মৃণালিনী পর্ব-২২

0
778

#মৃণালিনী
#পর্ব ২২
গ্রাম ক্রমশ শহরের দিকে এগোচ্ছিল, ছেলেরা বাইরে থেকে শিক্ষিত হয়ে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের পরিবেশ বদলে যাচ্ছিলো। নতুন স্কুলের উদ্বোধনে সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের আগমন উপলক্ষ্যে গ্রামের মেঠো রাস্তায় পিচের আস্তরণ পড়লো। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবই এই সব উন্নতি কে পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো।

সকাল থেকেই সাজো সাজো রব পড়ে গেলো বাড়িতে, স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাবেন শ্যাম সুন্দর। আশে পাশের কয়েক ঘর মানী গুণী মানুষ রাও নিমন্ত্রিত এখানে, তবে শ্যাম সুন্দরের কদরই আলাদা কারণ জমি তিনি দিয়েছেন এবং স্কুলের নামকরণ তাঁর বাবার নামেই। গর্বিত শ্যাম সুন্দর আত্মপ্রচারের কোনো সুযোগ কখনই ছাড়েন না, তিনি বাড়ির সবাইকেই সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য হুকুম জারি করলেন। পারুল বালা এসব ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী কোনো দিনই ছিলেন না, কুমুদও তাঁরই সঙ্গ ধরলেন, তাই শেষ পর্যন্ত সরমা এবং মৃণালিনী তাঁর সহযাত্রী হলো।

ওখানে সপরিবারে শ্যাম সুন্দর উপস্থিত হতেই হৈ চৈ পড়ে গেলো, সুরেশ নিজে এগিয়ে এলো তাঁর অভ্যর্থনার জন্যে, সরকারি কর্তাব্যক্তিরা উঠে এসে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলেন। চারিদিকে উপস্থিত গ্রাম্য মহিলাদের মধ্যে আধুনিকা মৃণালিনী সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগলো, দু একজন কৌতূহলী সরকারি কর্তার কৌতুহল নিবারণের উদ্যেশ্যে সৌম্য তাঁদের নিজের স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। আলাপ আলোচনা চলছিলো, স্বাধীনতার এতো বছর পরেও গ্রামে নূন্যতম সুযোগ সুবিধার অভাব নিয়েই সৌম্য এবং সুরেশ সরব ছিল। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নতুন, তিনি যথেষ্টই উৎসাহ ভরেই সমস্ত শুনছিলেন, তাঁকে গ্রামবাসীদের চাহিদা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে হাসপাতাল, বিদ্যুতের সঙ্গে মেয়েদের স্কুলের প্রসঙ্গ উঠলো। মৃণালিনী এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো,

আমি এখানে একটা মেয়েদের স্কুল খুলতে চাই, আপনি সাহায্য করলে হতে পারে,

খুব ভালো প্রস্তাব! আপনাদের মতো মহিলারা এগিয়ে এলে তো এগুলো অনেক সহজ হয়ে যায়!

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এককথায় সম্মত হলেন, উনি নিজের সাধ্যমত সরকারি সাহায্যের চেষ্টা করবেন কথা দিলেন। সমস্যা ছিলো জমির, সে জমি বাবার কাছ থেকে জোগাড় করে দেবে বলে জানালো সৌম্য, এ ব্যাপারে সে মোটামুটি সিদ্ধহস্ত।

নির্দিষ্ট সময়ে সব সম্পন্ন হলো, গ্রামের অন্যদের সঙ্গে নিয়ে সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে বিদ্যুতের ব্যাপারেও আলোচনা করলেন শ্যাম সুন্দর, তাঁদের সকলের এগিয়ে আসায় শরিকী জমি নিয়ে হওয়া গন্ডগোল তাঁদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি করেছিলো তা কিছুটা হলেও কমলো।

