মৃণালিনী পর্ব -৩৬

0
629

#মৃণালিনী
#পর্ব ৩৬
অবনী কাকার বাড়ি থেকে কাজ উদ্ধার করেই ফিরলো সৌম্য, তার মুখের খুশি সে বউয়ের কাছে গোপন করতে পারছিলো না আর। ঘরে ঢুকেই সে উত্তেজিত গলায় বললো,

আর কোনো চিন্তা রইলো না বুঝলে, এবার একসঙ্গে আমাদের দুটো সমস্যারই সমাধান হবে।

কিন্তু মৃণাল যথেষ্টই বুদ্ধিমতি, বিগত প্রায় বছর খানেকের অভিজ্ঞতায় সে কিছুটা হলেও গ্রাম্য রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলো। তাই সব কিছু যে অতো সহজে সমাধান হয়ে যাবে এরকম আশা তার ছিলো না। সে আস্তে আস্তে বললো,

কিন্তু সে তো একজন সম্মতি দিলেন! এখনও প্রায় জনা চারেক শরিক তো বাকি থেকে গেলো! তার মধ্যে আমার বিভাস আর বাবা নিয়েই বেশি সন্দেহ আছে! বাবা নিজেও কি আদৌ এতে রাজি হবেন!

কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো সৌম্য, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

চলো তাহলে, বাবার সঙ্গে কথাটা অন্তত সেরে আসি, শুভ কাজে দেরি কিসের!

স্বামীর পিছু পিছু শ্বশুর মশাইয়ের ঘরের দরজায় উপস্থিত হলো মৃণালিনী, ওদের কে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখেই, শ্যাম সুন্দর বিরক্ত মুখে তাকালেন।

আবার কি চাই?

আজ ছেলে এবং বউমা দুজনের ওপরেই তিনি সমান বিরক্ত হয়ে আছেন।

ওই শরিকি জমিটার ব্যাপারে একটু কথা বলতে এসেছিলাম বাবা, আমি অবনী কাকার বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম একটু আগে…

অবনী ও জমির ব্যাপারে কি করতে চায় আমি জানিনা, কিন্তু যে যাই বলুক ওখানে ক্লাব হতে আমি দেবো না কিছুতেই,

ছেলে কে থামিয়ে দিয়ে বিরক্ত গলায় বলে উঠলেন শ্যাম সুন্দর।

অবনী কাকাও সেটা চান না, আমি তাঁকে অন্য প্রস্তাব দিয়েছি। ওখানে একটা মেয়েদের স্কুল করার কথা ভাবা যেতে পারে, মৃণাল পড়াবে, আর আমার মনে হয় মহিলা শিক্ষিকা থাকলে কারোরই নিজেদের বাড়ির মেয়েদের পাঠাতে আপত্তি থাকবে না।

বউমা পড়াবে! তার যদি কাউকে পড়ানোর হয়, তো সে বাড়িতে বসে পড়াক না। এই তো অবনীর মেয়েও তো পড়তে আসে তার কাছে, আমি তো কোনোদিনও বারণ করিনি তাকে! তাই বলে তাকে রাস্তায় বসে মেয়ে পড়াতে হবে!

বিরক্ত গলায় বলে উঠলেন শ্যাম সুন্দর, মৃণালিনী হতাশ দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালো।

প্রশ্ন টা পড়ানোর বাবা, সেটা কোথায় বসে পড়াচ্ছে সেটা মুখ্য নয়! আর শুধু তো পড়ানো নয়, জমিটা উদ্ধার করার একটা ব্যাপারও আছে, একমাত্র এই কারণেই সবাই নিজেদের স্বার্থেই জমি দিতে রাজি হতে পারেন! আর অন্য কোনো কারণে এ গ্রামের সব শরিক একমত হয়েছে কখনো?

থামো তুমি! তুমি কি ভাবো আমি কিছু বুঝিনা! এই করেই তুমি আমার কাছ থেকে অতোটা জমি ছেলেদের স্কুলের জন্যে হাতিয়ে নিয়েছো! একই জিনিষ তুমি আবার করতে চাইছো! জমি দখলে রাখার নামে তুমি এখন বউয়ের জন্যে মেয়েদের স্কুল তৈরি করে নিতে চাইছো!

