হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৫৩.
ক্যাফেটেরিয়ায় একটা টেবিল জুড়ে পাঁচজন বসে। বহুদিন পর আবারও আড্ডা, হৈ চৈ, হাসি ঠাট্টা হবে। সূর্য এখনই টেবিলের উপর দুহাতের দু তিনটে আঙুল দিয়ে তুরি বাজিয়ে চলেছে। সেই সাথে ফিসফিস কন্ঠে বেসুরো গান গাইছে। তার গান শুনেই বন্ধুরা হাসিতে লুটিয়ে পরছে। এর মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলো হিমি। সবার দৃষ্টি তার দিকে। কোথায় সেই আগের হিমি? এ যে পুরো পাল্টে গেছে। গায়ে নেভি ব্লু কালারের লম্বা রাউন্ড ড্রেস। কানে বড় ঝুমকা। হাতে চুড়ির সংখ্যা বেড়েছে। কোঁকড়ানো চুলগুলো খোলাই আছে। গলায় চেইন। ঠোঁটটা অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই গোলাপি ঠেকছে। ডান হাতের মুঠোয় সাদা রঙের পার্স। হাটাচলায়ও কিছু পরিবর্তন লক্ষ্যনীয় তার। ক্যাফের দরজা থেকে টেবিল পর্যন্ত আসতেই দুবার পায়ে মোচড় খেয়েছে।
-দোস্ত। আই ক্যান্ট বিলিভ। তুই, দ্যা গ্রেইট হিমি, বিয়ার পর এক্কেরে টিপিকাল বউ হইয়া গেছোচ! হাতের বেল্ট, ঘড়ির বদলে চুড়ি! গায়ে আবার মাইয়াগো কুর্তি। কানের দুল দেইখা মনে হইতাছে এহনি তোর কান লইয়া ঠাস কইরা ছিড়া যাইবো। ঠোঁটে কি দিছোত মামা? তুই কি ময়দা দিছোত?
হিমি চেয়ারে বসতে না বসতেই কথাটা বলে উঠে সূর্য। বিরক্তি নিয়ে তাকায় হিমি। টেবিলে পার্স রেখে চোখ ঝাঁপটিয়ে বলে,
-আমার চা?
ইমন হাত উচিয়ে ওয়েটারকে চা আনতে বলে। ততক্ষনে হিমি ড্রেসের ওড়না দিয়ে নিজেকে বাতাস করছে। সূর্য তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো তার দিকে। তারপর অত্যন্ত রাগি গলায় বললো,
-ওই হারামী। আমার কথার জবাব দেস না ক্যান?
-তোর কথা সম্পূর্ণ আজাইরা। শুধু শুধু এগুলোর উত্তর দিয়ে সময় নষ্ট করবো কেনো?
হেসে উঠলো দোহা, ইমন, মেঘ, সোহিনী। সূর্য বাঁকা হেসে বললো,
-মামা? তোর গলার আওয়াজও দেহি অন্যরকম লাগে। ঘটনা কি? কোনো সার্জারী করাইছিস?
-ধুর ছাই। এতো ফালতু কথা বলিস কেনো? বিয়ে হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই আমি বদলে যাবো। নতুন পরিবেশ, নতুন পরিবার সবার সাথেই খাপ খাইয়ে চলতে হবে। বড়মা বলে দিয়েছে এখন থেকে আর শার্ট প্যান্ট পরা যাবে না। বাধ্য হয়ে এইসব পরছি। এদিকে বাচ্চা ডাক্তারের মা যখন যা পারছেন এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন। প্রথমে যাও কুর্তি টুর্তি পরেছি কিন্তু এখন না কি বাইরে বেরুলে এসব ড্রেস, কামিজ পরে যেতে হবে। তার সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি। কোনো মানে হয়?
