হিমি পর্ব-২৪

0
838

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

২৪.

-একটা কিছু তো মুখে দাও!

মিশ্মি মাথা নেড়ে জানান দিলো, না। সে খাবে না। আধঘন্টা ধরে টেবিল ভর্তি খাবার সামনে নিয়ে মুখ বন্ধ করে আছে মিশ্মি। না কিছু বলছে, আর না কিছু খাচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে ইয়াসির। নিজের ক্লাস ফেলে ব‌উয়ের কথা রক্ষায় শালিকে খুঁজতে আধঘন্টার চেয়েও বেশি সময় ব্যয় করেছে ইয়াসির। এরপর তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে ক্যান্টিনে নিয়ে এসেছে। ব্যক্তিগত কথা যেখানে সেখানে বলা যায় না। প্রয়োজন পরে প্রাইভেসির। সেই প্রাইভেসির কথা ভেবেই মিশ্মি আর তার বান্ধবী তন্নিকে দুলাভাইয়ের তরফ থেকে ছোট্ট একটা ট্রীট হিসেবে ক্যান্টিনে নিয়ে এসেছিলো সে। তন্নি নিজের ভাগের খাবারটুকু খেয়ে ক্লাসের জন্য মিশ্মিকে তাড়া দিচ্ছিলো। মিশ্মি ক্লাসে যেতে তৈরি তবে খেতে নয়। ইয়াসির তাই তন্নিকে চলে যেতে বলেছে। এও বলে দিয়েছে মিশ্মিকে না খাইয়ে সে ছাড়বে না। অথচ এখন অব্দি এক ফোটা পানিও মুখে তোলে নি মিশ্মি। ইয়াসিরের ধৈর্যের বাধ ভাঙছে। ব‌উয়ের ছোট বোন বলে কিছু বলতেও পারছে না সে। মুখে হাসি ঝুলিয়ে হেসে হেসে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষন পর মিশ্মি বলে উঠলো,

-স্যার আমার ক্লাসের দেরি হচ্ছে।

ইয়াসিরের বেপরোয়া জবাব,

-খাওয়া শেষ করে চলে যাও। আটকাই নি তো।

-আমার খিদে নেই।

-অথৈ বললো তুমি নাকি বাড়ি থেকে খেয়ে আসো নি। এখন দুপুর দুটো। এতক্ষন অব্দি খালি পেটে আছো, খিদে পাচ্ছে না কেনো?

মিশ্মি কৌতুহলী গলায় বললো,

-অথৈ কি করে জানলো?

-তার মানে তুমি খেয়ে আসো নি?

মিশ্মি জবাব দিলো না। ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিলো। ইয়াসির রয়ে সয়ে বললো,

-তোমার সাথে একটা জ্বরুরি কথা বলতে চাই মিশ্মি।

মিশ্মি চোখ ঘুরিয়ে ইয়াসিরের দিকে তাকালো। বিস্মিত গলায় বললো,

-কি কথা স্যার?

-দেখো মিশ্মি, আমি এখানে তোমার স্যার হিসেবে নয় দুলাভাই হিসেবে এসেছি। তোমার সাথে এ বিষয়ে কথা বলা উচিত কি না জানি না কিন্তু তোমার বোন খুব জোর করছে।

কয়েক সেকেন্ড থেমে বললো,

-তুমি কি সামহাও আমাদের বিয়েতে অখুশি?

মিশ্মি চমকে উঠলো। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেনো উঠছে সে বুঝতে পারছে না। যদিও উত্তরটা ‘হ্যা’ তবে তা তো কাউকে জানানো যাবে না। মিশ্মি অবাক হ‌ওয়ার চেষ্টা করে বললো,

-এসব কিছুই না স্যার। আপনাদের বুঝতে ভুল হচ্ছে।

ইয়াসির টেবিলে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখে শান্ত গলায় বললো,

