সর্বনাশিনী পর্ব-১১

0
2136

#সর্বনাশিনী
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
পর্ব-১১
ঘড়ির কাটা ঢং ঢং করে বেজে, মনে করিয়ে দিচ্ছে, এখন লাঞ্চের সময় প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে। দিলশাদ নিজের ডান হাতটা হাওয়া তুলে দেখলো। ব্যন্ডেজ করা। তারপর আবার খাবারের দিকে তাকালো। কিভাবে খাবে সে? এদিকে বড্ড ক্ষুধা -ও পেয়েছে। দিলশাদ উঠে এলো। খাবার টেবিলের পাশে যেতেই বড্ড মেজাজ গরম হলো। আজকের দিনটাতেই সব কটা মাছ আইটেম করতে হলো? হাহ্! দিলশাদ একবার ভাবলো খাবার টা চেঞ্জ করাবে, কিন্তু পেটের ভিতর চুচু ডাক আর ইঁদুরের লাফালাফি সইতে পাড়লো না। দিলশাদ অবাক হলো। মনে মনে ভাবলো,

” এমন তো কখন- ও হয়নি। এত ক্ষুধা কখনোই লাগেনি। আজ এমন কি হলো?”

পরে দিলশাদের মনে পড়লো। কাল দুপুরের পর থেকে এক ফোঁটা পানি ওর পেটে যায় নি। দিলশাদ হতাশার শ্বাস ছাড়লো। কাজের মাঝে এতই ডুবে গেছিলো সে, খাবারের কথা ভুলেই গেছিলো। দিলশাদ আর দেরি করলো না। একটি চামচ দিয়ে খাবার শুরু করলো। কিন্তু বাম হাতে ঠিক মতো খেতেই পারছিলো না। ঠিক সেই সময় দরজায় টোকা পড়লো। দিলশাদ তার শান্ত গভীর কন্ঠে বলল,

” কামিং!”

স্নেহা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো,

” স্যার এই ফাইলে আপনার সাইন লাগবে।”

দিলশাদ মাথা নাড়লো। ফাইলটি ভালো করে চেক করে খুব কষ্টে সাইনটি করে দিলো। আজ দিনের মধ্য ভাগেই এই লিখা লিখির কাজ টা বড্ড এড়িয়ে গেলেও এবার আর পারলো না। সাইন করার সময় রক্তে ভিজে যাওয়া সাদা ব্যন্ডেজটি চোখ এড়িয়ে গেলো না। স্নেহা তার বুকের মধ্যে ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করলো। তবে তা বুকের ভেতরেই কোথাও হাড়িয়ে গেল। স্নেহা পিছনে ফিরে চলে যেতে লাগলো। দু কদম এগিয়ে আবার ঘাড় বেকে পিছনে তাকালো স্নেহা তার ভাড়ি পল্লব নিয়ে। এবার আর স্নেহা থাকতে পারলো না। যাই হোক কোনো এক সময় এই ব্যক্তিটিকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে সে। দিলশাদের চোট পাওয়া হাতে খাবার তুলতেই দিলশাদ ব্যথায় মুখ কুচকে নিচ্ছে। দিলশাদের ব্যথাতুর মুখটা এতোটাই আকৃষ্ট করলো স্নেহার অবুঝ মনটাকে…. যে স্নেহা নিজের অজানতেই দিলশাদের কাছে পৌঁছে গেলো। দিলশাদের পাশে বসে তার হাত থেকে প্লেটটি নিয়ে খাবার নিজ হাতে মাখিয়ে মুখে তুলে দিলে। হুটহাট এমন এক অবস্থায় কি রিজেকশন দিবে দিলশাদ বুঝতে পাড়লো না। শুধু পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো খেতে লাগলো খাবার টুকু। দিলশাদ স্নেহা প্রতিটি মুহূর্ত গভীর ভাবে উপভোগ করতে লাগলো। স্নেহার তাকানো, তার চোখ, অগোছালো ছোট ছোট অবাধ্য চুল, ঠোঁট বাঁকানো, কখনো মাছের কাঁটা বাছার সময় মুখের অদ্ভুত ভঙ্গিমা সব কিছুই মনোমুগ্ধকর। দিলশাদের গোলাপী ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি অজান্তেই ভেসে গেলো। দিলশাদের হাসি মুখখানা বেশিক্ষণ আর রইলো না। ধারাম করে দরজা খুলে এক বিকট শব্দে। ভেসে আসে এক চিৎকার,

“এখানে কি হচ্ছে দিলশাদ?”

