#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
পর্ব ০৬
#সিলিভিয়া_ফারাশ
(১২)
জুবানের বাবা জুবায়ের ইমজাত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সেই সূত্রে সে নিজেও রাজনীতিতে জড়িয়েছে। জুবায়ের ইমজাতের সব গুনই পেয়েছে ছেলেটা। বাবার মতোই সুদর্শন তীক্ষ্ণ কুটিল বুদ্ধি সম্পন্ন আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো জুবানের বহু নারীতে আসক্তির এই গুণটাও বাবার কাছ থেকেই পাওয়া। বাবার আদর্শে একেবারে নিজেকে আপাদমস্তক মুরিয়ে রেখেছে জুবান। ছোট থেকেই দেখছে বাবার বহু মেয়েদের সাথে মেলামেশা। জুবানের মা সোফিয়া শুরুর দিকে প্রতিবাদ করত এতে দিন রাত তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবা মাকে কখনো হাসি মুখে কথা বলতে দেখেনি জুবান অবশ্য ক্যামেরার সামনে তারা একটা হ্যাপি ফ্যামিলি। জুবানের যখন বারো বছর বয়স তখন তার মায়ের সাথে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা ঘটে। এই দূর্ঘটনায় শয্যাসায়ী হয় সোফিয়া। সবাই এটাকে অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা হিসেবে জানলেও একমাত্র জুবান জানে এটা কোনো দূর্ঘটনা নয়।
সোফিয়া প্যারালাইজড হওয়ার পর জুবায়েরকে আর পায় কে? সে তো নিজের কাজ আর শয্যাসঙ্গীদের নিয়েই ব্যস্ত। এতটাই ব্যস্ত যে নিজের একমাত্র সন্তান যে বিপথগামী হয়েছে সেদিকে তার কোনো খেয়ালই রইল না। খুব ছোট বয়স থেকেই মেয়েদের সাথে মেলামেশা জুবানের। তার সৌন্দর্য আর টাকা পয়সা দেখে মেয়েরা কেমন নিজে থেকেই জুবানের কাছে নিজেদের শপে দিত। জুবান যাদের পছন্দ করে তাদের একরাতের বেড পার্টনার বানিয়ে দম নেয়। তবে সে কখনো কাউকে জোর করে না। নিখুঁত প্রেমের অভিনয় করে হলেও ট্রাপে ফাঁসিয়ে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে সে। তুরের সাথেও এমনটাই করবে ভেবেছিল জুবান কিন্তু সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। তুরের এই ঘুমন্ত রসগোল্লার মতো মিষ্টি চেহারার দিকে তাকিয়ে কিছুতেই খারাপ চিন্তা আসছে না তার।
তুরের ঘুম ভাঙ্গে পরদিন দুপুর বেলা। মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে তার। পাশ ফিরে জুবানকে বসে থাকতে দেখে এক মূহুর্তের জন্য ভয় পেয়ে যায় সে। জুবানের উস্কোখুস্কো চুল ফোলা ফোলা গাল। লাল টকটকে চোখ বলে দিচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি সে। তুরের মাথার পাশে চেয়ারে বসে ঝুঁকে তুরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জুবান। চোখের পলক ফেলছে না যেন পলক ফেললেই তুর ভ্যানিশ হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে গতকালের কথা মনে পরে তুরের। জুবান তাকে কিডন্যাপ করেছে মনে পড়তেই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় তুর। একটা জোরালো ফাইটের জন্য নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে সে কিন্তু ঘুম ঘুম ভাবটা এখনও কাটেনি তার। তুর শীতল গলায় বলল,
” নির্লজ্জতার সর্বনিম্ন স্তর পার করেছেন জুবান। আপনি নিচ জানতাম কিন্তু এতটা নিচে নামবেন সেটা ভাবতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত আমাকে কিডন্যাপ করলেন? আমাকে কিডন্যাপ করে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছেন আপনি। আপনাকে আমি ছাড়বো না। আমি এখান থেকে ছাড়া পাই কিংবা না পাই আপনাকে আমি জা/নে মেরে ফেলব। আপনার মতো নর্দমার কীটের সাথে কথা বলতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।”
হুট করেই উঠে দাঁড়ালো জুবান। ওয়াশ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
” বাড়ি ফিরে যাও রসগোল্লা। আর কখনও আমার চোখের সামনে আসবে না।”
শব্দ করে ওয়াশ রুমের দরজাটা বন্ধ করল জুবান। তুর অবাক চোখে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। হুট করে জুবানের কী হলো? নিজেই কিডন্যাপ করে আনলো আবার নিজেই মেজাজ দেখিয়ে চলে যেতে বলছে। মেজাজ তো এখন তুরের দেখানোর কথা।
” আপামনি ওঠছেন? আমরা তো ভয় পাইয়া গেছিলাম। ছোটো ভাইজান কত চিন্তা করতাছিল জানেন সারা রাত না ঘুমিয়ে আপনার পাশে বসে ছিল।”
” আপনি কে?”
তুরের এমন সোজা কথায় বিব্রতবোধ করলো মহিলা। হাতের খাবারের প্ল্যাটটা টি টেবিলে রেখে হাসি হাসি মুখ করে বলল,
” আমি জুলেখা। সবাই জুলু কয়। আফনেও জুলু কইবেন আমারে।”
” কেন? আপনাকে আমি জুলু বলতে যাব কেন? আপনাকে আমি কিছুই বলব না।”
তুর ওঠে দাঁড়ালো। দাঁড়ানোর পর মাথা ঘুরে উঠলো তার জুলেখা ঠিক সময় এসে ধরায় মাটিতে পড়া থেকে বাঁচল। জুবান এসে তুরকে বকাঝকা করতে লাগল,
” মুখে মুখে শুধু বড় বড় কথা বললে চলবে রসগোল্লা? খাওয়া দাওয়াও তো কিছু করতে হবে।”
জুবান ভাত মেখে তুরের সামনে ধরল। তুর চিৎকার করে বলল,
” আধিক্ষেতা আপনাকে আমি ঘৃণা করি জুবান। জুতো মেরে গরু দান করতে আসছেন। আপনি ভাবলেন কী করে আমি আপনার হাতে খাবার খাবো?”
