হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৪৮.
সকাল বেলা ঘুম থেকে জেগে শোবার ঘরের দরজা খোলা পেলো তাহির। স্বস্তির নিঃশ্বাস টেনে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে গেলো সে। হিমি ততক্ষনে জেগে গেছে। ঘরে এসে ঢোকলো হৃদি। হাতে তার গোলাপী রঙের জর্জেট শাড়ি। হিমি ভ্রু কুঁচকালো। হৃদি খাটের উপর শাড়িটা রেখে বললো,
‘ভাবি? ফ্রেশ হয়ে এই শাড়ি পরেই নিচে এসো। ফুপি পাঠিয়েছে।’
হিমি হাই তুলতে তুলতে বললো,
‘আমি শাড়ি পরতে পারি না হৃদি।’
‘এ বাবা! আমিও তো পারি না। এবার কি হবে?’
‘এতো স্ট্রেস নেয়ার কিছু নেই। যা পরতে পারি না তা না পরলেই বা কি?’
‘ফুপি তো বললো তোমায় শাড়ি পরিয়ে আনতে। হেই, ইউ টিউব! ওয়েট, আমি এক্ষুনি শাড়ি পরার প্রসেস টা দেখে নিচ্ছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। আমিই পরিয়ে দেবো নাহয়।’
‘তার দরকার নেই। আমি শাড়ি পরবো না।’
‘কেনো পরবে না?’
‘কখনো পরি নি। এসবে অভ্যাস নেই। তুমি বরং তোমার কোনো শার্ট, জিন্স এসব দাও।’
চোখ গোল গোল করে তাকালো হৃদি। বিস্মিত গলায় বললো,
‘তুমি শার্ট পরবে?’
‘হুম। আমি ওসবই পরি।’
‘কিন্তু ভাবি আমি তো শার্ট পরি না। আগে পরতাম। ফুপি বারণ করে দিয়েছে। ওয়েস্টার্ন সব জামা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এখানে তো থ্রি পিস, কুর্তি এসবই পরি আমি। তুমি নাহয় আমার নতুন কুর্তি পরে নিচে চলো!’
হিমি বিরোধীতা করলো না। হৃদি ঝড়ের বেগে নিজের ঘর থেকে নতুন কেনা লাল রঙা কুর্তি আর ম্যাচিং পায়জামা ওড়না নিয়ে এলো। হিমি মৃদু হেসে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকলো। কিছুক্ষন পর নিজের জামা গায়ে বের হতে দেখা গেলো তাকে। হৃদি কৌতুহলী গলায় বললো,
‘আবার তোমার জামা পরলে কেনো?’
‘তুমি অতিরিক্ত শুকনা হৃদি। তোমার ওই কুর্তি আমার গায়ে আঠার মতো লেগে যাচ্ছে। হাত নাড়াতেও কষ্ট হবে। পায়জামাও একরকম। আমি তোমার জামা পরে শ্বাস নিতে পারব না।’
‘তাহলে এখন কি করবো?’
কাতর গলায় প্রশ্ন করলো হৃদি। হিমি কিছু একটা ভেবে বললো,
‘তোমার ভাই তো আমার মতো আই মিন শার্ট প্যান্ট পরে। আমি নাহয় তার জামাই পরি আজ।’
‘ভাইয়ার কাপড়? তোমার হবে?’
