রহিবে মনের গহীনে পর্ব-৩৪শেশ পর্ব

0
3049

#রহিবে_মনের_গহীনে
#পর্ব_৩৪ (অন্তিম পর্ব)
#Nishi_khatun

কয়েকবছর পূর্বের মতো আজও ইফান এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছ। তবে আজ আর অতীতের মধ্যে বহুত তফাৎ আছে। সেদিন রুহানি ছিল ইফানের সামনে! আজ অরিন দাঁড়িয়ে আছে ইফানের সামনে।
রুহানি ইফানের ভালোবাসাকে অসম্মান করেছিল। তবে অরিন ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে এখানে দাঁড়িয়ে।

অরিনে সামনে স্থির জমাটবদ্ধ বরফের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে ইফান। অরিন ইফানের সামনে মাথা নিচু করে রেখেছে। দু জনে চুপচাপ কারো মুখে কোন কথা নেই।

ইফান নির্বাক আজ। মেয়েটা রেজাল্ট পাবার পর থেকে তার সাথে যোগাযোগ কম করছিল।
নানারকম অজুহাত দেখিয়ে ইফানকে এড়িয়ে গেছে। তবে আজ হঠাৎ করে ফোন করে বলে,”একটু এয়ারপোর্টের সামনে আসতে পারবে? কাছের একজন দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাবে। তাকে একটু শান্তনা দিবা। প্লিজ না করবে না! জলদী চলে এসো তোমার জন্য এখানে সারপ্রাইজ আছে।”

ইফান মনে মনে ভাবছে,”হায়রে বোকা আমি!
আমি কি জানতাম এখানে এসে নিজেকে শান্তনা দিতে হবে? মেয়েটা সেই যে তখন থেকে মাথা নিচু করে আছে উঁচু করার নাম নেই মুখে। কিন্তু নাহ এবার আমাদের নিরবতা ভাঙ্গার দরকার।”

ইফান নিজের জড়তা ভেঙ্গে অরিনের বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,”এসবের মানে কি? তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলে কেনো এখানে ডেকে এনেছ? বিদেশে যাচ্ছ তা-ই না? তো চলে যাও! যাবার আগে আমাকে কেনো ডেকেছ? তামাশা দেখাতে? সবাই আমাকে জোকার ভাবে। নিজেদের সিদ্ধান্ত আমার উপর চাঁপিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হয়ে বসে থাকে। আমাকে এভাবে কষ্ট না দিলে চলছিল না বুঝি?”

এবার অরিন ফোঁপাতে ফোঁপাতে ইফানের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে। দুজনের চোখাচোখি হতেই অরিন হুট করে ইফানকে আলিঙ্গন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

হঠাৎ এমন কান্ড ঘটবে এমনটা ইফান কল্পনাও করে নাই। তবে ঐ একপলকে অরিনকে দেখে বুঝতে পেরেছে, মেয়েটা প্রচুর মানুষিক বিষাদগ্রস্ত ছিলো। চোখের নিচে কালোদাগ পড়েছে, চেহারাতে কেমন ফেকাসে ভাব, মোটকথা এলোমেলো এক কন্যা তার বুকে মাথা রেখে কান্নারত আছে।

হুট করে অরিন নিজেকে স্বাভাবিক করতে ইফান কে ছেড়ে দু কদম পিছনে এসে বলে,”আমি জানি কিছু বছর পূর্বে আপনি এই এয়ারপোর্টে কারো কাছে খুব বাজে ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন। তবে আজ আমি আপনাকে সেই আঘাত ফিরিয়ে দিতে আসি নাই। আমি এসেছি আপনার স্বপ্ন পূরণের জন্য।”

ইফান গম্ভীরভাব নিয়ে বলে,”তুমি আমার অতীত জানলে কি করে?”

অরিন মাথা নিচু করে বলে,”আচ্ছা কোন ভাবে আমি যদি আপনার অতীতের মানুষের সাথে যুক্ত থাকি তাহলে কি আপনি আমার সাথে সম্পর্ক রাখবেন না?'”

ইফান বিরক্তিবোধ করে বলে,”আমার অতীতের ছায়াও মাড়াতে চাই না। সেখানে তুমি তার সাথে যুক্ত থাকলে তোমাকেও ভুলে যাব। সেখানে কোন সন্দেহের লেশ মাত্র থাকবে না।”

