হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৭০.(সমাপ্তি পর্ব)
লাল বেনারসী পরনে কনের সাজে স্টেজে তাহিরের কাছ ঘেষেই বসে আছে হিমি। ডান হাতটা তার পেটের উপর। বর কনের সাথে ছবি তোলায় ব্যস্ত অতিথিরা। হিমির খুশি আকাশ ছোঁয়া। তার বহুদিনের স্বপ্ন আজ বাস্তবে রুপান্তর হলো।
দূর থেকে মেঘ আর সোহিনী হিমিকে দেখছে। মেঘ অন্যমনস্ক গলায় বললো,
‘সূর্যরা যদি থাকতো!’
সোহিনী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শুকনো হেসে বললো,
‘তুমি জানতে সূর্য হিমিকে ভালোবাসে?’
মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায় মেঘ। বলে,
‘ও কাউকে জানায় নি। জানার কোনো স্কোপও রাখে নি। অবশ্য জেনে গেলেও কিছু করতে পারতাম না। এখন যেমন হিমি আর তার বরকে হাসি খুশি দেখছি তখনও দেখতাম।’
‘সূর্য আর দেশে ফিরবে না, না?’
‘হয়তো! এসব কথা তুললেই এড়িয়ে যায়। ওকে বলেছিলাম এট লিস্ট ভিডিও কলে জয়েন কর বিয়েটা। জবাবই দিলো না।’
‘কি দেবে? যাকে ভালোবাসে তার বিয়ে দেখবে কি করে?’
‘হিমির তো আগেই বিয়ে হয়েছে। তখন তো তেমন বিহেইভ করে নি।’
‘শক্ত ছিলো। আর পারছে না হয়তো।’
মেঘ গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়ে। বলে,
‘হিমিকে কি বলবো এখন?’
সোহিনী স্মিত হেসে জবাব দেয়,
‘যা এতোদিন বলেছি। সূর্য কোথায় জানি না আমরা। ও আর জানতে চাইবে বলে মনে হয় না।’
খানিক থেমেই প্রশ্ন করলো,
‘এই ইমন এখনো এলো না?’
মেঘ পকেট থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করে ইমনের নাম্বারে। প্রথমবার রিং হতেই কল রিসিভ করে ইমন। অটো থেকে মাথা বের করে বাইরেটা দেখে নিয়ে বলে,
‘পাঁচ মিনিট দোস্ত। হিমির বিদায় হতে দিস না। আটকে রাখিস। আমি জাস্ট পাঁচ মিনিটে পৌঁছে দেবো।’
খেঁকিয়ে উঠে মেঘ,
‘থাপ্পড় খাবি আহাম্মক। আমি ওকে আটকাবো? কি করে? গাঁধা! জলদি আয় তুই। তাহির ভাইরে দেখে মনে হচ্ছে পারলে এক্ষুনি বউকে নিয়ে পালায়।’
মেঘের কথায় হেসে উঠে সোহিনী। বেজে উঠে সোহিনীর মুঠোফোনও। দোহা ভিডিও কল করেছে। সোহিনী কল রিসিভ করে।
‘অ্যাই! হিমিকে দেখা না!’
‘তুই আসিস যখন আসিসই নি তখন আর হিমিকে দেখে কি করবি?’
রেগে যায় দোহা। কোলের ছেলেকে শান্ত করতে করতে বলে,
‘প্লিজ সোহু। জানিসই তো আমার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। এমন করছিস কেনো? দেখা না একবার। ওর কাছে ফোন নিয়ে যা তো। আমিই কথা বলছি। যা।’
সোহিনী মুখ ভেঙালো তাকে। তারপর ফোন নিয়ে হাঁটা দিলো স্টেজের দিকে। হিমি তখন আইস্ক্রিম খাওয়ায় মগ্ন।
রঙ বেরঙের বাতিতে ঘর আলোকিত। ঘরময় ফুলের সুগন্ধ। হিমি বিয়ের শাড়ি পাল্টে মেক্সি পরে নিয়েছে। তাহিরও ঢোলা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে আয়েস করে বিছানায় বসেছে।
‘কত করে বললাম এখন বিয়ে না করি। শুনলে না।’
হিমি ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘শুনলে কি হতো?’
‘বিয়ের রাতে আমাদের বাসর হতো।’
‘আপনি দিন দিন কেমন বেশরম হয়ে যাচ্ছেন বাচ্চা ডাক্তার।’
তাহির হেসে ফেললো। পাশ থেকে হিমিকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে কপাল ঠেকালো। স্মিত কন্ঠে বললো,
‘গান শুনবে?’
হিমি ঝট করে মাথা সরালো। তাহিরের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
‘আপনি গান গাইতে পারেন? আমি যখন জানতে চাইলাম তখন তো মানা করেছিলেন!’
তাহির খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো। এগিয়ে গিয়ে আলমারির ডান দিকের পাল্লা খোলে হেঙারে ঝুলানো কাপড় সরালো। কালো রঙের গিটার বের করতে করতে বললো,
‘গাইতে তো এখনো পারি না। শুধু গিটার বাজানো শিখেছি। সেটাই শুনাই। সাথে নাহয় বরের বিচ্ছিরি গলার একটুখানি বেসুরো গান হয়ে যাক!’
