হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
২৩.
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে অথৈ। অন্যমনস্ক হয়ে আছে সে। পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরে অথৈর কাধে থুতনি রাখলো ইয়াসির। আয়নায় অথৈর প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,
-কি ভাবছো?
অথৈ কিছুটা চমকালো। চিরুনি টেবিলে রেখে আলতো হাতে চুল ঠিক করে শীতল গলায় বললো,
-কিছু না।
ইয়াসির ভ্রু কুঁচকালো। বললো,
-মন খারাপ?
অথৈ মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে ইয়াসিরের থেকে নিজেকে ছাড়ালো। থমথমে চেহারায় সামান্য হাসি ফুটিয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করে দরজার দিকে এগুতেই ডান হাতের কব্জি ধরে হেঁচকা টান দেয় ইয়াসির। অথৈ তাল সামলাতে না পেরে হুমরি খেয়ে ইয়াসিরের বুকে পরে। কটমট চোখে তাকিয়ে বলে,
-কি হচ্ছে কি এসব? ভার্সিটি যেতে দেরি হচ্ছে না আপনার?
ইয়াসির দুষ্টু হাসলো। কাতর গলায় বললো,
-সুন্দরী বউ থাকলে আজীবন ভার্সিটি না গেলেও চলে!
অথৈ লজ্জা পেলো না মোটে। শান্ত গলায় বললো,
-আমায় ছাড়ুন। আপনি তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট করুন এসে।
ইয়াসির ছাড়লো না। বরং দু হাতে অথৈর কোমর আটকে দাঁড়িয়ে রইলো। অথৈ ক্লান্ত গলায় বললো,
-ছাড়ুন না।
-আগে বলো, কি হয়েছে?
-বললাম তো কিছু না।
-কিছু তো অবশ্যই আছে অথৈ। হয় কোনো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করছো নয়তো এমন কিছু হয়েছে যার জন্য তোমার মন খারাপ।
অথৈ চোখ সরালো। ইয়াসির জোর গলায় বললো,
-বলো!
-মিশুকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।
ইয়াসির কপাল কুঁচকালো। কৌতুহলী গলায় বললো,
-কিসের চিন্তা?
অথৈ সাহস যুগিয়ে বলতে শুরু করলো,
-মিশুর কিছু হয়েছে জানেন! ও খুব আপসেট থাকে। আমার মনে হয় ও আমাদের বিয়েতে খুশি নয়।
ইয়াসির গোল গোল চোখ করে বললো,
-বিয়েতে খুশি নয় মানে? বোনের বিয়েতে খুশি হবে না তা কি করে হয়? আই থিংক ও তোমায় মিস করছে। তাই আপসেট লাগছে।
-না। যদি তাই হবে তাহলে বিয়ের পর যতোদিন ওবাড়ি ছিলাম ততোদিন তো ও আমার সাথে থাকতো। গল্প করতো, কথা বলতো। সেসব কিছুই করে নি। উল্টো, দূরে দূরে থেকেছে। ইন ফ্যাক্ট মনে হচ্ছিলো ও আমার থেকে পালাচ্ছে।
-ধূর! কি যে বলো! ওসব কিছু না। আসলে, এতোদিন একসাথে থেকেছে হুট করে তোমার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় খুব একা হয়ে গেছে সে।
-আপনি বুঝতে পারছেন না। আমি বরং প্রথম থেকে বলি।
ইয়াসির মাথা ঝাকালো। অথৈ ইনোসেন্ট ফেইস করে বলতে লাগলো,
-আপনাকে বলেছিলাম না, ছোটবেলা থেকে আমরা বন্ধুর মতো ছিলাম! একে অন্যকে ছাড়া একদিন কোথাও থাকতাম না অব্দি। সব সময় সব কিছু একসাথে করতাম। এমনকি ঈদের জামাটাও সেইম কিনতাম। মিশু কখনোই আমার থেকে কিছু লুকোতো না। আমিও ওকে সব বলতাম। কিন্তু, এখন ও অন্যরকম হয়ে গেছে। আমার বিয়ে নিয়ে আমি যতোটা এক্সাইটেড থাকতাম তার থেকেও বেশি ও থাকতো। অথচ বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে ও চুপসে গেছিলো। ও এক্সাইটেড ছিলো না। বিয়ের শপিং এও যায় নি আমাদের সাথে। এঙ্গেইজমেন্টের দিনও উৎসাহিত ছিলো না মিশু। আমাকে হলুদও দেয় নি! বিয়ের দিন তো সকাল থেকেই গায়েব ছিলো। পরে জানলাম ওর বান্ধবীর শরীর খারাপ ছিলো তাই চলে গেছিলো। আমাদের ওয়ালিমাতেও আসে নি। ও বাড়ি যাওয়ার পরও সরে সরে থাকছিলো। এবার বলুন, আমার চলে যাওয়ায় আপসেট? না কি অন্য কোনো কারনে?