-তাহলে ভুলটা ভেঙে দিয়ে সত্যিটা বুঝাও।

মিশ্মি ঘন ঘন শ্বাস টানলো। ইয়াসির বললো,

-অথৈ তোমার কথা ভেবে অস্থির। কি হয়েছে তোমার, কেনো এমন বিহেইভ করছো এসব নিয়েই পরে আছে সারাদিন। বিয়েতে তোমার অনুপস্থিতি, বাড়িতে ওকে সময় না দেয়া, ওর থেকে দূরে দূরে থাকা, ওর সাথে ঠিক করে কথা না বলা আর এখন! ওর ফোন কল রিসিভ না করাতে ওর মনে হচ্ছে তুমি বিয়েটা চাও নি। বা কোনো এক কারনে অথৈর সাথে আগের মতো মিশতে পারছো না। আজ যদি তোমার থেকে উত্তরটা না নিয়ে যাই তবে তোমার বোনের রাগ আসমান ছুঁতে পারে। সে রাগ ভাঙানোর জন্য প্রচুর কাঠখড় পুড়াতে হবে শালিসাহেবা!

মিশ্মি আপন মনে হাসলো। মুখে বললো,

-উত্তরটা হলো পড়াশোনা। আমি পড়াশোনা নিয়ে অত্যধিক ব্যস্ত। ক্লাস, কোচিং, নোটসের চাপে ভয়াবহ অবস্থা। তাই খুব হতাশ লাগে। আর কিছু না। আগে অথৈ ছিলো। আমার সব পেরেশানি দূর করে দিতো। ওর জন্য হলেও টেনশন ফ্রী থাকতাম। ও চলে যাওয়ার পর থেকে একদম একা হয়ে গেছি কিনা, তাই বিস্বাদ লাগে সব। পানসে লাগে। এখন থেকে এভাবেই থাকতে হবে তাই নিজেকে গুছাচ্ছি।

ইয়াসির ঠান্ডা গলায় বললো,

-তাহলে অথৈর ফোন রিসিভ করছো না কেনো?

-আমার মোবাইলে কিছু প্রবলেম হয়েছে। ফুল ভলিয়োমে রাখলেও রিংটোন শোনা যায় না। তাই হয়তো খেয়াল করি নি। ব্যস এইটুকুই।

ইয়াসির কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে মিশ্মির দিকে তাকালো। চেহারায় খুশি বিরাজ করলেও চোখ দেখে মনে হচ্ছে কতকাল ঘুমায় নি সে। ইয়াসির আর কিছু বলবে তার আগেই সেখানে উপস্থিত হয় নিহান। মিশ্মিকে নিরব বসে থাকতে দেখে ছুটে আসে কাছে। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে বলতে লাগে,

-মিশু তুমি এখানে আর আমি তোমার সারা ভার্সিটিময় খুঁজছি। এতোদিন আসো নি কেনো? কোথায় ছিলে? মেসেজ সীন করো না, কল রিসিভ করো না। সমস্যা কি তোমার? না কি আমায় এভোয়েড করছো? ক্লাস‌ও তো করোনি আজকের। এখানে বসে আছো কেনো? কথা বলছো না কেনো?

মিশ্মি অনেকটাই ঘাবড়ে গেছে এতে। ইয়াসির ভ্রু কুঁচকে আছে। এই ছেলেটাকে বিয়েতে দেখেছিলো সে। মিশ্মিদের আত্মীয় হয়তো। নিহান চোখ ঘুরিয়ে ইয়াসিরের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসলো। মাথা চুলকে বললো,

-স্যার আপনি?

ইয়াসির এক ভ্রু উচিয়ে বললো,

-ইউ নো মি?

-হ্যা স্যার। আমি এই ভার্সিটির‌ই স্টুডেন্ট। প্রাণীবিদ্যা বিভাগ।

ইয়াসির হালকা মাথা উপর নিচ করে বললো,

-ওহ। মিশ্মিকে কি করে চেনো?

নিহান জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,

-আমরা একে অপরের আত্মীয়। মানে দু পরিবারের কথা বলছিলাম আরকি। ইয়াসির নিহানকে বসতে ইশারা করলো। মিশ্মির পাশের চেয়ারটা টেনে তাতে বসে পরলো নিহান। ইয়াসির মৃদু গলায় বললো,

-শালিসাহেবাকে ট্রীট দিতে চেয়েছিলাম। তিনি তো নিতে ইচ্ছুক নয়। সেই কখন থেকে খাবার খেতে বলছি একটা দানাও খেলেন না। সকাল থেকেও না খেয়ে। দুলাভাইয়ের ইজ্জত মেরে দিলো!

কথাটা বলে হাসলো ইয়াসির। গোল গোল চোখে তাকালো নিহান। চাপা স্বরে বললো,

-সকাল থেকে কিছু খায় নি?

