#মৃণালিনী
#পর্ব ২
রমণী বাবুর স্ত্রী নেই, এবং তিনি যথেষ্টই আধুনিক মনের মানুষ, তাই তাঁর বাড়িতে তাঁর ছাত্রদের আসা যাওয়ায় কোনো বাধা ছিলোনা কখনো। মেয়ে মৃণালিনীও একটুও পর্দানশীন নয়, সে শিক্ষিতা, স্কুল, কলেজে যাতায়াত করেছে সব সময়।
ঘটনার সূত্রপাত বেশ কিছুদিন আগেই, গত বেশ কিছুদিন ধরেই রমণী বাবুর বাড়িতে ক্রমশ যাতায়াত বাড়ছিলো তাঁর ছাত্রদের। তারা কতটা স্যারের কাছে পড়া বুঝতে আসতো আর কতটাই বা মৃণালিনীর দর্শনের জন্যে, সেটা আন্দাজ করা মুশকিল ছিলো।
সৌম্যও তার ব্যতিক্রম ছিলনা, গত কয়েক বছর ধরে স্যারের বাড়িতে যাতায়াতের সুবাদে সে অনেকটাই কাছ থেকে দেখেছিলো মৃণালিনী কে। তারপর পড়াশুনার জীবন শেষ করে কলেজের অধ্যাপক হিসেবে ঢোকার পরেও প্রাক্তন শিক্ষকের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেনি সে, কারণ টা অবশ্যই মৃণালিনী।
আই এ পাঠরতা মৃণালিনীর জন্যে পাত্র খুঁজতে একটু হিমশিম খাচ্ছিলেন রমণী বাবু, মেয়ে তাঁর একটু বেশি শিক্ষিতা হয়ে গেছে। এদিকে সৌম্যর আসা যাওয়াও ক্রমশই বাড়ছিলো, যদিও তা খুব বেশি নজরে পড়েনি তাঁর। আসলে এগুলো সাধারণত নজর করেন বাড়ির মহিলারা, আর মৃণালিনীর মা ছিলো না। তবু বাড়ির ঠাকুর চাকরদের চোখেও মাঝে মাঝেই ধরা পড়ছিলো এই অত্যধিক আসা যাওয়া। বাড়ির বামুন দিদি একদিন কথায় কথায় বাড়ির কর্তা বাবুর কানে তুলেই দিলেন কথাটা।
কিন্তু সব সত্যি বলার মতো ধৃষ্টতা তার ছিলো না, তাই সৌম্য পাত্র হিসেবে বেশ ভালো হতে পারে এটুকুই বলার মতো সাহস তিনি পেয়েছিলেন। প্রস্তাবটা খুব বেশি খারাপ লাগেনি কর্তা বাবুর, পেশায় অধ্যাপক মৃণালিনীর বাবা তাঁর জহুরীর দৃষ্টিতেই ভবিষ্যত দেখে ছিলেন প্রিয় ছাত্র সৌম্য সুন্দরের। তাই গ্রামের ছেলে হলেও নিজের আদরের মেয়ে মৃণালের উপযুক্ত পাত্র হিসেবে খুঁজে নিতে একটুও দ্বিধা করেন নি তিনি।
কিন্তু সেই প্রস্তাব সৌম্য কে কিভাবে দেবেন কিছুতেই স্থির করতে পারছিলেন না। নিজে বলতে না পেরে একদিন আর একজন প্রিয় ছাত্র বিমলের মাধ্যমে সৌম্য কে কথাটা জানালেন তিনি। বিমল আর সৌম্য অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, প্রায়শই একে অন্যের বাড়িতে যাতায়াত করে তারা। তাই বিমলের মাধ্যমে সৌম্যকে প্রস্তাব দেওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে হলো তাঁর।
তাঁর জানা ছিলো না, এই প্রস্তাব সৌম্যর কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। স্যারের এই সুন্দরী শিক্ষিতা কন্যা রত্ন টিকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ ছিলো তার, শুধু বলার সাহস টুকু সঞ্চয় করতে পারছিলো না সে। তাই প্রস্তাবটা প্রায় লুফেই নিয়েছিলো সৌম্য।
কিন্তু বাবা যদি জানতে পারেন যে নিজের পছন্দের মেয়েকে সে বিয়ে করছে, তাহলে সে সম্বন্ধ বাতিল করতে একটুও দেরি হবেনা তাঁর। তাই নিজেকে সম্পূর্ন সরিয়ে রেখে, বাবার ঠিকানায় ঘটক পাঠিয়ে খুব সুন্দর ভাবেই এই পর্ব টির সমাধা করেছে সে। বাবা বিয়ের দিন বুঝেছেন, সেটা বুঝেছে সে, কিন্তু আর সেটা নিয়ে যে বাবার কিছু করার নেই, সেটা সে ভালো করেই জানে।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেক আগেই, গ্রামের চারিদিকে নিস্তব্ধতা, মৃণালিনী জানলার গরাদে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে দূর থেকে শেয়াল ডাকার আওয়াজ ভেসে আসছে, কলকাতার মেয়ে মৃণালিনীর কাছে এ এক নতুন জগৎ। মা মরা একমাত্র মেয়ের বিয়ে ঠিক এতদূরে ঠিক করতে চাননি ওর বাবা, কিন্তু কপাল ঠেকায় কে!