ইয়াসির কিছু একটা ভাবলো। মৃদু হেসে বললো,
-কল করো ওকে। হয়তো তখন আমি থাকায় কথা বলতে আনকম্ফোর্টেবল ফিল করছিলো। ফোন কলে কথা বলতে অসুবিধা হবে না নিশ্চয়।
অথৈ গাল ফুলিয়ে বললো,
-করেছিলাম। কেটে দেয় নয়তো বাজতে বাজতে রিং কাটে। উঠায় না আমার ফোন। চাচিমনিকে কল করেছিলাম। মিশুকে দিয়েওছিলেন। ও হা হু করে রেখে দেয়।
ইয়াসির ছোট্ট শ্বাস টেনে বললো,
-ভাববার বিষয়। এক মাত্র শালী সাহেবার মন খারাপের রহস্য উদঘাটন করতে হবে। নয়তো একমাত্র বউয়ের মনে মেঘ জমবে!
অথৈ উচ্ছাসিত গলায় বললো,
-ও তো আপনার ভার্সিটিতেই পড়ে। কথা বলবেন ওর সাথে?
-আচ্ছা বলবো।
-আচ্ছা না আজই বলবেন বলুন! যেভাবেই হোক ওর মন ভালো করবেন!
ইয়াসির হাসলো। অথৈর কপালে কপাল দিয়ে হালকা বারি মেরে বললো,
-যা বলবে সব করবো এখন হাসো।
_____________________
সকালের প্যাশেন্ট দেখা শেষ হয়েছে। এখন আপাতত কারো কোনো এপোয়েন্টমেন্ট নেই। তাহির তাই হাত পা টান টান করে বসলো। ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছে তার। অ্যাসিস্টেন্টকে ডেকে কফি আনতে নির্দেশ দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে আয়েস করে বসলো সে। চোখ দুটো বোজে রাখলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রে তে করে কফি মগ নিয়ে ঢুকলো রেজা। টেবিলে কফি রেখে বাইরে বেরুলো সে। তাহির চোখ খোললো। চশমা নাকের উপর ঠেলে দিয়ে কাপ হাতে উঠালো। দু এক চুমুক কফি খেয়ে মুখ তেতো লাগলো তার। অথচ এই কফিটাই রোজ তিন চারবার খায়। আজ এতো বিশ্রী লাগছে কেনো? কারন উদ্ধার করতে গিয়ে মনে পরলো সুমিষ্ট চায়ের কথা! গতকাল হিমির খাওয়ানো চা অতিরিক্ত মিষ্টি হলেও দারুণ স্বাদের ছিলো। তাহিরের হুট করেই সেই চা খেতে মন চাইছে। হাত থেকে কফি মগ নামিয়ে সাইলেন্ট করে রাখা মোবাইল হাতে উঠালো। কল লিস্ট স্ক্রল করে কাঙ্খিত নাম্বারে কল লাগালো তাহির। প্রথমবার রিং হতেই ফোন উঠিয়ে কানে ঠেকালো হিমি। ব্যস্ত গলায় বললো,
-হ্যা বাচ্চা ডাক্তার! বলুন।
হিমি গলা কেশে বললো,
-আপনি কি ব্যস্ত?
-প্রচুর। কেনো?
তাহির অপ্রস্তুত গলায় বললো,
-আজকে দেখা করতে পারবেন?
হিমি অবাক হওয়া গলায় বললো,
-আপনার আর কোনো জিনিস আমার কাছে রয়ে গেছে বুঝি?
তাহির হাসার চেষ্টা করে বললো,
-না তা নয়।
-তবে?
হিমির সহজ স্পষ্ট প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো তাহির। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,
-আমার প্রয়োজন ছিলো কিছু। দেখা হলে বলতাম।
-আজ তো পারছি না বাচ্চা ডাক্তার!
তাহির বাচ্চাদের মতো করেই বললো,
-কেনো?
-পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে।
তাহির স্মিত গলায় বললো,
-আপনাকে?
-উহু,, দোহাকে।
-দোহা কে?
হিমি বুক ভরে শ্বাস টেনে বললো,
-হ্যা দোহা কে।
তাহির আবারও বললো,
-আমি আপনার কথা রিপিট করি নি হিমি। জানতে চেয়েছি, দোহা কে?
হিমি খাটে পা তোলে বসলো। শীতল কন্ঠে বললো,
-আমার ফ্রেন্ড। প্রথমবারের মতো ওকে দেখতে আসছে তো তাই বেচারি নার্ভাস হয়ে পরেছে। ওর নার্ভাসন্যাস দূর করতে আর সাহস যুগাতেই এখানে আমাদের মানে বন্ধুদের থাকতে হবে।
তাহির আনুনয়ের সূর তোলে বললো,
-সন্ধ্যের দিকেও ফ্রী হবেন না?
