ভুলবশত প্রেম পর্ব-২২

0
1848

#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক

২২

সার্টিফিকেটকে নিজের জায়গায় রেখে আদ্রিশ পুনরায় দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। উনি আমার থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখেই দাঁড়িয়ে আছেন। তবুও উনাকে এভাবে সামনে দেখে আমার ভেতরে তীব্র অস্বস্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি হলো। ফলস্বরূপ আমি চোখজোড়া কুঞ্চিত করে দু হাতের মুঠো শক্ত করে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলাম। অজানা কারণে পা দুটো বরফের ন্যায় জমে রইলো। দু কদম পাশ ফিরে যে এখান থেকে সরে দাঁড়াবো সে শক্তিটুকুও যেনো আমি হারিয়ে ফেললো। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়ে আমার সমস্ত স্নায়ু যেনো তার কর্মযজ্ঞ হতে বিরতি নিলো। আমি অনুভব করলাম, আমার হাত দুটো ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সহসা কুহু এবং নদীর কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম আমি। মুহূর্তেই চোখ মেলে সামনে চাইলাম এবং বেশ বিস্মিত হলাম বটে। কারণ এ মুহূর্তে আমার সামনে কেউ নেই। কিছুক্ষণ আগেও যে আদ্রিশ এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, অথচ এ মুহূর্তে উনি আমার সামনে নেই৷ বরং উনি এ রুমেই নেই। কুহুর কণ্ঠস্বর শুনে এতো দ্রুত উনি কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন এ ভাবতে ভাবতে আমি নিজেকে সামলে নিলাম। তন্মধ্যেই কুহু ও নদী নাস্তাসহ রুমে প্রবেশ করলো। আমায় দেখে নদী জিজ্ঞেস করলো,
” ভাইয়া এসেছে?”

নদীর প্রশ্নের কি জবাব দিবো এ ভাবতে ভাবতেই আদ্রিশ ওয়াশরুমের দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলেন। তোয়ালে দিয়ে মুখমণ্ডল মুছে নিতে নিতে নদীকে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমাকে খুঁজছিস কেনো চুন্নি?”

আদ্রিশের মুখে ‘চুন্নি’ সম্বোধন শুনে নদী বোধহয় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। ফলস্বরূপ মুখশ্রীতে অদ্ভুত কায়দা ফুটিয়ে তুলে প্রচণ্ড খিটখিটে গলায় আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বললো,
” বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ভাইয়া। আমি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তুমি এ নামে ডাকো কেনো আমাকে?”

আদ্রিশ দাঁত বের করে তৃপ্তির সহিত বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললেন,
” তুই যতবার নিষেধ করবি ততবারই আমি তোকে এ নামে ডাকবো।”
এই বলে উনি নদীর মাথায় গাট্টি মেরে তোয়ালে নিয়ে ব্যালকনিতে গেলেন। আদ্রিশের এরূপ কাজে নদীর রাগ যেনো তুঙ্গে উঠলো। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলো,
” আজ বাবা আসুক। তারপর দেখো, তোমার নামে কি কি কমপ্লেইন করি আমি। ”

আদ্রিশ ভেজা তোয়ালে ব্যালকনিতে রেখে রুমে এসে ডাবল সিটেড সোফায় বসে পড়লেন। একটু ঝুঁকে হাঁটুর উপর দু হাতের কনুই ভর করে দাপট গলায় বললেন,
” এই সন্ধ্যায় আমার কাছে কি চাই তোর?”