হিমিও ভাবলো। তাহির বলিষ্ঠ, সুঠাম দেহী পুরুষ। তার গায়ের পোশাক হিমির গায়ে হ্যাঙারে থাকা কাপড়ের মতো ঝুলবে বোধ হয়। তবুও উপায় নেই। বাধ্য হয়েই তাহিরের পারমিশন ব্যতীত তার আলমারি ঘেটে খয়েরি রঙের শার্ট আর জিন্স বের করলো হিমি। গায়ে শার্ট লাগিয়ে দেখলো মোটামোটি ঠিকঠাক লাগছে। কিন্তু জিন্স কোমরে ঠেকাতেই বুঝতে পারলো তাহির দৈত্যের মতো লম্বা। জিন্স পেটের উপরে পরলেও গোড়ালি ছাড়িয়ে যাবে। হিমি অসহায় মুখে তাকালো হৃদির দিকে। হৃদি আবারও ছুট লাগালো নিজের ঘরে। লুকিয়ে রাখা জিন্স নিয়ে ছুটে এলো হিমির কাছে। এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘এটা বোধ হয় তোমার হবে। ফ্রি সাইজ।’
হিমি জিন্স আর শার্ট নিয়ে আবারও ওয়াশরুমে ঢোকলো। এবার এই পোশাকগুলো পারফেক্ট হয়েছে তার গায়ে। যদিও শার্ট বেশ ঢোলা। হাতা কনুইয়ের কাছে গুটিয়ে রাখলো হিমি। চুলে চিরুনি চালিয়ে হৃদির সাথেই নিচে চললো সে। হৃদির চেহারায় ভয় স্পষ্ট। সে খুব ভালো করেই জানে মায়মুনা জামানের এসব পছন্দ নয়। বিশেষ করে মেয়েরা যখন ছেলেদের মতো পোশাক পরে তখন তিনি রেগে যান। আর এতো বাড়ির বউ হয়ে বিয়ের পরের দিন সকাল বেলাতেই অঘটন ঘটিয়ে দিলো!
খাবার টেবিলে সামনে চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসে আছেন মায়মুনা। আত্মীয়দের মধ্যে কয়েকজন নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন। বাকিরা ব্রেকফাস্ট করছে। এমন সময় হিমিকে নিচে নামতে দেখে চোখ গরম করে তাকালেন মায়মুনা। নিকট আত্মীয়দের মুখ হা হয়ে আছে। হিমির তাতে কোনো ভাবোদয় হলো না। দিব্বি নিচে নেমে খাবার ঘরের পাশে এসে দাঁড়ালো। মায়মুনা রেগে মেগে কিছু বলবেন তার আগেই হৃদি দৌড়ে গেলো ওনার কাছে। কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিস কন্ঠে বললো,
‘ফুপি? ভাবি শাড়ি পরতে জানে না। আমিও পারি না। তাই বাধ্য হয়েই ভাইয়ার জামা পরতে হয়েছে। আমার জামাগুলো ফিট হচ্ছে না।’
মায়মুনা জামান শান্ত হলেন কিছুটা। পাশ থেকে কটমটে গলায় হৃদির মা বলে উঠলেন,
‘হবে কি করে? শরীরে তো খালি হাড্ডি তোমার। বাঁশের মতো শরীরে যা তুমি পরবে তা কি অন্য কেউ পরতে পারবে? তোমার ডায়েটের আমি গোষ্ঠী উদ্ধার করবো দেখো!’
…………………………
‘আপনাদের কি মনে হয় না এভাবে মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভুল করেছেন?’
মায়মুনা জামানের কথার বিপরীতে হিমির পরিবারের লোকজন থতমত খেয়ে গেলেও মোজাম্মেল সাহেব হাসলেন। ঠোঁট চওড়া করে বললেন,
‘আপনার ঘরে মেয়ে দিয়েছি এতে ভুল হবে কেনো? বরং ভালো হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য!’
‘এমনটা মনে হওয়ার কারন?’
‘বেয়ান সাহেবা আপনি বোধ হয় আমাদের চিনতে পারেন নি। অবশ্য চেনার কথাও নয়। বেয়াই সাহেবের সাথে আপনাকে কখনো আমাদের বাড়ি আসতে দেখি নি।’
মায়মুনা জামান ভাবুক গলায় বললেন,
‘বেয়াই সাহেব কে?’
‘আপনার স্বামী। তৌসিফ।’
মায়মুনা জামানের চোখে বিস্ময়। তৌসিফ মাহমুদ ওবাড়িতে গেছে? কেনো গেছে? উনিই চাল চেলে উচ্ছৃঙ্খল, উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন? এতোদিন তবে আড়ালে ছিলেন? কথাগুলো আপন মনেই ভাবলেন মায়মুনা। কপালে জমলো বিন্দু বিন্দু ঘাম। ধাতস্থ হয়ে বললেন,
‘তাহিরের বাবার সাথে আপনাদের কি করে আলাপ হলো?’
