#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
৮
প্রত্যূষের হিম অনলের শীতল ছোঁয়ায় আধো আধো চোখ মেলে তাকালাম আমি৷ ঘুম ভাঙার পরও চারপাশের হৈচৈ পূর্ণ মহলে আমি ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। ক্ষণিকের জন্য মনে এ চিন্তা জাগ্রত হলো যে, আমাদের শান্তশিষ্ট বাসায় এমন মাছের হাট বসলো কি করে। পরক্ষণেই মনে পড়লো, আজ আপুর বিয়ে। এজন্য সকাল হতেই এতো হৈচৈ পূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে।
শীতের সকালের আলসেমি কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম আমি এবং একে একে রুমে যারা ঘুমিয়েছিলো তাদেরকে ডাকলাম। আপু কিছুক্ষণ পূর্বেই উঠে পড়েছে। সে আপাতত রুমে নেই। আমি বাকিদের ডেকে রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কারণ ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘর পার হয়ে গিয়েছে বহুক্ষণ পূর্বে। আর আধ ঘণ্টার পর পার্লারের জন্য বেরিয়ে না পরলে যে বরযাত্রী আপুর পূর্বেই কমিউনিটি হলে পৌঁছে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সকালের খাওয়াদাওয়া শেষে আপু, আমি, আভা, তাসনিম এবং লামিয়া পার্লারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলাম। ইমাদ ভাইয়া এখানকার সুপরিচিত এক পার্লারে আমাদের এপোয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন। সেই পার্লারে যাচ্ছি আমরা। আমাদের বাসা হতে সেই পার্লারে যেতে প্রায় বিশ মিনিটের মতো সময়ের প্রয়োজন হয়। আমরা একটা অটো নিয়ে পাঁচজনে বসে পার্লারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
পার্লারে ঢুকতেই সেখানকার এক কর্মচারী আমাদের পাঁচজনকে একত্রে দেখে খানিকটা ভড়কে গেলেন হয়তো। তিনি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনাদের মধ্যে ব্রাইড কে?”
কর্মচারীটির কথায় হাসি পেলেও আমরা চারজনে আপুর দিকে আঙুল তাক করে বললাম,
” এই যে আমাদের ব্রাইড।”
আপুকে দেখে কর্মচারীটি মৃদু হাসবার চেষ্টা করে বললেন,
” সরি ম্যাম। আসলে এতোজনকে দেখে একটু কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। যাই হোক, আসুন এদিকে। আপনার জন্য তো বুকিং দেওয়া আছে।”
এই বলে তিনি আপুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। আপু যেতেই আমরা চারজনে মুখ চেপে খানিক সময় হেসে নিলাম। আপাতত এতোজন মানুষের সামনে উচ্চস্বরে হাসাহাসি করা অর্থ নিজেদের অপর মানুষগুলোর সামনে হাসির পাত্র বানানো। সর্বপ্রথম আমাদের প্ল্যান ছিলো, আপুর সাথে যেকোনো একজন যাবে। কিন্তু সেই ‘যেকোনো একজন’ যে আসলে কে তা নির্বাচন করতেই আমাদের দুটো দিন শেষ। অতঃপর ইমাদ ভাইয়ার কানে কোনোভাবে এই সংবাদটা পৌঁছালে তিনি আমাদের চারজনের এপোয়েন্টমেন্টও নিয়ে রাখেন।
আমরা চারজনে একে একে গিয়ে একেকটা চেয়ারে বসে পড়লাম। পার্লার মোটামুটি ফাঁকাই আছে। মাত্র ২ জন ক্লায়েন্ট বাদে এখনও অব্দি কোনো ক্লায়েন্ট নেই সেখানে। ফলে আমরা চারজনে আরামে বসে পড়লাম।
আমি বসে পড়তেই হুট করে আমার ফোনে কল এলো। ব্যাগ হতে ফোন বের করে দেখলাম তিন্নি কল করেছে। ভেতরে বেশ চেঁচামেঁচি থাকায় আমি দ্রুত পার্লারের বাহিরে এসে ওর ফোন রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলাম,
” তিন্নি? আপুর বিয়েতে আসবি না তুই?”
