#মৃণালিনী
#পর্ব ৪১
আলোক তার বাবা মায়ের সঙ্গে বিদায় নেবার পরে বাড়িতে একটা শোরগোল পড়ে গেলো। বামুন দিদি নিরামিষ হেঁসেলের বারান্দায় পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলেন, এই মেয়ে কে নিজের দায়িত্বে এখানে নিয়ে এসে তিনি যে কতোবড় ভুল করেছেন, সে সবই কপাল চাপড়ে বলতে লাগলেন।
কি কতা! কি কতা! গরীবের মে, তার আবার পছন্দ! দয়া করে তারা তোরে বউ করে নে যাচ্ছিলো, তা সে তার সজ্জ্ব হলো নি গো! তারে নে মাতায় করি রাকতি হবে! কি কুক্কোণে তারে এ বাড়িতে নে এয়েছিলুম কে জানে! নিজের সব্বনাশ তো করলই, সাতে আমার ভালো মানুষ দাদাটারেও পতে বৈসে গেলো গো!
হারুর মা কখনই এসব দৃশ্যে অনুপস্থিত থাকে না, সে তার সাধ্যমতো বামুন দিদি কে সহানুভূতি জানাতে লাগলো।
ওই জন্যি বলে পরের মে আর নিজের মে! আজ যদি তোমার নিজের হতো, তাইলে কি আর তোমার কতা ভাবতো নি এট্টু! তা না, কিরম দেমাগ ধরি বৈসে রইলো দেকো!
কুমুদ একধারে চুপ করে বসেছিলেন। বড়ো জা এবং বউমা দুজনেই তাঁর অত্যধিক কুটুম প্রীতি তে মনে মনে বিরক্ত হয়েছেন বুঝেই, এই মুহূর্তে নীরব শ্রোতার ভূমিকা পালন করছিলেন। তাঁকে নীরব দেখেই বামুন দিদির কান্না আরও বাড়ছিলো। ক্রমশ তার বিলাপ এতটাই বাড়লো যে শ্যাম সুন্দর নিজের ঘর ছেড়ে দোতলার বারান্দায় বেরিয়ে এলেন।
আজ কি সকালের জল খাবার কিছু পাবো না! বাড়িতে এই সবই চলবে! ওই মেয়ে কে আর বাড়িতে রেখো না, ওকে নিজের বাড়ি পাঠানোর বন্দোবস্ত করো।
তাঁর ক্রুদ্ধ গলা কানে আসা মাত্রই বামুন দিদির বিলাপ বন্ধ হলো, তিনি তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে জলখাবারের জোগাড় করতে লাগলেন। নিজের ঘর গোছাতে গোছাতে বারান্দা থেকে আসা শ্বশুর মশাইয়ের গলা কানে আসছিলো মৃণালিনীর, সে তাড়াতাড়ি হাত চালালো। বামুন দিদির মনের অবস্থা খারাপ, তাঁর পক্ষে একা সব কিছু সামলানো এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।
সে যখন নিচে এলো, ততোক্ষনে বামুন দিদি তরকারি কড়ায় বসিয়ে দিয়েছেন। কুমুদ মাথা নিচু করে কুটনো কাটছেন, হারুর মা বাসনের ঝুড়ি কাঁখে পুকুরের দিকে রওনা দিয়েছে। আপাত শান্তি বিরাজ করছিলো সর্বত্র, কিন্তু এ শান্তি যে ক্ষণস্থায়ী তা উপস্থিত প্রত্যেকের মুখের থমথমে ভাবে প্রকাশ পাচ্ছিলো। তাকে হেঁসেলের বারান্দায় তরকারির ঝুড়ি টেনে বসতে দেখে কুমুদ আস্তে আস্তে কানে কানে বললেন,
কি করি মা? তোমার শ্বশুরমশাই যে করুণা কে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে কইচেন!
