মনের_অন্দরমহলে পর্ব ২৫

মনের_অন্দরমহলে পর্ব ২৫
#আনিশা_সাবিহা

–“এট লাস্ট, আই ফাউন্ড ইউ মাই বিউটিফুল ওয়াইফ।”

এতো সেই কন্ঠ যেটায় আমি বারে বারে মুগ্ধ হয়েছি! বেশ কয়েকটা ঢক গিললাম। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু বাস্তবে আমার গলায় কারো উষ্ণ গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। একহাত দিয়ে কেউ চেপে ধরে আমার চোখেমুখে অন্যহাত বুলিয়ে যাচ্ছে। ঘুমটা এতোটাই প্রগাঢ় হয়ে এসেছে যে চোখ খুলতে গিয়েও পারছি না। নড়াচড়া করার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছি। বহু কষ্টে ঘুমের সঙ্গে এক প্রকার যুদ্ধ করেই আধো আধো চোখ খুললাম। কিন্তু দেখতে তো পাবো না। হাতটা উঠাতের কারো গালে হাত পড়ল। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি পেয়ে আঁতকে উঠে হাত সরিয়ে নিলাম আমি। ছটফটিয়ে লোকটার বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে গেলাম। তৎক্ষনাৎ আমার ওপর ভার ছেড়ে দিল এক প্রশস্ত দেহ।

–“এ…এই কে আপনি? আমি কিন্তু চিৎকার কর…”

এরই মাঝে আমার মুখটা চেপে ধরল ব্যক্তিটি। তীব্র বেগে বলল,
–“স্টপ! এভাবে লাফানো বন্ধ করো। স্থির হয়ে থাকো। দেখতে দাও। কতক্ষণ পর দেখছি তোমায়। তুমি ঘুমিয়ে পড়তে পারো সমস্যা নেই।”

আয়াশের কন্ঠ শুনে চোখ বড় বড় হয়ে এলো আমার। গলা শুকিয়ে এলো। উনি এখানে কিভাবে? বিস্মিত হবো নাকি ভীত হয়ে পড়ব সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার ঠোঁটের ওপর থেকে হাত সরিয়ে আমার কপালের বাম সাইডে কাটা এবং ব্যান্ডেজ করা স্থানে আঙ্গুল ছোঁয়ালেন আয়াশ। ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলাম আমি।

–“খুব লেগেছে না? কত কষ্ট পেয়েছে আমার পিচ্চি বউ!”

আমার কপালের আঘাতপ্রাপ্ত জায়গায় বেশ গাঢ় ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালেন উনি। মনে প্রশান্তি বয়ে গেল। যেই অস্থিরতা ও যন্ত্রণা নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম সেটা যেন এক মূহুর্তেই উবে গেল। হ্যাঁ উনাকেই তো আমার দরকার! আমার সব সমস্যার সুরাহা আর আমার সুখের কেন্দ্রবিন্দু, ‘আয়াশ’।
আমার চোখমুখে নিজের ইচ্ছেমতো চুমু খেয়ে যাচ্ছেন উনি। এক কথায় পাগলামো শুরু করেছেন। কিন্তু হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল আমায় সাভারে নিয়ে গিয়ে এক জঙ্গলের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলার মতো বাজে কাজ করেছেন উনি। উনার জন্য আজ কতটা তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বীকার হয়েছি আমি। সঙ্গে সঙ্গে আয়াশকে ধাক্কাতে শুরু করলাম আমি।

–“উঠুন, উঠুন। আমি বলছি উঠে বসুন।”

আমার তীব্র রাগ শুনে উঠে বসলেন আয়াশ। আমিও ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। সোজাসুজি বললাম,
–“কি চাই এখানে আপনার? আপনি এখানে কি করে এলেন?”

–“জীবনে প্রথমবার আয়াশ রায়হান চোরের মতো কারো বাড়িতে ঢুকতে হলো। পাঁচিল টপকে এই বাড়ির রান্নাঘরে যেই ফাঁকা আর গ্রিল ছাড়া জানালা আছে সেখাম দিয়ে পা টিপে টিপে ঢুকতে হয়েছে। তুমি কোন ঘরে ঘুমিয়েছো সেটা দেখতে গিয়ে ভুল করে তোমার সো কলড কাজিনের ঘরে গিয়েছিলাম। আর একটু হলেই ধরা পড়তাম। তোমার কি মনে হয় না যে আমার এমন ভালোবাসা দেখে এখন তোমার আমায় জাপ্টে ধরা উচিত?”

চোখজোড়া ছোট ছোট হয়ে এলো। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বললাম,
–“কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে এসেছেন বুঝি?”

