হিমি পর্ব-৬৬

0
808

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৬৬.

ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছিলেন মুহিব রহমান। মতিউর রহমানের মৃত্যুর শোক এখনো কাটে নি কারোর। তবুও জীবনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বাস্তবতা মেনে নিয়ে আগের মতোই জীবনযাপন করছেন সকলে। মুহিব রহমানের ঘর অন্ধকার। বারান্দায় অল্প আলো জ্বলছে। তাহির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সচেতনতা মূলক কাশি কাশলো। মুহিব রহমান সচকিত হয়ে সোজা হয়ে বসলেন। ভ্রু কুঞ্চিত করে দরজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি ফুটালেন ঠোঁটে। বললেন,

‘ভেতরে এসো।’

তাহির ভেতরে ঢুকলো। মুহিব রহমান বললেন,

‘তোমার আপত্তি না থাকলে ঘরের বাতি নেভানোই থাক!’

তাহির মাথা দুলালো। মুহিব রহমান তাহিরের দিকে চেয়ার এগিয়ে দিলেন। তাতেই বসলো সে। মেয়ের জামাইয়ের সাথে এখনো সৌজন্যতামূলক কথা বার্তা হয়ে উঠে নি ওনার। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরছেন।

‘আজ চলে যাবে?’

‘জি। অনেকদিন তো থাকলাম। এবার বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।’

মুহিব রহমান চুপ করে গেলেন। কথা কি করে আগানো যায় তাই ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। উশখুশ করছেন। তাহির গলা কেশে বলে,

‘কিছু বলবেন?’

মুহিব রহমান মাথা দুলালেন। রয়ে সয়ে বললেন,

‘হিমিকে রেখে যাও। আরো কয়েকটা দিন থাকুক।’

‘আচ্ছা।’

তাহিরের এমন ছোট্ট স্পষ্ট জবাবে আবার‌ও চুপ করে গেলেন মুহিব রহমান। বেশ অনেকক্ষন নিরবতায় কাটার পর‌ও যখন তাহির উঠলো না তখন সহজ হলেন মুহিব রহমান। অপ্রস্তুত হেসে বললেন,

‘কয়েকদিন থেকেই তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম।’

‘কি ব্যাপারে?’

‘আমি তোমার বাবার বিষয়ে জানতে চাইছিলাম।’

তাহির গাঢ় নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘বাবার বিষয়ে আমি যতটুকু জানি সেটা আপনাদের বলেছিলাম। এর বেশি কিছু জানি না। উনি কোথায় গেছেন, কেনো গেছেন, ফিরবেন কি না একটা প্রশ্নের উত্তর‌ও নেই আমার কাছে।’

হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লেন মুহিব রহমান। মৃদু স্বরে বললেন,

‘ওহ। তুমি কি এখন‌ই চলে যাবে?’

‘হ্যা। আপনার থেকে কিছু জানার আছে। জানা হয়ে গেলেই চলে যাবো।’

কপালে চিন্তার ভাজ ফেললেন মুহিব রহমান। অন্ধকারে সেই ভাজ নজরে পরলো না তাহিরের। সে তার মতো করেই বললো,

‘আপনার আর হিমির মধ্যে যে দূরত্ব তা কি আপনি জেনে বুঝেই সৃষ্টি করেছেন?’

‘কিছুটা। আসলে, আমার স্ত্রীর মৃত্যুটা আমি মেনে নিতে পারি নি। ভেঙে পরি। তখন আমার কাছে আমার স্ত্রীই প্রাধান্য পেয়েছিলো। আমি ভুলে গেছিলাম আমার মেয়ের কথা। আপেক্ষিক ভাবে সেটা ভুল। তবে তখন আমার কাছে ঠিক ভুল বিচার করার সময় বা জ্ঞান কিছুই ছিলো না। হাসির চলে যাওয়াতে আমি অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে পরি। এ শহর, হাসির মৃত্যু মেনে নিতেই বিদেশ চলে গেছিলাম।’

‘বিদেশ থাকাকালীন একবার‌ও হিমির কথা মনে পরে নি?’