‘সে তো অনেক কাহিনী। ছোট করে বলি?’
মায়মুনা মাথা দুলালেন। মোজাম্মেল সাহেব আঙুলের ইশারায় মুহিব রহমানকে দেখিয়ে বললেন,
‘কনের বাবার সাথে বরের বাবার গলায় গলায় ভাব ছিলো একসময়। তৌসিফ যে অফিসে কাজ করতো সে অফিসের সাথে আমাদের ফ্যামিলি বিজন্যাসের পার্টনারশীপ ছিলো। মুহিব আর তৌসিফ বরাবরই একসাথে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো বলে ওদেরকে একই প্রজেক্টে কাজ করতে দেয়া হতো। তৌসিফ তো ছেলেকে নিয়ে প্রায়সই বাড়ি আসতো। তখন মুহিবের বিয়ে হয় নি। ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যবসার আলাপ শেষে পারিপার্শ্বিক কতো গল্প যে করতো তৌসিফ!’
মায়মুনা জামান সন্দিহান গলায় বলেন,
‘তাহিরের বাবা রিসেন্টলি আপনাদের বাড়ি গেছিলেন?’
‘না। ও তো সেই বাইশ তেইশ বছর আগে যেতো। অনেক বছর যোগাযোগ নেই। হিমি না বললে জানতামও না তাহির যে তৌসিফের ছেলে। এখন তো আবার তৌসিফ বলা যাবে না। বেয়াই সাহেব বলতে হবে!’
কথাটা বলে হাসলেন মোজাম্মেল সাহেব। বললেন,
‘তা বেয়াই সাহেব কোথায়? ডাকুন। কথা টথা বলি। নতুন সম্পর্কে মানিয়ে নিতে হবে তো!’
মায়মুনা জামান গাঢ় নিঃশ্বাস ফেললেন। মুহিব রহমান ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন,
‘মেয়ের বিয়ে এভাবে হোক চাই নি বেয়ান। আমাদের অগোচরেই হয়ে গেছে। অনেক স্বপ্ন ছিলো, ইচ্ছে ছিলো সব ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। প্রথমে ভয় এবং রাগ দুটো অনুভব হলেও এখন হচ্ছে না। কোনো এক অজানা কারনে মনে হচ্ছে আমার মেয়ের জন্য এই পরিবারই শ্রেষ্ঠ। আমার মা সব সময় একটা কথা বলতেন, আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্য করেন। আমিও তাই বিশ্বাস করি। আশা রাখছি এই বিয়েতে আপনার ছেলে এবং আমার মেয়েরও ভালো নিহিত। ওরা সুখী হলেই আমরা সুখী।’
মায়মুনা জামান প্রত্যুত্তর করলেন না। মোজাম্মেল সাহেব এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন,
‘হিমিকে দেখছি না যে! ঘরে?’
আমিনা বেগম যেনো এ প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিলেন। স্বামী প্রশ্ন করতেই চোখ উজ্জ্বল করে তাকালেন তিনি। মায়মুনা জামান ইশারায় পিউকে ডাকলেন। বললেন,
‘তাহিরের ঘরটা দেখিয়ে দাও।’
আমিনা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। মুহিব রহমান জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললেন,
‘হিমিকে এখানে ডাকা যায় না?’