ইয়াসির ডানে বামে মাথা নাড়লো। নিহান পুরো শরীর ঘুরিয়ে মিশ্মির দিকে তাকালো। শান্ত গলায় বললো,

-খাচ্ছো না কেনো? শরীর খারাপ করবে তো!

-আমার খিদে পায় নি। আপনার পেলে আপনি খেয়ে নিন।

কথাটায় কিছু ঝাঁঝ মেশানো ছিলো। নিহান নরম গলায় বললো,

-এসব খেতে ইচ্ছে না করলে বলো অন্য কিছু খাওয়াই। খিদে পায় নি বলো না। আমি জানি তোমার খিদে পেয়েছে। কিন্তু তুমি খাচ্ছো না।

মিশ্মি কড়া গলায় বললো,

-জানেন‌ই যখন তখন জোর করছেন কেনো?

-জোর করা জ্বরুরি তাই।

হাতের ইশারায় ক্যান্টিনের স্টাফকে ডেকে সব খাবার নিয়ে যেতে বললো নিহান। সাথে আরো কিছু অর্ডার‌ও দিলো। মিশ্মি রাগে গজগজ করতে করতে যেই না উঠে দাঁড়াবে অমনি তার হাত ধরে ফেলে নিহান। চোখ রাঙিয়ে বলে,

-যেখানে বসে আছো বসে থাকো। নড়বে না একদম।

মিশ্মি ভয় পায় না। রাগ হয় তার। এসব কিছুই অবজার্ভ করছিলো ইয়াসির। নিহানের মিশ্মির দিকে তাকানো, কথা বলা, খাওয়ার জন্য জোর করা সর্বোপরি মিশ্মিকে শাসন করা। ইয়াসির মনে মনে হাসছিলো। ওয়েটার খাবার দিয়ে যেতেই ইয়াসির উঠে দাঁড়ালো। বললো,

-ইউ গাইজ ক্যারি অন। আমার ক্লাস আছে। বাই।

নিহান মিশ্মি দুজনেই সায় জানালো। ইয়াসির বেরিয়ে যেতেই নিহান মিশ্মিকে খেতে বললো। কিন্তু না। মিশ্মি তার কথা থেকে এক চুল‌ও নড়বে না। বার কয়েক বলার পর‌ও যখন মিশ্মি খেতে রাজি হলো না তখন নিজ হাতেই খাওয়াতে উদ্যত হলো নিহান। মিশ্মি চমকে উঠলো। বললো,

-সবাই দেখছে ভাইয়া।

-আই ডোন্ট কেয়ার। নিজে না খেলে আমি এভাবেই খাওয়াবো। সময় নষ্ট না করে হা করো।

-বললাম তো আমি খাবো না।

নিহান দাঁতে দাঁত চেপে নিচু গলায় বললো,

-এক চড়ে দাঁত ফেলে দেবো। হা করতে বলছি করো নয়তো,,,,

মিশ্মি ঢোক গিলে। ঠোঁট উল্টে তাকায় নিহানের দিকে। নিহানের চোখে মুখে ভীষন রাগ। যদি সত্যি সত্যি চড় থাপ্পড় মেরে দেয়? মিশ্মির কান্না পায় এবার। এর চেয়ে তো ভালোছিলো ইয়াসির থাকতেই খেয়ে নেয়া। নিহান আরো একবার চাপা স্বরে ধমক দিতেই মুখ খোলে মিশ্মি। নিহান দু এক বার খাইয়ে মিশ্মির হাতে চামচ দেয়। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে বলে,

-এবার নিজে খাও। প্লেইট একদম ফাঁকা দেখতে চাই। শুরু করো। থামবে না, আর না কাঁদবে। চুপচাপ সব শেষ করে উঠো।

মিশ্মি আতঙ্ক নিয়ে খেতে লাগে। খাবারের স্বাদ বুঝতে পারছে না সে। শুধু গিলছে। বুক তার কাঁপছে। এই মুহূর্তে স্ট্রোক‌ও করতে পারে। মিশ্মির অবস্থা দেখে হাসি পেলেও হাসলো না নিহান। ঠোঁট চেপে ধরে হাসি আটকে থমথমে গলায় বললো,