-হয় হয়। মানে হয়। এই যে বললি না, বিয়ের পর স্বাভাবিক ভাবেই বদলে যেতে হয়। পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। তোকেও তো তাই করতে হবে হিমি।
মেঘের কথায় ফুঁসে উঠলো হিমি,
-আমি তো মানা করছি না। চেষ্টা করছি। কিন্তু ভদ্র মহিলার তাতেও আপত্তি। সম্পূর্ণ আমিটাতেই আপত্তি।
ওয়েটার চা এনে হিমির সামনে রাখলো। ইমন টেবিলে দু হাত রেখে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
-আপত্তি কিসের? এখন তো তুই ওনার কথামতো বাড়ির বউয়ের মতোই বিহেভ করছিস।
-ছাই করছি। রান্না শিখতে বলছে। আমার চুল নিয়েও ভয়াবহ সমস্যা ওনার। চুল কোঁকড়ানো কেনো? সোজা নয় কেনো? তেল দেই না কেনো? হাজারটা কথা। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের জবটাও ছেড়েছি ওনার কথায়। তারপরও থেমে নেই। বাইক চালানোয়ও আপত্তি।
-বাইক সাথে আনিস নাই? কেমনে আইলি তাইলে?
সূর্যের প্রশ্নের বিপরীতে মুখ ফুলালো হিমি। হতাশ গলায় বললো,
-গাড়িতে করে। দমবন্ধকর লাগছিলো।
দোহা হিমির হাতের উপর হাত রেখে বললো,
-মানিয়ে নিতে হবে তো। সব সময় কি আর নিজের মন মতো থাকা যায়?
-অবশ্যই যায়। চেষ্টা করলেই তা সম্ভব। তবে আপনজনদের মন রক্ষা করতে হলে তাদের কথাও একটু আধটু ভাবতে হবে। কিছুটা তাদের মতো কিছুটা নিজের মতো চললেই হলো।
হিমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
-কিন্তু সোহু উনি আমায় সম্পূর্ণ বদলাতে বলছেন। হিমি থেকে ওনার ছেলের বউ হতে বলছেন। এতসব আমি পারি না।
ইমন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো,
-পারা উচিতও নয়। প্রত্যেকের আলাদা কুয়ালিটি থাকে। অন্যরকম পছন্দ অপছন্দ থাকে। অভ্যাস, ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভালো লাগা মন্দ লাগা থাকে। সবকিছুই তো আর বদলে দেয়া সম্ভব নয়। হ্যা পরিস্থিতি যেমন হবে তেমন ভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু তা বলে নিজের অস্তিত্ব মিটিয়ে নতুন একটা মানুষ হয়ে যাওয়া কিছুতেই উচিত নয়। আর যদি হতেই হয় তবে সেটা নিজের জন্য হবে। অন্যকারো জন্য নয়।
দোহা মৃদু হেসে বললো,
-তোর সামনে বিয়ে না?
ইমন মাথা দুলালো। দোহা ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে রয়ে সয়ে বললো,
-বিয়ের পর সুপ্তি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে থাকতে পারবে? ও নিজেকে তোর জন্য তোর পরিবারের জন্য বদলাবে না?
-অফ কোর্স নট।
-ভুল বললি ইমন। সুপ্তি বদলাবে। আর ওর বদলে যাওয়ার প্রধান কারন হবে তার শ্বশুরবাড়ি।
ইমন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেঘ দু হাত আড়াআড়ি ভাবে টেবিলে রেখে তার উপর চিবুক রেখে বললো,
-কি করে?
