আলতা রাঙা পা পর্বঃ৮

0
1950

#আলতা_রাঙা_পা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৮)

” তোর বউকে বাপেরবাড়ি রেখে আয়, এখনই। ”

মায়ের আদেশে অমিত কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। নীরব চেয়ে থাকলেন আমার দিকে। তার চোখে চোখ পড়তে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। শাশুড়িমা নিজ থেকেই কারণ উল্লেখ করলেন,
” বাড়িতে বউ থাকতেও যদি আমাকে চুলা জ্বালাতে হয়, নাস্তা তৈরি করতে হয়। তাহলে বউ রেখে কী লাভ? ”

অমিত এবারও চুপ থাকলেন। আমার শ্বাস ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আসল। সেসময় টের পেলাম অমিত আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে কল্পনার আলোয় উপস্থিত হলো ছোট আপু। নরম শরীরের আঘাতের দাগগুলো হলো সূর্যের মতো তেজোময়। আমি শিউরে উঠলাম! প্রলয় ঘটল চিন্তাগম্যের! অশ্রুপাত শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণে বললেন,
” মাকে খুশি করার সূত্র বলে দেওয়ার পরও অংকে ভুল করলে? ”

আমি টলমল চোখে তার দিকে তাকালাম। তিনি হেসে ফেললেন। যেন আমার নির্বোধতায় দারুন মজা পেয়েছেন! ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই বললেন,
” আমার মা ভালোবাসতে ভালোবাসে। ”

আমার তাকানোর ভঙ্গি বদলানো দেখে অমিত বললেন,
” এখনও বুঝতে পারছ না? তোমাকে ভয় পেতে দেখে মা মজা করছে। ”

আমি পলক ফেললাম। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলাম শাশুড়িমার দিকে। তিনি মিটিমিটি হাসছেন। হাসিটি আমার পছন্দ হলো না। চোখে জমে থাকা পানি শুকিয়ে গেল নিমিষেই। ঠিক সেসময় চিনতে পারলাম আমার বদলে যাওয়া রূপ। খেয়াল হলো আমি কতটা দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলেছি। অথচ এমনটা আমি কখনই চাইনি। তবুও কেন এমন হলো? এ বাড়িতে থেকে যাওয়ার মতো ইচ্ছে, রুচি, বাসনা কোনোটাই নেই আমার। বের করে দিলে কী হবে? কিছুই না। আর অমিত? তাকে কেন এত ভয় পেলাম? হাত তুললেই কি আমি মেনে নিতাম? চুপচাপ মার খেয়ে যেতাম? একদমই না। আমি এত নরম মেয়ে নই। অত্যাচার সহ্য করা গৃহবধূও না। এই বিয়েটাই তো মন থেকে মেনে নিইনি! তাহলে এমন আচরণ আমার দ্বারা সম্ভব হলো কী করে?

” এখনও স্বপ্নে আছ নাকি? ”

অমিতের প্রশ্নে আমার ভাবনাচ্ছেদ ঘটল। আমার প্রশ্নের উত্তরও মিলল। স্বপ্নে না থাকলেও তার প্রভাব ঠিকই পড়েছে। এক মুহূর্তের জন্য নিজের মধ্যে ছোট আপুকে অনুভব করেছিলাম। সেজন্যই হয়তো এমন আচরণ করেছি।

আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম অমিতের দিকে। বললাম,
” ছিলাম, এখন আর নেই। ”

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে শাশুড়িমা এগিয়ে আসলেন। কাঁধে আলতো হাত রেখে আদুরে গলায় বললেন,
” পাগলি মেয়েটা! এইটুকুর জন্য এত ভয় পেলে চলে? আমিও তো এ সময়টা পাড়ি দিয়ে এসেছি, তাই না? আর কেউ না বুঝলেও আমি জানি এসময় কতটা ক্লান্ত থাকে শরীর, মন। একটু বিশ্রাম না নিলে হয়? পরিবারের জন্য তো মন কাঁদে সারাক্ষণ। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ মানিয়ে নিতেও অনেকটা সময় লাগে। তোকে এত অস্থির হতে হবে না। মাফ চাইতে হবে না। নিজের মতো করে ধীরেসুস্থে মানিয়ে নিতে থাক। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ”