আদ্রিশের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নদী গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ফলে নদীর পক্ষ হতে কুহু আদ্রিশকে বললো,
” আদ্রিশ ভাইয়া? আমাদের এখন ফুচকা খেতে মন চাচ্ছে। বাজার থেকে একটু এনে দাও না…..”
কুহুর কথায় তীব্র আকুতির দেখা মিললো। কিন্তু আদ্রিশের চেহারাখানার ভাব এমন যে, এসব আকুতি মিনতি করে লাভ নেই। এ কথার সত্যতা প্রমাণ করতেই যেনো আদ্রিশ কুহুর এ আকুতি হাওয়ায় উড়িয়ে বক্র কণ্ঠে বললেন,
” এ্যাহ, মামা বাড়ির আবদার পেয়েছিস না কি? ল্যাব থেকে কিছুক্ষণ আগে বাসায় ফিরলাম। একটু বসতে না বসতেই আমাকে বাজারে পাঠাবি! কত্ত বড় বেয়াদ্দব! ”

কুহু তার চেহারা ভাব পরিবর্তন করে কাঁদোকাঁদো ভাব তুলে ধরে বললো,
” আদ্রিশ ভাইয়া প্লিজ। খুব খেতে মন চাইছে তো।”

” তো নিজেরা গিয়ে খেয়ে আয়।”

” আমরা যেতে পারলে কি আর তোমায় বলতাম না কি? প্লিজ আদ্রিশ ভাইয়া……”

কুহুর কথা শুনে আদ্রিশ ভ্রু উঁচিয়ে নদীর দিকে তাকালেন। নিমিষের পর্যবেক্ষণ শেষে সদর্পে বললেন,
” তোর ঐ লাড্ডু ফ্রেন্ডটাকে বল আমাকে রিকুয়েষ্ট করতে। তাহলে আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে।”

আদ্রিশ, নদী আর কুহুর এহেন কাণ্ডকারখানা দেখে আমি এক কোনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলাম। আদ্রিশ যে এতো দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ তা উনার বহিঃরূপ দেখে বোঝা মুশকিল।
এদিকে আদ্রিশের মুখে ‘লাড্ডু’ সম্বোধন শুনে নদী পুনরায় তার গাল দুটো ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নদীর এরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে শুধু যে আমিই মিটিমিটি হাসলাম তা নয়। বরং আদ্রিশও হাসলেন। তবে আড়ালে।
কুহু নদীর বাহুতে নিজের বাহু দিয়ে ঈষৎ ধাক্কা মেরে বললো,
” আর কতো রিকুয়েষ্ট করবো আমি? এবার তুইই বল। ”

নদী ঝট করে আদ্রিশের দিকে চেয়ে তেজস্বরে বলে উঠলো,
” আমাদের তেলের গোডাউন নেই যে কাউকে তেল দিয়ে দিয়ে তালগাছে উঠাবো। লাগবে না ফুচকা। আমি বাবাকেই আনতে বলবো।”

আদ্রিশ এবার কৌতুক শোনার মতো হেসে উঠলেন৷ সোফায় গা এলিয়ে বসে বললেন,
” তাহলে আজকে ফুচকা খাওয়ার শখ মিটিয়ে দে। কারণ বাবার বাসায় আসতে আসতে রাত এগারোটা পার হয়ে যাবে। ”

এবার নদী যেনো অকূলপাথারে পড়লো। তবে তা আদ্রিশকে উপলব্ধি করতে দিলো না। বরং পূর্বের ন্যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো৷ এদিকে কুহু শেষ আশ্রয়স্থল ভেবে আমার কাছে এসে বললো,
” মিম আপু, চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে আদ্রিশকে ভাইয়াকে একটু বলো।”

আমি খানিক থতমত খেয়ে বললাম,
” আমি! তোমরাই আরেকটু বলো। তাহলেই এনে দিবে। ”

” প্লিজ আপু। তুমি বললে হয়তোবা কাজ হবে। আমাদের জন্য বলে দেখো না…..”

