হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
২১.
প্রখর রোদে মাঠের এক কোনে ঘাসের উপর বসে আছে সোহিনী, দোহা, মেঘ, ইমন আর সূর্য। কাধে তাদের ব্যাগ, হাতে কোকা কোলার বোতল। দুপুরের সময় হওয়ায় শিক্ষার্থীরা গিজগিজ করছে চারদিকে। ভাপ্সা গরমে অস্বস্তি লাগছে তাদের। দোহা বইয়ে ঠাসা ব্যাগ কোলের উপর নামিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। বললো,
‘এই রোদের মধ্যে বসে থাকার কোনো মানে হয়?’
‘তোর জন্য মহল তৈরি করবো না কি?’
ইমনের তাচ্ছিল্য মাখা কথায় মুখ ফুলায় দোহা। রাগি গলায় বলে,
‘আমি ছায়ায় বসার কথা বলছি।’
মেঘ কোকা কোলায় চুমুক বসিয়ে বললো,
‘ছায়া কোথায় পাবি এখন? রাস্তার ওইদিকে যাওয়া বারণ আছে। কি সব কাজ হচ্ছে! এখানেই বসতে হবে।’
‘এখানে বসার থেকে ভালো লাইব্রেরি বা কমন রুমে,,,,,’
দোহার কথার মাঝেই সূর্য বললো,
‘কমন রুমে আমি যামু না। আর ওই লাইব্রেরিতে? জনমেও না! ওই খচ্চর মহিলা খালি বকে। শান্তিতে কথাও কইতে দেয় না। মনটা চায়,,,, থাক কইলাম না।’
দোহা মুখ ফুলায়। সোহিনী শাড়ির আঁচলের কোনা দিয়ে নিজেকে বাতাস করে। কালো মুখটা রোদের তাপে আরো কালো দেখাচ্ছে। কপালের মাঝখানে লাগানো টিপটা ভ্রুয়ের কাছাকাছি নেমে এসেছে। নাকের ডগায় জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের উল্টো পিঠে মুছে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বললো,
‘এরপরের ক্লাসটা করা কি জ্বরুরী? না হলে, চলো বাড়ি যাই। এই গরম আর সহ্য হয় না।’
সূর্য রহস্যময় হাসি দিয়ে বললো,
‘ তুমি মামা রোজ রোজ শাড়ি পরো ক্যান? ঘটনা কি? আমাগো মেঘরে পটানো এতো সোজা না!’
মেঘ তড়িৎ গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে কৌতুহলী গলায় বললো,
‘আমার কথা উঠলো কেনো?’
‘তোমার কথা উঠবো না তো কার কথা উঠবো? দুইজনার চোখাচোখি, হাসাহাসি, ম্যাচিং কাপড় সবই তো নজরে পরে না কি!’
সূর্য থামতেই সোহিনী নিজের দিকে তাকালো। চোখ ফিরিয়ে মেঘকে দেখে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো সে। ইমন ঠোঁট টিপে হেসে বললো,
‘সত্যিই তো! তোরা দেখি এক রঙের পোশাক পরে আছিস। ব্যাপার কি?’
দোহা আয়েসি গলায় বললো,
‘এখানে ব্যাপারের কি আছে বুঝলাম না! ভাই বোনও তো এক রঙের পোশাক পরে না কি? ওরা পরলে দোষের কি?’
সূর্য এগিয়ে গিয়ে দোহার মাথায় টোকা মারলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,
‘কোথায় আমি ওদের প্রেমিক প্রেমিকা বানাতে চাইছি আর তুই ভাই বোনের ব্যাখ্যা দিস! গাধী!’
‘তোকে কে বলেছে আমাদের প্রেমিক প্রেমিকা বানাতে? না আমি বলেছি আর না মেঘ বলেছে। শুধু শুধু আজাইরা কাজ করিস কেনো?’
