যি।
— তাহলে এখন থেকে প্রেম পর্ব শেষ। স্বামী -স্ত্রীর পর্ব শুরু। কি বলো?
— আমি বলেছি তোমার প্রেমে পড়েছি। প্রেমে পড়া দিয়ে সংসার হয় না। দরকার পড়ে ভালবাসার।
— সেই ভালবাসার আবির্ভাব কবে হবে সেই অপেক্ষায় থাকতে হবে? চলো না প্রেম দিয়েই আমাদের “প্রেম নীড়” গড়ি। ধীরে ধীরে ভালবাসা এলে তখন “ভালবাসার নীড় “গড়বো না হয়!

নমনী হাসতে হাসতে বললো,
— তা হয় না।
নেত্র নিভলো। এরপর বললো,
— কেন নয়?
— কারণ প্রেম দিয়ে হাসি, আনন্দ আসলেও সুখ আসবে না। সুখ এক দূর্লভ বস্তু। ঠুংকো কিছুর জালে সে আটকায় না। দৃঢ় মাধ্যমের প্রয়োজন। সেই মাধ্যম হবে ভালবাসা। প্রেম শতবার হতে পারে, শত জিনিসের উপর হতে পারে। এইযে আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। দিনে দিনে তোমার প্রতিটা বিষয় গভীর পর্যবেক্ষণ করে তবেই পড়েছি। এটা এক প্রকার মায়াজালো বলতে পারো। এ মায়াজাল নামক প্রেম হঠাৎ আবার উধাও হয়ে যেতে পারে। আমি চাই না তা হোক। তাই যেভাবে চলছে চলুক না!

নেত্র হতাশ হলো। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়েই বললো,
— কি জানি নমনী! তুমি সত্যিই সহজ মানুষ নও।
— হয়তো।
বলেই খলখলিয়ে হেসে উঠে নমনী।

___
শুক্রবার দিনটি প্রতিটি বাড়ির জন্য ঈদের ন্যায় আনন্দের দিন। সাপ্তাহিক কার্য বিরতি যেন দিনটিতে প্রাণ ঢেলে দেয়। চাকুরিজীবী, ব্যবসিক কিংবা দিনমজুর হোক, প্রত্যেকের জন্য ছুটির দিন এটি। কিন্তু নেত্রদের বাড়িতে এ দিনে চলে হুড়োহুড়ি। রেহান সাহেব খুব সকালে উঠে নিজে বাজার করতে চলে যান। বাজার এলে চলে রান্নার ধুম। বিয়ে বাড়ির মতো হরেক রান্নার আয়োজন দেখে সকলের জিভে জল এসে যায়। আজও এমনটাই হচ্ছে। নমনী এবং মুমু এসব থেকে অজ্ঞাত। আমিরার মুখে সব শুনছে ওরা।
আমিরা বেশ আমেজে সবকিছু শুনিয়ে চলেছে। যেন এ বাড়ির শুক্রবারের ইতিহাস বলছে সে।
— আপনেরা দেখবেন আইজ কি কি হয়। আমরা অনেক মজা করি। দুপুরের খাওন শেষ হইলে আমরা যাবো পেকনিকে।
এ পর্যায়ে নদী ফোঁড়ন কেটে বললো,
— ধূর আপা, পেকনিক কি! ওটাকে বলে পিকনিক। তুই থাম আমি বলি।
নদী বলতে শুরু করে,
— শুক্রবার আমরা খুব মজা করি। সবাই ঘুরতে চলে যায়। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়।

নমনী উৎসুক হয়ে বললো,
— বাড়ির সবাই যায়? আর নেত্র?
— ওইতো! ভাইজান যায় না। কোথাও যেতে চায় না।
আমিরা বলতেই নমনীর মুখ থুবড়ো করে নেয়। নেত্র’র বিষয়ে সে যখনই সব জানতে চায় তখনই বিশেষ কিছু তথ্য বের হয় না। সে ঘুরতে পছন্দ করে না। শৌখিন কোনো কাজে তার আগ্রহ নেই। তার মা-বাবার সাথে সময় কাটানোতেও সে নারাজ। তাহলে ছেলেটা করবেটা কি? ভাবতে বসে নমনী হতাশা ছাড়া কিছু পায় না।

