রহিবে মনের গহীনে পর্ব-০১

0
5678

১.
–“মা দেখো, ১৬ বছরের কিশোরীকে আমি কখনোই বিয়ে করবো না। ওর এজ আর আমার এজ তুমি দেখেছো? আকাশ-জমিন তফাৎ। আর এতই চঞ্চল যে বাড়িতেই আমার মাথা খেয়ে ফেলে! সে কন্যা আমার বউ হলে আমার পুরো জীবনটা ত্যাজপাতা করে ছাড়বে।”

–“দেখ বাবা বয়সের সাথে কী যায় আসে? একটু বাচ্চামি করবেই। তোর সাথে বিয়ের পর তুই ঠিক ওরে মানুষের মতো মানুষ করে নিতে পারবি।”

–“মা ওর মতো চঞ্চল বিছুটি পাতাকে আমি কি করে নিজের মনের মতো করবো? বাচ্চা মেয়ের সাথে সংসারটাও করতে পারবো না। তাছাড়া এখুনি এই সব সংসার-বিয়ের ফ্যাসাদে পড়তে চাই না। যে আমার বউ হবে, আমার মনের মতো হবে।”

–“তোকে আমরা কেউ এখুনি সংসার করতে বলছি না। ওর ১৮ বছরের আগে তো তোদের সংসার করতে হচ্ছে না। দুই বছর যথেষ্ট সময় আছে, ওকে নিজের মনের মতো তৈরি করার জন্য। আমরা শুধু মাত্র শরীয়ত মোতাবেক বিয়েটা পড়িয়ে রাখবো।”

–“আহহ মা! কেন বুঝতে চাইছো না, ওর মধ্যে যখন ম্যাচুরিটি আসবে, তখন যদি সংসার না করতে চায়। তখন কী জোড় করে আমার সাথে বেঁধে রাখবে?”

–“খোকা! পরের কথা পড়ে ভাবা যাবে!
মরার আগেই তুই কেনো ভুত হচ্ছিস বলতো?”

–”ওরে আমার আম্মাজান! আমার পক্ষে এই ১৬ বছরের কেন ১০০ বছরের কন্যাকে বিয়ে করা সম্ভব না। আমি…..”

–“এই তোর সমস্যা কোথায়? বাবা মা’র মুখে মুখে তর্ক করছিস? তোর বাবা কতো বড় মুখ করে মেয়েটার বাবাকে কথা দিয়েছে। এখন তোর জন্য তার কথার খেলাফ হবে এটা মানতে নারাজ আমরা।’

–“মা তোমরা আমাকে কেন বলির পাঠা বানাচ্ছো? ইহান তো আছে ওর সাথে দিয়ে দাও বিয়েটা। ”

–“ইফাননননন রে!”
রেগে চিৎকার করে ইফানের বাবা বলল।

বাবার মুখে নিজের নাম এমন ভাবে শুনে ইফান জাওয়াদ একটু থতমত খেয়ে যায়। আজ পর্যন্ত ইফান কখনো বাবা-মা’র কথার অবাধ্য হয়নি। আজকেও হয়তো হতে পারবে না।
ইফান মনে মনে বলছে, “ইশ রে ইহানের মতো যদি আগে থেকে অবাধ্যতা করতাম তাহলে এরা জোড় করে আমার বাল্যবিবাহ দিতে পারতো না!”

ইফানে বাবা (ইজাজ রহমান) উদ্বিগ্নতা সহিত বলে উঠলো,”দেখ ইফান এই বিয়েতে তোর অমত করার কোন চান্স নেই। তুই মরে গেলেও বিয়েটা করে মরতে হবে। তাই ন্যাকামি না করে চুপচাপ হ্যাঁ বলে দে।”

ইফান মনে মনে কান্দে আর বলে,”ইফানে আজ ফাঁন্দে পড়িয়া বিয়ের পিঁড়িতে বসিবে। আহা কি কষ্টের বিয়ে রে। আগে যদি জানিতাম আমার এমনে জোড় করে বিবাহ দেওয়া হবে, তাহলে কখনো ভুলেও পিরিতির ক্লাসের স্টুডেন্ট হইতাম না।”

ইজাজ রহমান -আমি কি তোর নিরবতা কে সম্মতি মনে করবো?