‘এটা আজাইরা কাজ না রে পাগলী, পূণ্যের কাজ। তুই বুঝবি না। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, অতি শিঘ্রই মেঘ আর সোহিনীর জুনিয়র ভার্সন দুনিয়ায় আসবে।’
সূর্যের কথা বলার ভাব ভঙ্গীতে হাসি পেলেও শেষের কথায় আঁত্কে উঠলো সবাই। দোহা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
‘কি বাজে বকছিস সূর্য! বিয়ে না করেই বাচ্চা?’
দোহাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সূর্য বলতে লাগলো,
‘এক্সেক্টলি! বাচ্চা যখন দুনিয়ায় আসবেই তাহলে তোদের উচিত বিয়ে করে নেয়া। বিয়ে ছাড়া বাচ্চা, সমাজ মানবে না। তোদের পরিবারও না। আমার কথা শোন, চল এখন বেরিয়ে সোজা কাজি অফিসে যাই। তারপর রেজিস্ট্রি করে বাবা মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়া। মেনে নিলে ধুমধাম করে সেলিব্রিশন হবে আর না মানলে ছোটখাট ট্রীট!’
মেঘ এবার দু হাতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো সূর্যকে। সূর্য ঘাসের উপর শুয়ে পরে চোখ রাঙিয়ে বললো,
‘দোস্ত, তোর সোহিনী ওইদিকে। আমারে সোহিনী মনে করে কিছু করতে আসিস না আবার! সবাই কি ভাববে! ছিহ!’
মেঘ এলোপাথারি মারতে লাগলো সূর্যকে। সূর্যও নিজেকে বাঁচাতে মেঘকে কিল ঘুষি দিচ্ছে। ইমন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দোহা চোখ মুখ কুঁচকে এদের কান্ড কারখানা দেখছে। সোহিনী চেহারা অন্ধকার করে বসে রইলো কিছুক্ষন। তারপর ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে তাতে সময় দেখলো। তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
‘ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। তোরা কি খুন খারাবি করবি? করলে বল, আমরা যাই।’
সূর্য আর মেঘের হাতাহাতি থামলো। দুজনেই নিজেদের কলার, শার্ট, চুল ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো। দুজনেই হাঁপাচ্ছে। মেঘ শ্বাস টেনে টেনে বললো,
‘আর একদিন যদি এই ধরনের ফাউল কথা বলিস তাহলে নির্ঘাত তুই আমার হাতে খুন হবি।’
‘ওই দিনের অপেক্ষায় আছি। তবে তুই যাই বল না কেনো, আমার কথাগুলা ফাউল ছিলো না। ইন ফ্যাক্ট লজিকাল ছিলো।’
___________________
দিনের আলো নিভে গেছে। রাতের আঁধার ঘন হচ্ছে। নান্দনিক এক পার্কের বাইরের ফুটপাতে বাতাম চিবোচ্ছে হিমি। সাথে তার বাইক নেই আজ। তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় বাইক চালানো হলো না তার। আজ বিকেল থেকেই পা চালিয়ে সব জায়গায় যাচ্ছে হিমি। পকেটে কিছু খুচরো ছিলো। তা থেকেই দশটাকার বাদাম কিনেছে। বাকি কিছু চা খাওয়ার জন্য রাখা আছে। মাথা ব্যথার মহৌষধ যে চা তা হিমি সেই ছোটবেলা থেকেই জানে। ছোটবেলা থেকেই চা খেয়ে অভ্যস্ত হওয়ায় এখন চা ছাড়া চলে না তার। বাড়িতে স্বস্তি না পেলেও রাস্তার পাশের চায়ের দোকান গুলোতে জম্পেশ আড্ডার সাথে কড়া চায় মেলে। বাদাম খেতে খেতেই পার্কের গেইটের কাছে পৌঁছালো হিমি। ঘাড় বাঁকিয়ে পার্কের ভেতরে চোখ বুলালো। রাতের অন্ধকার ছোঁয় নি পার্কের ভেতর। চারদিকে লাইট জ্বলছে। ভেতরে বুঝি কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছে! হৈ হল্লুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পার্কের মতো নিরিবিলি জায়গায় অনুষ্ঠান করে চেঁচামেচি করার কি মানে খুঁজে পায় না হিমি। হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো সে। পাশ ফিরতে গিয়েই মুখোমুখি হলো কাঙ্খিত ব্যাক্তির। সকালের ইস্ত্রি করা কাপড়ের ভাজ নষ্ট হয়েছে খানিক। চুলগুলো এখনো পরিপাটি। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমায় ঢাকা পরেছে ঘন পল্লব। হিমিকে তার দিকে পলকহীন তাকাতে দেখে হাত উচিয়ে তুরি বাজালো তাহির। হিমির ধ্যান ভাঙলো। ঠোঙা থেকে আরো কয়েকটা বাদাম হাতে তোলে খোসা ছাড়ালো সে। হাতের তালুতে ফু দিয়ে খোসা গুলো উড়িয়ে দিলো বাতাসে। খোসা ছাড়ানো বাদাম মুখে দিয়ে ভ্রু নাচালো। তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে বললো,
‘আমার পিয়ানো?’