-যেভাবে আমি বদলেছি। আগের আমি তোদের কাছে বোকা হাবা ছিলাম। সূর্য তো কথায় কথায় বেক্কল, গাধী বলতো। এখন আমি বোকা থাকলেও সেন্সিবল বিহেইভ করতে হয়। বাড়ির বউ বোকা হাবা থাকে না কি? বাড়িতেও শাড়ি পরে থাকতে হয়। যে আমি একসময় শাড়িতেও হোঁচট খেতাম সেই আমি চব্বিশ ঘন্টা শাড়িতেই থাকি। মা বলতেন বিয়ের পর উনি ভুলে গেছেন ওনার পছন্দের খাবার কি ছিলো। ইউ নো হুয়াট গাইজ? বিয়ের পর থেকে আজ অব্দি আমার পছন্দের খাবার ও বাড়িতে রান্না হয় নি। আমি সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। এদিকে আমিন এসব পছন্দ করে না। টেলিভিশনে শাশুড়ির সিরিয়াল চলে, শ্বশুরের নিউজ চলে, ননদের পছন্দের শো চলে। চলে না সিনেমা। আমিন আর তার পুরো পরিবার শিক্ষিত হয়েও চায় না আমি আর পড়াশোনা করি। অনার্স শেষ হলেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে বলেছেন মা। আমিনও তাই চাইছে।
শেষের কথাটায় আঁতকে উঠলো বন্ধুরা। সোহিনী বিস্মিত গলায় বললো,
-তুই পড়াশোনা ছেড়ে দিবি?
-হু। আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখে গেছি। আর মানিয়ে নিতে নিতে কখন যে একবারেই বদলে গেছি খেয়ালই করি নি। মাত্র কয়েক মাস বিয়ের। এখনি মনে হচ্ছে কতো যুগ কেটে গেছে আমি হাসি না, দুষ্টুমি করি না। লাফালাফি করি না। আমিনের এসব বাচ্চামো পছন্দ নয়। আমি ভেবেছিলাম ও ভীষন হাস্যরসিক। কিন্তু না। ও খুব গম্ভীর। সবাই সেটা বুঝে না। জানিস তো, ওবাড়িতে আমার আর কথা বলা হয় না। সবাই কেমন চুপচাপ। গুমোট ধরা। আমিও চুপ করেই থাকি। তোদের ছাড়া আর কারো সামনে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। আমি বদলে গেছি। ভবিষ্যতে আরো বদলাবো। একটা কথাই খালি ভাবছি। পুরোদমে সংসারী হয়ে গেলে আর তোদের সাথে দেখা হবে না, না?
………………………………
-আন্টি? মামু ফোন করেছিলেন। মিশ্মি, আমার মামাতো বোন, ওর বিয়ে। আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিয়েছেন। চাইছেন আমি আর বাচ্চা ডাক্তার যেনো কদিন আগেই যাই।
মায়মুনা জামান হাদিসের বই পড়ছিলেন। চশমার উপর দিয়েই তাকালেন হিমির দিকে। বই বন্ধ করে সোজা হয়ে বসলেন। পা দুটো তখনও খাটে বিছিয়ে রাখা। শীতল গলায় বললেন,
-তোমার জ্যাঠু না বললেন তোমার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে?
-হ্যা। আসলে, মামাতো বোনের বিয়ে চাচাতো ভাইয়ের সাথেই হচ্ছে।
ক্ষীণ গলায় বলে উঠেন মায়মুনা,
-কবে বিয়ে? আর দাওয়াত তোমার হাতে পাঠাচ্ছে কেনো? নিজে এসে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দিয়ে যেতে পারছে না?
হিমি আমতা আমতা করে বলে,
-না মানে বলবেন তো। ওনারাই আসবেন। এখন শুধু আমাদের যেতে বলছেন। মানে আমাকে আর বাচ্চা ডাক্তারকে।
মায়মুনা জামান কপাল কুঁচকালেন। বললেন,
-বাচ্চা ডাক্তার! আবার? তোমাকে না বলেছি আমার ছেলেকে বাচ্চা ডাক্তার বলে না ডাকতে! তারপরও ডাকছো?
জিব কাটলো হিমি,
-সরি আন্টি।
-আন্টি? আমি তোমার আন্টি? আমার ছেলে বাচ্চা ডাক্তার? কি সমস্যা তোমার মেয়ে?
কথা বলতে বলতেই খাট থেকে নামলেন মায়মুনা। হিমির দিকে এগুতেই পিছিয়ে গেলো সে। জড়সড় হয়ে বললো,
-সরি সরি। শাশুড়ি মা।
মায়মুনা কয়েক মুহুর্ত স্থির দৃষ্টিতে দেখলেন হিমিকে। তারপর বললেন,
-আর আমার ছেলে?