ইফানের মুখে অরিন এমন কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তখন ইফানের পায়ের কাছে বসে পড়ে অরিন। তারপর অরিন নিজে থেকে বলতে থাকে,”রুহানিকা আমার বড় বোন। তবে সে নামে মাত্র বড় বোন! আমাকে সে কোনদিন বোন বলে স্বীকার করেনি। আমি তার বারো বছরের ছোট বলে সে আমার জন্য লজ্জায় পরত। একদিন তো আমার কারনে লজ্জায় পড়ে রাগে দুঃখে বাবা- মা’র সাথেও বাজে ব্যবহার করতো। তারপর কলেজে ভর্তি হয়ে নিজের পরিবারে সদস্যদের মৃত বলে সম্বোধন করেছে। নিজেকে এতিম বলে আপনাকে ঠকিয়েছে। আপনার ইনোসেন্ট কে সে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। যেইনা নিজের স্বার্থ সিদ্ধি হয়েগেছে তখন আপনার ভালোবাসা কে ছুড়ে ফেলেদিয়ে চলে গেছে। বিশ্বাস করেন এসবের কিছুই আমি জানতাম না। রেজাল্টের কিছুদিন আগে সব কিছু সম্পর্কে অবগত হয়েছি। জানেন নিজের বড় বোন যে কখনো তার ছোট বোনের জন্য লজ্জিত হতে পারে এটা কখনো ভাবতেও পারি নাই। কেমন বোন যে তার ছোট বোনের প্রতি হিংসা পরায়ণ হয়। সে আমাকে পছন্দ করে না এটা মানলাম তবে আপনাকে এভাবে ব্যবহার করতে পারে আগে জানতাম না। আমি আমার বোনের করা খারাপ কাজের জন্য লজ্জিত। যদি সম্ভব হয় আমাকে মাফ করে দিয়েন আমি সেই মেয়ের বোন যে আপনাকে ধোঁকা দিয়ে মৃত্যুরপথে ঠেলে দিয়েছিল!”

ইফান তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,” যে মেয়ে আমার ভালোবাসর মূল্যদান করে নি! সে যে তার ছোট বোনের সাথে সম্পর্ক রাখবে এটা কি ভাবে ভাবলে? তাছাড়া তুমি মাফ চাইছো কেন? আমি অনেক আগে থেকেই জানি রুহানি তোমার বড় বোন। আর তাছাড়া এখন ওর প্রতি কোন অনুভূতি নেই আমার। তা-ই তাকে নিয়ে কোন কথা না বলাই উত্তম। ”

অরিন আশ্চর্য হয়ে বলে,”আপনি আগে থেকে জানতেন রুহানিকা আমার বড় বোন?”

ইফান তাচ্ছিল্যের সাথে বলল- হ্যা জানতাম। যখন তোমার বাবা- মা মারা গেছিল তখন থেকে জানি।
তুমি হয়তো ভুলে গেছো আমি তোমাদের বাড়িতে কয়েকদিন ছিলাম। তা-ই একদিন হুট করে রুহানির ছবি আমার সামনে পড়ে। তোমার এমন মেন্টাল কন্ডিশন ছিলোনা যে তোমাকে জিজ্ঞাস করবো। গোলাপি খালাকে জিজ্ঞাস করি ছবির মেয়েটা কে?”

তখন সে বলে,” অরিন আম্মার বড় বোন রুহানিকা।”

-বাবা- মা’র মৃত্যু সংবাদ কী সে জানে না? ছোট বোনটা একলা পড়ে আছে তাকে শান্তনা দিতে দেশে আসবে না?

খালা আবারো বলে,”রুহানিকা আম্মা অরিন আম্মাজান কে পছন্দ করে না। কারণ অরিন ছোট বলে সবাই তাকে বেশি স্নেহ করে! রুহানিকা আম্মা এটা মোটেই পছন্দ করতো না ছোট থেকে। তা-ই তো বাবা- মা মারা গেছে শুনেও ছোট বোনটাকে আগলে রাখতে দেশে আসে নাই। তবে আদিত্য বাবা একদম উল্টা সে ছোট বোন বলতে অস্থির। তবে বাবার ছোট ছেলেটা খুব অসুস্থ। তাদের একলা বিদেশে রেখে আসা সম্ভব না। নয়তো সে কখনো চলে আসতো। সে অরিন কে তার কাছে নিয়ে যাবে। ”

ইফান অরিনকে উদ্দেশ্য করে বলে,”সেদিন আমার যা বোঝার ছিলো বুঝে গেছিলাম। তবে তুমি ওর আপন বোন তা-ই তার মতো হবে এমনটা কখনো চিন্তা করি নাই।”

অরিন- তাহলে আমাকে আপন করে নিতে আপনার সমস্যা কোথায় ছিল? আর আপনি এতো ভালো কেন বলতে পারেন?

ইফান বলে,”তোমার মত ঐ অল্প বয়সে রুহানির
প্রেমে পড়ে যে নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছি তা দ্বিতীয় বার রিপিট করতে চাইনি। আমি তোমার ঐ অল্পবয়স দেখে সত্যি ভয় পেয়েছি। কারণ এই বয়সের সকল মেয়ে যে ম্যাচিউরিটি সম্পন্ন হবে এমনটা কিন্তু নয়। তাছাড়া তুমি অনেক চঞ্চল ছিলে। আর আমি তোমার থেকে ঠিক বারো বছরের বড় ভাবতে পারো? তোমার মত মেয়ে যে আমাকে স্বামী হিসাবে মানবে এটাও কল্পনাতীত ছিল। আমি চেয়েছি তুমি নিজে উপযুক্ত হও তারপর না হয় আমাদের সংসার জীবনের কথা চিন্তা করা যাবে। তার আগে আমি তোমাকে জীবনের তিক্ততা সম্পর্কে অবগত করতে চাই নি। দুনিয়াদারি খুব কঠিন। এখানে আপন মানুষেরা মুখোশের আড়ালে থাকে। তা-ই সব সময় তাদের ভরসাতে থাকবে না। নিজেকে নিজের যোগ্য করে তুলবে যাতে করে কখনো বিপদে পড়লে তাদের ভরসাতে বসে থাকতে না হয় বুঝলে পিচ্চি। ”