যতই আস্তে বলা কথা হোক না কেনো, পাশেই বসে কড়ায় খুন্তি নাড়তে থাকা বামুন দিদির কান পর্যন্ত সহজেই তা পৌঁছে গেলো, তিনি উদ্বিগ্ন মুখে মৃণালের দিকে তাকালেন। ভাই ঝির এই বিপদের মুহূর্তে তাঁর ভরসার জায়গা শ্যাম সুন্দরই, তিনি তাকে বাড়ি চলে যেতে বলায় তাঁর মুখ আরো শুকিয়ে গিয়েছিলো।
বউ মা! একবার সৌম্যর সঙ্গে কতা কও! তারে এট্টু বাপ রে বুঝিয়ে কইতে কও। সোমত্ত মে! বাড়ি পাটিয়ে দেলে তারে গলায় দড়ি কলসি দিতে হবে!
নিচু গলায় বউ মার কানের কাছে মুখ এনে বললেন কুমুদ, মৃণাল মাথা হেলালো।
বলবো মা, চিন্তা করবেন না আপনি! ও বাবার সাময়িক রাগের কথা! তিনি নিজেও এরকম কিছুই চান না!
বামুন দিদি কপালে হাত ঠেকালেন,
দেকো ঠাকুর! তাই যেনো হয়!
করুণা কে কিছু খেতে দিয়েছো দিদি? ও তো কাল থেকেই কিছু খায়নি!
বামুন দিদি মাথা নাড়লেন,
না মা! সে কাল তে কিচুই মুকে তোলে নি কো! জেদ কি তার কম! এই কৈরেই তো সব্বনাশ খান করলো!
মৃণাল আর কোনো কথা না বলেই থালায় করুণার জন্যে খানিকটা খাবার নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। করুণা একবারের জন্যে বেরিয়ে এসে, তারপর সেই যে পিসির ঘরে ঢুকেছিলো, আর বাইরে বেরোয়নি। তার খুব আশা ছিলো আলোক এ বাড়ির দেওয়া প্রস্তাব ফেরাবে না। বেশ কিছুদিন ধরেই তার সঙ্গে আলোকের এই প্রণয় পর্ব চলছিলো, গরীব অশিক্ষিতা তরুণী টিকে সে বিয়ের লোভ দেখিয়ে তার সমস্ত অপকর্মের সঙ্গী করেছিলো।
গতকাল তার সবার সামনে তাকে কাজের মেয়ে বলে করা সম্বোধন, করুণা কে বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে আসলে আলোকের দৃষ্টিতে তার অবস্থান কোথায়! সেই থেকেই তার মুখে এক টুকরো খাবারও কেউ তুলতে পারে নি। মৃণাল খাবারের থালা নিয়ে তার ঘরে ঢুকে এলো,এতক্ষনে বউ দিদি কে খাবারের থালা হাতে তার ঘরে ঢুকে আসতে দেখে সে মুখ তুলে তাকালো।
উঠে বোস! না খেয়ে পড়ে থাকলেই তোর সব সমস্যার সমাধান হবে না, বড়ো মা কি বলেন মনে নেই! ভাতের ওপর রাগ দেখাতে নেই!
কড়া গলায় বললো মৃণালিনী, করুণা আস্তে আস্তে উঠে বসলো।
বউ দিদি! আমার কি হবে! মরা ছাড়া আর কোনো পথ নেই!
সে ভাবনা আমাদেরকেই ভাবতে দে, তুই নিজের কাজ কর।
বড়ো বাবু আমারে বাড়ি পাইঠে দিতে কোয়েচেন! আমি কোতা কে যাবো বউ দিদি!
কোথাও যাবি না, এখানেই থাকবি!
বউ দিদির কথাগুলো কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত করছিলো করুণা কে, হাতে থালা তুলে নিলো সে।
আমাকে এ গেরামের লোক টিকতে দেবে নে বউ দিদি, আমি পাপ করে ফেলেছি!
কিসের পাপ? কাউকে ভালোবাসা পাপ না! তোর ভুল একটাই, তুই ভুল লোক কে ভালোবেসেছিস। আর একটু আগেই এই যে এতগুলো কথা আলোক দা কে বলে এলি! এখনকার তোর সঙ্গে একটু আগের দেখা তোকে আমি মেলাতে পারছি না। আমি সব সময় তোকে ওই রকম দেখতে চাই! গ্রামের লোকের সাধ্য কি তোকে কিছু বলে? বড়ো মা আছেন না!