ইফানের মা জিনিয়া উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলেন,”আরে আপনিও যে কী বলেন না! ইফান কী আর আমাদের ছোট ছেলে ইহান না কী? ঐ বেয়াদব ছেলেটার মতো না আমার বড় ছেলেটা মাশাল্লাহ্ অনেক ভালো। ইফান কে আমরা যা বলবো ইফান তাই শুনবে এবং সে কাজ করবে।ইহানের মতো বিদ্রোহ করবে না।”

ইফান- বাবা বলছিলাম যে, দেখো মেয়েটার বয়স ১৬ বছর কিছু দিন পর মেয়েটা কলেজে ভর্তি হবে। আর কোথায় আমি ভার্সিটির লেকচারার। আমার সাথে মেয়েটার বয়সের পার্থক্য কিন্তু অনেকটা।

ইজাজ রহমান রেগে অস্থির হয়ে বলে, “এই তুই কি বুড়ো হয়ে গেছিস? আজ না হয় কাল তোর বিয়ে করতেই হবে। সেখানে বাচ্চা একটা বউ পাচ্ছিস তাতে আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলবি। সে কচি বউ পেয়ে আলহামদুলিল্লাহ্‌ না বলে আমার এজ, এজ, এজ করে ছাগলের মতো ডেকে যাচ্ছে।”

জিনিয়া বেগম- এই তুই জানিস আমার শাশুড়ি মা মাত্র তেরো বছর বয়সে তোর ২৮ বছর বয়সী দাদুভাই এর বউ হয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে আসছিল!

ইফান বিড়বিড় করে বলল- “এই জন্যই তো বুইড়া কচি বউটাকে একলা রেখে ওপারের টিকিট কেটে চলে গেছে। বুইড়া বয়সে কচি বউ পেয়েছিল এটাই তার ভাগ্য! এই জন্য তো বহু কষ্টে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের বাবা হয়েছিল।”

ইজাজ রহমান – এই তুই কী বললি? আমার বাবা বুইড়া ছিলো? তোর বাবা বুইড়া। ”

ইফান -তুমি নিজেকে বুড়া মনে করলে আমার সমস্যা নেই। তাই বলে বংশের পরম্পরা মেন্টেইন করতে আমাকেও কচি মেয়ে বিয়ে করতে হবে এর কোনো মানে হয় না।

ইজাজ রহমান – আজ তুই যতোই চিৎকার করিশ না কেন সমস্যা নাই। আজকের এই বিয়েটা দরকার হলে তোর ঐ ত্যাড়া ঘাঁড় করবে।

এমন সময় হঠাৎ করে সেখানে ঝড়ের গতিতে সেই ১৬ বছর বয়সী কিশোরী কন্যার আর্বিভাব হয়।

“ওয়াওওওও! বাহ কী দারুণ! এই বাবার বন্ধুর বড় ছেলে তোমার বিয়ে? শোনো না! বলছি যে আমি আগে কখনো কারো বিয়ের দাওয়াত খায়নি। তোমার বিয়েতে আমাকে একটু সুন্দর শাড়ি কিনে দিও কিন্তু। আমি আগে কখনো শাড়ি পড়ি নাই। তবে শুনেছি বিয়েতে যারা বরযাত্রী যায় তারা সবাই শাড়ী পড়ে।”

ইফান- এই বাঁচাল মেয়ে থামাও তোমার কথার প্যাঁচাল।

জিনিয়া বেগম- আহহহ ইফান এমন কাকের মতো রুক্ষ ব্যবহার করিশ কেনো অরিনের সাথে?”

ইফান- আগে কখনো শুনেছো! যে বরযাত্রী সকলে শাড়ী পড়ে যায়। এমনকি ছেলেরাও?