ওপাশে তিন্নির উদাসীন কণ্ঠ শুনতে পেলাম। সে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
” না রে। আব্বু কোনোভাবেই রাজি হলো না। ”
তিন্নির কথায় আমার ঠোঁটের কোনে বজায় থাকা হাসিটা মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেলো। ওর ফোন আসার আগ পর্যন্তও আমি এই আশায় ছিলাম যে, আংকেল ওকে বিয়েতে আসতে কোনোপ্রকার বাঁধা দিবে না। তবে এখন ওর কথায় সে আশার আলো দপ করে নিভে গেলো। আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
” ওহ।”
ওপাশ হতে তিন্নি নিশ্চয়ই মেকি খুশির অভিনয় করে বললো,
” আমি যাচ্ছি না তো গিয়েছে? নিশাত তো যাচ্ছে।”
আমি উদাসীন কণ্ঠে বললাম,
” একজন কখনোই দুজনের শূন্যস্থা পূরণ করতে পারে না। তুই আসলে অন্যরকম মজা হতো। ”
আমার হাবভাব দেখে তিন্নি কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো,
” আচ্ছা, শোন। কালকে কিন্তু ফরেনসিকের আইটেম আছে।”
তিন্নির কথা কর্ণপাত হতেই আমার খারাপ মেজাজ আরো খারাপ পর্যায়ে চলে গেলো। আমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললাম,
” আচ্ছা? দেওয়ান স্যারের কি আমার সাথে কোনো শত্রুতা আছে? আমি উনাকে বলে আসলাম, আমার আপুর বিয়ে বলে আমি তিনদিন কলেজে আসতে পারবো না। এরপরও স্যার কোন আক্কেলে আইটেম দিলো? যে চ্যাপ্টার আমাদের আরো চারদিন আগে শেষ, সে চ্যাপ্টারের আইটেম আরো কিছুদিন পরেই নিতে পারতো। নাহ, তা তো উনি করবেন না। এবার গিয়ে স্যারকে বলবো, স্যার আমার পেন্ডিং আইটেমটা আপনি দিয়ে দিয়েন। ”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই ওপাশে তিন্নির উচ্চ শব্দের হাসি শুনতে পেলাম। এদিকে আমার মেজাজ ধীরেধীরে গগনচুম্বী হওয়ায় আমি চুপচাপ গাল ফুলিয়ে এবং ভ্রু কুঁচকে ওর হাসির শব্দ শুনতে লাগলাম। এদিকে ওর হাসির শব্দ অনবরত শুনতে শুনতে দেখতে পেলাম, ইমাদ ভাইয়ার ছোট বোন থেকে শুরু করে উনার কাজিন এবং মধ্য বয়স্ক দুজন মহিলা পার্লারে ঢুকছে। ইমাদ ভাইয়ার ছোট বোন, ইমা আমাকে দেখে মুচকি হেসে ইশারায় ‘হাই’ বলে চলে গেলো। ইমাদ ভাইয়ার পরিবার হতে এই পাঁচজনের পার্লারে আগমন দেখে আর বুঝতে বাকি রইলো না, কি কারণে আজকের দিনে এতো সুপরিচিত পার্লারে ক্লায়েন্টের অভাব দেখা যাচ্ছিলো।
ওপাশ হতে হঠাৎ তিন্নির কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম। ও জিজ্ঞেস করলো,
” কি ব্যাপার মিম? কথা বলছিস না কেনো?”
আমি তৎক্ষনাৎ বলে উঠলাম,
” এই তো কথা বলছি তো। আচ্ছা, বল। গতকাল কি ওয়ার্ড হয়েছিলো?”
” অবভিয়েসলি হয়েছে। ওয়ার্ড না হয়ে থাকতে পারে না কি!”
আমার মাঝে পুনরায় বিরক্তির আভাস টের পেলাম। বললাম,
” একটা দিন রোগী কম থাকলে কি হয়। অন্তত এই ছুটি নেওয়াতে ওয়ার্ড তো মিস যায় না। মহাযন্ত্রণা। উফ।
আচ্ছা, তিন্নি,তোর সাথে পরে কথা বলছি।”
” আচ্ছা। বিয়েটা ইনজয় কর। কারণ এরপর তোর বিয়ের সানাই বাজবে। তখন আর সিঙ্গেল অবস্থায় কোনো বিয়ের দাওয়াত খেতে পারবে না সোনা। তখন সব হবে মিঙ্গেল মিঙ্গেল। ”
” আরে রাখ তো তোর সিঙ্গেল মিঙ্গেল। আমি রাখি এখন। বাই।”
এই বলে আমি কল কেটে দিলাম। ফোন হাতে প্রচণ্ড বিরক্তি এবং ক্রোধ নিয়ে ঘুরতেই সাদিককে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। উনাকে এ মুহূর্তে এখানে কল্পনাও করতে পারিনি আমি। ফলস্বরূপ উনাকে দেখে খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। সাদিক আমাকে দেখে মুচকি হেসে দিলেন। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” ভয় পেয়ে গেলেন না কি?”
উনাকে দেখে ভয় পাওয়া সত্ত্বেও নিজের সম্মান বাঁচিয়ে রাখতে জোরপূর্বক হেসে বললাম,
” না না। এমন কিছু না। তো আপনি এখানে যে?”