কুহুর মিনতি শুনে আমি আদ্রিশের দিকে চাইলাম। আদ্রিশ যে এতক্ষণ আমাদের দিকেই চেয়ে ছিলেন তা উনার চাহনি দেখামাত্রই উপলব্ধি করলাম। ফলে আমি খানিকটা সংকুচিত হয়ে এলাম। তবুও কুহুর পক্ষ থেকে এক প্রকার বিরস কণ্ঠে উনাকে বললাম,
” এতো করে যখন রিকুয়েষ্ট করছে, ওদের রিকুয়েষ্ট রাখলেই তো হয়।”

আদ্রিশ আমার কথায় কিয়ৎক্ষণের জন্য আমার দিকে চেয়ে রইলেন। অতঃপর চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর হতে মানিব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। কিন্তু বেরিয়ে যাবার পূর্বে নদীর মাথায় পুনরায় গাট্টা মেরে বললেন,
” সবার জন্য দুই প্লেট। কিন্তু তোর এ ঢঙের জন্য তুই এক প্লেট ফুচকা পাবি। ”
এই বলেই উনি বেরিয়ে পড়লেন এবং সাথে সাথেই নদী স্বাভাবিক হয়ে বললো,
” ভাইটা যে এমন এক নমুনা হয়েছে! এর ডাবল পিছ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। ”
এই বলে সে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। কুহুও তার পাশে সোফায় বসতে বসতে বললো,
” তোর ক্ষেত্রেও তাই৷ প্রতিবার আদ্রিশ ভাইয়ার সাথে গ্যাঞ্জাম পাকাবি। আর বলি বানাবি আমাকে। আজ তো মিম আপু ছিলো বলে আদ্রিশ ভাইয়া রাজি হলো। তা না হলে কতক্ষণ যে রিকুয়েষ্ট করতে হতো আল্লাহ জানে। ”

নদী আর কুহুর কথাবার্তা শুনে আমি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” সবসময় এমন হয়?”

কুহু জবাব দিলো,
” প্রায় সময়ই। এই দুই ভাইবোনের ঝগড়া যেনো কমতেই চায় না। ”

কুহুর কথা শুনে প্রত্যুত্তরহীন বসে রইলাম আমি৷ বিশ মিনিটের মাঝেই আদ্রিশ রুমে প্রবেশ করলেন। উনার পিছু পিছু ফুচকা নিয়ে প্রবেশ করলেন একজন সার্ভেন্ট। আদ্রিশ প্যান্টের দু পকেটে হাত গুঁজে ব্যালকনিতে যেতে যেতে বললেন,
” নে, খাওয়া শুরু কর।”

আদ্রিশ যেতেই স্বস্তি এবং তৃপ্তি সহকারে ফুচকা খেলাম। আমাদের খাওয়া শেষ হওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই আদ্রিশ রুমে প্রবেশ করলেন। অঘোষিতভাবেই পুনরায় উনার এবং নদীর মাঝে খুনসুটিময় ঝগড়া চলতে লাগলো। আমার মন চাইলো তাদের এ ঝগড়ার সাক্ষী না হয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখি, গাছ দেখি। শেষমেশ কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই আমি উঠে গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। ব্যালকনিতে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। সে হাওয়ার তালে মাধবীলতা ফুলগুলো দুলে বেড়াচ্ছে। মাথার উপরে অবস্থিত উইন্ড কাইমটি মিষ্টি টুংটাং শব্দ তুলে বেড়াচ্ছে। এ যেনো এক ঐন্দ্রজালিক ক্ষণ। আমি ক্ষণেই প্রগাঢ়ভাবে এ মুহূর্তে আবদ্ধ হলাম। মাধবীলতার নৃত্য দেখে লোভ সামলাতে না পেরে একটু এগিয়ে গিয়ে গাছটির কাছে দাঁড়ালাম। দুলতে থাকা ফুলগুলো আলতো করে হাতের মুঠোয় নিয়ে নির্নিমেষ চেয়ে রইলাম।

অকস্মাৎ পাশে নদীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে খানিক তটস্থ হলাম৷ দ্রুত হাত হতে ফুলগুলো ছেড়ে দিয়ে নদীর দিকে চেয়ে মৃদু হাসলাম। নদী বিস্তৃত হেসে জিজ্ঞেস করলো,
” লাগবে?”

আমি ওর প্রশ্নের অর্থোদ্ধার করতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি লাগবে? ”

নদী ভ্রুসহ চোখজোড়া উঁচিয়ে মাধবীলতা গাছের দিকে ইশারা করে বললো,
” ফুল লাগবে?”