অরিন- এইযে বাবার বন্ধুর আদরের বউ(জিনিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে) আপনার ছেলেটা এতো কথা প্যাঁচায় কেন বলেন তো? আমি কী বলেছি ছেলেরা শাড়ি পড়ে? আর এই যে শুনেন আমি না হয় কথার মাঝে “মেয়েরা” উল্লেখ করতে ভুলে গেছি। কিন্তু আপনি তো লেকচারার তাহলে নিজে কী ভাবে বুঝতে ভুল করলেন?

-এই যে বাবার বন্ধু শুনো! তোমার ছেলেটার মাথায় পুরাই গবরে ভরা। উনি যে কী করে ভার্সিটির টিচার তা-ই বুঝি না। আচ্ছা থাক সেসব কথা। এখন সবাই বলো তোমাদের এই লেকচারার ছেলের বিয়ে কবে?”

ইজাজ রহমান “আজ রাতে ইফানের বিয়ে।”

অরিন- আল্লাহ গোওওও! আল্লাহ! আপনার আমাকে আগে বলবেন না? আমি ফাঁকা হাতে ঐ মাস্টারের বিয়ের দাওয়াত খাবো না কি? কিছু গিফট তো কিনতেই হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে বাবা-মা তো নেই। তাহলে টাকা কোথায় পাবো? ওয়েট করুন, ভাইয়া কে কল করে বলি আপনার ছেলের বিয়ে আমাকে জেনো কিছু টাকা বিকাশে পাঠিয়ে দেয়।

জিনিয়া বেগম- একদম না! ইফানের বিয়ের কথা তুমি কাউকে বলবা না বুঝলে?

অরিন -কেনো বলবো না? আপনার ঐ গোমড়া-মুখো ছেলের বিয়ের কথা সবাই জানে না?

ইজাজ রহমান- নাহ! ইফানের বিয়েটা সিক্রেট বিয়ে! এ বিয়ের খবর আমি, তুমি,তোমার আন্টি আর ইফান ছাড়া কেউ জানবে না।

–“ওমা! বাবার বন্ধু আপনিও কি বোকা! বরের বউ ছাড়া তো বিয়ে হয় না। তা-ই বউ কে তো দরকার হবে। তা সে বউটা কোথায়?”

ইজাজ রহমান- বউটা রাতে জানবে।
তুমি এখন নিজের রুমে যাও। সন্ধ্যা বেলায় তোমার রুমে একজন হুজুর যাবেন উনি যা বলবে তুমি তা-ই করবে, আচ্ছা?

অরিন “জ্বি” বলে চুপচাপ চলে আসে।

অরিন নিজের রুমে এসে ড্রেস সিলেক্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। রাতে বাবার বন্ধুর বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা। এই প্রথম কারো বিয়ের দাওয়াত খাবে একটু সাজগোজ না করলে হয়?

আচ্ছা ঐ লেকচারার এর বিয়ে তবে বিয়েবাড়িটা এতো নিরব কেনো? বিয়ে বাড়িতে কতো মানুষের আনাগোনা থাকে শুনেছি তাহলে এখানে কেউ নাই কেনো? ওহ আচ্ছা এটা সিক্রেট বিয়ে তো। তাই জন্য এ বিয়েতে মানুষের আনাগোনা নেই।

বিকালে একবার বিয়ের আগে নতুন বর কে দেখতে তার রুমে লাফাতে লাফাতে পৌঁছে যায় অরিন। ইফান বারান্দাতে চুপচাপ মন খারাপ করে বসে ছিলো।

অরিন পিছনে থেকে ইফানে গালে হলুদের গুড়া মাখিয়ে দেয়।

আচমকা কারো আলতো হাতের স্পর্শে ইফানের পুরো শরীরটা শিহরিত হয়ে ওঠে। পেছনে ফিরতেই দেখে অরিন একগাল হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অরিনের মুখে এমন হাসি দেখে ইফানের পুরো শরীরটা রাগে রিঁ রিঁ করে উঠে।
নিজের মুখে হাত ছুঁইয়ে দেখে হলুদেরর গুড়া।

ইফান হলুদের গুঁড়া দেখিয়ে দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে,”এসবের মানে কী?”