হিমি মুখ ভর্তি বাদাম চিবোতে চিবোতে তাহিরকে পাশ কাটিয়ে এগুলো। হিমির জবাব না দিয়ে চলে যাওয়া দেখে তাহির ভড়কে গেলো। হিমিকে ফলো করে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’
‘জাহান্নামে!’
‘বেশ। তবে যাওয়ার আগে পিয়ানো তো দিয়ে যান।’
হিমি থামলো। পেছন ফিরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তাহিরের উদ্দেশ্যে বললো,
‘এতোই যখন প্রিয় তখন আগে আসা উচিত ছিলো। আমি কতক্ষন ধরে আপনার অপেক্ষা করছি কোনো আইডিয়া আছে?’
‘হাসপাতালের কাজ ফেলে হুট করে চলে আসা যায় না। অন্য একজনকে আমার শিডিউল দিয়ে তবেই এসেছি। একটু তো দেরি হবেই! আচ্ছা, আই এম এক্সট্রিমলি সরি। এবার তো দিন।’
তাহিরের অনুরোধ করে বলা কথাগুলো শোনে হিমির মন গললো। প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট পিয়ানো বের করে তাহিরের দিকে এগিয়ে দিতেই কারো ধাক্কা লাগলো। হিমির হাত ফসকে পিয়ানো পরে যেতে নিলে লুফে নিলো তাহির। পিয়ানো নিজ হাতে নিয়ে বুকের সাথে লাগিয়ে ঘন গাঢ় শ্বাস ফেললো। চোখ বোজে স্বস্তির নিঃশ্বাস টেনে বললো,
‘এক্ষুনি পরে ভেঙে যেতো! থ্যাঙ্ক গড!’
হিমি শান্ত গভীর চোখে দেখলো তাহিরকে। ফাঁকা ঠোঙা মুঠোয় নিয়ে মুচরে ছুড়ে ফেললো। দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা বাদামের টুকরো জিব দিয়ে বের করে থু করে ফেলে দিলো দুরে। ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘আপনি এই পুরনো নষ্ট পিয়ানোকে এতো ভালোবাসেন কেনো?’
তাহির কৌতুহল নিয়ে বললো,
‘নষ্ট? পিয়ানো নষ্ট হয়ে গেছে?’
হিমি মৃদু হাসলো। বললো,
‘উহু, আমি খালি দেখছিলাম। আপনার রিয়েকশন! আপনি জানেন না পিয়ানো নষ্ট না ঠিক? শেষ কবে চালিয়েছিলেন?’
তাহির আমতা আমতা করে বললো,
‘কখনো চালাই নি।’
‘চালান নি! কেনো?’
‘আমি চালাতে জানি না।’
‘তাহলে এটা নিজের কাছে রেখেছেন কেনো?’
‘আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ এটা আমায় দিয়েছিলেন। সে মানুষটা আমার কাছে নেই। তার স্মৃতি ভেবেই রেখে দিয়েছি।’
হিমি মাথা দুলালো। পকেটে দু হাত গুজে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে বললো
‘চলে যাবেন?’
