#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৬
আপু দ্রুত আভার হাত হতে ফোনটি নিয়ে নিলো। ফোনের স্ক্রিনের দিকে কিয়ৎক্ষণ প্রশ্নাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। অতঃপর নিজের আতঙ্কিত মুখখানা আড়ালে নেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে আপু জোরপূর্বক হেসে বললো,
” মাঝে মাঝেই এসব আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে। ফোন রিসিভ করলেই বিপদ। এটাও ওমন বোধহয়।”
এই বলেই আপু চট করে কল কেটে দিলো। আপুর এ প্রতিক্রিয়া দেখে আমার সন্দেহ কিঞ্চিৎ গাঢ় হলো। তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি একান্তে কিছু সময় নিয়ে আপুকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবো।
কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই আপুর ফোনে পুনরায় সেই নাম্বার হতে কল এলো। এবার আপুকে বললাম,
” রিসিভ করে দেখো, কে কল করেছে। লাউড স্পিকারে দিয়ে রেখো। আননোন নাম্বার থেকে কল করে কিছু বললে আমরা চারজন তো আছিই। তুমি রিসিভ করো। ”
আমার কথায় আপু অনিচ্ছা সত্ত্বেও কল রিসিভ করে সালাম দিলো। ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো,
” ওয়ালাইকুমুস সালাম। ”
ওপাশে ইমাদ ভাইয়ার কণ্ঠ শুনে আপুর চেহারায় স্বস্তির ছাপের দেখা মিললো। আমিও খানিকটা স্বস্তি পেলাম এতে।
সালামের উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে ইমাদ ভাইয়া স্বস্তির সহিত বললেন,
” যাক বাবা, ফোন তো রিসিভ করলে! আমি তো ভেবেছিলাম আননোন নাম্বার দেখে আজ বোধহয় ফোনই রিসিভ করবে না তুমি।”
আপু এ মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ইমাদ ভাইয়ার কথা শুনে ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
” প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম বলে রিসিভ করিনি। আপনার ফোন কোথায়? কার ফোন দিয়ে কল করেছেন আপনি?”
” আমার ফোনের ব্যাটারি একদম ডাউন৷ দশ মিনিট আগে চার্জে দিয়েছি। এটা আদ্রিশের নাম্বার। ওর ফোন থেকেই কল করেছি তোমাকে। তুমি এ নাম্বারটা সেভ করে রেখো। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।”
” আচ্ছা, আমি সেভ করে রাখবো। ”
এরপর খানিক সময়ের নীরবতা বিরাজ করলো দুজনের মাঝে। এদিকে ফোন লাউড স্পিকারে থাকায় আমার, আভার, তাসনিম এবং লামিয়ার চোখেমুখে দুষ্টু হাসির রেখার দেখা মিললো। স্বভাবতই আমরা চারজনে নিজেদের মনেই স্বতন্ত্রভাবে কিছু দুষ্টু বুদ্ধি নিয়ে পর্যালোচনা করলাম। এ সবকিছু আমরা আপুর সামনে বসেই চোখের ইশারায় করলাম। এদিকে আপু কথা বলার জন্য বসা থেকে উঠতে নিলেই আমরা চোখ গরম করে তাকে বসিয়ে দিলাম। ফলস্বরুপ আপুও আমাদের দিকে গরম চোখে তাকালো। কিন্তু আমাদের দল ভারী হওয়ায় আপু এ যাত্রায় জিতে উঠতে পারলো না। আমি আপুকে বসিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
” এখানেই কথা বল আপু। আমরাও দেখতে চাই, প্রতি রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোরা কি কথা বলিস। ”
আমার কথা শুনে আপু পুনরায় উঠতে নিলে আমরা পুনরায় তাকে বসিয়ে দিলাম। আপুর সাথে এমন দুষ্টুমি করার সুযোগ আমরা কেউই হাতছাড়া করতে চাইলাম না।
বেশ কিছুক্ষণ পর ইমাদ ভাইয়া মিহি সুরে বললেন,
” কথা বলছো না কেনো নাফিসা? কিছু কি বলার নেই আমাকে?”
আপু নির্বাক বসে রইলো৷ আমাদের সামনে যে সে কথা বলতে পারছে না তা যথার্থই বুঝতে পেলাম আমরা। আপুর এহেন অবস্থা দেখে এবং ইমাদ ভাইয়ার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন দেখে আমরা চারজনে মিটিমিটি হাসতে লাগলাম।
ইমাদ ভাইয়া পুনরায় বললেন,
” কি ব্যাপার নাফিসা? তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?”