অরিন বাচ্চাদের মতো উওর দেয়, “আমি শুনেছি বিয়ের আগে না কি নতুন বর-বউ কে হলুদ মাখানো হয়। আপনার তো সিক্রেট বিয়ে, কেউ তো মনে হয় না হলুদ মাখাবে। আমি সবার পক্ষ থেকে সে কাজ করে দিলাম। খুব ভালো কাজ করেছি তা-ই না, বাবার বন্ধুর বড় ছেলে!”

ইফান জোড়ে চেঁচিয়ে বলে, “এই বেয়াদপ মেয়ে জলদি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। নয়তো তোমায় তুলে দো’তালার বারান্দা থেকে নিচে আছাঁড় দিবো।”

অরিন – শুভ কাজে দেড়ি করতে নেই। জলদি করেন। আমি পটল তুলি তাহলে আপনাকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে জেলখানা। শুনেছি সেখান খুনিদের জামাই আদর করে। দেখা গেলো বিয়ের আগেই আপনার অবিবাহিত বউটা বিধবা হয়ে গেলো।”

ইফান জোড়ে চিৎকার করে বলে, “এই অরিন তুমি থামবে? জাস্ট গেট আউট ফ্রম মাই রুম!”

অরিন মুখ ভেঙ্গচি কেটে চলে যাবার সময বলে,
–“দেখিয়েন আপনার বউ জীবনেও আপনাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না। আপনি মেয়েদের সাথে ভদ্রভাবে কথা বলতে পারেন না। আর হ্যাঁ গরিবের কথা বাঁশি হলে সত্যি হয়। এটা আমার কথা না লোক-মুখে শোনা কথা।”

অরিন চলে যাবার পর ইফান নিজের চুল টানাটানি করতে থাকে তারপর বলে “হে আল্লাহ! আমার মনের গহীনে অন্যের বসবাস। সেখানে আমার জীবনে এই মেয়েটা কে সাজিয়ে রাখি কী করে?”

সন্ধ্যাবেলা কাজি সাহেব আসলেন।
তার সাথে ইজাজের পারিবারিক উকিল-বাবু আসেন। তার কথা মতো কাজী সাহেব অরিনের সামনে গিয়ে বিয়ের সকল ফর্মালিটি পূরণ করে তাকে “কবুল” বলতে বলা হয়।

তখন অরিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
–“আমি বাবার বন্ধুর ছেলেকে স্বামী হিসাবে কেনো মানতে যাবো?”

জিনিয়া বলে,”কারণ তোমার বাবা-মা’র ইচ্ছা এইটাই। এখন তুমি কী তাদের কষ্ট দিতে চাও না কী আনন্দ? সেটা তোমার ইচ্ছা। ”

অরিন কিছু সময় চিন্তা-ভাবনা করে দেখে বাবা-মা’র এটাই যখন ইচ্ছা ছিলো তখন আমার মানতে সমস্যা নেই। তারপর হাসি মুখে দ্রুত গতিতে সে কবুল বলে দেয়।

এদিকে ইফানের কাছে এসে তাকে কবুল বলতে বলা হলে সে নাক শিটকাতে থাকে।

তখন ইজাজ জোড়ে একটা ধমক দিয়ে বলে,”বেয়াদব ছেলে একটা! ঐ বাচ্চা মেয়েটা কত দ্রুত কবুল বলে দিয়েছে আর তুই ছেলে হয়ে মেয়েদের মতো ন্যাকামি করছিস”

বাবার কাছে অপমানিত হয়ে ইফানও মুখ গোমড়া করে কবুল বলে দেয়। এরপর মোনাজাতের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হয়।
ইফানের রুম থেকে সবাই বেরিয়ে গেলেই ইফান রুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে।



চলবে!?

#রহিবে_মনের_গহীনে
#পর্ব_০১
#Nishi_khatun

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here