মৃণালিনী পর্ব -৩৯

0
700

#মৃণালিনী
#পর্ব ৩৯
সকাল হতে না হতেই হৈ চৈ পড়ে গেলো, আলোক কে চণ্ডী পন্ডপে ধরে আনা হয়েছে। খবর পেয়েই শ্যাম সুন্দর হন্তদন্ত হয়েই বেরোচ্ছিলেন, অসুস্থ শরীরেই পারুল বালা বেরিয়ে এলেন,

দেকো ঠাকুর পো, করুণার নাম যেনো সামনে না আসে, আই বুড়ো মে, বে দিতে পারবো নে কিন্তু!

মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলেন শ্যাম সুন্দর, পেছন পেছন সৌম্য। বিচার পর্ব সমাধা হলো দ্রুতই, কারণ বিচার করার মতো খুব বেশি কিছুই ছিলো না। না সে করুণা কে সঙ্গে নিয়ে যেতে পেরেছিলো, না তার সঙ্গে থাকা পুঁটলির টাকা, গয়না, কাগজ তার হস্তগত হয়েছিলো। বিচার শেষ হবার পরে তাকে বাইরের বৈঠকখানা ঘরে এনে বসানো হলো, পারুল বালা তাকে বাড়িতে ঢুকতে দিলেন না,

খবরদার! ওই নোংরা ছেলে যেনো আমার বাড়ির চৌকাঠ না পেরোয়! ওর বাপ মা কে খপর দাও, তারাও এসে দেকুক তাদের গুণধর ছেলে কে!!

চৌধুরী বাড়ির বৈঠকখানায় ততোক্ষনে গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছিলো, গৃহকর্ত্রী পারুল বালা তাঁর ভাইপোর কি শাস্তির ব্যবস্থা করেন তা দেখার জন্যে সকলেই উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।কিন্তু পারুল বালা অন্য ধাতের মানুষ, ব্যাক্তিগত ব্যাপার জনসমক্ষে প্রকাশ করার বান্দা তিনি নন। ভিড় লক্ষ্য করেই কৌতুহলী গ্রামবাসীদের দিকে ঘুরলেন তিনি,

এবার সব এসো দিকি বাছা! এখানে কোনো পালা হচ্ছে নে! এসব আমাদের নিজেদের সমিস্যে, তোমাদের এ কতায় থাকার মতো কিচু নেই কো!

মুহূর্তের মধ্যে খালি হয়ে গেলো বৈঠকখানা, এখনও তাঁর গলায় সে দাপট ফিরে আসে মাঝে মাঝে! আস্তে আস্তে বাড়ির সবাই জড়ো হয়েছিলো, মৃণালিনীও কৌতূহলী দৃষ্টিতে আলোকের মুখের দিকে তাকিয়েছিলো। এখানে আলোক কে নিয়ে আসার কারণ আসলে একটাই, গত রাত থেকেই বামুন দিদি পারুল বালার পায়ে পড়ে গিয়েছেন, আলোকের সঙ্গে তাঁর ভাইঝির বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। করুণা জানিয়েছে আলোক তাকে বিয়ে করবে কথা দিয়েছিলো, সেই জন্যেই সে পালিয়ে যাচ্ছিলো বাড়ি থেকে।

হারু ম্রিয়মাণ মুখে সদর দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তার বিষণ্ণ মুখ মৃণালিনীর নজর এড়িয়ে যাচ্ছিলো না। করুণার গতরাতের ঘটনার পর থেকেই সে একটাও কথা বলে নি। হারুর মাও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েছিলো, তার মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে ছিলো। এই গ্রামের যে কোনো মুখরোচক খবর তার নখদর্পণে থাকে, এই প্রথম বার এতো উত্তেজনাপূর্ন একটা খবর সে নিজের ছেলের জড়িত থাকার কারণেই খুব বেশি উপভোগ করে উঠতে পারছিলো না।

বউ বাইরের দরজাটা একটু বন্ধ করে দাও তো,

নিচু গলায় বললো মৃণালিনী, হারুর মা এই সুযোগ আর নষ্ট করলো না। দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে সে মৃণালের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো,

বউমা! আমার হারু রে এট্টু দেকো মা! ছেলেটা আমার বড্ড বোকা, কতোবার কয়েছি, এসব কতায় থাকিস নি! তা সে শুনলে তো! আজ কি বেপদে পড়লুম বলো দিকি!

