মৃণালিনী পর্ব-১৬

0
878

#মৃণালিনী
#পর্ব ১৬
কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছুটে চলেছে কয়লার ইঞ্জিন, কামরার জানলায় মাথা রেখে বসেছিলো মৃণালিনী। স্টেশন ছেড়ে ট্রেন চলতে শুরু করার পর যেনো অনেকটা হালকা লাগছিলো তার। কতদিন পরে আবার প্রিয় মানুষগুলোর কাছে ফিরে যাওয়া! পরীক্ষা দেবার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো মৃণাল, বিশেষ করে সৌম্য শনিবারে না আসায় আরও চিন্তা হচ্ছিলো তার।

যাই বলিস মা, তোর জ্যেঠ শাশুড়ি কিন্তু মানুষ একটুও ভালো নন, বড্ড কড়া কড়া কথা কন!

বামুন মাসির গলার আওয়াজে চমকে উঠে তাকালো মৃণালিনী, মনের মধ্যে একটু অশান্তি হলো, কাল রাতে বড়ো মার চিৎকার যে ওদের কানেও গিয়েছে সেটা বুঝতে পারলো। কিন্তু এসব খবর বাবার কানে গেলে তিনি যথেষ্টই দুঃখ পাবেন, হয়ত সৌম্য কে ডেকে দু চার কথা বলতেও পারেন। কিন্তু সেতো এসব কিছুই চায় না,

এসব কথা বাবাকে বলার দরকার নেই বামুন মাসি, বাবা শুনলে কষ্ট পাবেন। আর বড়ো মা একটু কড়া কথা বলেন ঠিকই, কিন্তু আমাকে খুব ভালো বাসেন। ওনার গলাটা একটু জোরে, এই যা, অন্য কিছু নয়,

বামুন মাসির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো মৃণাল, বামুন মাসি মাথা নাড়লেন। ওর এই কথাই যে যথেষ্ট সেটা ও জানে, আর তিনি বাবার সামনে মুখ খুলবেন না।

বাড়ি পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো, রমণী বাবু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন মেয়ের জন্যে, এতদিন পরে বাবা কে দেখে মৃণালের চোখের জল বাঁধ মানছিল না আর। সন্ধ্যে বেলায় সৌম্য কলেজ থেকে ফিরে শ্বশুরবাড়িতে এলো, মৃণাল তখন অধীর আগ্রহে তার জন্যেই ছাদে অপেক্ষা করছিলো। সৌম্য কে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই সে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো।

সৌম্য সবে বউ কে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখে শ্বশুর মশাই কে কিছু না জানানোর অনুরোধ করতে যাচ্ছিলো তার আগেই রমণী বাবু তাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন।

সৌম্য একটু ভীত দৃষ্টিতে মৃণালের দিকে তাকালো, ইতিমধ্যেই তার তৈরি করা পরিকল্পনার খবর মেয়ের কৃপায় তাঁর কানে পৌঁছে গেছে কিনা চিন্তা করতে করতে সে শ্বশুর মশাইয়ের ঘরের দরজায় পৌঁছে গেলো।

যদিও রমণী বাবুর তাকে ডেকে পাঠানোর কারণ অন্য ছিলো। অতো বড় বাড়িতে তিনি ঠাকুর চাকর নিয়ে একা থাকেন, অনেক বার সৌম্য কে মেস ছেড়ে তাঁর বাড়িতে এসে থাকার জন্যে বলেছেন আগে, কিন্তু সে রাজি হয়নি। শ্বশুর বাড়িতে এসে থাকতে তার সম্মানে লেগেছিলো।

আমি চাই যতদিন মৃণাল এখানে থাকবে, ততদিন তুমি এখান থেকেই কলেজে যাতায়াত কর। তাতে ওরও সুবিধা হবে, আমি তো আছিই, তার সঙ্গে তোমার সাহায্য পেলে,ওর পরীক্ষার ফল আরও ভালো হবে।