ছেলেকে ধমকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন শ্যাম সুন্দর। সৌম্য ভ্রু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন, তারপর শান্ত গলায় বললো,

আমি আপনাকে কখনো মিথ্যে বলতে চাইনি বাবা, সেটা আপনিও জানেন! কিন্তু আপনি নিজেই আমাকে মিথ্যে বলতে বাধ্য করেছেন সব সময়! এই যে দেখুন, আজ আপনাকে সত্যি বলেছি বলেই তো আপনি একটা সাধারণ ব্যাপার কে অসাধারণ করে তুলছেন। মৃণাল শিক্ষিতা, তার শিক্ষা কে আপনিও আপনার প্রয়োজনে ব্যবহার করে এসেছেন এতো দিন, কিন্তু আজ আপনাকে জমি ছাড়তে হবে বলে আপনি ওকে পড়াতে দিতে রাজি হচ্ছেন না! আর স্কুলের জমির কথা বলছেন? তাতে কি আপনারও স্বার্থ ছিলো না? আপনিও তো বিদ্যুতের হিসেব কষেছিলেন মনে মনে! আজ বিদ্যুৎ আসেনি বলেই তো জমির জন্যে আফসোস করছেন! যদি এসে যেতো, তাহলে তো বাকি জমি গুলো দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতে পারতেন, এই হিসেব কি আপনার ছিলো না!

এবার একটু হলেও থমকে গেলেন শ্যাম সুন্দর, নিচে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে কুমুদ ততোক্ষনে ওপরে উঠে এসেছেন। স্বামীর রাগ দেখতে অভ্যস্ত হলেও ছেলে কে রেগে যেতে কখনো দেখেন নি কুমুদ, তাই সৌম্যর গলার আওয়াজ তাঁর মনের মধ্যে যথেষ্টই ভয়ের সঞ্চার করলো। তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেখেই প্রায় চিৎকার করে উঠলেন শ্যাম সুন্দর,

দেখো, তোমার ছেলের কলকাতায় থেকে কি উন্নতি হয়েছে! সে আমার জমি নিয়ে দান খয়রাত করতে চায়! নিজের এক কাঠা জমি বাড়ানোর কোনো ক্ষমতা নেই, দান করতে তিনি সিদ্ধ হস্ত! কালই তোমার বউমা বলছিলো না! আমি দায়িত্ব ছাড়তে চাইনি তোমার ছেলের কাছে? এই তো হবে দায়িত্ব ছাড়লে! শুধু আমার চোখ বোজার অপেক্ষা! ঝুলি হাতে তোমাদের রাস্তায় বেরোতে হবে ভিক্ষা করতে!

জমি তো তোমার কম নেই কো! আর এ জমি তে ক কাঠাই বা আচে তোমার? বেশিটাই তো অবনী ঠাকুরপোর! তিনি যদি দিতে চান তালে তোমার দিতে কি হয় শুনি?

ক কাঠা মানে! আমার ভাগ অল্প বলে কি সে জমি তে আমার দাবি নেই?

সে কতা যদি বলো, তবে আজ পর্যন্ত কি দাবি দেকাতে তুমি পারলে বলো তো! সেই কবে তে ওই জমি নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া তো কম হচ্ছে নে! এক কাটাও কি ঘিরতে পেরেছো এতো দিনে? যে ছেলের কাচে কিচু ছাড়তে চাইছো নে, সেই তো তাও কিচু করলো! সারা জেবোন টা শুদু প্যাঁচ কষে কষে কাটিয়ে দিলে, কারুর কতা ভাবলে নে ককনো!