তুমি একটু দাঁড়িয়ে যেও সৌম্য, কথা আছে,

বাবার সঙ্গে ফিরে আসতে গিয়েও সুরেশের কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো সৌম্য, সে একটু পরে আসছে জানিয়ে ওদেরকে চলে যেতে বললো। মাঠের কোণে একটা চেয়ার নিয়ে বসেছিলো সে, হাতের কাজ সেরে, কর্তা ব্যক্তিদের বিদায় করে সুরেশ ওর পাশেই চেয়ার নিয়ে বসলো।

তোমাকে একটা কথা জানানোর ছিলো ভাই, তুমি আমার যা উপকার করেছো এর পরে এটা না জানালে আমি শান্তি পাবো না। তোমাদের পুকুরের পাশে একটা জমি আছে জানোতো? যেটা নিয়ে কিছু গোলমাল চলছে?

ঘাড় হেলালো সৌম্য, সে কিছুদিন ধরেই শুনছে এই কথাটা,

সেখানে এই গন্ডগোলের সুযোগে দখল নিয়ে একটা ক্লাব তৈরির চেষ্টা চলছে, আর তার পেছনে মাথা হচ্ছে তোমাদের আলোক দা!

সৌম্য অবাক হয়ে গেলো, ক্লাব! এখানে স্কুল নেই, হাসপাতাল নেই, অথচ ক্লাব! তাও আবার আলোকদার উস্কানি তে! কিন্তু সুরেশের সামনে এ নিয়ে আর বেশি কিছু বলতে চাইলো না ও,

ঠিক আছে, আমি বাবার সঙ্গে কথা বলবো!

সুরেশ কে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি চলে এলো ও, মনের মধ্যেকার অশান্তি টা কিছুতেই গেলো না। এক্ষুনি কোনো প্রমাণ ছাড়াই এই কথাগুলো বাবা কে বলা উচিত হবে কিনা বুঝে উঠতে পারছিলো না। আলোকদা বড়ো মার ভাইপো, বড়ো মা এই কথাগুলো কে কিভাবে নেবেন সেটাও ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো।

পরের দিন ফিরে যাওয়া, রাতে শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিলো না সৌম্যর। কারণ বুঝতে না পারলেও স্বামীর অস্থিরতা নজরে আসছিলো মৃণালের,

কিছু হয়েছে তোমার? খুব অস্থির লাগছে তোমাকে!

আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললো মৃণালিনী,

সুরেশ বলছিলো আমাদের শরিকি জমিতে ক্লাব করার জন্য উস্কানি দিচ্ছেন আলোক দা!

সৌম্যর কথায় খুব বেশি অবাক হলো না মৃণাল, সেতো হিসাব মেলাতে গিয়ে আগেই আলোকের অসততা লক্ষ্য করেছিলো।

হতেই পারে! এরকম অনেক গোলমাল তিনি হিসাবেও করেছেন! তাই তো বাবা আমার হিসেব দেখা বন্ধ করতে চাননি।

বউয়ের শান্ত গলার কথায় অবাক হয়ে গেলো সৌম্য,

তুমি জানতে! বাবাও জানেন! তাহলে কিছু করছেন না কেনো!

করতে গেলে বড় প্রমাণ লাগে, সেরকম প্রমাণ কই! আর বাবা তো সব কিছু দেখে উঠতে পারেন না, তাই আমাকে ডাকেন! তবে ক্লাবের কথাটা তিনি জানেন না।

সৌম্য চিন্তিত হলো, বাবাকে ক্লাবের ব্যাপারে কিভাবে জানাবে মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো।

বাবা যদি জানতে পারেন আমি মেয়েদের স্কুল করতে চাই, তাহলে খুব সমস্যা হবে তাইনা?