আমার উদ্যত পাদুটো আবারও আটকে গেল এই মমতাময়ীর মায়ায়।

” শুধু খেয়াল রাখিস, তোদের ভেতরের ব্যাপারগুলো যেন বাইরে না আসে। কেউ কানাকানি করতে না পারে। ”

আমি বুঝতে পারিনি এমনভাবে তাকালে তিনি ফিসফিসে বললেন,
” গোসল করিসনি কেন? ”

অমিত শুনতে পেল নাকি কে জানে! তিনি আমাদের একা ছেড়ে চলে গেলেন। শাশুড়িমাও সুযোগ বুঝে মনে করিয়ে দিলেন আত্মীয়রা এখনও বাড়িতে ঘুরঘুর করছে। এ অবস্থায় তাদের সামনে পড়া মানে লজ্জা!
” নাস্তার জন্য সবাইকে ডাক পাঠানো হয়েছে। জলদি গোসল করে আয়। অমিতের জামা-কাপড়ের পাশে সুতি শাড়ি ভাঁজ করা আছে। নতুন বউ শাড়ি পরলে ভালো লাগবে। ”

আমি আর সময় ব্যয় করলাম না। রুমের দিকে ফিরে এলাম। ভিন্ন ভিন্ন রঙের অনেকগুলো শাড়ি রাখা। কোন রঙটা পরব ভাবনায় পড়তে অমিতের গলা পেলাম,
” লালটা পরো। সোনালি পাড়ের সাথে আলতা রঙটা খুব মানায়। ”

আমি খানিকটা চমকালেও তার দিকে ফিরলাম না। লাল রঙ ফেলে অন্য রঙের একটি শাড়ি নিয়ে বললাম,
” আমার পেছন পেছন ঘুরা বন্ধ করুন। এটা আমার অপছন্দ। ”

___________
” অমিত তাহলে আলতা পরানোর মতো স্থায়ী দুটো পা পেল! ”

অপরিচিত নারী কণ্ঠে আমি ঘাবড়ালাম। চোখ তুলে তাকালাম নারী মুখটার দিকে। তার চোখদুটো তখনও আমার পায়ের দিকে স্থির।
” গোসল করার পরও রঙ রয়ে গেছে মানে অমিত তোমাকে অনেক ভালোবাসে, ঠিক বলেছি তো?

প্রশ্ন করেই তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমি গোসলখানা থেকে পুরোপুরি বের হলাম। এককদম এগিয়ে এসে বললাম,
” আপনি? ”

তিনি উত্তর না দিয়ে হাসলেন। নিজের পাদুটো বিছানায় তুলে আরাম করে বসলেন। আমাকে ইশারায় বসতে বললেন। আমি বসলে হাতদুটো টেনে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
” হিন্দুরা তো সিঁদুর নিয়ে মজা করে, আমি আলতা নিয়ে করলাম। ”