‘পরেছে। কিন্তু আমি চাই নি মনে পরুক। যতোবার হিমির কথা মনে পরতো আমার মনে পরে যেতো হাসির মৃত্যু। তাই ইচ্ছা করেই হিমিকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছিলাম। সব যখন আমার আয়ত্তে ছিলো তখন দেশে ফিরার ইচ্ছা জাগলো। জানো, আমার দেশে ফেরার আরো একটা কারন ছিলো হিমি। আমি আমার মেয়েকে দেখতে চাইছিলাম। তার সাথে সময় কাটাতে চাইছিলাম। যেটুকু সময় তার থেকে দূরত্বে কেটেছে তার দ্বিগুন তাকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।’

‘তাহলে দূরত্ব বেড়ে গেলো কি করে?’

মুহিব রহমান চেয়ারে গা এলালেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

‘দেশে ফিরে হিমিকে দেখে আমি চিনতে পারি নি। এই কথাটা আমায় খুব কষ্ট দিচ্ছিলো তাহির। আমি নিজের কাছে ছোট হয়ে গেছিলাম। আমার মেয়ের সাথে আমি চোখ মেলাতে পারছিলাম না। অপরাধবোধ কাজ করছিলো। মনে হচ্ছিলো হিমি আমায় চায় না। হয়তে আমায় ঘৃণা করে। মেয়ের বেশ ভুষা, আমার থেকে দূরে দূরে থাকা আমায় সেটা মানতে বাধ্য করিয়েছে। তারপর হঠাৎ করে মাইনোর হার্ট অ্যাটাক হয় আমার। হাসপাতাল বাড়ি এসবের মধ্যে মেয়ের সাথে কথা বলা তাকে বুঝানো হয়ে উঠে না। কিছুটা সুস্থ হ‌ওয়ার পর জানতে পারি হিমি তার মামা বাড়ি গেছে। আমি ভেবেছিলাম কয়েকদিন পর‌ই ফিরবে। কিন্তু হিমি প্রায় মাস খানেক পর ফিরেছিলো। আমার মনে হলো আমি আসায় হিমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটা তার বাবাকে অপছন্দ করে। আর কখনো তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় নি। যখন করতাম তখন ভয় হতো। যদি ও আমায় ছেড়ে একেবারে চলে যায়!’

তাহির শুকনো হেসে বললো,

‘এদিকে হিমি ভাবে আপনি তাকে ভালোবাসেন না। আপনি চান না উনি আপনার সাথে থাকুন। কোনো এক কারনে ওনার ধারনা হয়েছে আপনি হিমিকে অপছন্দ করেন।’

‘স্বাভাবিক।’

‘না স্বাভাবিক নয়। ওনাকে বলা হয়েছে আপনারা মানে আপনি আর ওনার মা ছেলে সন্তান চেয়েছিলেন। মেয়ে হ‌ওয়ায় আপনি খুশি হন নি। আর তাই ওনাকে অবহেলা করে বিদেশ চলে গেছিলেন।’

হতভম্ব গলায় প্রশ্ন করলেন মুহিব রহমান,

‘কে বলেছে এসব?’

‘সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি কি সত্যিই মেয়ে সন্তান হ‌ওয়ায় খুশি ছিলেন না?’

‘এটা ভুল। আমি আর হাসি কখনোই ছেলে মেয়ে বিভেদ করি নি। বরঞ্চ আমরা আমাদের অনাগত সন্তানকে ভালোবেসেছি সে ছেলে না মেয়ে সেটা না জেনেই।’

‘তাহলে ছেলে সন্তানের জন্য কাপড়-চোপড়, খেলনা এসব কেনার মানে কি?’

‘ছেলে সন্তানের কাপড়? ‌তুমি ভুল বলছো। আমরা শুধু ছেলে সন্তানের কাপড় খেলনা কিনি নি, মেয়ের জন্য‌ও কিনেছিলাম। কেননা আমরা তখন জানতাম না আমাদের বাচ্চা ছেলে না মেয়ে হবে। ইন ফ্যাক্ট আমরা দুটো নাম ডিসাইড করেছিলাম। মেয়ে হলে হাফসা আর ছেলে হলে মাহিন।’

উদ্বিগ্ন গলায় তাহির বললো,

‘হিমি তো বাক্সে বন্দী শুধুই ছেলেদের পোশাক খেলনা পেয়েছিলো। ওর ভাগের জিনিস তো পায় নি!’

