#ভুলবশত_প্রেম
#লেখনীতে:সারা মেহেক
২৬
গতকাল রাতের ঘটনার পর হতে আমি আদ্রিশের ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি। এতে কোনো সন্দেহ নেই উনি আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু আমি? সত্যি বলতে আমি উনার অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হলেও নিজের অনুভূতি সম্পর্কে অবগত হতে পারলাম না। আমি নিজেও উপলব্ধি করতে পারলাম না উনায় নিয়ে আমার মাঝে আদৌ কোনো অনুভূতির উদ্রেক ঘটেছে কি না। অদ্ভুত এ ব্যাপারটার কারণও ঠিক উপলব্ধি করতে পারলাম না। যেনো, আমি নিজের বেলায় সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছি।
তবে উনি যে আমায় পছন্দ করেন তা আমি মেনে নিয়েছি এবং এ ঘটনাটাকে এখানেই শেষ করে দিতে চাইছি। কারণ উনার সাথে আমার ভবিষ্যত কল্পনা করা সত্যি বলতে অসম্ভব। এর অবশ্য কারণও আছে। প্রথমত, উনাদের ক্লাস আর আমাদের ক্লাসের পার্থক্য। উনারা যেখানে হাই সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত, সেখানে আমরা মিডেল ক্লাস সোসাইটির মধ্যে পড়ি। আপুকে এমন পরিবারে বিয়ে দিয়ে আব্বু আম্মু শিক্ষা নিয়ে নিয়েছে। ফলে আমার ব্যাপারে কিছুতেই এ বিয়েতে তারা রাজি হবে না৷ আমি নিজ চোখে দেখেছি, আপুর বিয়ের সময় আব্বু আম্মুর উপর দিয়ে কি পরিমাণ মানসিক অত্যাচার গিয়েছে! যদিও ইমাদ ভাইয়াদের পরিবার অত্যন্ত ভালো। তবুও মেয়েপক্ষ বলে কথা! অন্তত সমাজের সামনে যেনো ছোট হতে না হয় সেজন্যই কত আয়োজন! উপরন্তু, আপুকে শোনানো আনোয়ারা দাদির সেই খোঁটাসম্পন্ন কথাগুলো! আবার হলুদের দিনের সে ঘটনার পর হতে আনোয়ারা দাদি আদ্রিশকে ভালো চিনেন না৷ হয়তো এমন আরো অনেকেই আছে। সব দিক বিবেচনায় আদ্রিশের সাথে আমার ভবিষ্যত জীবন কল্পনা করাও অসম্ভব। অতএব, এখন হতে আদ্রিশের নিকট হতে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে উনাকে উপেক্ষা করার চিন্তাভাবনা করে মনস্থির করলাম।
এ নিয়ে চিন্তা করার কারণে আজ ক্লাসগুলোতেও ঠিকমতো মনোযোগী হতে পারিনি৷ ফলস্বরূপ মেজাজ প্রচণ্ড খিটখিটে হয়ে আছে আমার।
এই খিটখিটে মেজাজ নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে বাসায় যাবার জন্য রিকশা ডাকতেই কোথা হতে যেনো রিতু এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো। আচমকা রিতুকে দেখে রোহান ভাইয়ার কথা মনে পড়লো৷ এদিকে রিতু হাস্যজ্জ্বল চেহারায় আমায় জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছিস দোস্ত?”
বহুদিন পর রিতুকে দেখে খানিক অবাক হলাম। তবুও স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বললাম,
” আলহামদুলিল্লাহ আপু আছি। তুই কেমন আছিস?”
” আমিও ভালো আছি। ভেবেছিলাম নাফিসা আপুর বিয়েতে তোর সাথে দেখা হবে। কিন্তু ভাইয়া আমাকে যেতে দিলো না। ”
রিতুর কথায় চট করে আমার মনে সন্দেহের বাতি জ্বলে উঠলো। ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কেনো? রোহান ভাইয়া তোকে আসতে দিলো না কেনো?”