–“তোমার কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে আসব কেন? আমি তো এসেছি আমার পাগলামি শান্ত করতে।”

বেশ স্বাভাবিক গলায় বললেন আয়াশ। আমি তা শুনে ঠেস মেরে বললাম,
–“হ্যাঁ সেই তো! আপনি তো নিজেরটা ছাড়া কিছু দেখতেই পান না। সবসময় নিজেরটা হলেই সব ঠিক হয়। কেন অন্যের সুখ-দুঃখের কথা ভাবতে পারেন মাঝে মাঝে। শুধুমাত্র আপনার জেদ, ইচ্ছে, রাগের জন্য সকলের জীবন বিপন্ন করতে আপনি রাজি। প্রথমে তো আমাকে জোর করে বিয়ে করলেন তারপর এভাবে জঘন্য প্লান করে জাস্ট বাড়ি থেকে বের করে দিতেও পিছুপা হলেন না।”

বলেই রাজ্যের পানি জমা হলো আমার চোখে। ঢক গিলে বারংবার নিজের কান্না লুকিয়ে চেষ্টা করতেও ব্যর্থ হয়েও অবশেষে আমার চোখ গড়িয়ে পানি পড়েই গেল। ডান চোখ দিয়ে পানি গড়াতেই আমার গালে গাল ঘষে দিলেন আয়াশ। আমি উনার বুকে কিল মেরে রাগ-দুঃখ মিশ্র কন্ঠে বললাম,
–“সরুন! স্পর্শ করবেন না আমাকে।”

–“তোমার কষ্টটা ঠিক কি কারণে নিশাপাখি? তোমাকে বাড়ি থেকে এভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে সেকারণে নাকি আমি এই কাজটা করেছি সেটা ধারণা করতে পেরেছো সেকারণে?”

কিছু বলতে উদ্যত হলেও থমকে গেলাম। মনের কোণে প্রশ্ন উঁকি দিয়ে বলল, ‘সত্যিই তো! আসলে আমার এতো বিরহ কেন? এই বাজে লোকটার জন্য?’

–“এই উত্তর দিতে বলব না। কারণ আমি জানি সত্যিটা লুকিয়ে যাওয়া তোমার স্বভাব। তুমি সরল মেয়ে হলেও আমার জন্য যেসব অনুভূতি উপচে পড়তে চাইলেও সেগুলোতে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাও। এটাই তার কারণ।”

আমি বাকহারা হয়ে স্থির হয়ে বসে রয়েছি। আয়াশ আমার মাথা নেড়ে দিয়ে যাচ্ছেন আর শান্ত ভঙ্গিতে কথা বলছেন। যেন আমি কোনো ছোট বাচ্চা আর আমাকে শান্ত ভাবে বোঝানো হচ্ছে। আমি মিনমিন করে বলে উঠলাম,
–“আপনি খুব স্বার্থপর!”

–“এটা তুমি একদম ঠিক কথা বলেছো। আমার মতো স্বার্থপর মানুষ আর দুটো হয় না। আমি তোমায় স্বার্থের জন্যই বিয়ে করেছি। শুধু নিজের স্বার্থে। তুমি আমার মনে প্রশান্তি এনে দেওয়ার কারণ, তোমার হাসি আমার মস্তিষ্ক শান্ত করে দেওয়ার কারণ। এসবের জন্য হলেও তোমাকে চাই। আই এম অ্যা বিগ সেলফিশ।”

আমার কানের পাশ থেকে চুল সরিয়ে ফিসফিস করে কথাগুলো একনাগাড়ে বললেন আয়াশ। আশেপাশে কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতার পর আমার হৃৎস্পন্দন ঘোড়ার গতিতে ছুটতে শুরু করল।

–“তাহলে কেন এতোটা লেইম প্ল্যান করলেন? সত্যি বলতে কি জানেন তো! আপনার কথাগুলে সত্যি মনে হয়। কিন্তু আজকে আমার সঙ্গে যা যা করেছেন আমার সবটা অবিশ্বাস্য লাগছে।”

কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম আমি। আয়াশ সঙ্গে সঙ্গেই হাসা শুরু করলেন। উনার হাসার কারণ খুঁজে না পেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম আমি। উনি হাসতে হাসতেই বললেন,
–“বাট দ্যা রিয়েলিটি ইজ, আমি তোমায় আমার বাড়ি থেকে কেন নিজের মন থেকে বের করার আগেই মরে যাব।”

বুক ধক করে উঠল। কি অসহ্যকর অনুভূতি! অসহ্যকর সঙ্গে সুন্দরও বটে। এমন অনুভূতিও হয় যেটাতে অসহ্য আর সুন্দর দুটোই মিশ্রিত থাকে? আমি কিছু বলার আগেই আয়াশ নিজ থেকে বলে উঠলেন,
–“সব ওই নোংরা মহিলার কাজ। পারলে মার্ডার করে দিতাম! আই হেট দিস ওমেন।”

এক দফা চমকে উঠলাম আয়াশের কথায়। উনার মা এসব কান্ড ঘটিয়েছেন? আমি অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
–“আ…আপনার মা? কিন্তু ড্রাইভারটা বলল যে আপনি?”

