গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক পর্ব-৩

0
1987

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-3)
লেখনীতে—ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

মেহজার কাছে অনুষ্ঠানটা হুট করেই ভালো লেগে গেল। খুব ভালো লাগছে। সব কিছুতে রঙিনতা পাচ্ছে। আনন্দটা এমন যে সে এই খুশিতে নিজেকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে ফেলতেও পারবে। অদ্ভুত না! হ্যাঁ অদ্ভুত। ভালোবাসার মানুষটি পাশে থাকলে আমাদের মধ্যে এই অদ্ভুত কান্ড গুলো সবচেয়ে পরিলক্ষিত। ইশ! প্রেমে পড়লে এমন সব অনুভূতির সাথে পরিচিত হতে হয়। আচ্ছা এটা তো প্রেম নয়! ভালোবাসাও নয়। ভালোলাগা, ভালোলাগার মধ্যে কি এতটা প্রশান্তি আছে! কোথায়! আরও কত মানুষকেও তো ভালো লেগেছে। এমন ভালো লাগা তো আর কারো উপর জন্মায়নি।

ইরফান ইয়াজিদ! কেমন আছেন আপনি?

“ভালো। আপনি?”

“এইতো। দিন কাল কেমন চলছে।”

“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালোই।”

“বিরক্ত হচ্ছেন বুঝি!”

“কিছুটা।”
ইরফানের কছে আসা নিহা নামক মেয়েটি ইরফানের এমন ব্যবহারে অপমানিত বোধ করলো। সে আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। ইরফানকে সব মেয়েরাই চায়। এমন সুন্দর সুদর্শন পুরুষকে তো সব নারীই চাইবে বিয়ে করতে। কিন্তু সবার ভাগ্যে তো আর এমন পুরুষ থাকেনা! বর কনে ছাড়াও এখন আরেকটি মূল আকর্ষণ ইরফান ইয়াজিদ। মেহজার কিছুটা কষ্ট হচ্ছে তবে সেটা প্রকাশ করতে চাইছেনা। প্রকাশ করেই বা কি হবে! ইরফান কি তার কষ্ট মূল্যায়ন করবে! আসলেই বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেয়াটা বোকামি।
রেশমির সাথে দেখা করে মেহজা খেতে বসে। টেবিলে রাদিফ, রাফসান, সিনান, নিজাম, রেশমির ছোট বোন রুম্পা, আর মেহজার ছোট খালামণির মেয়ে ঈশিতা বসেছে। আরো দুটি চেয়ার খালি থাকে তখন সেখানে একটিতে নিজামের প্রেমিকা শ্রাবণী বসে আরেকটি খালি থাকে। ইরফানকে দেখে রাদিফ উঠে যায়। ইরফানের সাথে কুশল বিনিময় করে তাকে ওদের সাথেই খেতে বসতে বলে। ইরফানও আর না করেনা। সে ভেবেছিল চলে যাবে কিন্তু না খেয়ে গেলে তার বন্ধু রাগ করবে। তাড়াতাড়ি খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে গেলে সে সোজা বাড়িতে যাবে তারপর সেখান থেকে আরেকটি পোগ্রামে। শান্তি নেই।

ইরফানকে আসতে দেখে মেহজা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ইরফানের সামনে সে কীভাবে খাবে! ইরফানকে দেখেই সিনান বলে উঠে

“আরে মি. ইরফান ইয়াজিদ যে! ধন্যবাদ আমাদের সাথে জয়েন করার জন্য।”

বদৌলতে ইরফান একটি মনমুগ্ধকর হাসি উপহার দেয়। তা দেখেই ঈশিতা শেষ। বিয়ের অনুষ্ঠানে এই একটি লোককেই তার এত ভালো লেগেছে। কথা বলার ধরণ, হাটার ধরণ, হাসি, তাঁকানো সবটাই যেন আলাদা। ছাব্বিশ বছর বয়সি ঈশিতার এই প্রথম কোনো পুরুষকে এতটা ভালো লাগলো। ইরফান টেবিলে বসেই সবাইকে হাই বলে। পরিচিত হয় সকলের সাথে। ঈশিতার সাথে যখন কথা বলতে যায় তখন চিকন একটা কন্ঠে ঈশিতা বলে উঠে

“আমি ঈশিতা হাসনাত। একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্টার্নি করছি।”

“ডক্টর!”