হাসলো হিমি। চোখে মুখে উৎফুল্লতা তার। তাহির হিমির পাশে এসে বসলো। হেড বোর্ডে মাথা ঠেকিয়ে গিটারে টুং টাং আওয়াজ তুললো। গলা পরিষ্কার করে গানও ধরলো।
‘তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
নিবিড়, নিভৃত, পূর্ণিমা, নিশীথিনী-সম!
তুমি রবে নিরবে
হৃদয়ে মম।
মম জীবন যৌবন
মম আখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে
নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
নিবিড়, নিভৃত, পূর্ণিমা, নিশীথিনী-সম!’
এটুকুতে থামলো তাহির। হিমির চোখ ছলছল করে উঠলো। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে দুহাতে তালি বাজাতে লাগলো সে। তাহির গিটার নামিয়ে রেখে বললো,
‘হয়েছে। আর সান্তনা দিতে হবে না। আমি জানি আমার গলা ভীষন খারাপ।’
হাসলো হিমি। বললো,
‘ধুর ছাই! আমার তো ভালোই লেগেছে। মনে হচ্ছিলো এই গানটা আপনার চাইতে ভালো কেউ গাইতেই পারবে না।’
তাহির বিষম খেয়ে গেলো। চোখ সরু করে বললো,
‘পাম দেয়া শিখলে কোথা থেকে?’
হিমি হঠাৎ মুখটা অন্যরকম করে ফেললো। তাহিরের এক হাত টেনে নিজের পেটের উপর রাখলো। তাহির ধরফরিয়ে সোজা হয়ে বসে বললো,
‘কি হয়েছে হিমি? অস্বস্তি হচ্ছে?’
হিমি জবাব দেয় না। তাহিরের হাত শক্ত করে ধরে রাখে পেটের উপর। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবারও একই ঘটনা ঘটে। তাহির তব্দা খেয়ে যায়। মাথাটা হিমির পেটের দিকে এগিয়ে নিয়ে কান লাগায় পেটের উপর। মৃদু হেসে বলে,
‘বাবাই? তুমি মাম্মামকে কষ্ট দিচ্ছো? নট ডান। একবার শুধু আমাদের কাছে এসো তারপর বুঝাবো তোমায়।’
…………………………
হাসপাতালের করিডোরে ভীড় করে আছেন হিমির পরিবারের লোকজন। প্রায় চার ঘন্টা আগে আই সি ইউতে ঢোকানো হয়েছে হিমিকে। হিমির সমস্ত রিপোর্ট নরমাল। ডক্টররা অনেক আগে থেকেই বলেছিলেন নরমাল ডেলিভারি হবে। কোনো কম্প্লিকেশন নেই। অথচ এখন তারা অপারেশন করাতে চাইছে। দীর্ঘ তিনঘন্টা প্রসব বেদনা ফেইস করার পর অজ্ঞান হয়ে গেছে হিমি। এমতাবস্থায় নরমাল ডেলিভারি সম্ভব নয়। তাছাড়া হিমির ব্লিডিং হচ্ছে। একমাত্র সমাধান সি সেকশন। কথাটা শুনেই আঁতকে উঠেছেন পরিবারের সবাই। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। তাহলে কেনো হচ্ছে? সব ঠিক হবে তো? এসব ভাবনায় আটকে গেছেন সবাই।
আরো দু ঘন্টা পর বাচ্চা কোলে নিয়ে আই সি ইউ এর বাইরে বের হয় তাহির। এতক্ষন সে হিমির সাথে আই সি ইউতেই ছিলো। মেডিসিনের ডক্টর বলে সার্জারির ব্যাপারে তেমন কিছু আইডিয়া নেই। তবে যা বুঝেছিলো সেটাই হয়েছে শেষ মুহুর্তে। তাহিরের কোলে হিমি তাহিরের মেয়ে, বাচ্চাটা যখনই চোখ খোলে তখনই চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় হিমির নিঃশ্বাস। পাল্স রেইট থেমে যায় তার। বডি রেসপন্স করে না। ডক্টররা বহু চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। হিমি মারা গেছে। পৃথিবীতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেই সে অন্য জগতে পারি জমিয়েছে।
তাহির এখনো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে অশ্রু নেই। মুখটা ফ্যাকাশে। কোলের শিশুর দিকে একপলক দেখে কপালে চুমু আঁকলো তাহির। সদ্য জন্ম নেয়া মেয়ে চোখ খোললো। হাসলো। তাহিরের চোখ সাথে সাথেই ভিজে উঠলো। হুবহু হিমি মনে হচ্ছে তার। মেঝেতে বসে পরলেন মুহিব রহমান। দুহাতে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলেন। প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বছর আগে ঠিক এমনই একটা ঘটনা ঘটেছিলো। হাফসা মারা গেছিলেন। হিমির জন্ম হয়েছিলো। এমন ভাবেই মেঝেতে বসে কাঁদছিলেন মুহিব রহমান। কাঁদছিলেন বাকিরাও। আজও তাই হচ্ছে। অতীত এভাবে ফিরে আসবে কেউ কখনো কল্পনাও করে নি। হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেল্ফ বলে যে কথাটা আছে সেটা আজ আবারও প্রমাণ হলো। কান্নার আওয়াজ বাড়লো ওনার। মোজাম্মেল সাহেব পাথর হয়ে গেছেন। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন হিমির মেয়ের দিকে। নিহান মিশ্মিকে খবরটা জানিয়ে নিজেও ডুকরে উঠলো। মায়মুনা জামান প্রথম বারের মতো উপলব্ধি করলেন হিমিকে তিনি বড্ড ভালোবাসেন। বড্ড বেশি। হিমির মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তিনি। বুকে হঠাৎই ব্যথা শুরু হলো। তারপর চেয়ারেই অজ্ঞান হয়ে পরে গেলেন তিনি। ছুটে গেলো নিহান আর নার্স। মায়মুনা জামানকে তুলে পাশের একটা কেবিনে ঢুকিয়ে প্রেশার চেক করা হচ্ছে। তাহির তখনও নিজেকে অদৃশ্য সুঁতোয় বেঁধে রেখেছে।
বাড়িতে কান্নার রোল পরেছে। হিমির নিথর দেহটা মেঝের উপর রাখা খাটিয়ায় শুয়ানো। ভীষন স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। ফর্সা চেহারা আরো ফর্সা লাগছে। চোখে মুখে যেনো প্রশান্তি তার। আমিনা বেগম খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। হিমির মামার বাড়ির সবাইও গত রাতে এসে পৌঁছেছেন। একটু পরই জানাজা। হানিফ শরীফের বয়স এই দুদিনেই কয়েক বছর বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। সেই কখন থেকে একটা চেয়ারে বসে আছেন তিনি। চোখ অশ্রুশিক্ত।
তাহির সাদা পাঞ্জাবী পরে মেয়েকে কোলে নিয়ে নিচে নামলো। পুরো বাড়ি আতর আর আগর বাতির গন্ধে ভরে উঠেছে। তাহির মেয়েকে কোলে জড়িয়ে রেখে হিমির খাটিয়ার পাশে বসলো। বুক হু হু করে উঠলো তার। মিশ্মির কোলে মেয়েকে দিয়ে আলতো করে হাত রাখলো হিমির মাথায়। মনে করতে লাগলো হিমির সাথে কাটানো প্রত্যেকটা মুহুর্ত। সেই প্রথম দিন থেকে শেষদিনের সফর। হিমি। এই মেয়েটাকে কখনো ভুলা সম্ভব নয় কিন্তু তাকে ছাড়া বাঁচা সম্ভব? হিমি ছাড়া বেঁচে থাকাটা আদৌ বেঁচে থাকা? হাত পা কাঁপতে থাকে তাহিরের। আর মাত্র কয়েক মুহুর্ত। তারপর হিমিকে বিদায় দিতে হবে। চিরতরের বিদায়। এ বাড়িতে আর হিমি থাকবে না। হিমি আর কোথাও থাকবে না। তবুও থাকবে। কেমন অদ্ভুত লাগছে সব। অনুভুতিগুলো অদ্ভুত। চিন্তা চেতনাও অদ্ভুত। হিমি নেই। এটাই সত্যি। ফিরবে না সে। কখনোই না। তবে হিমির মেয়ের মধ্যে নিশ্চয় হিমি আছে। পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের হৃদয়ে হিমি থাকবে। আজীবন থাকবে।
লাশ ঢাকা হলো। খাটিয়া ধরে তোলা হলো। তাহির, নিহান, মুহিব রহমান, মোজাম্মেল সাহেব, হানিফ শরীফ, হাশিম শরীফ, মেঘ এরাই ছিলেন হিমির খাটিয়ার পাশে। কান্নার ধ্বনি উঠলো আবারও। আমিনা বেগম বুঝি আবারও জ্ঞান হারালেন!
সমাপ্ত
[বি:দ্র: বহুদিনের প্রতীক্ষার সমাপ্তি। সমাপ্তি ‘হিমি’রও। আরো আগে শেষ করতে চাইছিলাম। কিন্তু ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারনে লিখতে পারি নি তাই দেরি হয়েগেছে। অবশেষে তিন দিনে লিখে শেষ করেছি। পাঠকদের মন কতোটা রক্ষা করতে পেরেছি জানি না তবে সম্পূর্ণ চেষ্টা করেছি। গল্প সম্পর্কিত নিজের মতামত ব্যক্ত করবেন আশা করি।
আজকের পর্বে তিনটা চমক ছিলো। এক. সমাপ্তি পর্ব। দুই. হিমির কার্বন কপি তার মেয়ের আগমন। তিন. হিমির মৃত্যু। কোনটায় বেশি চমকেছেন?🙂
আমায় কেউ বকা দিবেন না। গল্পের পরিণতি এমনটাই ভেবে রাখা ছিলো। মৃত্যু চিরন্তন সত্যি। তাই হিমি মারা গেছে। আমি মারি নি তাকে😒।]