” কি জানি। ভাইয়া আমায় বললে তো! আমি বিয়েতে যাওয়া নিয়ে ভাইয়ার কাছে পারমিশন চাইতেই ভাইয়া এক বাক্যে না করে দিলো। আর তুই তো জানিসই, আব্বু আর ভাইয়াকে আমি কি পরিমাণ ভয় পাই! ভাইয়া যেখানে একবার নিষেধ করে দিয়েছে সেখানে আমার দ্বিতীয় কথা বলার সাহস নেই। ”
রিতুর কথা শুনে আমি আর কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করলাম না। রিতু পুনরায় বললো,
” চল, আমাদের বাসায় চল। অনেকদিন আসিস না।”
রিতুর কথায় আমার মাঝে কেমন যেনো ভয় চেপে বসলো। আমি চট করে বলে উঠলাম,
” আরে না না। এখন যাবো না। অন্য কোনোদিন যাবো। ”
” সে কি! একই এলাকায় বাসা থাকার পরও এ কথা বললে মানা যায় না। ”
” আমি এখন বাসায় নাইরে রিতু। গত ৩/৪ দিন যাবত আপুর শ্বশুরবাড়িতে আছি। ভাইয়া একটু বাইরে গিয়েছে তো তাই আমাকে নিয়ে গিয়েছে। ”
” তো? যাই বলিস না কেনো, আজ আমি তোর কোনো এক্সকিউজ মানবো না। আজ আমার সাথে যেতে হবে মানে যেতেই হবে। আজকের দুপুরের খাবার আমাদের বাসায়েই খেতে হবে। আর কিছু শুনতে চাই না আমি। ”
এই বলে রিতু আমার হাত ধরে রাস্তার ওপারে গিয়ে ওদের প্রাইভেট কারে উঠতে বললো। অগত্যা রিতুর জোরাজোরিতে ওর সাথে না পেরে কারে উঠে বসলাম। কার স্টার্ট দিতেই রিতুর মুখের বুলি ফুটতে শুরু করলো।
.
আমাদের শহরের এমপি হওয়ার দরুন রিতুর বাবার বিলাসিতার অভাব ছিলো না। একই এলাকায় কিন্তু দুটো বিপরীত রাস্তায় আমাদের দুজনের বাসা অবস্থিত। স্কুলে থাকা অবস্থায় প্রায়শই রিতু আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসতো। এ নিয়ে অবশ্য তখন আম্মুর কাছে খুব করে বকা শুনতাম। কিন্তু তখন রিতু আমার বেস্টফ্রেন্ড হওয়ায় এ নিয়ে ওকে কিছু বলতে পারিনি।
আজ বহুদিন রিতুদের বাসায় এসে সব নতুন নতুন লাগলো। বাসায় এসেই রিতু আমাকে তার রুমে বসিয়ে নিচে খাবারের আয়োজন করার কথা বলতে চলে গেলো। এদিকে রুমে একা একা বসে থাকায় বিরক্ত অনুভব করায় ওর রুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। দ্বিতীয় তলায় রিতুর রুমের এক রুম পরেই রোহান ভাইয়ার রুম। হাঁটতে হাঁটতে রোহান ভাইয়ার রুমের কাছে আসতেই রুম হতে উচ্চস্বরে উনার কণ্ঠ এবং অপরিচিত এক ছেলের কণ্ঠ শুনতে পেলাম৷ দুজনেই ফোনে লাউড স্পিকারে কথা বলছেন। উনাদের কথার মাঝেই হঠাৎ আদ্রিশের নাম শুনতেই আমি চমকে উঠলাম। ফলে দ্বিতীয় কোনো চিন্তা না করে রোহান ভাইয়ার রুমের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য আদ্রিশকে নিয়ে উনারা কি কথা বলছেন তা সম্পর্কে জানা।
দরজার এপারে আড়ি পাততেই রোহান ভাইয়ার কণ্ঠে শুনতে পেলাম,
” আমি ডিলের কথা ভুলিনি মিস্টার ইকবাল। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ”
রোহান ভাইয়ার মুখে মিস্টার ইকবালের নাম শুনতেই আমার বুকটা ধক করে উঠলো। রোহান ভাইয়ার মুখে মিস্টার ইকবালের নাম শুনে আমার মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি হলো। অনেকটাই নিশ্চিতভাবে ধরে নিলাম, আদ্রিশের মুখে যে মিস্টার ইকবালের নাম শুনেছি, ফোনের ওপাশের লোকটিই সেই মিস্টার ইকবাল। তবে রোহান ভাইয়া, আদ্রিশ ও মিস্টার ইকবালের মাঝে কি যোগসূত্র থাকতে পারে তা আন্দাজ করতে পারলাম না। পুরো বিষয়টা জানতে আমি পুনরায় রোহান ভাইয়ার কথোপকথন শুনতে আগ্রহী হলাম। ফোনের ওপাশে মিস্টার ইকবাল কিছুটা তেজস্বরে বললেন,