বিরক্ত গলায় বললেন কুমুদ, স্ত্রী এবং ছেলের যৌথ আক্রমণের মুখে প্রতিরোধ করার কোনো উপযুক্ত ভাষা না পেয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলেন শ্যাম সুন্দর।

যা করতে চেয়েছিলাম সবটাই আপনার, আমার এমনকি গ্রামের সবারই ভালোর কথা ভেবেই! কিন্তু আপনি তো তাতেও আমার অভিসন্ধিই খুঁজে পেলেন। তাই অহেতুক আপনার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই! লাভ ক্ষতির হিসেব আপনি আমার থেকে একটু হলেও বেশি বোঝেন সেটা আমি জানি, তাই মৃণালের জন্যে না হলেও নিজের স্বার্থেই যে আপনি ওই জমি ক্লাবের কাছে যাওয়া থেকে বাঁচাতে এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত মেনেই নেবেন এটা জানা কথা। আপনার বিচার বুদ্ধি কিছু কম নেই, একবার এখানে ক্লাবের নামে জমি দখল হওয়া যদি শুরু হয় তাহলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন অজুহাতে অনেক জমিই যে আপনার দখল হয়ে যাবে সেটা আপনি মুখে না স্বীকার না করলেও মনে মনেই জানেন নিশ্চয়ই। আর বিভাস এর সাথে হাত মিলিয়ে যদি এ জমিতে স্কুল হওয়া আপনি আটকাতে চান তাহলে যে আপনি খাল কেটে কুমির নিয়ে আসবেন সেটাও আপনার অজানা নয়। তাই কাল আলোচনা সভায় আপনি অমত করবেন না এটুকু আমি আশা রাখি।

চুপ কর বাবা, এই রাতে আর হৈ চৈ করিস নে, এ বাড়ির হাঁড়ির খবর জানার জন্যে সব হ্যাঁ করে বসে আচে। বাপের সঙ্গে ছেলের গন্ডগোলের খবর বাইরে গেলে সে কি কিচু ভালো হবে বাবা?

ছেলে কে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন কুমুদ, মৃণালিনী এতক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো, এবার মাথা নাড়লো,

মা ঠিকই বলেছেন, রাত অনেক হয়েছে, এসব এখন থাক! তুমি তোমার বক্তব্য রেখেছো, এবার বাবা কে ভাবতে দাও! উনি যথেষ্টই বিচক্ষণ, জমি নিজেদের হাতে রাখার অন্য কোনো পন্থা জানা থাকলে এতো দিনে তার প্রয়োগ করতেন নিশ্চয়ই। রাতের মধ্যে যদি নতুন কিছু ভেবে বার করতে পারেন তাহলে কাল সকালে সেটা তুমি জেনে নিও। না হলে অবনী কাকা তো তোমাকে কথা দিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই, বাবারও অমত করার কোনো জায়গা থাকবে না আর।

কথাগুলো বলেই মৃণালিনী শ্বশুর মশাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, সে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুমুদ এবং সৌম্য দুজনেই তার পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শ্যাম সুন্দর গম্ভীর মুখে বসে রইলেন, ক্লাবের হাতে যাওয়া জমি বাঁচাতে ইস্কুলের হাতে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায়ের সন্ধান করতে লাগলেন মনে মনে।

দোতলার বারান্দায় বেরিয়েই নিচে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ানো পারুল বালা কে দেখতে পেলো মৃণালিনী, তিনি উদ্বিগ্ন মুখে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওদের কে এক সঙ্গে শ্যাম সুন্দরের ঘর থেকে বেরোতে দেখে তাঁর মুখে বিরক্তির রেখা ফুটলো,

আজ রেতে কি সবাই উপোস দেবে নাকি! এই রাত দুপুরে পাড়া জাগিয়ে কোন্দল না করলেই কি তোমাদের চলচে নে বাছা! বাড়ির ঠাকুর চাকর রা কি সারারাত তোমাদের জন্যে বসে থাকবে? খেয়ে দেয়ে কোন্দল করলে হতো নে? নিচে নেমে খেয়ে তাদের উদ্ধার কর দিকি!

বড়ো জার গলা আরও চড়া হবার আগেই কুমুদ দ্রুত নিচের সিঁড়িতে পা দিলেন, মৃণালও তাঁর সঙ্গী হলো। সৌম্য মুখ গম্ভীর করে বললো,

আমি খাবো না বড় মা, আমার খিদে নেই!