আপু তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
” আরে না না। আমি আপনার উপর রেগে থাকবো কেনো?”
” তাহলে কথা বলছো না কেনো?”
আপু পুনরায় মৌনতা পালন করলো। ইমাদ ভাইয়া খানিক বাদে কণ্ঠে পূর্বের সুর বজায় রেখে বললেন,
” মিস করছো না আমাকে? আমি কিন্তু তোমাকে খুব মিস করছি৷ আজ সাদিকের কাছে তোমার হলুদের ছবিগুলো দেখলাম। বিশ্বাস করো নাফিসা, হলুদ শাড়ীতে তোমায় অপরূপ সুন্দরী দেখাচ্ছিলো। তোমার এ ছবি দেখে আমি আরেকদফায় তোমার প্রেমে মজে গেলাম৷ আমি…..”
ইমাদ ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই আমার চারজনে নিজেদের উপস্থিতি টের পাওয়াতে একত্রে ‘ওহহো’ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। আমাদের এহেন কাজে হয়তো ইমাদ ভাইয়া হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই কারণেই তিনি বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
” তোমরা আমাদের কথা শুনছিলে এতক্ষণ! ”
আমি উচ্ছল গলায় বললাম,
” বাহ, আমাদের কণ্ঠস্বর এই এক টোনেই এতো দ্রুত চিনে ফেললেন আপনি! নট ব্যড।”
ওপাশে ইমাদ ভাইয়া সশব্দে হেসে উঠলেন। বললেন,
” বউয়ের খোঁজ রাখি, তারমানে এই না যে শ্যালিকাগণের খোঁজ রাখবো না। তোমাদের সাথে যে পাঁচ ছয়বার কথা হয়েছে তাতে তোমাদের কণ্ঠ চেনা কোনো দুঃসাধ্য ব্যাপার নয় আমার পক্ষে। ”
” এজন্যই তো আপনি বেস্ট। আমার আপুর জন্য আপনার চেয়ে ভালো লাইফ পার্টনার হয়তো পাওয়া যেতো না।”
” উঁহু, ভুল বললে। আমার জন্য তোমার আপুর মতো লাইফ পার্টনার হয়তো শত চেষ্টার খোঁজাখুঁজিতেও পাওয়া যেতো না। এক্ষেত্রে আমি…..”
ইমাদ ভাইয়াকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে কে যেনো বলে উঠলো,
” আজকে আমার ফোনে এক হাজার টাকা ফ্লেক্সিলড দিবি তুই। ব্যাটা আধ ঘণ্টা যাবত এতো কি কথা বলছিস তুই? একটা দিনেরও তর সইছে না তোর?”
ইমাদ ভাইয়া সেই অজ্ঞাত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” শালা কিপ্টা। কেটে দিচ্ছি এখন৷ আমার ফোন দিয়েই কথা বলবো এখন। এতোক্ষণে যথেষ্ট চার্জ হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই। ”
এই বলে ইমাদ ভাইয়া পুনরায় আপুর উদ্দেশ্য বললেন,
” নেট কানেকশন অন রেখো। আমি ভিডিও কল দিচ্ছি। ”
আপু ছোট্ট করে জবাব দিলো,
” আচ্ছা।”
এপাশ হতে আপুর জবাব শোনামাত্রই ইমাদ ভাইয়া কল কেটে দিলেন এবং প্রায় এক মিনিটের মাঝেই আপুর ফোনে ইমাদ ভাইয়া ভিডিও কল দিলেন। আপু কল রিসিভ করে ফোনটি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে বসে পরলো এবং তাকে ঘিরে আমরা চারজনে বসে পড়লাম।
স্ক্রিনে ইমাদ ভাইয়ার দেখা মিলতেই আমরা একে একে চারজনে সালাম দিলাম তাকে। তিনিও সালামের জবাব দিয়ে আমাদের সাথে টুকটাক কথা বলতে শুরু করলেন। কথার এক পর্যায়ে আমি রসিয়ে রসিয়ে উনাকে বললাম,
” তা আপনি যে আমাদের আপুর প্রেমে আরেকদফা পা পিছলে পরলেন তাতে আপনার অনুভূতি কেমন? ”
ইমাদ ভাইয়া মিষ্টি হেসে জবাব দিলেন,
” পা পিছলে পড়ার পর যেমন অনুভূতি হয় ঠিক তেমনটাই অনুভূত হচ্ছে আমার৷ অর্থাৎ ব্যাথা করছে বুকটায়। প্রচণ্ড ব্যাথা।”