একটু দ্বিধা জড়ানো গলায় বললো মৃণালিনী, সৌম্য মাথা নাড়লো,

সে তো হবেই! তবে সেসব এখন থেকে ভেবে লাভ নেই! আগে একটু এগোক তারপর না হয় দেখা যাবে ভেবে। এখন বরং বিমল আর সরমার ব্যাপারটা ভাবি একটু! বিমল কে কিভাবে জিজ্ঞেস করবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না,

হেসে বললো সৌম্য, মৃণালিনীর মজা লাগলো। সৌম্যর মতো বুদ্ধিমান ছেলের পক্ষে বিমল কে বোনের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটা যে এতটাই কঠিন কাজ সেটা তার মনে হচ্ছিলো না।

পরের দিন সকালে সৌম্য চলে যাওয়ার পরে তার কাজ ফুল তোলা সেরে এসে মৃণাল নিচে রান্না ঘরের দাওয়ায় বসেছিলো, এমন সময় গ্রামের এক মাত্র ঘটক শিব বাবু এসে ঢুকলেন। তাঁকে দেখেই পারুল বালা এগিয়ে এলেন, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েই যে ঘটক মশাইয়ের আগমন সেটা সবাই বুঝতে পারলো।

মৃণাল এই ভয়টাই পাচ্ছিলো, কবে বড়ো মা শিবু ঘটক কে ডেকে পাঠান, সেই চিন্তা তাকে কদিন ধরেই চিন্তিত করে রেখেছিলো। ননদ আর বৌদি তে দৃষ্টি বিনিময় হলো, মুখ শুকনো করে ওখান থেকে উঠে গেলো সরমা। সবে মাত্র সৌম্য কলকাতায় ফিরে গিয়েছে, সেদিন রাতেই সে সময় চেয়ে নিয়েছে মৃণালের কাছে, তাই এতো তাড়াতাড়ি যে কিছু হবার নয় সেটা মৃণাল বুঝতেই পারছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে বেশিদিন সময় তাদের হাতে আছে কিনা সে বিষয়ে মৃণালিনী যথেষ্টই চিন্তিত হয়ে পড়লো।

মেয়ে শিক্ষিত না হলে বড়ো সমস্যা হয়ে যাচ্ছে কর্তা মা, এই দেখুন না, আপনাদেরই জ্ঞাতি ওই অবনি বাবুর মেয়ে কে! কম সম্বন্ধ তো আনলাম না! হচ্ছে কই! সবাই আজকাল পড়া শুনা জানা মেয়েই চায়!

ঘটকের কথায় প্রায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন পারুল বালা, দেওর কে তিনি বড়ো মুখ করে বলেছেন কদিন আগেই, এখন যদি সেই শিক্ষাই আবার তাঁর পথের কাঁটা হয়ে ওঠে!

ওই বাড়ির বিভার সঙ্গে তুমি আমাদের মেয়ের তুলনা কর শিবু! দুটো এক হলো! আমাদের মেয়ে কত সুন্দর!

সুন্দর হলেই হয় না কর্তা মা, এই তো দেখুন না, আপনাদের ছেলেই কি আর অশিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করেছে! সব ছেলেই আজকাল এমন ধারা! আমি কি করি বলুন তো!

অসহায় গলায় বলে উঠলেন শিবু ঘটক, যিনি নিজেই আজকাল এখানকার মেয়েদের পাত্র খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন। মৃণালিনী মনে মনে যথেষ্টই পুলকিত হচ্ছিলো, সরমার অশিক্ষিত হওয়াকে তার এই মুহূর্তে শাপে বর বলেই মনে হচ্ছিলো। একে পাত্রের সন্ধান না পাওয়া, তার সঙ্গে সৌম্যর শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করার প্রসঙ্গ টেনে আনা, দুই মিলিয়ে পারুল বালা কে আরো ক্রুদ্ধ করে তুললো,

তা তুমি কি একানে মুক দেকাতে এয়েচো বাছা! খবর না নিয়ে আর আমার দোরে পা দিও না কোনোদিন!

শিবু ঘটক খুব ভালো করেই চেনেন পারুল বালা কে, তাই কোনো তর্কে না গিয়ে এরপরের বার সৎ পাত্রের খবর নিয়েই তবে আসবেন কথা দিয়ে আপাতত পালিয়ে বাঁচলেন। এই খবরে আর কেউ খুশি না হলেও সরমার মুখের উজ্জ্বলতা নজর এড়ালো না মৃণালিনীর, বেচারা কদিন থেকেই বড্ড মন মরা হয়ে আছে।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here