হিমি ভাবলো। বললো,
-হয়তো না।
তাহির মুখ ছোট করলো। গাঢ় শ্বাস টেনে বাই বলে ফোন কাটতে নিলেই হিমি বলে উঠলো,
-রাতে সময় হবে আপনার?
তাহির চমকে উঠা গলায় বললো,
-কখন?
-এই যেমন ধরুন, এগারোটার দিকে?
তাহির মৃদু হেসে ছোট্ট করে বললো,
-হু।
হিমি বালিশে ঠেস দিয়ে বসে বললো,
-ডান। তাহলে এগারোটায় দেখা হচ্ছে! ব্রীজে কিন্তু!
তাহির সম্মতি জানিয়ে ফোন কাটলো। হিমি ফোন বিছানার উপর রাখতেই তার দিকে ঝুঁকে পরলো সোহিনী আর দোহা। হিমি নাচালো। সোহিনী বাঁকা হেসে বললো,
-ডাক্তারের সাথে ঘন ঘন দেখা করার কারন কি দোস্ত?
-ডাক্তার বুঝি তোকে না দেখে থাকতে পারছে না?
দোহার কথা শুনে রাগ লাগলেও কিছু বললো না হিমি। সোহিনী মজা করে বললো,
-ও কি পারছে তার বাচ্চা ডাক্তারকে না দেখে থাকতে? দেখিস না, কল আসা মাত্র রিসিভ করে নিলো। কি মধুর সুরে কথাও বললো। ব্রীজে আবার দেখাও করবে রাতে। ঘটনা তো অনেক দূর এগুলো সখি!
হিমি ঠোঁট চওড়া করলো। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে বললো,
-আর একটু পরই কিন্তু ওরা আসছে। তুই ঠিক আছিস দোহা?
শুরু দোহার ভয়। বুকটা তার দূরুদুরু করছে। হাত পা অসার হয়ে আসছে। ঢোক গিলে অসহায় দৃষ্টিতে হিমি আর সোহিনীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-প্লিজ আম্মুকে বল না আমি যাবো না ওদের সামনে। আমার কেমন কেমন লাগছে। নির্ঘাত ওদের সামনে আবোল তাবোল কোনো কান্ড করে ফেলবো। মান সম্মান তো যাবেই সাথে কেঁদে দিলে কেল্লাফতে।
-চুপ করে বসে থাক। রিলেক্স হ। মান সম্মান গেলে যাক কান্না কাটি করা যাবে না। দেড় ঘন্টা ধরে করা মেক আপ নষ্ট করবি তো খবর আছে!
সোহিনীর কথা শুনে হেসে দিলো হিমি। দোহা ঠোঁট উল্টে বললো,
-দোস্ত আমি এই শাড়ি পরে হাঁটতে পারবো না। ট্রাস্ট মি, পরে যাবো। আমার এখনই কান্না পাচ্ছে।
হিমি সান্তনা দিয়ে বললো,
-পরবি না। সোজা হয়ে আস্তে আস্তে হাঁটবি। বসার ঘরে গিয়েই সোফায় বসে পরবি। ব্যস।
দোহা ভাবুক গলায় বললো,
-এই আমায় কোন সূরাটা বলতে বলবে রে? আমি তো সব গুলিয়ে ফেলছি। কোনটা রিহার্স করবো? হিমি, বল না কোনটা?
হিমি বিরক্তি নিয়ে সোহিনীকে সরতে বলে খাটে শুয়ে পরলো। দোহা ভ্রু কুঁচকালো। হিমি চোখ বোজে রেখে বললো,
-সেই সকাল থেকে তোর এক গাদা ফাউল প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। এখন যা জিজ্ঞেস করার সোহুকে জিজ্ঞেস কর। আমাকে ঘুমাতে দে। পাত্রপক্ষ চলে গেলে ডাকবি। খবরদার ভয়ে কাঁদবি না। নয়তো থাপ্রাইয়া তোর দাঁত ফালায় দেবো। সোহু? ওরে শান্ত কর।
দোহা মুখ কালো করে তাকালো। সোহিনী দোহাকে চেয়ারে বসিয়ে চতুর্থ বারের মতো শান্ত করতে থাকলো। সাথে কি করে হাসবে কথা বলবে সেসবও বুঝালো। রিলেক্স হতে বললো। এতো কিছুর পরও দোহার বুকের বাজতে থাকা ঢোল থামছে না। বরং সময়ের সাথে সাথে তার গতি বাড়ছে।
চলবে,,,,,,,,,,,,