তাহির জবাব দিলো না। পিয়ানো কোটের পকেটে রেখে কয়েক কদম এগুলো। হিমিও পা মেলালো তার সাথে। কৌতুহলী গলায় বললো,
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
তাহির ঘাড় কাত করে বললো,
‘হাসপাতালে।’
‘গাড়ি কোথায় আপনার? আনেন নি?’
তাহির হাঁটতে হাঁটতেই বললো,
‘না। সকালে গাড়ি সাথে করে নিয়ে যাই নি তাই রিকশা করেই আসা যাওয়া করছি। আপনি বাড়ি ফিরবেন না?’
‘ফিরবো। তবে চা খেয়ে।’
তাহির থমকালো। বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘চা খেয়ে বাড়ি ফিরবেন! বাড়ি গিয়েও তো চা খেতে পারেন। না কি আমার মতো আপনাকে কেউ চা খেতে দেয় না?’
হিমি পাল্টা প্রশ্ন করলো,
‘আপনাকে চা খেতে দেয় না মানে? আপনি চা খান না?’
তাহির মাথা নেড়ে নাকচ করে আবারও হাঁটায় মনোযোগী হলো। হিমি পায়ের গতি বাড়িয়ে চলতে লাগলো। তাহিরের পাশাপাশি পৌঁছে বললো,
‘চা না খেয়ে আপনি থাকেন কি করে? মাথা ব্যথা করে না?’
তাহির নিঃশব্দে হাসলো। ভ্রু চুলকে বললো,
‘মাথা ব্যথা করলে ব্ল্যাক কফি খাই। চেম্বারে একবার খেয়েছিলাম চা। ভালোই লেগেছে।’
হিমি মুখ বাঁকিয়ে বললো,
‘আপনার চেম্বারে খেয়েছেন?’
তাহির মাথা উপর নীচ করলো। হিমি তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
‘ওটা কোনো চা হলো? আসল চা আমি আপনাকে খাওয়াবো। যেমন স্বাদ তেমন সুগন্ধ! আহা,,,, ভাবলেই মন শান্ত হয়ে যায়। মাথা ঠান্ডা হয়ে যায়। আর বুকে প্রশান্তি নামে। আসুন আসুন!’
কথাটা বলেই তাহিরের এক হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো হিমি। তাহির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে এতে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
‘আরে আমি চা খাবো না! ছাড়ুন। আমায় যেতে হবে। দেরি হয়ে যাবে তো! হিমি?’
‘ছাড়বো না। আগে চা খাবেন তারপর যাবেন। দেরি হবে না প্রমিস!’
‘কিন্তু আমি চা খেতে চাইছি না। বুঝার চেষ্টা করুন।’
হিমি তাহিরের দিকে ফিরলো। হাতটা শক্ত করে ধরে রেখে ঠোঁট উল্টে বললো,
‘প্লিজ, এক কাপ! আমি আটকাবো না আর। সত্যি বলছি। মাথা ব্যথার সাথে সাথে আপনার দুশ্চিন্তাও গায়েব হয়ে যাবে। চলুন না!’
তাহির কথা বাড়ালো না আর। হিমি প্রশস্ত হেসে তাহিরকে নিয়ে এগুতে থাকলো। তাহির বাঁধা দিলো না। এতদিন শুধু বাচ্চাদের ঠোঁট উল্টাতে দেখেছে তাহির। আজ প্রথমবার বাচ্চা ছাড়াও অন্য কাউকে ঠোঁট উল্টাতে দেখলো। বাচ্চাদের তরুণী এক মেয়েকে রিকুয়েস্ট করতে দেখলো। তাহিরের মনে প্রশ্ন জাগলো, এই মেয়ে কি বাচ্চাদের মতোই দৌঁড়ঝাঁপ করে? কাঁদে? হাসে? প্রশ্নগুলো করা হয় না তার। সব প্রশ্ন করতে নেই। উত্তরও খুঁজতে নেই। শুধু লুকিয়ে রাখতে হয়। প্রশ্নগুলো মনে খুব গোপনে থাকে। তাদের সেখানেই থাকতে দেয়া উচিত।
চলবে,,,,,,,,,,,