#জাস্ট_ফ্রেন্ডস
#৩য়_পর্ব
~মিহি
প্রেমা হাঁপাচ্ছে। রুদ্ধকে ঠিক সময় না সরালে হয়তো কী বিপদ হতো! আর এই রুদ্ধটা কি ছাগল? ট্রাক দেখে সরে না গিয়ে পাগলের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। রুদ্ধ চুপ করে দাঁড়িয়ে প্রেমাকে দেখছে। এই দুর্ঘটনা তার মনে একটু হলেও সাহস দিয়েছে। এবার সে নিজের মনের কথা না জানিয়ে কিছুতেই প্রেমাকে যেতে দিবে না।
-“রুদ্ধ, তুই কি দিন দিন ছাগল হচ্ছিস?”
-“একজনের প্রেমে পাগল হচ্ছি।”
-“কীহ! তুই আর প্রেম? সত্যি?”
-“নাহ! মিথ্যা। খুব মাথা ধরেছে রে। চল বাড়িতে যাবো।”
-“আমি কোথায় থাকবো?”
-“আমার বাড়িতে?”
-“আমি তোর সাথে কেন থাকবো?”
-“রুশার ঘর ফাঁকা আছে, ওখানে থাকিস। আমার ঘরে থাকা লাগবে না!”
-“ইশস! আমি কি সেটা বলছি? চল তো চল।”
___________________________________________________________________________________________
-“গুরু, কাজ তো হলো না। অন্য কোনো মেয়েকে বলি দিলে কাজটা হবে না?”
-“আমি যখন বলেছি ঐ মেয়েকে লাগবে, তখন ঐ মেয়েকেই লাগবে। তোমরা যেভাবে পারো ঐ মেয়েকে নিয়ে এসো, নাহলে দেবীকে তুষ্ট করা যাবে না। আর ওর বন্ধুকে মারতে পারোনি, তাই না?”
-“নাহ গুরু।”
-“ওর উপর নজর রাখো। মেয়েটাকে যে করেই হোক আমাদের আয়ত্তে আনতে হবে। আমি বলেছিলাম মেয়েটা দারুণ চতুর। সামলে রাখতে হবে।”
-“আমরা চেষ্টা করছি।”
কল কেটে দিয়ে শ্যামলা লোকটা পানের পিক ফেলে রাস্তায়। এই মেয়ের পিছু নিতে হবে। পাশে বসে থাকা ট্রাক ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে নেমে পড়ে লোকটা। একটু দুরত্ব বজায় রেখে নিজের স্কুটারে করে রুদ্ধ আর প্রেমার পিছু নিতে থাকে।
রুদ্ধ আর প্রেমা একটা বাসার সামনে এসে নামতেই লোকটা একটু দূরত্বে স্কুটার থামায়। দুজন ভেতরে প্রবেশ করলে লোকটা আবারো তার গুরুকে কল দিল।
-“গুরু। ছেলে-মেয়ে তো এক বাড়িতে এসে উঠেছে।”
-“কলিযুগ! ঘোর কলিযুগ! উভয়ে যেন আমাদের যজ্ঞের পূর্বে কোনো আপদ না ঘটাতে পারে সেদিকে নজর রাখ। কোনো অনৈতিক কার্য দেখামাত্র মেয়েটাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে আনবি। কেউ আটকালে তাদের কার্যক্রম অবশ্যই বর্ণনা করে সর্বসম্মুখে চুনকালি মাখাবি ওদের মুখে। কোনোক্রমেই যেন বেঁচে পালাতে না পারে।”
-“আচ্ছা গুরু। আমি নজর রাখছি।”
-“আমি যজ্ঞে বসবো। এখন আর আমাকে পাবি না। তটস্থকে যোগাযোগযন্ত্রটা দিয়ে যাচ্ছি। কোনো দরকার পড়িবা মাত্র ব্যাকুল হয়ে যেন যোগাযোগের চেষ্টা করিস না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে আগে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করবি।”
-“জ্বী আচ্ছা গুরু।”
শ্যামলা লোকটা কল কেটে পকেটে পড়ে থাকা দূরবীন দিয়ে রুদ্ধ প্রেমার বাড়ির দিকে নজর রাখতে শুরু করলো।
রুশার বিছানায় মাত্রই বসেছে প্রেমা। ঘর বেশ কিছু সময় বন্ধ থাকায় একটা দমবন্ধ আবহাওয়া বিরাজ করছে। দু’সপ্তাহ ধরে রুশা ক্যাম্পে। ঘরের জানালাটা খুলে দিল প্রেমা। বাইরে থেকে আসা দমকা হাওয়ায় প্রেমার এলোমেলো চুলগুলো কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। রুদ্ধ দরজায় এসেও থেমে যায়। প্রেমা জানালার ধারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। এলোমেলো চুলগুলো উড়ছে। কোনো সিনেমার শুটিংয়ের থেকে কম সুন্দর নয় দৃশ্যটা। প্রেমে পড়ার পরবর্তী মুহূর্তগুলো বুঝি এতটাই সুন্দর হয়? দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় ধারণ করতে পারলে দারুণ হতো।
-“কী রে, দরজায় দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস? আর এত রাতে এ ঘরে আসলি যে?”