নেত্র বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজেনি আজ। বেশ আমোদ খেলে জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। নমনী ঘরে ঢুকে কিছুটা থমকায়। এ যে নেত্র’র স্বভাব বহির্ভূত! তার বিবাহ জীবনের ক’ মাসের একদিনো নেত্রকে বই হাতে ছাড়া দেখেনি।
— তুমি ঠিক আছ? – নিবিড় কৌতুহলে প্রশ্ন করে নমনী।
নেত্র ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
— হু। কখন এলে?
— সবে। কি হয়েছে?
— কোথায় কি হয়েছে? মনটা ভালো নেই। জীবনের প্রথম বইয়ের উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। এমন তো হবার কথা নয়!
— কারণ তোমার জীবনে আমি এসেছি।
— অনেক আগেই তো এসেছ। তাহলে এতদিন কেন এমন হয়নি?
— হয়তো আমার প্রেমের বহিঃপ্রকাশ তোমার জীবনে প্রাণ ঢেলে দিয়েছে!
নেত্র বিস্ময়ে চোখ কুঁচকে নমনীর দিকে চেয়ে বললো,
— মানে বলতে চাইছ এতদিন আমার মধ্যে প্রাণ ছিল না?
— জি।
— Why?
— প্রাণ তো ছিলো, তবে সেই প্রাণে সুখ ছিল না। আনন্দ ছিল না। একে কি প্রাণ থাকা বলে! বলে না।
— আজব! শোনো না, একটু প্রেম করি?

নমনী অনুসন্ধিৎসু নজরে নেত্র’র দিকে তাকায়। দুই পাশের কোমরে দু’ হাত রেখে আক্রমনাত্মক হয়ে উঠতেই নেত্র ভয় পাওয়ার ভঙ্গি করে ছিঁটকে দূরে সরে যায়। তারপর গা দুলিয়ে হেসে উঠতেই নমনী আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। নেত্র সেদিকে জোর নজর দিয়ে পরমুহূর্তেই নমনীর এক হাত ধরে হেঁচকা টানে নিজের অতি নিকটে নিয়ে আসে। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই এমন কি ঘটে যেতে নমনী ঘাবড়ে যায়। দীর্ঘ , ঘন পল্লবের চোখজোড়া মেলে তাকাতেই নেত্র’র চোখে ধরা পড়ে যায় ওর ভয়ার্ত মুখখানা। কিন্তু আজ আর রেহায় বুঝি নেই নমনীর। অন্তত নেত্র’র অপরিবর্তিত মুখোভঙ্গি সে কথার জানান দিচ্ছে।
নমনী আতঙ্কিত গলায় বললো,
— কি করবে তুমি?

নেত্র জবাব দিল না। নমনীর কোমর স্পর্শ করতেই সে কেঁপে উঠল। ধীরে ধীরে নেত্র’র হাত কোমর ছাড়িয়ে পিঠ স্পর্শ করতেই নমনীর চোখ বন্ধ করে নেয়। তারপর পরবর্তী ধাপের অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু অনেকটা সময় অতিবাহিত হতেও যখন সবকিছু স্বাভাবিক ঠেকলো, তখন চোখ খুলে নমনী। পিঠে একটা হাতের স্পর্শও অনুপস্থিত। নেত্র তার থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। তার মানে যে ভয় সে করছি তা কেবলই বৃথা।
নেত্র হাসতে হাসতে বললো,
— প্রেম বালিকা! কি মনে করেছিলে? এখনই অধিকার ফলাতে চলে আসবো?
নমনী বললো,
— যেভাবে টেনে ধরেছিলে, তাতে অন্য কিছু মাথায় আসছিল না। হঠাৎ এত সুবুদ্ধির উদয় হলো কেন?
— আমার সুবুদ্ধির উদয় হওয়ার দরকার পড়ে না। আমি সর্বদা সুবুদ্ধি নিয়েই চলি। যেখানে তুমি এখনো প্রেম সম্পর্ক ব্যতীত নতুন কোনো সম্পর্কে জড়াতে প্রস্তুত নও, সেখানে তোমার মত ব্যতীত আমি এগোই কিভাবে? তবুও আশা করছি যতটুকু করেছি অন্তত সেটুকু আমাদের মাঝে জায়েজ।
— জি না, জায়েজ না। আমার অনুমতি ছাড়া এক পা এগোবেন তো এক্ষুনি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়বো।
নেত্র ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বললো,
— কোথায়?
— বাবার বাড়ি।
— কি অশুভ কথা!
— হু।
— থ্রেট দিচ্ছ?
— একদম না। সত্যি সত্যি এমন করবো।

নেত্র হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানার এক কোণে গিয়ে বসলো। তারপর অসহায়বোধে নমনীর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে আবার চোখ সরিয়ে নেয় তিক্ত মেজাজে। এরপর বলে,
— একই বিছানায় শুতে পারব, নাকি তাও কপালে জুটবে না?