একদিন কলেজ থেকে ফিরে সৌম্য আর বিমল কে বাবার ঘরে কথা বলতে দেখেছিলো মৃণাল, ওরা চলে যাবার পরে বাবা ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার কয়েকদিন পরে সৌম্যর বাবা এলেন ওদের বাড়িতে, এক দেখাতেই পছন্দ করলেন মৃণালিনী কে, আর এই অজ পাড়া গাঁ ওর নিয়তি হলো।
মা হারা মৃণাল একটু আদুরে, বাড়ি ভর্তি চাকর ঠাকুরের শাসনই বড়ো হয়েছে সে। সারাদিন পড়াশুনা, ঘর গোছানোর মধ্যেই তার জীবন শুরু হয়েছিলো, ঠিক সংসারী হবার জ্ঞান গুলো দেবার মতো লোক তার জীবনে ছিলো না। গিন্নি বান্নি কেউ না থাকায় ঘরোয়া ব্যাপার গুলো সম্বন্ধে অভিহিত করার মতো কেউ ছিলনা তার, তাই এ বাড়িতে পা দিয়েই জ্যেঠ শাশুড়ির দাপট দেখে একটু অবাক হয়ে ছিলো সে।
বউ দিদি চলো তোমাকে বড়মা ডাকছেন,
সরমার কথায় চমক ভাঙলো মৃণালিনীর, বড়মা কে প্রথম দর্শনেই যথেষ্ট ভয়ঙ্কর লেগেছে তার, তাই তিনি ডাকছেন শুনেই মনের ভিতরে একটা হালকা ভয় ভাব ফিরে এলো। সরমা র পেছন পেছন পারুলবালার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো সে।
এসো বাছা, এখানে এসো,
একটু গম্ভীর গলাতেই ঘরের ভেতর থেকে ডাক দিলেন তিনি, যদিও মা হারা মিষ্টি মুখের মেয়েটিকে তাঁর খারাপ লাগেনি কিন্তু সেটা তাকে বুঝতে দেওয়া চলবে না, লাগাম একটুও ঢিলে দিলেই পেয়ে বসবে একদম।
এই নাও এইটে তোমার,
নিজের বিয়ের একটি ভারী গয়নার বাক্স তার হাতে তুলে দিলেন তিনি। ভারী সুন্দর একটা বিছে হার, খুব খুশি হয়ে তার উচ্ছাস প্রকাশ করতে যাচ্ছিলো মৃণালিনী, পারুলবালার পরবর্তি কথায় থমকে গেলো,
কাজ কর্ম কিছু জানা আছে, নাকি বিদ্যের জাহাজ হয়েছো শুধু!
সংসারিক জ্ঞান খুব বেশি না থাকলেও সে যথেষ্টই বুদ্ধিমতি, সব প্রশ্ন যে উত্তরের অপেক্ষা তে করা হয় না, সেটা জানা আছে তার। তাই চুপ করেই থাকলো সে, পারুল বালা খুশি হলেন, যাক আর যাই হোক মেয়েটি চোপা করেনা মুখে মুখে।
আমাদের বাড়ির কিছু নিয়ম কানুন আছে, সে তুমি থাকতে থাকতে বুঝে যাবেখন, তোমার শাউড়ি সব বুঝিয়ে দেবে, যা ওকে তোর মায়ের ঘরে নিয়ে যা, সরমা র দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।
সরমা দরজার বাইরেই দাঁড়িয়েছিলো বড়মার অনুমতি ছাড়া এঘরে ঢোকার সাহস তার নেই, এতক্ষনে ঘরে ঢুকে এসে মৃণালিনী র হাত ধরে টানলো সে।
দুজনে আস্তে আস্তে মায়ের ঘরের দরজায় উপস্থিত হলো, কুমুদ অতো কড়া শাশুড়ি নন, তিনি নিজেই বড়ো জায়ের শাসনে অতিষ্ট, অন্য কাউকে শাসন করার মতো ক্ষমতা তাঁর নেই।
মা, বউ দিদি এসেছে,
ওমা! এসো এসো
বলেই উঠে বসলেন তিনি,
মন খারাপ করছে নাতো?