মৃণাল মৃদু হাসলো,

হারুর কিচ্ছু হবে না বউ, ও সব কিছু আমাকে জানিয়েই করেছে, তুমি অতো চিন্তা কোরো না।

হারুর মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। শ্যাম সুন্দর পারুল বালার দিকে ফিরে নিচু গলায় বললেন,

নাও বৌদি কি বলার আছে তোমার তাড়াতাড়ি বলো। আমি সুরেশ কে সদরে পাঠিয়েছি, ওকে পুলিশে দেবো।

মৃণাল চমকে উঠলো, সৌম্যও অবাক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো,

পুলিশে দেবে! কোন অপরাধে? তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে বাবা? আলোক দার কাছে তো কিছুই পাওয়া যায় নি।

শ্যাম সুন্দর ঘাড় নাড়লেন,

কে বললো নেই? বউমার করা হিসেবের খাতা, আর ওর গরমিল করা হিসেব, সব আমি গুছিয়ে রেখেছি। আজকের কথা নাকি সেসব! ওকে জেলের ঘানি টানিয়েই ছাড়বো, উকিল শ্যাম সুন্দর কে ও চেনে না।

আলোক মাথা নিচু করে বসেছিলো, এসব কথা তার কান পর্যন্ত যাচ্ছিলো কিনা বোঝা মুশকিল। দেওরের কথা শুনে এবার ভাই পোর সামনে এগিয়ে এলেন পারুল বালা,

দেকো বাছা, ওসব থানা, পুলিশ আমি করতে চাই নে কো, হাজার হোক তুমি আমার বংশের ছেলে! তুমি যাকে বে করতে চেয়েছিলে তাকে নে এ বাড়ি তে দূর হয়ে যাও! তোমার বাপ মা কে আমি খপর দে ডেকিচি, তারা এলে ওই মায়ের মন্দিরে দাঁড়িয়ে আমি তোমাদের বে টুকু দে নিছিন্ত হবো! আর কোনোদিন এমুকো হয়ো নি কো।

আলোক মাথা নাড়লো, সে যে যথেষ্টই ধুরন্ধর সেটা এই মুহূর্তে স্পষ্ট হচ্ছিলো, সে আসলে করুণা কে ব্যবহার করেছে মাত্র। করুণার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া জমির কাগজ পত্র, টাকা আর পারুল বালার গয়নাই তার আসল লক্ষ্য ছিলো, সেগুলো পেয়ে গেলেই যে সে করুণা কে ছুঁড়ে ফেলে দিতো সেটা তার আচরণ থেকে বোঝা যাচ্ছিলো।

আমি ভদ্রলোকের ছেলে, কাজের মেয়ে কে বিয়ে করবো! ও বললেই হবে! আমি কখনো ওকে বিয়ের কথা বলিনি!

মৃণাল চমকে উঠলো, আলোক যে এতো নিচে নামতে পারে সেটা তার ধারণাও ছিলো না। ওখানে উপস্থিত সবাই অবাক দৃষ্টিতে আলোকের দিকে তাকালো। দরজার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা করুণা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পারুল বালা নিজেও থমকে গেলেন। বামুন দিদি দরজার পাশে ভাই ঝি কে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আলোকের এই কথার পরে আর নিজেকে সংযত রাখতে না পেরেই প্রায় তেড়ে এলেন,

কি কইলে তুমি? আমরা কাজের নোক! তা এতদিন এ কতাখান কি ভুইলে মেরেছিলে নাকি? কত্তা মা এর একখান বিচের কইরে দিতে হবেই কিন্তু,

শেষের কথাগুলো তাঁর পারুল বালার উদ্যেশ্যে ছিলো, পারুল বালা কোনো উত্তর না দিয়েই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজের ভাই পোর এই অধঃপতন তিনি সম্ভবত কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

কুমুদ এতক্ষন একধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবার আলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর স্বভাবমতই আলোকের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে নিচু গলায় বললেন,

বাবা, মেয়েটা কে উদ্ধার করো! তুমি ওকে ফিরিয়ে দিলে ওর সম্মান যাবে বাবা! আর কেউ যে ওকে বে করবে না বাবা!