মৃদু হাসলো মৃণালিনী, করুণা ধীরে ধীরে সহজ হচ্ছিলো।
তুই কলকাতায় থাকবি? তোকে দাদার সঙ্গে আমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দেবো না হয়, সেখানে এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না,
বউ দিদির কথা করুণার সাহস বাড়াচ্ছিল, আলোক তাকে ফেলে গেলেও এখনও যে অনেক পথ খোলাই আছে সেটা বুঝেই শান্তি পাচ্ছিলো সে। মৃণাল ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আগেই করুণা পিছু ডাকলো,
বউ দিদি! আমি অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলিছি গো! বড়ো মা আমারে মে ভাবেন! আমি তেনার গয়নায় হাত দিইচি! আমারে ঠাকুর মাপ করবে নি!
মৃণাল ঘুরে তাকালো,
নিজের অপরাধ যখন বুঝেছিস, তখন আর এ বিষয়ে কথা বলিস না!! আশা করছি এই ভুল তুই আর কোনোদিনও ভবিষ্যতে করবি না।
করুণা মাথা নিচু করে বসে রইলো, তার চোখে অনুশোচনা ফুটে উঠছিলো। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরে নিজের ঘরে উঠে এলো মৃণালিনী। সৌম্য শুয়ে ছিলো, গত কাল রাত থেকে কারোরই ভালো করে ঘুম হয়নি, তাই আজ মৃণালিনীও শুয়ে পড়লো।
আলোক দা যে এতটা নিচু মানসিকতার মানুষ তা আগে বুঝিনি জানো!
সৌম্যর কথায় বিরক্তি ফুটে উঠছিলো, ঘাড় নাড়লো মৃণাল,
মেয়েটার কি হবে কিছু ঠিক করলে? ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিলে কেমন হতো?
বউয়ের কথায় একটু চিন্তা করলো সৌম্য,
সে পাঠানোই যায়, দেখি তাহলে কলকাতায় ফিরে স্যারের সঙ্গে কথা বলে, ওনার মত আছে কিনা সেটা জানতে হবে তো। এবার গিয়ে কথা বলে এসে পরের সপ্তাহে জানাবো তোমায়।
মৃণাল খুশি হলো, বাবার অমত যে হবে না সেটা জানেই সে, তার বাবা কে সে খুব ভালো করে চেনে। স্বামীর সঙ্গে বলা কথোপকথন কিছুটা হলেও তাকে স্বস্তি দিলো, করুণার ভবিষ্যত নিয়ে সে চিন্তায় পড়ে ছিলো। এখানকার লোকেদের সে খুব ভালো করে চেনে, গ্রাম্য রাজনীতির কাছে পৃথিবীর বড় বড় রাজনীতিবিদ হার মেনে যাবেন।
তবে আজ কিন্তু করুণা কে একদম অন্য রকম লাগলো! ও যে আলোক দা কে ফিরিয়ে দিতে পারে তা আমার একটুও মনে হয় নি,
গলায় উচ্ছাস এনে বললো মৃণাল, সৌম্য মাথা নাড়লো।
নাহ! ও যথেষ্টই বুদ্ধিমতি মৃণাল, নিজের ভালো ও বোঝে! আলোক দা কে বিয়ে করা মানে যে নিজের পায়েই কুড়ুল মারা, সেটা কি ও বোঝেনি বলে তোমার মনে হয়? ও ও কিন্তু নিজের স্বার্থই দেখেছে!
না গো, ওর চোখে আমি অনুশোচনা দেখেছি! বড়ো মার গয়নার কথা ও নিজে মুখেই বললো আজ! আমার মনে হয় ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।
বুঝতে পারলেই তো ভালো! আমরা তো ওর ভালোই চেয়ে এসেছি সব সময়। তাও ও আলোক দাকেই বিশ্বাস করেছে!
একটু ক্ষোভের গলায় বললো সৌম্য, মৃণাল মাথা নাড়লো,
এই আঘাত টা ওর দরকার ছিলো! আলোক দা ওকে আমাদের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলছিলো এতদিন। এবার ও বুঝতে পারবে আসলে আমরাই ওর প্রকৃত হিতাকাঙ্খী!
