গোধূলী আকাশ লাজুক লাজুক পর্ব-২৮

0
3339

#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-২৮)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

একটি বট গাছের নিচে ইরফান মেহজাকে নিয়ে এসেছে। সে ভেবেছিল হয়তো কত শত আয়োজন করে রেখেছে ইরফান। কিন্তু ইরফান তো ইরফানই! সে আগেও তার অনুভূতির দাম দিত না এখনো দেয়না। মেহজা মন খারাপ করে বট গাছের নিচে বসে পড়ে। ইরফানও গাড়ি থেকে তখন একটি কেক নিয়ে আসে যার মধ্যে তার আর মেহজার রাদিফের বিয়ের দিন তোলা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অসাধারণ ছবি। হুট করেই মেহজা যেন সব অভিমান ভুলে গেল একটি কেকই যেন তাকে আনন্দিত করল। তবে ইরফান কিন্তু আদৌও এত ছোট পরিকল্পনা করেনি প্রেয়সীর জন্য। জোরে একটি শিষ বাজাতেই গাছটা আলোকিত হয়ে পড়ে। হরেক রকম রঙিন আলোয় গাছটি উজ্জ্বল করে উঠে। চারিদিকে আতশবাজি ফুটতে থাকে আকাশের বুকে হওয়া স্কাইশট গুলোতে স্পষ্ট লিখা থেকে হ্যাপি এনিভার্সেরী। মেহজার চোখে জল চিকচিক করে, প্রিয় মানুষটি যে তার কল্পনার ঊর্ধ্বে যেতে পারে তা সে ভাবতেই পারেনি। ইরফানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে। ইরফানও পরম ভালোবাসা মিশিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মেহজার কাছে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে এই সেই ইরফান যাকে পাওয়ার জন্য এক সময় সে অনেক পাগলামী করেছিল। আজ সেই ইরফানকে সে পেয়েও গেছে এত আনন্দ সে কোথায় রাখবে এখন? কারো নজর লেগে যাবেনা তো! মেহজা হু হু করে কেঁদে ওঠে। ইরফান তাকে কাঁদতে বাধা দিল না, কাঁদুক না একটু! সুখের সাথে একটু দুঃখ মেশানো অনুভূতি না থাকলে কী হয়?

ইরফানের বাহুডোরে আবদ্ধ মেহজা ইরফানকে আজ মুখে বলেই দিয়েছে ” ভালোবাসি মি. ইয়াজিদ!” পাষণ্ড ইরফান বদৌলতে একটুও ভালোবাসি বলল না তাকে। তাতে অবশ্য মেহজার দুঃখ নেই। আজকাল সে ইরফানের ভালোবাসার গভীরতা উপলদ্ধি করতে পারে। ইরফানের বিরুদ্ধের তার অভিযোগটাও সীমাবদ্ধ বলা চলে। ইরফানকে হুট করেই মেহজা অনুনয়ের সুরে বলে,

“আমার এইচ এস সি পরীক্ষার পর অনুষ্ঠানটা করলে কী খুব সমস্যা হবে?”

“একদমই না।”

“আপনি সত্যি বলছেন।”

“তুমি চাইলে অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করেই না হয় অফিসিয়ালি আমার ঘরে যেও।”

“না না! এইচ এস সি হলেই হবে। আমার ধৈর্যসীমা খুব কম।”

“তাই?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু আমার তো আছে।”

“আপনি একটা বাজে লোক।”

“তোমারই তো!”

“হ্যাঁ! আপনি শুধুই আমার।”

মুখ উঁচিয়ে কথাটি বলল মেহজা। দেখতে পেল ইরফনের চোখে মুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে আছে। আলতো হেসে চোখ বুজে সে।

————————-

সিনান আর অনার আকদ করিয়ে ফেলেছে সবাই। অনার শত বারণ করার পরও তারা কিছু শুনেনি। বর্তমানে অনার রুমে অনার বিছানায় সিনান বসে আছে। অনা তার থেকে এক হাত দূরুত্বে বসে আছে। সিনান নীরবতা ভেঙে বলে,

“কিছু বলবেনা অনা?”

“কি বলব? আর কিছু বলার বাকি আছে আমার! আর এখন কিছু বলেও কি কোনো লাভের লাভ হবে?”

“হবে আবার হবে না।”

“পেচিয়ে কথা বলা মানুষ আমর একদম পছন্দ না।”

“তোমার তো আমিটাকেই পছন্দ না অনা।”

“জানেন যখন বিয়ে করলেন কেন?”