–“এর আগেও বলেছি এখনো বলছি নিশাপাখি উনাকে আমার মা বলে অন্তত ‘মা’ এর মতো পবিত্র শব্দটাকে অসম্মান করবে না। যেই মায়ের নিচে জান্নাত থাকে সেই মা কখনোই এমন হতে পারে না। সি ইজ নট মাই মাদার। ওই মহিলা কারোর মা হওয়ার যোগ্যতাই রাখে না। আর বাকি রইল ড্রাইভারের কথা? বাড়ির যেই ড্রাইভার তাকে ওই মহিলা ছুটি দিয়ে দিয়েছিল। আর যেই ড্রাইভার তোমায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়েছে তাকে আমি চিনতাম না। তবে হ্যাঁ আমার ড্রাইভারের বাড়ির পাশেই বাড়ি ছিল বলে আজ রাতেই ওর বাড়িতে গিয়ে তোমার খোঁজ পেয়েছি। সাভারে গিয়েছিলাম। তোমায় যেই জঙ্গলের পর মেইন রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল সেখানে। সেখানে টং এর দোকানদারকে জিজ্ঞেস করায় তোমার ছবি দেখানোর পর সে তোমায় চিনতে পেরে বলেছিল তোমার নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে। বিশ্বাস করো, তখন মনে হচ্ছিল আমি হয়ত তোমায় হারিয়ে ফেলেছি। আমি আমার প্রাণভোমরা হারিয়ে ফেলেছি।”

বলেই বড় শ্বাস নেন আয়াশ। উনার বলা প্রতিটা শব্দে আমার ভুল ধারণা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমিও যেন এটাই চাইছিলাম। মিথ্যে হয়ে যাক আমার মনে থাকা ভুল ধারণাগুলো। মুছে যাক আয়াশের বিরুদ্ধে থাকা কথাগুলো। আবার আয়াশ বলতে শুরু করেন।

–“তারপর জানতে পারি সেখানকার আশেপাশেই কোনো হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তোমায়। আমি খোঁজ করি। এট লাস্ট হসপিটাল পাই কিন্তু তুমি ছিলে না। হঠাৎ করেই মনে হয় ওই ড্রাইভার তো আমার নাম করে তোমায় জঙ্গলে ফেলে এসেছে। তাই হয়তবা তুমিও স্বাভাবিকভাবে আমাকে দোষী ভাবছো। তাই আমার কাছে আসো নি। আমি আবার খবর নিই ঢাকার মধ্যে বা আশেপাশে তোমার কোনো আত্মীয়ের বাড়ি আছে কিনা। জানতে সফল হই। এখানে তোমার মামার বাড়ি। তোমার মামা তোমায় অনেকটা ভালোবাসেন। নিজের মেয়ের চোখে দেখেন। তাই আমি সিউর হই তুমি এখানেই আসবে। আর দেখো আই এম নট রং!”

আমি স্তব্ধ! দেওয়ালের সঙ্গে নিজের মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করল। নিজেকে মনে মনে হাজারটা বকাঝকা করলাম। এ কাকে অবিশ্বাস করেছিলাম আমি? উনাকে অবিশ্বাস করার অপরাধে চোখ ভর্তি পানি এলো।

–“তোমাকে যে কেন আমার #মনের_অন্দরমহলে লুকিয়ে রাখতে পারি না!”

স্নিগ্ধ ভরা কন্ঠ আয়াশের। আমাকে মাতাল করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। আয়াশকে সরি বলার জন্য ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে আমার। উনি আমার গাল আলতো স্পর্শ করে বললেন…..
–“তোমায় পেয়েছি। এখন ওই ড্রাইভারকে আমি মেরে ফেলব। ওর বাঁচার কোনো অধিকার নেই।”

এবার আমি উনার ঠোঁট চেপে ধরলাম। মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে বললাম,
–“না! আপনি আইনজীবী। আইনের রক্ষক। আপনাকে এসব মানায় না।”

আয়াশ আমার হাত সরিয়ে ফেললেন। বায়না ধরা কন্ঠে বললেন,
–“তাহলে আমায় জড়িয়ে ধরো। তাহলে এসব করব না।”

মিইয়ে গেলাম আমি। কান গরম হয়ে গেল। কপাল কুঁচকে এলো। কিছুটা লজ্জা পেলাম। আয়াশ হেঁসে দিয়ে বললেন,
–“তোমায় জড়িয়ে ধরতে হবে না। আমিই জড়িয়ে ধরছি আসো।”

বলেই দুহাতে আমাকে জাপ্টে ধরলেন আয়াশ। আজ আমি ছটফট করলাম না ছাড়া পাবার জন্য। এই স্পর্শ খুব শীতল! বরণ আস্তে আস্তে নিজের কাঁপা কাঁপা হাতজোড়া তুলে আয়াশের পিঠে রাখলাম। এই মূহুর্ত কি এখানেই থামিয়ে দেওয়া যায় না?

চলবে…

[বি.দ্র. আনিশা চরিত্র প্রচন্ড চাপা স্বভাবের। আয়াশের মনে ওর জন্য অনুভূতি আছে কিনা সেটা আয়াশকেই বুঝে নিতে হবে আর আপনাদেরকেও। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজকের পর্ব ছোট হয়ে গেছে জানি। তবে আজ আমি ব্যস্ত।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here