“বলা চলে।”

“নাইস টু মিট ইউ মিস. হাসনাত।”

“সেম টু ইউ মি. ইরফান ইয়াজিদ।”

সিনান মাঝপথে ফোঁড়ন কেটে বলে

“মি. ইরফান ইয়াজিদ! আপনি প্রথম সাক্ষাতেই তাকে মিস বলে সম্মোধন করলেন। আপনার তাকে মিসেস মনে হলো না কেন?”

“কারণ তার চেহারায় কিছু একটা আছে যার মাধ্যমে বুঝলাম।”

রাফসান বলে উঠে

“আর মেহজা আপুকে কি মনে হয় ইয়াজিদ ভাই!”

এই প্রশ্নে ইরফান কিছুটা বিব্রত বোধ করে। মেহজাও কিছুটা নুইয়ে যায়। তবুও সে চাইছে উত্তরটা। উপস্থিত সবাই কিছুটা অবাক হয় রাদিফ রাফসানকে চোখ রাঙানি দিলে রাফসান একদম চুপ হয়ে যায়। ইরফান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে

“মেয়ে। তবে অন্যরকম।”

সিনান কিছুটা ব্যাঙ্গ করে বলে

“আরে মেয়ে আবার কেমন রকম! তাছাড়া ও কি ছেলে নাকি! অদ্ভুত উত্তর মি.

“হয় ইরফান বলুন নয় ইয়াজিদ।”

“ঐ একটা বললেই হয়।”

“আপনি দুটোই বলছেন।”

সকলেই হেসে উঠে। আর মেহজা ইরফানের দিকে তাঁকিয়ে থাকে। কি সুন্দর করে প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছে ইরফান। কেউ ধরতেই পারেনি। ঈশিতা বলে

“মি. ইয়াজিদ! আর ইউ সিঙ্গেল?”

“100%”

সকলে আরেকবার হেসে উঠে শুধু মেহজা বাদে। আজ তার সবচেয়ে প্রিয় ঈশিতা আপুকে খুব খারাপ লাগছে। আজ তার উপর খুব রাগ হচ্ছে। কারণ একটাই! জনাব ইরফান ইয়াজিদ। লোকটি ঈশিতার সাথে খুব বেশিই হেসে কথা বলছে। আর তার সাথে সবসময় গম্ভীর কন্ঠে বা ধমকের সুরে কথা বলবে। মেহজা এতক্ষণ খেতে লজ্জা পাচ্ছিল এখন লজ্জা ভুলে সে কেমন গাপুস গুপুস করে সব খাবার খাচ্ছে। একপ্রকার খাবার নিয়ে যুদ্ধ করছে। বিষয়টা সকলেরই চোখে পড়ে ভালোভাবে। মেহজা হঠাৎ এমন করে খাচ্ছে কেন? ইশ! খুব ক্ষিদে পেয়েছিল বোধ হয় বেচারির। সকলে ছোট বাচ্চা বাচ্চা করছে। আবারও বাচ্চা বাচ্চা শুনে মেহজার রাগ আরো বেড়ে যায়। হুট করেই সে অনুভব করে তার পায়ের সাথে কারো পা লাগছে। মেহজা আশেপাশে দেখে নেয়। তার সামনে বরাবর ইয়াজিদ তার পাশেই সিনান আর মেহজার ডান পাশে ঈশিতা বাম পাশে রুম্পা। পরপর তিনবার কেউ তার পায়ের সাথে পা লাগায়। এবার তো ব্যাপারটা ফেলে দেওয়ার মতো নয় সে ইচ্ছে করেই হাতের পার্সটা ফেলে নিচু হয়ে নেওয়ার ভান করে যা দেখতে পায় তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ইরফান তার পা মেহজার পায়ের সাথে লাগাচ্ছে। কিন্তু কেন? মেহজা হুট করেই হেসে দিল। ইরফান কি তাকে পছন্দ করে!

টেবিলে বসা ইরফান হয়তো কখনোই জানবেনা ঈশিতার পায়ের সাথে পা লাগানোর অত্যাচার থেকে বাঁচতে সে বারবার তার পা সামনে নিয়ে মেহজার পায়ের সাথেই লাগিয়েছে। আর তাতে মেহজার ছোট্ট মনে আরো কিছু সুপ্ত অনুভূতির জন্ম হয়েছে।
খাবার মাঝখানে হুট করেই মেহজা আর ইরফানের চোখাচোখি হলে মেহজা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। আর ইরফান নির্বিঘ্নে চেয়ে রয়।