“ভালো লাগে তাই।”

“যা দরকার ছিল তা তো পেয়েই গিয়েছিলেন। কোন ভয়ে এখন আমাকে বিয়ে করছেন? ওহ পুলিশে দিব তাই?”

“উহু! কোনো পুলিশেই আমাকে কিছু করতে পারবেনা। কারণ আমি কোনো অন্যায় করিনি।”

অনা এবার রেগে গিয়ে সিনানের কলার চেপে ধরে বলে,

“সেই রাতে আপনি যা করেছেন তা অন্যায় ছিল না? ঘৃণিত অন্যায় ছিল সেটা, চরম পাপ ছিল সেটা।”

“সেই রাতে কিছুই হয়নি অনা।”

সিনানের আলতো হেসে বলা কথাটি অনার হৃদয়ে শীতলতা এনে দিল যেন। সিনানের কথা তার বিশ্বাস হচ্ছে কেন তা সে নিজেও জানেনা। তবুও নিজের দাম্ভীকতা বজায় রেখে বলে,

“আপনি মিথ্যে বলছেন।”

“একদম নয়। চাইলে এক্ষুণি প্রমাণ দিতে পারি! দিব?”

“কীসের প্রমাণ?”

“দুটো অপশন আছে। একটা হচ্ছে ছোট খাটো একটি রেকর্ডার আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটি শারীরিক…….

“আপনি নোংরা লোক!”

“নোংরা হই বা যাই হয়ে থাকিনা কেন সত্য একটাই তুমি কুমারী আছো।”

এই কথাটি বলেই সিনান তার রুম থেকে প্রস্থান করে। অনা শুধু চেয়ে থাকে অবাক চোখে। তার মন মস্তিষ্ক দুটোই বলছে সিনানকে ভরসা করতে। যদি কিছু হয়েও থাকে তাহলে তো সে নিজেও বুঝতে পারত একটু হলেও। সিনানের গমনের পরই অনার মা এসে তাকে বলল,

“সিনান এমন রেগে বের হলো কেন অনা? কিছু হয়েছে?”

“না।”

“সত্যি বলছিস তো?”

“হ্যাঁ।”

“সিনান কি তোকে বলেছে আজ রাতে মিশনের উদ্দেশ্যে তাকে মিশর যেতে হবে।”

“মিশন? তাও আবার মিশরে!”

“হ্যাঁ তো, তোকে বলেনি কিছু?”

“না বলেনি আমাকে।”

“দুই বছরের জন্য যাচ্ছে শুনলাম।”

“তাই নাকি! ভালোই তো।”

“আরে ভালো না ছাই! শুনেছি এসবে বিপদ থাকে অনেক। কত মানুষ মরেছে। আমার তো ভয় করছেরে।”

“তুমি এখন যাও আমি একটু ঘুমাতে চাই।”

“এই অবেলায় ঘুমাবি কেন? শরীর খারাপ!”

“না, মন!”

অনার মা আসিয়া বেগম বের হয়ে এলেন রুম থেকে। অনার হুট করেই সিনানের জন্য মায়া জন্মালো। কে জানতো এই মায়া গভীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাবে একদিন!”

————————————————–

“আমাদের বিয়ের তিন বছর পর হুট করেই আমার পেটে ইজহাম চলে আসে। ওর বাবা তো সেই খুশি হয়েছিল কিন্তু মুহূর্তেই আমার ক্যারিয়ারের কথা ভেবে সে চুপসে যায়। তার এত খুশির বলিদান সেদিন আমি দিতে পারিনি। মা হওয়ার মত আনন্দের বিষয়টি আমি সাদরে গ্রহণ করেছি। প্রথম বর্ষের শেষের দিকে ইজহাম হয়। আমার সত্যি বলতে একটুও কষ্ট করতে হয়নি। তার বাবা,ফুফুরা, দাদা-দাদু,নানা-নানু, মামা-মামি সবাই তাকে মহা আনন্দে লালন পালন করেছে। দেখতে দেখতে আমার অনার্স কমপ্লিট হয়ে গেল। পাড়ি জমালাম সূদুর আমেরিকায়। ইয়াজিদের বিজনেসের কাজটা এখানেও থাকাতে তাকে বছরের ছয়মাস আমেরিকা আর ছয়মাস বাংলাদেশ দৌঁড়াতে হতো। যা খুব কষ্টের ছিল। ততদিনে আমারও মাস্টার্সের জন্য আমেরিকার নাম করা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া হয়ে যায়।
এক বছর হলো আমেরিকায় এসেছি। সবাইকে খুব মিস করি। ইরা আপুর সাথে সপ্তাহে একবার দেখা হয়। একদিন হলিডেতে সেও ক্যালিফোর্নিয়ার এই বাড়িটিতে আসে আমাদের সাথে দেখা করতে।
ইয়াজিদ লোকটি আমাকে খুব ভালোবাসে। যদিও যে আজ অব্দি মুখ ফুটে ভালোবাসি বলেনি। অবাক হওয়ার হলেও এটা সত্যি। তবে তার প্রতিটি কাজে প্রমাণ পায় আমাকে আর বাবুকে খুব ভালোবাসে তিনি। আজ আমি খুব খুশি। কারণ আজ আমার আর তার দ্বিতীয় সন্তানের এই পৃথিবীতে আসার সুসংবাদটি আমি জানতে পেরেছি। আর দেখ! লোকটি তা সম্পর্কে মোটেও অবগত না। বাহিরে ছেলের সাথে স্নো ফল নিয়ে খেলায় মত্ত সে। আচ্ছা! দ্বিতীয় জনের আসার খবরে সে কি খুব খুশি হবে? যেমনটি হয়েছিল ইজহামের বেলাতে!”