ইমাদ ভাইয়ার এহেন কথায় আপু লজ্জায় মিইয়ে গেলো। তবে আমরা সমস্বরে হেসে উঠলাম। আমি বললাম,
” তাই না কি? প্রেমে পড়লে যে এতো ব্যাথা হয় তা তো জানতামই না আমি।”
(লেখনীতে:সারা মেহেক)
ইমাদ ভাইয়া জবাব দিলেন,
” প্রেমে পড়োনি তো কখনো। এজন্য এমন অনুভূতি হয়নি তোমার। একবার কারোর প্রেমে পড়েই দেখো। ব্যাথার সাথে সাথে আরো অনেক অনুভূতির সাথে পরিচিত হবে তুমি। ”
আমি বেশ গর্বের সহিত বললাম,
” ওসব প্রেম টেমের ফাঁদে আমি পা রাখছি না কখনো।”
আমার কথার প্রত্যুত্তর স্বরূপ এবার আপু বলে উঠলো,
” এসব থেকে এতো দূরত্ব বজায় রেখে চলিস তো…..দেখিস অতি শীঘ্রই তুই এ ফাঁদে পা রেখে মারাত্মকভাবে ফেঁসে যাবি। তখন আমরা সবাই বলবো, ‘ ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’।”
আপুর কথা শেষ হওয়া মাত্রই ইমাদ ভাইয়াসহ সকলে সমস্বরে হেসে উঠলো। এদিকে আমি কপট রাগ দেখিয়ে চোখমুখ কুঁচকে আপুর দিকে তাকিয়ে আছি। ইমাদ ভাইয়া এবার বললেন,
” বি প্রিপেয়ার্ড মিম।”
আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। বরং সরু চোখে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ ফোনের ওপাশ হতে কে যেনো বলে উঠলো,
” কাকে কি নিয়ে প্রিপেয়ার্ড হতে বলছিস তুই?”
ইমাদ ভাইয়া জবাবে কিছু বললেন না। বরং ফোনটা নিজের সামনে হতে সরিয়ে নিয়ে পাশে ধরে বসলো। তথায় উদোম শরীরে আধশোয়া অবস্থায় ফোন নিয়ে বসে থাকা কারোর সামনে ধরে বললেন,
” এই যে, মিমকে বলছিলাম। ”
ইমাদ ভাইয়ার কথা শোনামাত্রই সে ব্যক্তিটি মাথা তুলে ফোনের দিকে চাইলো। অচিরেই উদোম ব্যক্তিটির চেহারা ঠাহর করতে পেরে আমরা সকলেই স্তব্ধ চাহনিতে চেয়ে রইলাম। উদোম শরীরের ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং স্বয়ং আদ্রিশ। এদিকে পুরো ঘটনাটি ঠাহর করতে কিয়ৎক্ষণ সময় নিলেন আদ্রিশ। অতঃপর উনি ঝড়ের গতিতে ফোন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের দু হাত দিয়ে শরীর ঢাকার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালালেন। আদ্রিশের এহেন কাণ্ডে ইমাদ ভাইয়াসহ আমরা পাঁচজনে ফিক করে হেসে ফেললাম। মুহূর্তটির কথা চিন্তা করতেই আমাদের সকলের হাসির গতি পূর্বের চেয়ে বহুগুণে বেড়ে গেলো। ইমাদ ভাইয়া তখনও আদ্রিশের দিকে ফোনের ক্যামেরা তাক করে আছেন। এদিকে আদ্রিশ নিজের উদোম শরীর ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তড়িঘড়ি করে সোফা হতে একটি গেঞ্জি নিয়ে পরতে পরতে ইমাদ ভাইয়া ভাইয়ার উদ্দেশ্যে রাগত স্বরে বললেন,
” শালা ইমাদের বাচ্চা ইমাদ, তোকে নিয়ে এখন আমি ফুটবল খেলবো। শালা, মেয়েদের সামনে আমার ইজ্জত সম্মান রাখলি না৷ ভাবীর সামনে তো রাখলিই না বরং ভাবীর বোনদের সামনেও রাখলি না৷ সাহস কত বড় তোর! আমার ইজ্জত নিলামে দিয়ে এখন দাঁত কেলিয়ে হাসছিস! এর রিভেঞ্জ আমি নিয়েই ছাড়বো। দেখে নিস।”
আদ্রিশের এহেন কাণ্ডে হাসতে হাসতে আমাদের সকলের পেটে খিল ধরে যাওয়ার উপক্রম হলো।
®সারা মেহেক
#চলবে
গ্রুপ সারা’র গল্পকুঞ্জ