তা থাকবে কেনো বাছা! কম কোন্দল তো করলে নে সেই তে বাপের সঙ্গে! পেট তো তাতেই ভরেচে তোমার! খাবার ঢোকার আর জায়গা কোতা! আমারই হয়েচে যত জ্বালা! তা দয়া করে নিচে নাববে? নাকি আমায় আবার এই বুড়ো হাঁটু নে ওপরে তোলা করাবে!

এরপরে আর কোনো কথা থাকে না, বড়ো মা এই বয়সে হাঁটুর ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে, খাবারের থালা হাতে দোতলায় উঠে আসবেন এটা সৌম্যর কাছে কখনোই কাম্য ছিলো না, তাই বিরস বদনে সে আস্তে আস্তে নিচে নেমে এসে করুণার পেতে রাখা আসনে বসলো। একটু পরেই শ্যাম সুন্দরও নেমে এলেন, পাশাপাশি আসনে খেতে বসলেও পিতা পুত্রের বাক্যালাপ আজ বন্ধ রইলো।

বামুন দিদি খাবার দিতে শুরু করলেন, পারুল বালা এবং কুমুদ তদারকি করতে লাগলেন, মৃণাল দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ করুণা কে খুঁজছিলো, কিন্তু সে সেই যে আসন পেতে, জলের গেলাস রেখে চলে গিয়েছিলো আর খাবার দালানে এলো না। স্বামী এবং শ্বশুর খাওয়া শেষ করে চলে যাবার পরে মৃণাল বড়ো মা এবং শাশুড়ির সঙ্গে খেতে বসলো। আজ তর্কাতর্কি তে সত্যি সত্যিই রাত অনেকটাই বেশি হয়ে গিয়েছিলো, তাই পারুল বালা সবাই কেই একসঙ্গে বসে যেতে হুকুম দিলেন।

হারু কে দালানের এক পাশে খেতে দিয়ে বামুন দিদি তাঁর, করুণার আর হারুর মার থালা মৃণালিনীর পাশে রাখলেন কিন্তু তাও করুণা এলো না। বার দুয়েক ডাকাডাকির পরেও করুণা না আসায় এবারে পারুল বালা গলা তুললেন, তাঁর গলার জোর এই অসুস্থ শরীরেও যথেষ্টই ছিলো, করুণা থমথমে মুখে হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত হলো। তাকে দেখেই বিরক্ত হলেন পারুল বালা,

এই মাজ রেতে এতো তোমার কি কাজ মা গো! ডাকলে সাড়া পাইনে কেনো? কোতা থাকো!

একেণের সব কইরেই গেছি বড়ো মা, ঘরখান এট্টু গুইচে রাকছিলুম!

তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো করুণা, পারুল বালা সন্তুষ্ট হলেন।

তা ভালো! মাজে মাজে এট্টু পোস্কার করলে ঘর দেকতেও ভালো লাগে! নাও বাছা বসে পড় দিকি নি, রাত তো কম হয় নে কো! লণ্ঠনের তেল আর পুড়িয়ে কাজ নেই, তেলের যা দাম!

করুণা বসে পড়লো, সৌম্য এবং শ্যাম সুন্দর দুজনেই ওপরে উঠে যাওয়ায় পরিবেশ অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছিলো। মহিলা মহলে নানা রকম মুখরোচক আলোচনা চলতে লাগলো, হারুর মার ভূমিকাই তাতে সবচেয়ে বেশি ছিলো, এ গ্রামের গোপন খবর তার কাছেই বেশি থাকে সব সময়। একমাত্র মৃণালিনী চিন্তিত হলো, এই রাত দুপুরে লণ্ঠনের আলোয় করুণার ঘর গোছানোর কি দরকার পড়লো মনে মনে ভাবতে ভাবতেই অন্য মনস্ক হয়ে পড়লো সে, এসব আলোচনা আর তাকে স্পর্শ করছিলো না।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here