সৌম্য কে ঘরে ঢুকে আসতে দেখে বললেন তিনি। এবার আর শ্বশুরের প্রস্তাবে অসম্মত হওয়ার কিছু ছিলো না সৌম্যর, এই প্রস্তাব তার জন্যে যথেষ্টই আনন্দের, তাই সানন্দে রাজি হলো সে। মৃণাল কিছু তার পরিকল্পনার ব্যাপারে বাবা কে জানায়নি এটা বুঝে সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। মৃণালের সঙ্গে আসার আগে যথেষ্টই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিলো, সেগুলো মিটিয়ে নেবার এই সহজ সুযোগ হাতছাড়া করার মতো মূর্খ সে নয় একটুও।

রাতে ঘরে এসে প্রথম সুযোগেই বউয়ের কাছে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলো সৌম্য, এতো সহজে স্বামীর সাহায্যে পরীক্ষা দিতে আসার সুযোগ পেয়ে মৃণাল তো অনেক আগেই তার মান অভিমান ভুলে গিয়েছিলো তাই নিজেদের মধ্যেকার ভুল বোঝাবুঝি খুব সহজেই মিটে গেলো। বাপের বাড়ি আসার আনন্দ, এতো দিন পরে স্বামীর সাহচর্য, সব মিলিয়ে সে রাতটা মৃণালের কাছে একদম অন্য রকম ছিলো, দুজনের বাঁধ ভাঙা উচ্ছাস ভাসিয়ে নিয়ে গেলো দুজনকেই।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচ থেকে বামুন মাসির করা চা, নিজের হাতে করে নিয়ে এসে সৌম্যর ঘুম ভাঙ্গালো মৃণাল, আগের বার চা করুণা নিয়ে এসেছিলো বলে যথেষ্টই ক্ষোভ ছিল সৌম্যর।

বাবা বলেছিলেন পৌঁছে টেলিগ্রাম করতে,

খাটে বসে স্বামী কে উদ্যেশ্য করে বললো মৃণালিনী, সৌম্য মাথা নাড়লো,

ঠিক আছে, আজ কলেজে যাবার সময় করে দিয়ে যাব না হয়,

আমি একটা কথা ভাবছিলাম, মা খুব মন খারাপ করেছিলেন তুমি শনিবার বাড়ি যাওনি বলে, জোর করে গাড়িও পাঠিয়েছিলেন স্টেশনে। তুমি বরং বাড়ি গিয়ে খবরটা দিয়ে এসো, রথ দেখা আর কলা বেচা, দুইই হবে একসাথে।

সংসার বড়ো জটিল মৃণাল, কতো কিছু যে ভেবে চলতে হয়! সংসারের থেকে বড়ো রাজনীতির জায়গা আর কি আছে!! বড়ো মা চান না আমি যাই, কিন্তু মা চান! তাই এমন কিছু করতে হবে যাতে দুজনেই দুঃখ না পান। এই প্রস্তাবটা ভালো, বাবার সুস্থতার খবর নিয়ে গেলে বড়ো মা নিশ্চয়ই রাগ করবেন না আর।

এতো ভালো মন্দ ভেবে কাজ করো তুমি! সব কিছুই কি পরিকল্পনা করে চলতে হয়!

হেসে বললো মৃণাল, তাদের বাড়িতে সে কখনো এসব নিয়ে ভাবে নি আগে। ভাবার প্রয়োজনও ছিলো না কখনো, তাদের পিতা পুত্রীর সংসারে রাজনীতি করার মতো কেউ ছিলনা কোনোদিনই। সৌম্য হাসলো,

ভাবতে হয় বৈ কি! যদি কোনো জিনিস সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই বিতর্ক এড়ানো যায়, তাহলে মিছিমিছি প্রতিবাদী হওয়ারই বা দরকার কি! এই যে যদি বাবা বা বড়ো মা জানতেন আমি নিজের পছন্দে বিয়ে করতে চাইছি, তাহলে দুঃখ পেতেন। সেক্ষেত্রে আমাকে যে কোনো একটা দিক ছাড়তে হতো, কিন্তু আমি তো কাউকে হারাতে চাইনি! অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা যেমন ভাবতে পারিনি, তেমনি এটা করতে গিয়ে বাড়ির সবার বিরাগভাজনও হতে চাইনি। তাই ঘটক কে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠানোর ছোট্ট পরিকল্পনায় যদি সব দিক বজায় থাকে তাহলে এটুকু করতে অসুবিধা কি!