ছলছল চোখে প্রশ্ন করে বসলো সেহের। সেহেরকে এমন সময় হয়তো দুজনের কেউ আবিষ্কার করে নি এখানে। সেহেরকে দেখে দুজনের কোনো মুখমন্ডলের পরিবর্তন হলো না। তবে, স্নেহা লাস্ট খাবার টুকু দিলশাদের মুখে তুলে দিতেই সেহেরের মাথা গরম হয়ে গেলো। এক টানে খাবারের প্লেটটি টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললো মাটিতে। রাগে গজ গজ করে স্নেহাকে টেনে তুলে ঠাট্টিয়ে এক চর মেরে দিলো।বলল,

” বেহায়া মেয়ে লজ্জা করে না, অন্যের বয়ফ্রেন্ডের গা ঘেসতে?”

স্নেহা ঠোঁট বাঁকালো। পাশ থেকে দিলশাদ ধমকে উঠে বলল সেহেরকে,

” সেহের আর ইউ আউট ওফ মাইন্ড?”

” দিলশাদ তুমি… তুমি আমাকে এভাবে ঠকাচ্ছো? আমি এখানে আজ না আসলে জানতেই পারতাম না, তুমি আমার পিট পিছে ছিঃ!”

দিলশাদের এবার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। শক্ত গলায় বলল,

” সেহের আমি তোমাকে কিভাবে ঠকিয়েছি? তোমাকে শুধু সহ্য করছি, এ জন্য কারণ তুমি আমার মাকে বাঁচিয়েছো। তাই বলে আমার মাথায় চড়তে বসার অনুমতি দি নাই।”

স্নেহার সামনে এভাবে কথা গুলো শুনে মাটি বসে বিলাপ শুরু করে দিলো। সেহের সত্যি এ মেয়ের কাছে হেরে যাবে? ও প্রথমে স্নেহা, তারপর মারিয়া, এমন অনেক নারীকে সে সরিয়ে দিয়েছে দিলশাদের জীবন থেকে এবার কি এই আকৃতা শেখকেও সরাতে হবে? আজ সকালেই মারিয়া যদি তাকে ফোন না করতো? তাহলে সে আজো হাসপাতালে বসে থাকতো।

স্নেহা এসব দেখে হাসলো মনে মনে। দিলশাদের দিকে সিরিয়াস লুক করে তাৎক্ষণিক ভাবে বলল,

” স্যার আমি আসচ্ছি। ”

বলেই বেড়িয়ে গেলো। স্নেহা যেতেই সেহের দিলশাদের পা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

” দিলশাদ, তুমি প্রতিবার আমাকে এড়িয়ে যাও, আমি তোমাকে কত ভালোবাসি আর তুমি? আমাকেেত অবহেলা করো? আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না।”

দিলশাদ তার পা ঝাটা মেরে সেহেরকে সরিয়ে দিলো। এবং যেতে যেতে বলল,

” আমার মনে ছোট থেকেই সেই একজনের বসবাস। আর সে হচ্ছে স্নেহা। সে ছিলো সে আছে এবং থাকবে!”

দরজা খুলে আবার বন্ধ হলো। সেহের নিজের হার এভাবে হবে মেনে নিতে পাড়ছে না। তবে সে লড়বে, লাষ্ট পর্যন্ত লড়াই করবে। দিলশাদ তার ছিলো থাকবে।

অন্যদিকে স্নেহা গাড়ির ভিতর বসে আছে। হাতের ফোনটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যাচ্ছে। একটি ফোনের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর ফোনটি বেজে উঠলো। ফোনটি তুলতেই ওপাশ থেকে কিছু বলতেই স্নেহা বলল,

” ধন্যবাদ আপনাকে স্যার!”