খুব নরম গলায় বললেন কুমুদ, তাঁর নিজেরও প্রায় এই বয়সীই একটি মেয়ে আছে, তাই মৃণালিনীর কষ্ট টা কিছু হলেও বুঝতে পারলেন। মন তো বাবার জন্যে একটু খারাপ লাগছিলো, কিন্তু তাও মাথা নেড়ে খাটের পাশে পা ঝুলিয়ে বসলো ও।
শাশুড়ির কাছ থেকেও কিছু প্রাপ্য হলো মৃণালের, কূমুদের গয়নার কোনো অভাব নেই। যখন যা ইচ্ছে নিজের মতো করেই কেনা কাটা করেন তিনি, বউ মা কে কি দেবেন স্থির করতে না পেরে নিজের সব গয়নাই মেলে ধরলেন একমাত্র পুত্রবধূর সামনে, আর তো কাউকে তাঁর দেওয়ার নেই! মৃণালিনী কিছুটা সংকুচিত হলো, গয়না পরতে কে না ভালোবাসে! কিন্তু তা বলে বেছে নেওয়া! কিছুটা থতমত খেলো সে।
সরমা উচ্ছসিত হলো,
ওমা! তুমি বাছতে পারছনে বউদিদি, দাও আমি বেছে দিচ্ছি,
সরমা বৌদি কে বেছে দেওয়ার সুযোগে নিজের জন্যেও বেছে নিল দু একটা, কাল দাদার বৌভাতে পড়তে হবে তো!
দুজনে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজেদের ঘরের দিকে যাচ্ছিলো এবার, আজ রাতে তাদের একসঙ্গেই থাকা। দুটি প্রায় সমবয়সী তরুণী আর কিশোরী এইটুকু সময়েই বেশ বন্ধু হয়ে উঠেছে দুজনে, সরমা বেশ গর্বিত তার বৌদি কে নিয়ে, হাজার হোক কলকেতার মেয়ে বলে কথা! তার বন্ধুরা এর আগে কোনো দিনও কলকাতার মেয়ে দেখেনি।
বাহ! কি সুন্দর গন্ধ গো! এটা কামিনী ফুলের গাছ না!
বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা গন্ধে মুগ্ধ হয়ে বাগানের দিকে পা বাড়ালো মৃণালিনী,
আরে করো কি! কামিনীর গন্ধে সাপ আসে জানোনা? এই অন্ধকারে কেউ বাগানে পা দেয়?
এগিয়ে যাওয়া বৌদির হাত চেপে ধরলো সরমা, এতো পড়াশুনা জানা বৌদি এই সাধারণ কথাটা জানে না জেনে অবাক হচ্ছিলো সে।
দু পা পিছিয়ে এসেই চমকে দাঁড়ালো মৃণালিনী, শক্ত করে ধরলো ননদের হাত
বাবা গো, ওদিকে অন্ধকারে কে গো!
সরমা ওদিকে তাকিয়েই হেসে ফেললো,
ইস, তুমি কি ভীতু গো, ওটা তো দোতলায় দাদার ঘরের জানলা, দাদা জানলায় দাঁড়িয়ে আছে, তারই ছায়া।
সৌম্য বেচারা বড়ো মার ভয়ে বউয়ের মুখোমুখি হবার সাহস না পেয়ে নিজের ঘরের জানলাতেই দাঁড়িয়ে ছিলো। অন্ধকারের মধ্যে ঘরের জানলা দিয়ে আসা লণ্ঠনের আলোয় ভুত বলে তাকে ভেবেছে মৃণালিনী। সরমার হাসি থামছিলো না, সে গ্রামের মেয়ে যথেষ্টই ডাকা বুকো। দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে সবটাই শুনছিল সৌম্য, সেও হাসি চাপতে পারছিলো না আর।
বরের ছায়া আর হাসির আওয়াজে তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করলো মৃণালিনী, ইসস, আজ না কালরাত্রি, স্বামীর ছায়া দেখাও পাপ!
ক্রমশ
ছবি অন্তর্জাল