মৃণাল অবাক হলো, সে এগুলো কে কখনোই সমর্থন করে না। তার বাবার শিক্ষা তাকে এ ব্যাপারে সায় দেয় না। সারা জীবন সত্যের পথে থাকার শিক্ষাই তাকে তার বাবা দিয়ে গিয়েছেন।

কিন্তু এগুলো তো মিথ্যাচার! বাবা বলেন জীবনে কখনো মিথ্যাচার করা উচিত নয়!

একদম ঠিক বলেন, উনি বিদ্বান মানুষ, আমার শিক্ষক, ওনার সমালোচনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে পুঁথিগত শিক্ষা আর বাস্তবে তার প্রতিফলন দুটো এক হয় না কখনো। যেটাকে তুমি মিথ্যাচার বলছো সেটা আসলে সত্য গোপন। সংসারে শান্তি বজায় রাখতে গেলে কিছু সত্য গোপন রাখতে হয়। যেমন ধরো, আমি তোমাকে ছাড়া এক মাস থাকতে পারবো না এটা যেমন ঠিক, তেমনি শনিবারে বাড়ি গেলে বড়ো মা তাঁর কথা রাখা হয় নি বলে অসম্মানিত হতেন, এটাও ঠিক। তাহলে সবাইকেই ভালো রাখতে গেলে এটুকু সত্য গোপন তো করতেই হবে তাই না!

যদি ধরো এই পরিকল্পনা টুকু আমি না করতে পারতাম, তাহলে তোমার এতো দিনের পরীক্ষার প্রস্তুতি, সে তো বৃথাই যেতো তাই না! বাবার কথা মতো যদি তুমি সত্যি কথা বলতে, বড়ো মা বা বাবা কেউ তোমাকে পরীক্ষা দিতে আসতে দিতে রাজি হতেন না। যদি তোমার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতাম তাহলে ওনারা অপমানিত হতেন। এবার যদি তুমি জেদ দেখিয়ে চলেও আসতে, তাতে শুধু এইবারের মতোই পরীক্ষা দিতে পারতে, আর ভবিষ্যতে এগোতে পারতে না। বড়ো মা অন্ন জল ত্যাগ করতেন, বাবা তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করে দিতেন। সব কিছু হাতের বাইরে বেরিয়ে যেতো, তার থেকে এটাই কি ভালো হলো না! তুমি নিজেই ভাবো! কার্যসিদ্ধি করতে গেলে মাঝে মাঝে সত্য গোপন করতে হয়, স্ব্য়ং যুধিষ্ঠির করেছেন আর তুমি আমি তো সাধারণ মানুষ!

অবাক দৃষ্টিতে সৌম্যর দিকে তাকিয়ে রইলো মৃণালিনী। সংসার অনভিজ্ঞ মৃণাল তার সংসার অভিজ্ঞ স্বামীর শিক্ষায় ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠছিলো। সংসারের এই ভয়ঙ্কর রাজনীতির সঙ্গে যে তার বাবার দেওয়া পুঁথিগত শিক্ষার কোনো মিল নেই এটা ক্রমশই প্রকাশ্য হচ্ছিলো তার কাছে। এই সংসারের জটিল আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে নিজের স্বপ্ন পূরণ যে যথেষ্টই কঠিন সেটা বুঝতে পেরে সে দুঃখিত হয়ে পড়লো।

দুঃখ পেয়োনা মৃণাল, সমস্যা যেমন আছে তেমনি তার সমাধানও আছে!! শুধু সব কথা গায়ে মাখতে হয় না। সংসারে তো কতো কথা হয়, সব কিছু গায়ে না মেখেও চলা যায়। তোমার জীবনে এই মুহূর্তে তো একটাই লক্ষ্য, আরও পড়া। সেটা নিয়েই ভাবো, দেখবে অন্য কোনো দিকে মন দেওয়ার সময়ই পাবে না। বড়ো মা কে লুকিয়ে কি ভাবে পড়বে তার বিভিন্ন উপায় বার করতে করতেই তোমার সময় চলে যাবে,

মুচকি হেসে বললো সৌম্য, মৃণালিনীও হেসে ফেললো। সৌম্যকে যে ও কতোটা ভুল বুঝেছিলো, সেটা ভেবে নিজেই লজ্জিত হচ্ছিলো এই মুহূর্তে।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here