এ জীবন নাটকেরই মঞ্চ – ২
ফারজানা আহমেদ
_________
– সোহেল, তুই আজকে থেকে যা। আরো কিছু কাজ আছে। আর কালকে রোহিতাকে কলেজেও ভর্তি করাতে নিয়ে যাবি। তোর খালু যেতে পারবেন না।
কথাটা বলে ভেতরে চলে গেলেন রিনা বেগম।
– এই রোহিতা। মোবাইল নিয়ে এসেছি। এইবার বলো, ফেইসবুক আইডির নাম কী?
রোহিতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল নিহিন। রোহিতার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মনে মনে এই আশঙ্কাই করছিলো সে। ঠিক, ঠিক এই মেয়েটা এসেই ফেইসবুক আইডির কথা বলল। আল্লাহ! এবার কী হবে? রোহিতা ফেইসবুক চালায় এটা তো তার মা ছাড়া কেউ জানে না। সোহেলও জানে না। ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়’ – প্রবাদটি যে-ই বলেছে একদম ঠিক ঠিক বলেছে। রোহিতা ঢোঁক গিলল। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল।
– ফেইসবুক আইডি মানে? রোহিতা তুই ফেইসবুক চালাস?
সোহেল কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রোহিতাকে। নিহিন বলল, হ্যাঁ তো কী হয়েছে…
– আরে আমি কেন ফেইসবুক চালাতে যাব? ও… ও… মানে ও একটা নায়কের ফেইসবুক একাউন্ট নিতে এসেছে।
নিহিনকে চিমটি কেটে থামিয়ে কথাটা বলল রোহিতা। তারপর নিহিনের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকালো। নিহিন হাবার মতো তাকিয়ে থাকল। সোহেল বলল, মানে? কিসের নায়ক? মিথ্যা বলছিস?
নিহিন এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, হ-হ্যাঁ, আসলে একটা নাটক আছে। মানে ঐযে স্টারপ্লাসে দেয়। ইস পেয়ার কো কেয়্যা নাম দু। ঐটারই নায়কের আইডি নিতে…
নিহিনের কথাটা পুরো করার আগেই সোহেল গটগট পায়ে ঘরের ভেতর চলে গেল। রোহিতা আঁতকে ওঠে নিহিনকে বলল, ফাঁসিয়ে দিয়েছিস রে মেয়ে আমারে! এতো বড় গলা কেন তোর?
– আমি কী করলাম! আমি জানি নাকি তুই চুরি করে চালাস? তাছাড়া শোন, তুই করে বলছিস, শুনতে ভালোই লাগছে। একসাথে পড়ব যেহেতু…
– ইতিহাস কপচাতে হবে না। সোহেল ভাই মনে হয় আমার মোবাইল খুঁজতে গেছে।
কথাটা বলে দৌড় দিলো রোহিতা। নিহিন অবাক হলো। তারপর রোহিতার পিছু নিলো। রোহিতা নিজের ঘরে গিয়ে দেখল সোহেল তার মোবাইলটা নাড়াচাড়া করছে। রোহিতা গিয়েই গরম গলায় বলল, মোবাইলটা দাও।
সোহেল ঠাণ্ডা গলায় বলল, লক খুলে দে।
– কেন দিব? মোবাইল দাও আমার।
– লক খুলে দে, চেক করব।
– একজনের পারসোনাল ফোন এভাবে ঘাটানো অভদ্রতা।
– তোর আবার পারসোনাল? কী আছে? তোর বয়ফ্রেন্ড?
রোহিতা বিরক্তিকর আওয়াজ করল। পেছনে নিহিন দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। তার ভীষণ মজা লাগছে এসব দেখে। রোহিতা বলল, পারসোনাল বলতে যে শুধু বয়ফ্রেন্ডই থাকবে এমন কোনো কথা নেই।
সোহেল এবার ভালোভাবে তাকালো রোহিতার দিকে। তারপর নিহিনের দিকে তাকালো। রোহিতার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে নিহিনকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি একটু বেরোও। ওর সাথে দুটো কথা বলব।
নিহিন কপাল কুঁচকে বলল, আমি? বেরিয়ে যাব?