‘পায় নি কারন ওর ভাগের পোশাক ও পরেছে। ছোট ছিলো বলে মনে নেই হয়তো। অথবা কেউ সেই দিকে খেয়াল করে নি। সবাই হয়তো এটাই বুঝাচ্ছিলো আমরা ওকে ভালোবাসি কিন্তু এটা বলে নি যে পোশাক ও ওই সময় পরেছে সেসব আমাদের কেনা। তাই এতসব মিস আন্ডার্স্টেন্ডিং!’

‘আচ্ছা আঙ্কেল, বিদেশ থেকে আসার সময় নিহানের জন্য জিনিস আনার কথা আপনার মনে ছিলো। হিমির কথা ভুলে গেছিলেন?’

‘তোমায় বললাম না দেশে ফেরার একটা কারন ছিলো হিমি। তাহলে ওর কথা কি করে ভুলবো? আমি ওর জন্য‌ও জিনিস কিনেছিলাম তাহির। দেওয়া হয় নি। পারি নি। সংকোচ, জড়তা, অপরাধ বোধের কারনে এতবছর যাবত মেয়েটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠিক করে কথা বলতে পারি নি। গিফ্টস কি করে দিতাম? ইউ নো, আমি ওর প্রত্যেক জন্মদিনে উপহার কিনেছি। মাঝরাতে ওর ঘরেও গেছি। কখনো ওকে পাই নি, কখনো পেয়েও দিতে পারি নি। হিমি কোনো এক অজ্ঞাত কারনে আমায় ভয় পেতো। মাথা তুলে তাকাতো না। চুপ করে থাকতো। আমায় দেখলেই গুটিশুটি মেরে থাকতো। আমি বুঝতাম। কিন্তু বুঝেও কিছু করতে পারি নি। এই যে তোমায় এতো কথা বলছি, এর একটা শব্দ‌ও আমি হিমিকে বলতে পারবো না। আমার গলা কাঁপবে।’

তাহির মেরুদন্ড সোজা করে বসে বললো,

‘আপনাকে কিছু বলতে হবে না। যা শুনার ছিলো, জানার ছিলো সব‌ হিমি শুনে নিয়েছেন। জেনেছেন। আশা করি বুঝেছেন।’

মুহিব রহমান সোজা হয়ে বসে কপাল কুঞ্চিত করলেন। তাহির উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে দু হাত গুঁজে দরজার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘বাইরে দাঁড়িয়ে অন্যের কথা শুনা উচিত নয়। জানেন না?’

মুহিব রহমান সেদিকে তাকালেন। অন্ধকারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ তাহির দেখছে। কি করে? মুহিব রহমান সংকোচ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কম্পিত গলায় বললেন,

‘কে বাইরে?’

কোনো জবাব এলো না। তাহির মৃদু হেসে বললো,

‘আপনার মেয়ে। আসছি আমি।’

মুহিব রহমান আঁতকে উঠলেন। ওনার সব কথা হিমি শুনে ফেললো? তাহির আগে থেকেই জানতো? না কি এখন দেখলো? তাহির কি হিমিকে সবটা জানাতেই এসব প্রশ্ন করছিলো? হিমি বাবাকে এবার কি ভাববে? তাহির বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। দরজা পেরিয়ে ছায়ামানবীর পাশে দাঁড়িয়ে পরলো সে। হিমির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

‘আপনার বাবা চাইছেন আপনি থাকুন। থাকবেন?’

হিমি জবাব না দিয়ে অভিমানী চোখ তুলে তাকালো। চোখের জল গালে আঠার মতো লেগে আছে তার। ফুঁপাচ্ছেও একটু একটু। তাহির বললো,

‘থাকুন তবে। আমি চললাম। মান অভিমান মিটিয়ে নিন।’

হিমির থেকে জবাবের অপেক্ষা না করে হন হন করে বেরিয়ে গেলো তাহির। হিমি মৃদু কম্পন তুলে ঠাঁই দাঁড়িয়ে র‌ইলো। মুহিব রহমান‌ও নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে র‌ইলেন। ঘরটা তখন‌ও অন্ধকার। বাড়ি নিস্তব্ধ।

চলবে,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here