কথায় কথায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো প্রায়, মৃণালিনী যখন তুলসী তলায় প্রদীপ দেখিয়ে ফিরলো, হারুর মা ততোক্ষনে ঘরে ঘরে লন্ঠন পৌঁছে দিয়েছে। বড়ো মার ঘর যেনো বেশ অন্ধকার! একটু উদ্বিগ্ন হয়েই দরজায় দাঁড়ালো মৃণাল, পারুল বালা গলা তুললেন,
ওকানে কে?
আমি বড়ো মা, লন্ঠন কমানো কেনো? শরীর খারাপ নাকি!
ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলো মৃণালিনী। পারুল বালা মাথা নাড়লেন,
না বাছা! শরীল ঠিক আচে, মনটা বড়ো কু ডাকচে! সোমত্ত মে! যার তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতি তো পারি নে! গেরামের মানুষ জন কে তো কম দিন দেকলুম নে, চৌধুরী বাড়ির সব্বনাশ করার চেষ্টায় তাদের দিন যায়! এ সুযোগ কি আর তারা ছাড়বে! কি যে আপদ ঢুকিয়ে ছিলুম, একন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি!
কিছু একটা হবে ঠিক বড়ো মা! আপনি চিন্তা করবেন না। আমি তো ভেবেছিলাম ওকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেবো, বাবার কাছে থাকবে।
তাড়াতাড়ি হাত তুললেন পারুল বালা,
না, না! ওসব একদম কোরো নে কো! বেয়াই মশাই একা মানুষ! তাঁরে ওসব ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলো নে! সোমত্ত মে, কেউ চোকের আড়াল করে!
মৃণাল একটু থতমত খেলো। বড়ো মার কথায় যুক্তি আছে, আবেগের বশবর্তী হয়ে কিছু করা যে ঠিক হবে না সেটা এই মুহূর্তে বুঝতে পারছিলো।
ওরে বে দে দেবো! আর রাকবো নে ঘরে! অন্য কোতাও পাঠানোর দরকার নেই কো!
মৃণাল ঘাড় নাড়লো,
ঠিক আছে বড়ো মা, আপনি যা ভালো মনে করবেন তাই করুন তাহলে।
তুমি হারুর মা রে দে শিবুরে একখান খপর করো দিকি! সে ব্যাটা কিচু কাজে আসে নাকি দেকি এট্টু! হারুর মা রে ডেকে নে এসো বরং!
মৃণাল ডাকার আগেই হারুর মা এসে উপস্থিত হলো, সে সম্ভবত দরজার বাইরে লুকিয়ে দুজনের কথোপকথন শুনছিল। এসব গোপন কথায় তার ভারি উৎসাহ। ঘরে ঢুকেই উৎসাহের গলায় বললো,
এই তো মা! তোমার ঘরের সামনে দে যাচ্ছিলুম, তা তোমার মুকে নিজের নামখান শুনি আর দেরি করলুম নি! একুনি শিবু ঘটক রে ডেইকে নে আসি?
পারুল বালা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, মৃণাল হেসে ফেললো।
এই রাতে নয় বউ, কাল সকালে ডেকে এনো,
হাসি চাপতে চাপতে বললো মৃণালিনী, হারুর মা লজ্জায় পড়লো,
না, সে আর আমার কি! লোকের দুটো উবগার হয় আর কি! বামুন দিদি তো কেঁদে ভাইসে দিচ্ছে একদম, তাই বলা!
আর বেশিক্ষন দাঁড়ালো না হারুর মা, কত্তা মায়ের বিরক্তি ভরা মুখ তার মনের মধ্যে যথেষ্টই ভয়ের সঞ্চার করছিলো। সে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই মৃণাল বড়ো মার দিকে তাকালো, ততোক্ষনে পারুল বালার মুখ নরম হয়ে এসেছিলো। পরস্পরের দৃষ্টি বিনিময় হলো, ফোকলা মুখে হেসে ফেললেন তিনি, মৃণাল নিজেও আর হাসি চাপতে পারছিলো না।
ক্রমশ