নদীর কথায় যেনো হাতের মুঠোয় এক ঝাঁক সুখ পেয়ে বসলাম। আমি সাথে সাথে উৎফুল্লতার সহিত ওর প্রশ্নের জবাবে বলে বসলাম,
” হ্যাঁ হ্যাঁ৷ লাগবে। ”

নদী আমার জবাবে স্মিত হাসলো। আমার সামনে দাঁড়িয়েই আদ্রিশের উদ্দেশ্যে বললো,
” ভাইয়া, ঐ মাধবীলতা ফুল লাগবে। ”
আদ্রিশ কিয়ৎ তেজস্বরে বললেন,
” আমার ফুলগুলোয় হাত লাগালে খবর আছে।”

” ইশ! আমার না। মিম আপুর লাগবে। ”

নদীর কথায় আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আদ্রিশের দিকে চাইলাম৷ আদ্রিশও নদীর উপর হতে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে চাইলেন। নিমিষের জন্য আমায় পর্যবেক্ষণ শেষে ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
” আচ্ছা। নিক ও।”

আদ্রিশের সম্মতি পাওয়া মাত্র আমি এক মুহূর্তও দেরি করলাম না। পা এগিয়ে গাছের কাছে এসে দু গুচ্ছ মাধবীলতা ফুল তুলে নিলাম। ফুলের গুচ্ছ দুটো হাতের মুঠোয় পেয়ে এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমি বোধহয় সব সুখ পেয়ে বসেছি৷ এক ফুলের গুচ্ছকে ঘিরে কি অদ্ভুত এক অনুভূতি! মন চাইছে এ মুহূর্তে চুলের বাঁধন খুলে এক গুচ্ছ মাধবীলতা কানে গুঁজে নেই। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় সে ইচ্ছে বিসর্জন দিতে হলো আমায়।
আমি ফুল নিয়ে আদ্রিশের রুমে চলে এলাম৷ আদ্রিশ সোফায় বসে মনোযোগ সহকারে ফোন চালাচ্ছেন। অনেকক্ষণ যাবত এ রুমে থাকায় খানিক অস্বস্তি বোধ করলাম আমি৷ ফলে নদীর রুমে যাওয়ার জন্য ওর অনুমতি চাইলাম। কুহুর সাথে গল্পে মশগুল থাকতে থাকতে সে ভদ্রতাসূচক কণ্ঠে আমায় অনুমতি দিলো। অতঃপর নদীর রুমে এসে দরজা কিঞ্চিৎ ভিড়িয়ে ওর রুমে অবস্থিত ডাবল সিটেড সোফায় বসে পড়লাম। একদৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ মাধবীলতা গুচ্ছ দুটির দিকে চেয়ে রইলাম৷ সহসা কানের পিছে ফুল গুঁজে রাখার চিন্তা আসতেই আমার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো। দরজা ভিড়িয়ে রাখায় আমি সোফা ছেড়ে উঠে মাথা হতে ওড়না কাঁধে নিলাম। মুহূর্তেই চুলের বাঁধন খুলে মাধবীলতার এক গুচ্ছ কানের পিছনে গুঁজে নিলাম। অতঃপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখলাম।

আচমকা দরজার ওপাশে কারোর পদশব্দে খানিক ভীত হলাম। দ্রুত কান হতে ফুল সরিয়ে খোঁপা বেঁধে মাথায় ওড়না নিলাম। অতঃপর চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো সোফায় বসে পড়লাম।
®সারা মেহেক(আগামীকাল ২ পর্বের অণুগল্প পাবেন। ইন শা আল্লাহ )

#চলবে
নতুন পেজে আগামী ১২/১৩ তারিখ থেকে ‘নব্য দিনের সূচনা’ দ্বিতীয় খণ্ড দিবো ইন শা আল্লাহ। গল্প পড়তে নতুন পেজে লাইক দিয়ে রাখবেন।
নতুন পেজ সারা মেহেক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here