বলেই ফোনটি কেঁটে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে হসপিটালের ভিতরে ঢুকে পরে স্নেহা। বিশাল বড় একটি কেবিন। হসপিটালের মধ্যে খুব সুন্দর করে ঘরের মতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিন্দুর কেবিনটি। স্নেহা বিন্দুর পাশে বসলো। নিথর দেহটি পড়ে আছে হসপিটালের সাদা চাদর জড়িয়ে। স্নেহার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। বিন্দু সব সময় স্নেহাকে তার মেয়ের মতো দেখেছে, আদর করেছে। কখনো পর ভাবেনি। এমনকি স্নেহাকে দিলশাদ বাসা থেকে বের করে দেয়ার পরেও বিন্দু দেখে করতে গেছে কয়েকবার স্নেহার সাথে। স্নেহা তখন অভিমানে কথা বলে নি। অথচ এই বিন্দুই তাকে বাঁচাতে গিয়ে আজ প্যারালাইজড। স্নেহা বিন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” মা আমাকে চিন্তে পেরেছেন? আমি আপনার স্নেহু। মা আপনি সেদিন না থাকলে আজ হয়তো আমি পৃথিবীতে থাকতাম না। কিন্তু কি অদ্ভুত তাই না মা, যেই ব্যক্তি আপনার আর আমার অস্তিত্ব বদলে দিলো, সে ঠিকই আছে আর আমরা গন্তব্যহীন!”

স্নেহা কিছুক্ষণ চোখের জল ফেললো। বিন্দুকে আবারো ভালো করে দেখে স্থান ত্যাগ করলো। যে কোনো মুহুর্তে দিলশাদের গার্ড চলে আসতে পারে, এই ভেবে সে দ্রুত চলে গেলো। কিন্তু পিছনে আর ফিরলো না। হয়তো ফিরলে দেখতে পেতো বিন্দুর চোখের কোনে থেকে-ও জল গড়িয়ে পরছে।

———-+

কয়েকটা দিন কেঁটে গেলো। শীত পেরিয়ে বসন্ত চলে এলো। নীল আকাশের রঙ্গিন ঘুরি বাতাসে উড়ে আর কোকিলের সুর শুনে আগমন জানলো দু-হাত ভড়ে। তেমনি এক বিকেলে হেলতে দুলতে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে এলো সেহের। কিছু একটা নিয়ে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তখনি একটি কালো রঙ্গের গাড়ি এসে থামলো সেহেরের সামনে। সেহের কিছু বুঝে উঠার আগেই কিছু লোক এসে জোর করে তুলে নিলো গাড়িতে। সেহের চিৎকার করবে তার আগেই মুখের সামনে কাপড় চেপে ধরতেই জ্ঞান হারালো সে। যখন জ্ঞান ফিরলো, নিজেকে এক অপরিচিত জায়গায় আবিষ্কার করলো সে। অন্ধকার একটি রুম। চারিদিকে ভ্যাপসা গন্ধ । বমি চলে এলো সেহেরের। ঠিক সে সময় সেহের খেয়াল করলো পর্দার আড়ালে কোনো ছায়া মূর্তি। সেহের ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। গলার শব্দ কোথাও হারিয়ে যেতে লাগলো,

” স্নেহা… স্নেহা? এটা তুমি? প্লিজ আমাকে মেরো না আমাকে যেতে দাও।”

ছায়া মুর্তিটির কোনো পরিবর্তন হলো না। সে শুধু স্নেহার দিকে তাকিয়ে রইলো। সেহের কাকুতি মিনতি করতে লাগলো। কিন্তু নিজের জায়গা থেকে নরতে পারলো না।শিকলে বাঁধা তার পা। এবার স্নেহা বলল,

” সেহের তোমার মনে আছে? এভাবেই একটি রুমে আমাকে বন্দী করে রেখে ছিলে? এখন তোমার পালা।”

বলেই স্নেহা দরজা লাগিয়ে চলে গেলো। বিড়বিড় করে বলল,

” সেহের সময় তোমাকে এবার সব ফিরিয়ে দিবে।”

চলবে,

আমি রি-চেক দি নাই। কারণ ফোনটা ভাইয়ের বেশিক্ষণ হাতে পাইনা লিখেই পোস্ট করে তাকে দিয়ে দিতে হয়। আশা করি বুঝবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here