নমনী মুখ বেঁকে নেয়। আদিখ্যেতার স্পষ্ট প্রকাশে সে বেশ বিরক্তি বোধ করল। তাই সে রাগান্বিত হয়েই বললো,
— এতদিন তবে কোথায় ঘুমিয়েছ? নতুন করে প্রশ্ন করে কি বুঝাতে চাইছ? আমি খুব খারাপ?
— এই জন্যই বলে, ‘ সব করো প্রেম করো না’। বলি কি আর বুঝে কি! শুভ রাত্রি। আর হ্যাঁ, কাল খুব সকালে ডেকে দিও তো। ইম্পরট্যান্ট ক্লাস এ্যটেন্ড করতে হবে।
— আজ্ঞে জনাব!

নমনীর ক্লাস শেষ করে বেরতে বেরতে দুটো বেজে গেল। এদিকে আজ নেত্রও বাসায় পৌঁছবে দেরিতে। তাই সে দ্রুত রিকশাযোগে বাড়ি পৌঁছে যায়। গেটে প্রবেশ করতেই কিছুটা অবাক হলো নমনী। নেত্র’র বাইক গ্যারেজে রাখা। অর্থাৎ সে বাড়িতে আছে। এমন তো হবার কথা নয়। সে বলেছিল, তার ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যাবে। নমনীর মনে মনে আকাশ পাতাল ভাবনা নিয়ে ভেতরে ঢুকতে আমিরার মুখোমুখি হলো। সে ট্রে হাতে দোতলার সিঁড়িতে উঠতে যাচ্ছিল। নমনী পথ রোধ করে বললো,
— নেত্র ফিরেছে?
— ভাইজান তো সেই সকালেই ফিরছে। আপনে যাইবার পরপর-ই।
— ট্রেতে নাস্তা কার জন্য? কে এসেছে?
— ভাইজানের বান্ধবী।

নমনী চমকালো ভীষণ। নেত্র তবে মিথ্যে বলেছে! সে আবারো প্রশ্ন করলো,
— বাড়ির সবাই কোথায়?
— কেউ নাই। নিলয় ভাইজান আর ভাবি গেছে কানাডা যাওনের কি সব ঠিকঠাক করতে। আম্মা গেছে আব্বারে নিয়া হাসপাতালে। বাড়িতে আমি আর নদী ছাড়া কেডাও নাই।
নমনী উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
— বাবার কি হয়েছে?
— পেশার বাড়ছে। আপনে উপরে যান।

নমনী ওপরে উঠে নিজ ঘরের সম্মুখে এসে থেমে গেল। ভেতর থেকে কড়া মেয়েলি পারফিউমের গন্ধ নাকে প্রবেশ করতেই সে হাঁচতে শুরু করে। আমিরা তার পাশেই ছিল। সে বললো,
— কি হইছে?
— আমিরা, ট্রে আমাকে দিয়ে তুমি যাও।
আমিরা তার কথামতো ট্রে নমনীর হাতে দিয়ে চলে যায়।

নমনী কাঁপা হাতে ট্রে সামনে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। দেখে বিছানার উপর বেশ আয়েশে শুয়ে রয়েছে একটি মেয়ে। অসম্ভব পাতলা, যাকে বলে রুগ্ন প্রকৃতির মেয়েটাকে দেখেই নমনীর মেজাজ চড়ে যায়। খোলা চুলে মেয়েটা ইনিয়ে বিনিয়ে আঙুল ডুবিয়ে খেলায় মত্ত। নমনীকে দরজার সামনে দেখে মেয়েটা তড়াৎ করে বসে খুব সহজভাবে উঠে এলো তার কাছে এবং বললো,
— Hi! I am Naura. বাংলায় ‘ নৌরা’।

চলবে…………..

( আমি অত্যন্ত দুঃখিত এতদিন পর গল্প দেয়ার জন্য। প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম। এছাড়াও আমার অতি শ্রদ্ধেয় আপন একজন মানুষকে এর মাঝে হারিয়েছি। মানসিকভাবে প্রচন্ড ডিপ্রেশনে ছিলাম। আপনারা অনেকেই গল্পের জন্য ইনবক্সে নক করেছেন। আমি দুঃখিত রিপ্লাই না দিতে পারার জন্য। আর আপনারা আমার গল্পটাকে মনে রেখে পড়ার জন্য যে অপেক্ষা করছেন। এটা জেনে সত্যি আবেগাপ্লুত। রিভিশনের সময় নেই। তাই ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হ্যাপি রিডিং।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here