সোহেল বলল, হ্যাঁ।
রোহিতা বলল, কেন ও বেরোবে? ও বেরোবে না।
সোহেল রোহিতার দিকে ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। নিহিন বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। যাই আমি। কাল সকালে ভর্তি হতে যাবি শুনলাম, আমাকে ডাকিস। একসাথে যাবো।
নিহিন চলে গেল। সোহেল রোহিতার কাছে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, নতুন বান্ধবী বানিয়ে ফেলেছিস এক দিনে?
রোহিতা সোহেলের হাত থেকে নিজের মোবাইলটা নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমার ফোনটা দেও।
– পারসোনাল কী আছে?
– তোমাকে কেন বলব?
– বয়ফ্রেন্ড আছে তোর? সতেরো বছর বয়সে বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছিস?
– মা কে ডাক দিব কিন্তু।
– ডাক না। দেখি ডাক।
রোহিতা নিজের মোবাইল নেয়ার চেষ্টায় বৃথা হলো। হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ রাঙিয়ে তাকাল সোহেলের দিকে। সোহেল হেসে বলল, বয়সটা তো এখন রঙ লাগার। পারসোনাল মানে কী আছে? নিষিদ্ধ ভিডিও?
রোহিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, মানে? বুঝি নি।
সোহেল কিছু একটা বলতে গিয়েও আঁটকে গেল। রোহিতার দিকে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে মোবাইলটা ওর হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল। রোহিতার কানে বারবার বাজতে লাগল ‘নিষিদ্ধ ভিডিও’ কথাটা। নিষিদ্ধ ভিডিও মানে কী বুঝালো সোহেল ভাই?
_____________
কলেজ থেকে মাত্র ফিরে এসেছে নিহিন। কাঁধ থেকে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেললো বিছানার উপর। তারপর মা মা বলে চেঁচাতে চেঁচাতে রান্নাঘরের দিলে গেল। নিলুয়া বেগম আলু কাটছিলেন। নিহিন উনার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, মা কমার্স নিছি। বলছিলাম আর্টস নিব কিন্তু রোহিতা দেখলাম কমার্স নিছে।
নিলুয়া আলু কাটা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা। কয়েকটা ছোট মাছ নিয়ে এসেছেন তোর বাবা। এইগুলো একটু কেটে দে৷ এতোক্ষণ থেকে বসে বসে আলু কাটতে গিয়ে কোমরে ব্যথা হয়ে গেছে।
কথাটা শোনামাত্রই নিহিন চড়ে গেল। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, তোমার বিবেক দেখে অবাক হলাম মা। বাইরে থেকে এসেছি। ক্লান্ত আমি। একটু বসব, কিছু খাব, রেস্ট নেব। তুমি আমাকে মাছ কাটতে বলছ? কেমন মা তুমি?
কথাটা বলে গটগট করে প্রস্থান করল নিহিন। নিলুয়া বেগম একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার বাইরে তাকালেন৷ উঠোন পেরিয়ে রোহিতাদের ঘর দেখা যাচ্ছে। বারান্দায় মায়ের সাথে মাছ কাটতে বসেছে রোহিতা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোমরের ব্যথা নিয়েও মাছ কাটতে বসলেন নিলুয়া। আল্লাহ এক এক ঘরে এক এক ধরনের আওলাদ দেন। কেউ আওলাদের থেকে অনেক সুখ পায়, আবার কেউ পায় অনেক কষ্ট।
একটা রুটি ডিম ভাজি দিয়ে খেয়ে কাপড় নিয়ে পুকুরে গোসল করতে বেরোলো নিহিন। আজ রোহিতার সাথে একসাথে পুকুরে গোসল করবে সে। রোহিতাদের বারান্দায় এসে দেখলো রোহিতা মাছ কাটছে তার মায়ের সাথে। নিহিন গিয়েই হেসে হেসে বলতে লাগল, কীরে কামের বেটি? মাছ কাটতেছিস। এখন তো তোর সাথে মাছের আঁশটে গন্ধ লেগে থাকবে।
রোহিতা কিছু বলল না, হাসলো। তারপর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আর মাত্র কয়টা আছে মা। আমি কাটতে পারব এগুলো। তুমি গোসল করে নেও। আর দা রেখে দিয়ে যাও, আমি ধুয়ে নেব।
রিনা বেগম দা উল্টিয়ে রেখে উঠে চলে গেলেন। এমন সময় তানজিম আসলো। তানজিমকে দেখে নিহিন বলল, তোর ভাই? প্রথম দেখলাম। কিসে পড়ে?