সাদিক সপ্রতিভ হেসে বললেন,
” ঐ যে দেখলেন না পার্লার বাহিনীকে? দুই গাড়ি ভর্তি করে ওদের রাখতে এসেছিলাম। একদল এলো আমার সাথে। আরেকদল এলো ড্রাইভারের সাথে।”
সাদিকের এ হাসিতে আমার মাঝে মৃদু ভালোলাগা বিরাজ করলেও তা লুকিয়ে রেখে ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
” ওহ।”
সাদিক এবার জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনি কিসে পড়েন?”
হুটহাট এমন প্রশ্নে আমি চমকায়িত হলেও চেহারায় স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বললাম,
” জি, এমবিবিএস থার্ড ইয়ারে। ”
উনার চেহারা যেনো উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। উনি পুনরায় উৎসুকতার সহিত জিজ্ঞেস করলেন,
” কোন মেডিকেলে?”
আমি উনাকে মেডিকেলের নাম বলতেই উনি চমকপ্রদ গলায় বললেন,
” ওয়াও। কোইন্সিডেন্সটা দেখো। আমি ঐ কলেজেই ফার্মাসিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি। ”
সাদিকের কথা কর্ণপাত হতেই আমার মাঝে ক্ষুদ্র এক ভালোলাগার শিহরণ বয়ে গেলো। আমি উনার হাসির সাথে তাল মিলিয়ে বললাম,
” বাহ। এখন তো তাহলে রোজ রোজই আমাদেরই দেখা হবে। ”
” তা আর বলতে। ”
সাদিকের কথা শেষ হতেই হঠাৎ পিছন হতে আদ্রিশ উনার কাঁধে হাত রেখে পাশে দাঁড়ালেন। আমার দিকে নিমিষের জন্য তাকিয়ে সাদিকের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,
” রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুই যুবক যুবতীর মাঝে এতো হাসাহাসি হচ্ছে কি কারণে?”
সাদিক খানিক চমকিত গলায় বললেন,
” আরে আদ্রিশ ভাই যে? তুমি এখানে কেনো?”
আদ্রিশ আমার দিকে বাঁকা চাহনিতে চেয়ে বললেন,
” নদী বাসা থেকে আসবার সময় ভুলে ড্রেস এনেছিলো না। সো, মহারাণীকে ড্রেস দেবার জন্য ছুটে চলে আসতে হলো। তা এখানে দাঁড়িয়ে এতো হাসাহাসি করছিলি কি নিয়ে?”
সাদিক উচ্ছ্বাসের সহিত বললেন,
” আরে আদ্রিশ ভাই, জানো না, মিম আর আমি একই কলেজে। আই মিন, ও থার্ড ইয়ারে পড়ে আর আমি ফোর্থ ইয়ারের লেকচারার। বলছিলাম, এখন থেকে তো রোজ রোজই দেখা সাক্ষাৎ হবে।”
আদ্রিশ সাদিকের পিঠে মৃদু শব্দে চাপড় মেরে স্বাভাবিক সুরে বললেন,
” বাহ, ভালো তো। আচ্ছা এখন চল, আমাদের ইমাদ সাহেবকে তো রেডি করতে হবে না কি! দেখা গেলো, ভাবী রেডি হয়ে বিয়ের আসরে উপস্থিত। কিন্তু আমাদের ইমাদ এখনও রেডি হচ্ছে। ”
এই বলতেই উনাদের দুজনের মাঝে অল্পবিস্তর হাসির রোল পরে গেলো। উনাদের এ হাসাহাসির পর্ব শেষ হতেই উনারা উল্টো পথে হাঁটা ধরলেন। সামনের গাছের নিচে সাময়িক পার্কিং করে রাখা কারে প্রথমে সাদিক উঠলেন। অতঃপর আদ্রিশও উঠলেন। তবে গাড়িতে বসবার পূর্বে অজানা কোনো কারণে আমার দিকে আড়চোখে নিমেষের জন্য তাকালেন। যেতে যেতে উনার এ চাহনি উনার পিছে বেশ ক’টা প্রশ্ন ফেলে রেখে গেলেন।
®সারা মেহেক(গ্রুপ: সারা’র গল্পকুঞ্জ)
#চলবে
( সকলকে বেশি বেশি রেসপন্স এবং কমেন্ট করার অনুরোধ রইলো। আপনাদের এতো কম রেসপন্স দেখে লেখার ইচ্ছেটা একটু হলেও নুয়ে পড়েছে আমার এবং এমনটা সব রাইটারের ক্ষেত্রেই হয়। শুধু যে, আমার ক্ষেত্রে হয় তা নয়। এজন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। অগ্রিম ধন্যবাদ❤️)