-আপনার ছেলে তো আপনারই ছেলে।
-সেটা নয়। আমার ছেলে তোমার কে হয়?
হিমি চোখ নামিয়ে অস্থিরতা প্রকাশ করছে। মায়মুনা জেদ ধরা গলায় বললেন,
-কে হয়?
-আমার স্বামী।
-তাহলে অদ্ভুত নামে ডাকো কেনো?
-অদ্ভুত না তো। উনি ডাক্তার। তাও আবার চাইল্ড স্পেশালিস্ট। তাই বাচ্চা ডাক্তার বলে ডাকি।
-আজ থেকে ডাকবে না।
-ডাকবো না?
-না। ডাকতে হলে নাম ধরে ডাকবে।
হিমি মিন মিন করে বললো,
-ডাক্তার সাহেব বলে ডাকতে পারি?
মায়মুনা ঝট করে জবাব দিলেন,
-না। তুমি ওর পেশেন্ট? না পেশেন্টের আত্মীয় যে ডাক্তার সাহেব বলে ডাকবে? তাহিরের সাথে তোমার সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর। তাহির বলে ডাকতে না পারলে ওগো, হেগো, এই যে, শুনছেন এসব বলবে। আর তাও না পারলে বাচ্চার নাম ঠিক করে এর বাবা ওর বাবা বলে ডাকো।
হিমি বিষম খেলো। মায়মুনা চোখ মুখ কুঁচকালেন। বললেন,
-কাঁশছো কেনো? বিয়ে যখন হয়েছে বাচ্চা তো হবে। আগে থেকে বাচ্চাদের নাম ঠিক করে রাখো। স্বামীকে ডাকতেও অসুবিধা হবে না আর মনেও থাকবে ও তোমার স্বামী।
-বাচ্চাদের?
-হ্যা বাচ্চাদের। এখন যাও। কাল চা বানানো শিখিয়েছিলাম। মনে আছে?
হিমি মনে মনে কিছু একটা ভেবে বললো,
-হুম।
-এখন আমার জন্য এক কাপ চা বানাও। নিজের জন্য বানাবে না। তাহির, হৃদি এদেরকেও দেবে না। আমি চাই না এই অল্প বয়সে চা খাওয়ার অভ্যাস করে শরীর স্বাস্থ্য নষ্ট করো।
হিমি বলতে চাইলো, ‘আমি চা খাই। অনেক আগে থেকেই খাই। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন এই অভ্যাস পাল্টানো যাবে না। গেলেও আমি পাল্টাবো না।’ কিন্তু বললো না। সব কথা বলতে নেই। বললে হয়তো বকা খাবে। নয়তো রাগ করবেন শাশুড়ি। হিমি তাই মনের কথাটা মনেই চেপে রেখে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো। মাথায় অতিরিক্ত তেল দেয়ায় চুলগুলো আঠালো হয়ে আছে। চপচপে লাগছে। বিরক্ত লাগছে তার। কিন্তু এবারও কিছু বলতে পারছে না। সাবধানে ধীরে স্থিরে চা বানিয়ে মায়মুনার ঘরে ঢুকলো হিমি। মায়মুনা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হিমির থেকে জানতে চাইলেন কি করে বানিয়েছে চা। কি কি উপকরণ দিয়েছে। হিমিও যথাযথ জবাব দিয়ে গেছে। চা ভালো হয়েছে বুঝতে পেরেই চায়ে চুমুক বসালেন মায়মুনা। সাথে সাথে মুখ বাঁকালেন। বললেন,
-চিনি দিয়েছো কেনো? আমি চিনি খাই না। জানো না?
-সরি শাশুড়ি মা। আবার বানাবো?
-আর দরকার নেই। ঘরে যাও। গোছগাছ করো। কাল বিকেলে যেও তোমার মামার বাড়ি। উনি ফোন করেছিলেন একটু আগে। তাহিরকে বলে দিও হাসপাতালের ডিউটি শেষে জেনো ওবাড়ি যায়।
চলবে,,,,,,,,,,