———————-

বৈশাখ মাসের প্রথম দিন আজ। মানে পহেলা বৈশাখ! চারিদিকেই সাজ সাজ রব। ইরফানের আজ কাজের চাপ বেশি। দীর্ঘ ছয় মাস পর তার মা-বাবা, বড় বোন ও তার বাচ্চারা দেশে আসছে। ইরফানের বড় বোন ইরা আমেরিকা থাকে। তার ছোট সন্তান মৃদুল হওয়ার সময় তার বাবা মা তার সাথেই ছিল কারণ সেখানে সে ও তার স্বামী ছাড়া আর কেউ নেই যে ইরাকে সাপোর্ট করবে! সবাই আসছে সেই উপলক্ষে তার বাকি দুই বোন ইমা ও ইকরা এসেছে।

মেহজা দুপুরের দিকেই সব রকম মজা মাস্তি করে বাসায় ফিরছিল। তখনই একজন মহিলার সাথে ধাক্কা খায়। মেহজা আন্তরিক ভাবে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চায়। মহিলাটি মেহজার এমন অমায়িক ব্যবহারে খুবই খুশি হয়। মুহূর্তেই তার মেহজাকে মনে ধরে। ছেলের জন্য এমন একটি মেয়েই তো চাইছিলেন তিনি। কিন্তু, পরক্ষণেই মন খারাপ হয়ে যায় যখন শুনে সে সবেমাত্র এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছে। তার ছেলের থেকে তো মেয়ের বয়স খুব কম। তবে মেয়েটি লম্বা ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। থাক! বয়স কম হলে হোক। তার ছেলেও তো আহামরি বুড়ো না। মেহজা মহিলাটির সাথে কথা বলে বিস্মিত হয়। ইনি ইরফানের মা। মহিলাটির সাথে তার আগে দেখা হয়নি হবে কি করে! তারা এখানে এসেছে মাত্র চারমাস আর ইরফানের মা ছয় মাস আগে থেকেই আমেরিকা ছিলেন। সেই সুবাদে আগে পরিচিয়ও হয়নি। কথায় কথায় তিনি মেহজাকে রাতে তাদের সাথে খাওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানায়। একপ্রকার অনুরোধই করে। মেহজা ভদ্রমহিলার অনুরোধ ফেলতে পারেনা তাই রাজি হয়ে যায়।

লাল আর সাদার সংমিশ্রণে জর্জেটের থ্রি পিসটা পড়ে নিজেকে আয়নায় ভালো করে একবার দেখে নেয়। হুট করেই শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ইরফানের কথা ভাবলেই এমন লাগে। কি একটা বিশ্রী ব্যাপার।

ডাইনিং এ খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ইরফানরা কেউই খেতে বসছেনা কারণ একটাই! তার একজন বিশেষ অতিথি আসবে। কলিংবেল বাজতেই ইরফান উঠে বলে

“আমি দেখছি।”

দরজা খুলেই সে হতবাক! মেহজা? মেহজা এখন এই সময়ে এখানেই বা কেন? আবার কোনো ঝামেলা করতে আসেনি তো। রেগে কিন্তু ঠান্ডা কন্ঠে মেহজাকে উদ্দেশ্য করে বলে

“কি চাই!”

মেহজা এমন প্রশ্নে লজ্জিত হয়। কিছু বলতেও লজ্জা লাগছে। “আপনার মা আমাকে খেতে ডেকেছে তাই খেতে এসেছি” এটা বলবে! উহু এটা বলা তো যাবেইনা। তো কি বলবে! তখনি মেহজাকে এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে ইরফানের মা মাহিমা বেগম বলে

“কি চাই মানে! ও ই তো আমার বিশেষ অতিথি। তুমি ভিতরে আসো মেহজা মামনি। এই অপদার্থ আতিথেয়তা করতে জানেনা একদমই।”

মেহজার সামনে তার মা তাকে এভাবে অপমান করবে তা কল্পনাতেও সে ভাবতে পারেনি। এখন মেহজা যদি তাকে নিয়ে হাসে! মনের কথা মনেই থেকে গেল মেহজা সত্যিই হেসে দিল তাও খুব জোরে।

ইরফান রাগ করে উপরে চলে যায়। মেহজা ভালো করে তাদের পুরো বাসা দেখছে। তাদের বাসা নরমাল ফ্ল্যাট গুলোর মতোই কিন্তু ইরফানদেরটা ডুপ্লেক্স। তার মানে ঊনিশ ও বিশ দুই ফ্লোর জুরেই তাদের বাসা। ওহ হ্যাঁ! শুধু ঊনিশ বিশই নয় একুশ-বাইশ, তেইশ-চব্বিশ এই তিনটিই ডুপ্লেক্স। এমনটাই তো তার বাবার থেকে শুনেছে।

#চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here