-আস্তে খাও। বিষম খাবে নাহলে।

_____________________

সূর্য ডুবেছে কয়েক মুহুর্ত আগে। এখনো আবছা আলো আছে চারপাশে। বসার ঘরে পরিবারের বড় সদস্যরা আলোচনায় ব্যস্ত। কি আলোচনা করছেন তা হিমির অজানা। সে জানতেও না। তবে মাঝে মাঝে কানে আসে তাদের কথা বার্তা। কখনো চিৎকার, কখনো হুংকার, কখনো অট্টহাসি, কখনো গম্ভীর কথোপকথন। আজ‌ও তাই হচ্ছে। কোনো এক বিষয় নিয়ে গম্ভীর আলোচনায় বসেছেন মামার বাড়ির সবাই। মাঝে মাঝে কানে আসছে মামানির চেঁচানো, ধমকানো। ছোট মামীর কান্নার স্বর‌ও কানে আসছে সাথে তার আহাজারি। মামুর গলার আওয়াজ খুব কম পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ স্ত্রীকে থামাতে বলে উঠছেন,

-অনু থামো এবার।

কখনো ছোট ভাইয়ের ব‌উয়ের উদ্দেশ্যে বলছেন,

-এভাবে চেঁচিয়ে পুরো শহরকে জানানোর কোনো মানে আছে। শান্ত হ‌ও।

ছোট মামা এখনো অফিস থেকে ফেরেন নি বলেই তিনি আলোচনায় থাকতে পারলেন না। হিমি ভাবে এখন যদি ছোটমামাও থাকতেন তবে ব্যাপারটা কেমন হতো। নিশ্চয় আর সবদিনের মতো থতমত খেয়ে এক কথা বলতে গিয়ে আরেক কথা বলতেন। গুছিয়ে বলার অতি চেষ্টায় সব এলোমেলো করে বলতেন। সবাই নিশ্চয় ছোটমামার আবোল তাবোল কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পরতো। ঝগড়া, কথা কাটাকাটি সব থমকে যেতো। হাসিতে মুখোরিত হতো সব। কিন্তু হলো না। সময়ের গতির সাথে বাড়তে লাগলো ঝগড়া ঝাটি। উচ্চ হতে লাগলো সবার গলার আওয়াজ। হিমি মুখ বিকৃত করে এসব না শোনার ভান ধরে জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকালো। কিছু সময়ের মধ্যেই ধরাম করে এক আওয়াজ হলো। হিমি চমকে উঠলো। ঘাড় ঘুরালো। মনে হলো কেউ পরে গেলো হয়তো। হিমির ভাবনার মাঝেই আবার‌ও ধরাম করে আওয়াজ হলো। সাথে শুরু হলো ছোট মামীর গর্জন করে মিশ্মিকে বকা। বাইরে থেকে কারো কান্নার ধ্বনি ভেসে এলো ঘরে। হিমির বুকে ধক করে উঠলো। গলাটা মিশ্মির না? মিশ্মি কাঁদছে? ওকে কি ছোট মামি মারলো? ভাবনাকে পাশে রেখেই দৌড়ে গিয়ে দরজা খোললো। হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে দেখলো মিশ্মির চুলের মুঠি ধরে এলোপাথারি গালে চড় থাপ্পড় লাগাচ্ছেন মিশ্মির মা রোশন আরা। মিশ্মিকে নিজেকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টা না করেই মাথার পেছনে হাত রেখে কেঁদে চলেছে। হানিফ শরীফ পেছন থেকে জোর গলায় বলছেন,

-ছোট ব‌উ ছাড়ো! এতো বড় মেয়েকে কেউ মারে? ছাড়ো বলছি। অনু আটকাও না। এই ছোট ব‌উ? আরে মেয়েটাকে ছাড়ো না।

অনাহিতা এগিয়ে এলেন না। থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে র‌ইলেন। রোশন আরা থামছেন না দেখে দৌড়ে গেলো হিমি। ছোট মামীর হাত ধরে আটকে তাকে ঠেলে ঠুলে সরিয়ে দিয়ে মিশ্মিকে বুকে টেনে নিলো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠেছে তার। চুলের কয়েক গাছি রোশন আরার হাতে লেগে আছে। মিশ্মি চুলের গোছায় হাত রেখে ফুঁপাচ্ছে। চাপা আর্তনাদ করছে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here