জুবান খাবারের প্ল্যাট নামিয়ে আরেকটা পাত্রে হাত ধুয়ে নিল। আহত চোখে তাকিয়ে বলল,
“এই টুকুন একটা শরীর পুরোটাই তেজ দিয়ে ভরপুর। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছ না কিন্তু তেজ দেখাতেও ভুলছো না। জুলু আপা নতুন খাবার নিয়ে আসো রসগোল্লার জন্য। ”
” আপনাকে না বলেছি এমন উদ্ভট নামে ডাকবেন না।”
ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো জুলু। দুজনকে একসাথে বেশ মানায় কিন্তু ছোটো ভাইজানের রসগোল্লায় তো একটুও মিষ্টতা নেই। কেমন ঝাঁঝে ভরপুর।
(১৩)
“কাল রাজনীতিবিদ জুবানের সাথে ছিলেন রক্তজবা?”
সায়নের এমন শীতল কন্ঠে এক মূহুর্তের জন্য থমকালো তুর। তড়িৎ গতিতে সায়নের দিকে তাকালো। সায়ন খুব স্বাভাবিক ভাবে লিফটের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবটা এমন যেন তুর নামক কেউ যে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ আগেই জুবান ওকে অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। লিফটে ওঠে সায়নের সাথে দেখা তার। হঠাৎ সায়ন তার সাথে এভাবে কথা বলছে কেন? তাদের এই স্বল্প পরিচয়ে এভাবে কথা বলার মতো সম্পর্ক তো এখনো গড়ে উঠেনি। সায়নের কথায় কিছুর একটা আভাস পেলো তুর। চাপা রাগ অভিমান আর অধিকার বোধের সংমিশ্রণ। তুর বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে সায়নের শ্রুভ্র মুখের দিকে। লিফট থামলো। একটা মেয়ে উঠলো লিফটে। তুর সায়নকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারল না। পাঁচ তলায় এসে সে নেমে গেলো। ফ্ল্যাটের দরজা আজও খোলা। তোয়া দরজার সামনে একটা চেয়ারা বসে ঝিমুচ্ছে । তোয়ার শ্যাম বর্ণের মুখটা চুপসে গিয়েছে। চোখের পানি শুকিয়ে গালে লেপ্টে আছে। তুর এগিয়ে যেতেই ছুটে এলো তোয়া। ঝাঁপিয়ে পড়ল তুরের উপর। বোনকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। নাক টেনে বলল,
” রাতে কোথায় ছিলি আপু? তুই জানিস আমি কত ভয় পেয়েছিলাম। সারারাত ঘুমাতে পারিনি আমি। তুই ঠিক আছিস তো আপু? তোর কিছু হয়নি তো?”
তোয়া একটানা কথা বলেই যাচ্ছে। তুর মুচকি হেসে তোয়ার মাথায় হাত বুলাল। পাগল একটা। কেঁদে কেটে চেহারার কি হাল করেছে দেখো।
শাহরিন এখন ল্যাবে আছে। কেসের তদন্তের ব্যপারে কথা বলতে এসেছে সে। ডক্টর চৌধুরীর সাথে কথা বলছে শাহরিন।
” খুনি কোনো বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ শাহরিন। সে খুনের আগে ভিকটিমের উপর খুব নৃশংসভাবে অত্যাচার করে। তারপর বুকের চামরা তুলে নেয় এরপর বুকের মাংস কেটে নেয়।”
” বুকের চামরা আর মাংস তুলে নেওয়ার সময় ভিকটিম জীবিত থাকে নাকি মৃত?”
“অবশ্যই জীবিত থাকে। খুনি ভিকটিমকে জীবিত রেখেই তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।”
” খুনি কোনো সাধারণ মানুষ হলে ভিকটিমকে জীবিত রেখে চামড়া আর মাংস তুলে নেওয়া কীভাবে সম্ভব?”
” তোমার ধারণাই ঠিক শাহরিন। খুনি কোনো সাধারণ পেশার মানুষ নয়। পেশাদার কোনো ডক্টরের কাজ এটা।”
শাহরিনের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে ওঠেছে। কোনো ডক্টর কেন এই খুন গুলো করছে? প্রতিশোধের নেশায় নাকি অন্য কোনো ব্যপার। ম্যাসেজ টোনের শব্দে মোবাইলে চোখ রাখল শাহরিন।
” শাহ্ যদি খুনগুলো বন্ধ করতে চাও তাহলে বন্ধ হওয়া সেই ৩০১ নাম্বার কেসটা রিওপেন করো। সেই কেসটা সমাধান করতে পারলেই এই কেসটাও সমাধান হয়ে যাবে। তোমার কাছে সময় মাত্র ৫ দিন। পাঁচ দিন পর আবার একটা লাশ পাওয়া যাবে। চলো তোমাকে একটা ক্লু দেই। এবারের লাশ পাওয়া যাবে শহরের সেই স্থানে যেখানে একই সঙ্গে কারো মুখে হাসি ফুটে তো কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইউর টাইম স্টার্ট নাউ।”
চলবে….