-“রুমের সুইচ ঠিক আছে কিনা চেক করতে আসলাম।”
-“ঢঙ করার জায়গা পাও না? যাও যাও, অত খাতির লাগতো না আমার।”
-“কয়দিন পর চলে যাচ্ছিস, আগেরবার তো না বলে গেছিস। সুযোগ পাইনি খাতির করার। এখন একটু খাতির-যত্ন করি।”
-“বাব্বাহ! এত ভালো হলি কবে? এই শোন না, চল আমরা সাতদিনের একটা এডভেঞ্চার ট্যুরে যাবো, কোনো ভৌতিক বাড়িতে।”
-“তোর মাথা খারাপ? তুই জানিসই আমি ভূতে ভয়…না মানে আমার ভূত পছন্দ না।”
-“তোরে কি ভূতের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছি যে ভূত পছন্দ হওয়া লাগবে? শুভ্ররে বলে ভালো একটা স্পট বের কর। আমরা কালই রওনা দেব।”
-“আমারে কোন পাপের শাস্তি দিতেছিস? আমারে ছাইড়া দে মা। এসব ভূত-প্রেতের বাঁশবাগানে আমি নাই।”
রুদ্ধর কথায় প্রেমা হাসতে হাসতে পড়ে যেতে ধরে। রুদ্ধ ধরে ফেলে তাকে। প্রেমা হাসছেই। রুদ্ধর ভূতের ভয় সেই আদিকাল থেকে। এমনিতে রাত-বিরাতে বাইরে ঘুরতে তার ভয় লাগে না কিন্তু ভূতের নাম নিলেই তার ঘাম ঝরে। বিষয়টা এমন যে ভূতের নাম নেওয়ার আগ অবধি রুদ্ধ একা একা কবরস্থানেও বসে থাকতে পারবে কিন্তু ভূতের নাম নিলেই শেষ! বাথরুমে যাওয়ার জন্যও আন্টিকে লাগবে। এই ভীতু রুদ্ধটাকে দু’বছর বড্ড মিস করেছে প্রেমা। হুট করে লন্ডনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা এখন ভুল মনে হচ্ছে। সে চাইলেই তো থেকে যেতে পারত এই চিরচেনা শহরে। নিজেকে কেন যেন প্রতারক মনে হয় প্রেমার। খুব সূক্ষ্ম একটা প্রতারণা সে করেছিল নিজের বন্ধুদের সাথে। কাউকে কিছু না জানিয়েই উড়াল দিয়েছিল এক উন্নত শহরে যার বাতাসে এখন মিশে আছে প্রেমার দীর্ঘশ্বাস। ব্যস্ত-যান্ত্রিক সে শহরে আর মন টেকে না প্রেমার। দূরে আযান দিচ্ছে।আজ আর ঘুমোনো হলো না প্রেমার। মাথায় এখন ভ্রমণের ভূত ভর করেছে। আর এই ভূতকে ছাড়ানোর উপায় হলো আরেক ভূতের সাথে যত দ্রুত সম্ভব সাক্ষাৎ করা। শুভ্রকে বলে একটা ভুতুড়ে জায়গা খুঁজতেই হবে।
___________________________________________________________________________________
-“নিফিউ পাড়ায় যাবি?”