অরিন এবার একগাল হেসে ইফান কে আলিঙ্গন করে বলে, “আপনার বয়স ১০০ বছর হলেও আমার সমস্যা নেই। কারণ বুইড়া হলেও আপনি আমারি থাকবেন। তাছাড়া অল্প বয়সটা না হয় আমারি থাক।”

ইফান অরিনের গাল টেনে বলে,”এবার বলো তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? আর কোথাও যাচ্ছ তা আমাকে আগে কেন জানানোর প্রয়োজন বোধ করো নাই?”

অরিন ইফানের বুকে মাথা রেখে বলে,”আমি আমার স্বামীর স্বপ্ন পূরণ কতে বিদেশে স্টাডির জন্য যাচ্ছি। তাকে সারপ্রাইজ দিব বলে আগে জানানোর প্রয়োজন মনে করি নাই। আমার বোনের জন্য আপনার যে স্বপ্ন মাঝ পথে দিশা হারিয়ে ছিল। সে স্বপ্ন আমি আপনার স্ত্রী হয়ে পূরণের পণ করেছি। এবার আপনি আমাকে দেশ ছেড়ে যাবার অনুমিত দিন। আপনি অনুমিত না দিলে আমি যাবো না। এখন বলেন আপনার জবাব কি?”

ইফান অরিনে কপালে চুম্বন করে বলে,” তুমি আমার স্ত্রীর সে কথা তো সারাদুনিয়া জানে না। তারপর ও তুমি আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য আমার কাছ থেকে দূরে যেতে চাইছো?”

অরিন অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে,”আমি না হয় গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে যখন দেশে আসবো! তখন সারা পৃথিবী কে জানিয়ে তোমার সাথে সুখে দাম্পত্য জীবনের শুভসূচনা করবো। ততোদিন বিবাহিত ব্যাচেলার হয়ে দুজনে দু প্রান্তরে থেকে চুটিয়ে প্রেম করবো। তাছাড়া অল্পবয়সী মেয়েটা বিয়েরপর প্রেম করতে ভালোবাসে সংসার করতে নয়। এটা আমার বাণী অন্যদের নয় বুঝলে!”

ইফান অরিন কে নিজের বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”ওরে দুষ্টু বউ রে আমার।
কতো কিছু প্লানিং করে রাখছে ভাবা যায়?”

এমন সময় অরিনের ফ্লাইট এর ঘোষণা করে দেয়। অরিনকে এখন বিমানে উঠার জন্য ইফানের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।

অরিন ইফানের হাতে চুম্বন করে বলে,”এবার আমাকে বিদায় দাও, যেতে হবে! আচ্ছা তুমি কি কয়েকবছরের দূরত্বো আমাকে ভুলে যাবে?”

ইফান নিজের বুকের উপর হাত রেখে অরিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি নিশ্চিত মনে সেখানে গিয়ে লেখাপড়া করো সমস্যা নেই।
আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো যতোদিন পর্যন্ত তুমি দুজনের স্বপ্ন পূরণ করে দেশে না আসো।
এটুকু বিশ্বাস তুমি আমাকে করতেই পারো।”

ইফান কে শেষ আলিঙ্গন করে অরিন ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে নিজ জন্মভূমি ত্যাগের পথে পা বাড়িয়ে দেয়। ভালোবাসর মানুষকে ছেড়ে যাওয়ার কাজ কী এতোটা সহজ? তবে তাকে যেতে হচ্ছে। বিশ্বাস আছে ফিরে এসে সুখের সাগরে ভেলা ভাসাবে দুজনে।

আস্তে আস্তে অরিন ইফানের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। তখন ইফান মনে মনে বলে,

“যেদিন প্রথম অনুভব করছি ভালোবাসি তোমায়!
হৃদয়ের সবটা জুড়ে তোমার বিচরণ।
তুমি #রহীবে_মনের_গহীনে
কিছুটা অপ্রকাশিত অনুভূতির আড়ালে।”

(আসসালামু আলাইকুম! সবাইকে ধন্যবাদ
এতোদিন গল্পটা কে এতো ভালোবাসা দেওয়ার জন্য।
আশা করি আমার আগামী গল্প গুলোকেও
এভাবে ভালোবাসা দিয়ে আমার পাশে থাকবেন।
কাল থেকে পবিত্র রমজান মাস শুরু। সবাইকে রমজান মুবারক! বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করবেন। আমার পরিবারের সবার জন্য দোয়া করবেন! ফি আমানিল্লাহ্।)

“সমাপ্ত”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here