——- ডায়েরীতে এতটুকু লিখেই হাত থামালো মেহজা। আনন্দে তার শরীর কাঁপছে। পেটে হাত বুলিয়ে ডায়েরীটা লক করে দেয়। আজ সুপার শপে পাসওয়ার্ড সিস্টেম এই সুন্দর ডায়েরীটি দেখে লোভ সামলাতে পারেনা। ফটাফট কিনে নেয়। আজ থেকে সে সব কিছুই এই ডায়েরীতে বন্ধি করে রাখবে বলে মনঃস্থির করেছে।

চেয়ার ছেড়ে বড় জানালাটির পাশে দাঁড়ায়। ছোট্ট টি টেবিলটা থেকে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা কেটলি থেকে ঢেলে নেয়। এক চুমুক দেওয়ার পরই হঠাৎ তার নজরে যায় কেটলির পাশে একটি কাগজ। চায়ের কাপটা শব্দ করে রেখে কাগজটি খুলে বিস্মিত হয় সে, যাতে লেখা আছে,

“ধন্যবাদ প্রিয়তমা! সবকিছুর জন্যই ধন্যবাদ। আমার পরবর্তী সন্তানকে নিজ গর্ভে ধারণ করার জন্য আরো ধন্যবাদ। একদম বিচলিত বা অবাক হবেন না যে আমি জানলাম কীভাবে! আপনি কি এটা জানেন না যে আমি সবদিকেই খেয়াল রাখি! এই মাসের পিরিয়ডটা যে মিস গিয়েছে তা আমি জানি। ডক্টর স্টেইফির কাছ থেকে আজ প্রেগন্যান্সী রিপোর্ট এনেছেন তাও জানি। ধারণা সঠিক! ডক্টর স্টেইফি আপনাকে রিপোর্ট দেওয়ার আগেই আমাকে ইনফর্ম করেছে বেগমজান। সরি টু সে! আপনার সারপ্রাইজটা ভেস্তে গেল। আর শুনুন

“ভালোবাসি খুব”
আমি ভালোবাসি কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারিনা। কারণ আমার গোধূলী আকাশটা লাজুক লাজুক!
আমার আর ইজহামের পক্ষ থেকে লিটল ওয়ানকে অনেক ভালোবাসা।”

মেহজার ঠোঁট প্রশস্ত হয়। এই প্রথম লোকটি ভালোবাসি বলেছে মুখে নয় ঠিকই লিখে তো বলেছে! মেহজা চট করেই সামনে তাঁকায়। তাঁকিয়ে দেখে ইরফান তার দিকেই তাঁকিয়ে আছে মুখে লেগে আছে সেই মুঁচকি হাসি। হঠাৎ তার নজরে গেল পাশে থাকা স্নোম্যানটার দিকে। যার গায়ে মেহজার ওড়না পেচিয়ে রাখা হয়েছে। কপট রাগ দেখিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ইজহাম চেঁচিয়ে বলে,

“মাম্মা!”

এই একটি ডাক আর প্রিয়তমর মুঁচকি হাসি দুটোই তার রাগ বিলীন করে নিমিষেই! মেহজা আকাশের দিকে তাঁকায় সবকিছুর জন্যই মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করে সে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here