‘ডাকা যায়। তবে আমি ডাকতে চাইছি না। নতুন বউ। ঘরে থাক। যারা দেখা করতে চাইবে তারা দেখে আসবে। বউ ও আর সবার মতো শানত শিষ্ট নয়। প্রচন্ড বেয়াদব। বড়দের মুখের উপর কথা বলতে দুবার ভাবে না। কখন কাকে কি বলে বসে কে জানে! তার উপর মেয়ে হয়েও মেয়েলী স্বভাব নেই। এ কেমন শিক্ষা দিয়েছেন আপনারা? শাড়ি পরতে জানে না, সালোয়ার কামিজ পরে না, কিসব ছেলেদের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। চুলগুলোও সোজা না। আপনাদের খারাপ লাগলে দুঃখিত তবে এমন ধারা মেয়ে আমি আমার ছেলের জন্য চাই নি।’
মুহিব রহমান যদি জানতেন ওনার একটা প্রশ্নে মায়মুনা জামান এতো কথা বলবেন তবে উনি প্রশ্নটা করতেন না। মায়মুনার কথা শোনে এবং মুখ দেখে মনে হচ্ছে এতক্ষন ধরে এসব কথা জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি। হিমির বাবা প্রশ্নে উগরে দিলেন শুধু। আমিনা বেগম তটস্থ হয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন। তিনি হাসি হাসি মুখ করে বললেন,
‘যাও যাও মেয়েকে দেখে এসো। আমরা পরে আসছি।’
আমিনা বেগম মাথার আঁচল ঠিক করে পিউয়ের সাথে চললেন। মোজাম্মেল সাহেব চায়ের পেয়ালা হাতে উঠালেন। এক চুমুক চা খেয়ে নিয়েই বললেন,
‘বললেন না তো, তৌসিফ কোথায়? বাইরে গেছে?’
‘বাইরে গেছিলেন। ফিরেন নি।’
‘ওহ। কোথায় গেছে? মানে, কখন ফিরবে? যাওয়ার আগে দেখা হয়ে গেলে ভালো হতো।’
‘উনি আর ফিরবেন না। চলে গেছেন।’
চমকালেন মুহিব রহমান। ফিরবেন না মানে কি? তৌসিফ কি মারা গেছে? কবে হলো এমন? মোজাম্মেল সাহেব চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন,
‘সরি টু হিয়ার দিছ নিউজ।’
‘আপনারা ভুল ভাবছেন। মা বলতে চেয়েছেন বাবা আমাদের সাথে থাকেন না। অনেক আগেই চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।’
তাহিরের কথা শোনে ঘাড় ঘুরালেন সবাই। সে এগিয়ে এসে মায়মুনা জামানের সোফার পাশে দাঁড়ালো। রাদিবা ভ্রু উচিয়ে বললেন,
‘কেনো চলে গেছেন?’
তাহির পকেটে হাত গুজে রেখে বললো,
‘পারিবারিক কিছু সমস্যার কারনে।’
‘কোথায় গেছে জানো না?’
‘না। বাবা আমাদের থেকে দূরে থাকতেই চলে গেছিলেন। তাই বলে যান নি কোথায় যাচ্ছেন। আমরাও জানতে পারি নি। এনিওয়ে, হিমির সাথে দেখা হয়েছে? উনি আপনাদের সবাইকে খুব মিস করছেন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। বসুন আপনারা।’
মুহিব রহমান ভড়কে যাওয়া চোখ জোড়া মেলে তাকালেন। এমন একটা ভাঙা সংসারে মেয়ের বিয়ে হলো! ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় হওয়া ছেলে কি আদৌ হিমির জন্য যথাযথ? ভেবে পান না তিনি। তাহিরের মায়ের কথাবার্তায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ওনার ধ্যান ধারনা কেমন। বুঝা যাচ্ছে হিমির উপর ভীষন অসন্তোষ তিনি। এই অসন্তুষ্ট মহিলা কি কখনো মেনে নিবেন হিমিকে? বাবা হয়ে তিনি জানেন ওনার মেয়ে কখনোই বদলাবে না। জেদীরা তাদের আশেপাশের কারো কথা কানে তুলে না। যেমন থাকতে চায়, যা করতে চায় তাই করে, তেমনই থাকে। হিমিও তেমনটা থাকবে। তৌসিফের মতো একজন মানুষ যে কিনা ছেলের জন্য পাগল ছিলো সেই কিনা ছেলে, স্ত্রীকে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো! কেনো হলো? নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে উদ্দেশ্যটা কি তার? আজীবন ছন্নছাড়া, হাসিখুশি থাকা মানুষটা নিজের পরিবার থেকে দূরে থাকছেই বা কেনো? কোথায় আছে তৌসিফ? বেঁচে আছে? জানতে হবে মুহিব রহমানকে। মেয়ের কথা ভেবে হলেও সবটা জানতে হবে।
চলবে,,,,,,,,,