– ক্লাস সেভেনে পড়ে। ক্যান্টনমেন্ট এ। নানুবাড়ির পাশে, ওখানেই থাকবে। আজকে চলে যাবে।
– ও।
তানজিম রোহিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার সবকিছু গুছিয়ে দিছিস? খাওয়াদাওয়া সেরেই আব্বা নিয়ে যাবেন বলেছেন।
– দিয়েছি। গোসল করে ফেল, যা। সোহেল ভাই পুকুরে আছেন।
– না রে বাবা আমি পুকুরে না। বাথরুমেই করব।
তানজিম চলে গেল। নিহিন বলল, কী করে কাটছিছ? গন্ধ লাগে না?
রোহিতা হেসে বলল, লাগলেও করতে হবে। বিয়ে হলে তো সব করতে হবে। তাহলে বাপের ঘরে মায়ের কাজে সাহায্য করলে কী হয়?
– আরে ধুর। বাপের ঘর মাস্তির ঘর। ফুল অন মাস্তি করবি। এসব কাজ কাম করে মরবি কেন?
– বিয়ের পরে ঠিকই অন্যকে কাজ করে খাওয়াবি। এখানে মা কে একটু সাহায্য করে উনার মুখের হাসি দেখার মাঝেও শান্তি আছে।
নিহিন হেসে বলল, হ্যাঁ। এইতো আমিও দেখলাম মা কে মাছ বানাতে। আমি বলেছি একটু সাহায্য করি? উনি আমাকে একদম কাজ করতে দিলো না। বলল উনি পারবে। তাই চলে এলাম গোসল করতে।
রোহিতা হাসলো। মাছ বানানো শেষে সব গুছিয়ে রাখলো ঠিকমতো। তারপর কাপড় নিয়ে গোসলে গেল পুকুরে। নীরব নিস্তব্ধ পুকুর। কোনো বাতাস নেই। কারো নাড়াচাড়া নেই। দুপুরের খটোমটো রোদটা হালকা নিভেছে। রোহিতা কাপড় রেখে পানির প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই শিরশির অনুভূতিতে কেঁপে উঠল। সে নিহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ঠাণ্ডা রে! আয় না…
বলেই যখনই ঝাঁপ দিতে যাবে ঠিক তখনই শান্ত পুকুরের পানিকে অশান্ত বানিয়ে লাফঝাপ দিয়ে পুকুর থেকে উঠে এলো সোহেল। রোহিতা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। নিহিনও ভয় পেলো। ওরা যতোক্ষণে ধাতস্থ হলো ততক্ষণে সোহেল পাড়ে উঠে এসেছে। গায়ের পানি মুছছে। লুঙ্গিও বদলে ফেলেছে। রোহিতা আর নিহিন ভ্যাবলার মতো একে ওপরের দিকে তাকাল। রোহিতা সোহেলকে ধমক দিয়ে বলল, তুমি এতোক্ষণ ডুব দিয়ে এখানে ছিলে? তোমার শ্বাস বন্ধ হলো না? আর এভাবে উঠে আসে কেউ? দুর্বল হৃদপিণ্ড হলে নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করতাম।
– লুঙ্গি টা ধুয়ে দিস। আর তাড়াতাড়ি গোসল করে আয় আমার খাবার দে। বাড়ি ফিরব।
রোহিতার কথাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিজের যা বলার তা বলে পুকুর থেকে চলে গেল সোহেল। রোহিতা কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সোহেলের যাওয়ার পথে। নিহিন রোহিতার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আচ্ছা ইনি কে হয় তোর?
– খালাতো ভাই।
– হট আছে। দেখেই ঘাম ছুটে যায় এমন হট। প্রেমিকা আছে?
রোহিতা কপাল কুঁচকে তাকালো নিহিনের দিকে। তার ভারি বিরক্ত লাগলো। কেন যেন রাগ হলো নিহিনের ওপর। সে কিছু না বলে শরীরে সাবান ঘষতে লাগল। নিহিন আবার বলল, কীরে? বললিনা প্রেমিকা আছে কিনা? না থাকলে নাম্বারটা নিয়ে ট্রাই মারব। অথবা ফেইসবুক আইডি। মালটার পারসোনালিটি জোশ। সো মাচ এটিচ্যুড!
রোহিতা ধমক দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি গোসল সার নয়তো ফেলে চলে যাব। আমার কাজ আছে।
নিহিন ঠোঁট উলটে গোসল করতে লাগল।
________
(চলবে)