” আমার মনে হয় না আপনি সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনটা করলে এক ফর্মুলা নিতে এতোদিন সময় লাগতো না। আপনি হয়তো ডিলটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। ”
” এমনটা মোটেও না মিস্টার ইকবাল। আমি আমার দ্বিতীয় লোক লাগিয়ে দিয়েছি আদ্রিশের ল্যাবে। এটা ঠিক যে, আমার কিছু ভুলের জন্য প্রথম ইনফর্মার প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার আমি সেরকম ভুল করিনি। এবার মেপে মেপে পা ফেলছি আমি। ”
” সে তো দেখছিই, কত মেপে মেপে পা ফেলছেন আপনি৷ ”
” এ কাজটা করার জন্য আমাকে একটু সময় তো দিতে হবে মিস্টার ইকবাল। ড্রাগটার ফর্মুলা আদ্রিশ কোথায় কিভাবে রেখেছে তা ওর মাধ্যমেই বের করাতে হবে। এজন্য আমরা একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছি। আমি চাইছি যে, সাপও মারবো কিন্তু লাঠিও ভাঙবে না। ”
” যাই করেন মিস্টার রোহান। আমি দ্রুত রেজাল্ট চাই। আমি আর দু মাসের মধ্যেই সুইজারল্যান্ড ব্যাক করবো। এর মাঝেই সব কাজ হওয়া চাই আমার।”
” জি বুঝেছি আপনার কথা। ফর্মুলাটা যেমন আপনার জন্য ইম্পর্ট্যান্ট তেমনি আমার জন্যও ইম্পর্ট্যান্ট। যাস্ট আমার লোকের সাহায্য রিসার্চ পেপারটা কোনোমতে বের করাতে হবে। কিন্তু আপনি হয়তো এতোদিনে বুঝেই গিয়েছেন যে আদ্রিশ গভীর জলের মাছ। এতো সহজে সে আমাদের কাছে ধরা দিবে না। ”
” জি তা তো বুঝেই গিয়েছি। আচ্ছা, আপনি কি নিশ্চিত, মিস্টার আদ্রিশ আমাদের দুজনার মধ্যকার ডিল সম্পর্কে কিছু জানে না?”
” জি আমি একদম নিশ্চিত মিস্টার ইকবাল। আপনিও নিশ্চিন্তে থাকুন। তবে কাজের মাঝে হয়তো আপনার কিছু হেল্প লাগতে পারে। ”
” জি জি। এ নিয়ে আপনি টেনশন করবেন না। আপনি শুধু কাজটা শেষ করুন। তাহলে আজ রাখছি।”
” আচ্ছা। তাহলে পরে কথা হবে। ”
এই বলেই রোহান ভাইয়া কল কেটে উনার রুমের অপর মানুষটাকে বললেন,
” তুই আরো খোঁজ খবর কর এ নিয়ে। কাজটা খুব দ্রুতই সারতে হবে আমাদের। ”
রোহান ভাইয়ার কথায় আগন্তুক সায় দিয়ে বললো,
” হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। আপাতত এ নিয়ে টেনশন বাদ দে। চল একটু বাইরে ঘুরে আসি। ”
আগন্তুকের কথা শোনামাত্র আমি ত্রস্ত পায়ে রোহান ভাইয়ার রুমের সামনে থেকে চলে এলাম। দ্রুত রিতুর রুমে গিয়ে বসতেই অনুভব করলাম, আমার হৃদপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন গতি। রোহান ভাইয়া ও মিস্টার ইকবালের কথোপকথন শোনার পর এটা বুঝতে বাকি রইলো না যে, আদ্রিশ ও রোহান ভাইয়ার মাঝে প্রফেশনাল শত্রুতা কি নিয়ে তৈরী হয়েছে। তবে আমি এটা জানতে পারলাম না, আদ্রিশ কোন ফর্মুলা তৈরী করেছেন যার জন্য মিস্টার ইকবাল ও রোহান ভাইয়া উনার পিছে পড়ে আছেন। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, উনি কোনো ছোটখাটো ড্রাগ ফর্মুলা তৈরী করেননি। এমনটা হলে মিস্টার ইকবাল দেশের বাইরে থেকে এসে এ নিয়ে লাফালাফি করতেন না। নিশ্চয়ই বড় কিছুর সম্পৃক্ততা আছে সেই ফর্মুলার সাথে । যার পিছনে উনারা পড়ে আছেন।
®সারা মেহেক
#চলবে
গত পর্ব : https://www.facebook.com/615626882415008/posts/970464086931284/?app=fbl