-“এইটা কি এই পৃথিবীতেই?”
-“বাংলাদেশের মেয়ে হয়ে বাংলাদেশের অলিগলি চিনোস না? লজ্জা লাগা দরকার।”
-“লজ্জা লাগতেছে! এখন বল এডা কই।”
-“বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মধ্যবর্তী এক দুর্গম স্থানে একটি গ্রামের পাশে এই জঙ্গলটি অবস্থিত। তল্যাংময় (সাকা হাফং) চূড়ার গাঁ ঘেষা এই জঙ্গলটি বান্দরবান জেলা ও মিয়ানমারের চিন রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত….একটা আর্টিকেল সেন্ড করছি মেসেঞ্জারে। পড় ঐটা। তাহলেই বুঝতে পারবি।”
-“জায়গা তো ইন্টারেস্টিং কিন্তু ভীতুর ডিম কি রাজি হবে?”
-“ওরে ম্যানেজ করা তো তোর বাম হাতের খেল। ক্যামনে ম্যানেজ করবি কর।”
-“আমার একার দায়িত্ব নাকি? তোরা সবাই মিলে কিছু প্ল্যান কর।”
-“আরে শোন! তুই গেলে, ও এমনেই যাবে। কোনো প্ল্যান-ট্ল্যান লাগবে না।”
-“হ! আমি তো ওর বউ লাগি!”
-“কী যে লাগিস তা তো ওই জানে।”
-“এই কী বিড়বিড় করতেছিস রে?”
-“তুই যা তো ওরে ম্যানেজ কর। আমি প্যাকিং শুরু করতেছি।”
প্রেমা কল কেটে সারা ঘরে পায়চারি করতে থাকে। রুদ্ধ একটু আগেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। মিনিমাম এক ঘণ্টা না ঘুমালে সে সারাদিন ঘেউ ঘেউ করবে। মেজাজ থাকবে তুঙ্গে। এখন কী করবে বুঝে উঠতে পারে না প্রেমা। আচমকা একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়। রুদ্ধর ঘুম হলো কুম্ভকর্ণের ঘুম। বাড়িতে এখন আগুন লাগলেও ওর ঘুম ভাঙানো যাবে না।
রুদ্ধর ঘরে ঢুকে ওর বেশ কয়েকটা কাপড় প্যাক করে প্রেমা। রুদ্ধ বিছানায় মরার মতো ঘুমোচ্ছে। রুদ্ধর বাবা-মাকে নিজের প্ল্যান জানাতেই তারা হেসে উঠে। সব ঠিকঠাক করে শুভ্রকে কল করে গাড়ি নিয়ে রুদ্ধর বাড়িতে আসতে বলে সে।
-“কীরে? রুদ্ধর বাড়িতে ডাকলি? তাও এত সকালে? তনয়া আর রেহানকে তো প্রায় ঘুম থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসলাম।”
-“আরেকজনকে তুলতে হবে। ঘুমের ঘোরে আছে, পুরোটা তুলে গাড়ির পিছনে ফেলে আসতে হবে।”
-“কারে? রুদ্ধ? ঐ সত্তর কিলোর আলুর বস্তা? আমার কি নিজের হাড়ের উপর মায়া-দয়া নাই?”
-“তোরে একা তুলতে বলছি? দেখ, ঐ ঘুমাইছে চাদর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে। এখন তুই চাদরের এক ধার ধর, আমি আরেক ধার। তারপর এভাবে গাড়িতে নিয়ে জাষ্ট বলের মতো ছুঁড়ে মারা। ইটস সো ইজি।”
শুভ্র ক্ষতবিক্ষত দৃষ্টিতে প্রেমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই আকাম করতে গিয়ে যদি রুদ্ধর ঘুম ভাঙে, তাহলে রুদ্ধ শুভ্রকে পুঁতে ফেলবে। ঢোক গিলে প্রেমার কথায় সম্মতি দিল সে।
চলবে…