শাশুড়ির কথায় ক্ষিপ্ত হচ্ছিলো মৃণালিনী, এই বাজে মানসিকতার লোকটির কাছে তাঁর এই আবেদন অসহ্য লাগছিলো তার। আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে সে সবে মাত্র শাশুড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে দয়া ভিক্ষা করতে বারণ করতেই যাচ্ছিলো, পেছন থেকে আসা বড়ো মার কণ্ঠস্বর তাকে থামিয়ে দিলো।

ভদ্দর নোক! চোর আবার ভদ্দর নোক! বোকা মে টা কে দে সব কাজ করিয়ে তাকে গেরামের নোক এর সামনে ছোটো করে চলে যেতে চায় যে, তার আবার বড়ো বড়ো কতা! কাকে বলিস কাজের মে! তুই ও তো আমার ঘরেই পড়ে ছিলি এতদিন! ও মেও তাই! তাইলে তোর সঙ্গে ওর আর তফাৎ কি!

পিসিমা! তুমি আমাকে ওর সঙ্গে তুলনা করলে!

আলোকের গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ছিলো।

চোপ! কে তোর পিসিমা! তুই আমার ঘরের কাজের নোক। ঠাকুর পো র জমি দেকার জন্যে তোকে এনিচি। তোর বাপ তোকে খেতে পড়তে দিতে পারছিলো নে, তাই আমার পায়ে পড়েছিলো। নাইলে আমার আবার কিসের বাপের বাড়ি, আর কিসের ভাইপো! কোনো দিন টাকা ছাড়া আমার ভাইরা বুজেচে কিচু! যদ্দিন টাকা তদ্দিন বোন, আমি কিচু বুজি না ভাবিস! কে আর এই পারুল বালা কে দরকার ছাড়া মনে করেচে কখনো!

তাঁর বলা কথাগুলো যে শুধুই ভাইপো আলোকের উদ্যেশেই নয়, সেটা উপস্থিত সবাই বুঝতে পারলো, বিশেষ করে শ্যাম সুন্দর। বৌদি কে তো তিনিও সারা জীবন ব্যবহার করে এসেছেন নিজের স্বার্থেই। দাদার সম্পত্তি নিজের দখলে রাখার জন্যেই যে তাঁর বৌদি কে গিন্নি সাজিয়ে রাখা, সেটা যে আসলে পারুল বালা বুঝতেন এবং জেনেও না বোঝার ভানই করে এসেছেন সারা জীবন, আজ তাঁর কথায় সেটা স্পষ্ট হচ্ছিলো, মাথা নিচু করে নিলেন শ্যাম সুন্দর।

এবার কুমুদের দিকে ঘুরলেন পারুল বালা,

আর কতো কাল নোকের পায়ে পড়ে থাকবি! তোর বউ তো তোকে কম সেকায় নে এতো দিন ধরে! তবে! আমার কিচু ছিলো নে, তাও তো শুধু এই মুকের জোরেই টিকে রয়েচি! নিজের কতা টুকু নিজেই বলবি তো! তা না, শুধুই নাকি কান্না! ঝাঁটা মেরে বিদেয় কর আবাগীর বেটা কে! ও ছাড়া কি দুনিয়ায় আর পাত্তর নেই!

অবাক হয়ে এই অশিক্ষিতা গ্রাম্য মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইলো মৃণালিনী, সে বড়ো মা কে যত দেখছিলো ততই আশ্চর্য্য হচ্ছিলো। তাঁর কড়া কড়া কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই অচেনা পারুল বালা ক্রমশই তাকে মুগ্ধ করছিলো। যে কড়া কথাগুলো একদিন তাকেও কম কষ্ট দেয়নি, সেগুলো যে আসলে নিজেকেই সংসারে দামী করে রাখার একটা প্রয়াস মাত্র, সেটা এতদিনে উপলব্ধি হচ্ছিলো তার। বড়ো মার জন্যে এক অজানা কষ্টে তার মনের মধ্যে ভাঙচুর হতে লাগলো।
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here