বলতে বলতে আরেকদফা হেসে ফেললেন। সে হাসি দীর্ঘ হলো। হাসির মধ্যেই বললেন,
” তখন আমি খুব ছোট। ক্লাস থ্রি কী ফোরে পড়ি। স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাম লিখিয়েছি। রবীন্দ্রসংগীতে দল নাচ হবে। সে নাচের জন্য আবার শাড়িও পরতে হবে। সবাই খুব সুন্দর করে শাড়ি পরল। আমিও পরলাম। নাচ শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে দেখলাম সকলে আলতা পরেছে। কিন্তু আমি পরিনি। এখন কী হবে? আলতা ছাড়া তো ওদের মতো লাগবে না। আমি দলনেতার কাছ থেকে আলতার ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু হাতভর্তি চুড়ি নিয়ে পরি কী করে? বসলে তো শাড়িও নষ্ট হয়ে যাবে! এদিকে মাও কাছে নেই। স্টেজের সামনে বসে আছে আমার নাচ দেখবে বলে। আমি আলতা হাতে এক কোণ থেকে ডাকলাম। মা শুনল না। অমিত শুনল। ইশারায় বললাম মাকে ডেকে দিতে। সে বুঝল না। ছুটে আসল আমার কাছে। আমি মাকে ডেকে দেওয়ার জন্য বলতে যাব তখনই আমাদের ডাক পড়ল নৃত্য পরিবেশনের জন্য। আমি দৌড় দিতে গিয়েও থমকে গেলাম। অমিতের হাতে আলতা দিয়ে বললাম, ‘ ভাই, পায়ে পরিয়ে দে তো। ‘ অমিত আলতার মুখ খুলতে গিয়ে আলতা ফেলে দিল আমার গায়ে। সারা শরীরে মেখে সে কী কেলেংকারি অবস্থা! নাচ থেকে বাদ পড়ে গেলাম। এই দুঃখে আমি কেঁদেকেটে বুক ভাসালাম। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিলাম। অমিতের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। আমার এই শোক পালন অমিত মানতে পারল না। সে অভিমান ভাঙানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাবাকে বলে আলতা আনাল। মায়ের কাছ থেকে আলতা পরানো শিখে আমার পিছ পিছ ঘুরতে শুরু করল। আমি অভিমান ভাঙলেও আলতা পরলাম না। অমিত ধরে নিল শাড়ি পরলে আলতা পরতে হয়। তারপর থেকে আমি শাড়ি পরলেই সে আলতা নিয়ে হাজির হয়ে যেত। একসময় এ ব্যাপারটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেল। আমি বড় হলাম ও বড় হলো কিন্তু আলতা পরানোর অভ্যাসটা ছাড়ল না। তন্মধ্যেই আমার বিয়ে হলো। স্বামীর সাথে ইতালি চলে যেতে হলো। অমিত দুঃখ পেল। আমিও। ভাবলাম, এবার বোধ হয় আলতা পরানোর অভ্যাসটা কাটবে। কিন্তু কাটেনি। কয়েক মাস পর মা ফোন দিয়ে নালিশ করতে শুরু করল, অমিত নাকি মায়ের পায়ে আলতা পরিয়েছে। কাজটা করেছে ঘুমের মধ্যে। মা তো রেগেমেগে ফায়ার! পাশের বাসার কাকিমা দেখে নাকি খুব হেসেছে। বুড়ো বয়সে এসবে মানায়? আমিও অমিতকে….”
” আপনি অমিতের আপু? ”

আমার হঠাৎ প্রশ্নে তিনি থমকে গেলেন। বলতে চাওয়া কথাগুলো ভেতরে চালান করে বললেন,
” ধরে ফেলেছ তাহলে? ”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না তাই চুপ থাকলাম। তিনি বললেন,
” অমিত বলেছিল, তুমি খুব সাহসী, বুদ্ধিমতী। প্রথম দেখায় প্রমাণ দিয়ে ফেললে? ”
” বুঝিনি। ”
” বিয়ের পরদিনই স্বামীকে নাম ধরে ডাকছ। তাও আবার তার আপুর সামনে। এর জন্য কিন্তু সাহস লাগে। ”

আমি আবার চুপ হয়ে গেলাম। সেসময় অমিত রুমে ঢুকলেন। আমার সাথে চোখাচোখি হতে বললেন,
” বিয়েতে ইরফান ভাইয়াও আসতে চেয়েছিলেন। অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলেন দেখে বিয়েরদিন আসতে পারেনি। আপু মাত্রই আসল। ”

আমি ধরে নিলাম ইরফান ভাইয়া আপুর স্বামী। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
” ভাইয়া এ রুমে আসলেন না যে? ”

আপুর হাসি হাসি মুখটা মলিন হয়ে গেল। আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন,
” ছুটির ব্যবস্থা করতে পারেনি। ”
” আপনি একাই এসেছেন? ”

আপু উত্তর দিল না। মলিনভাব কাটিয়ে বললেন,
” শুনেছি, বিয়ের সবকিছু নাকি ভাই নিজে গিয়ে কিনেছে। বউকে কী কী দিল? দেখাও তো দেখি। বিয়ের উপহারগুলোও কিন্তু দেখব। ”

আমি বসা থেকে দাঁড়ালাম। বিয়ের শাড়ি, গয়না বের করতে গিয়ে থমকে গেলাম। মনে হলো অমিত যে সবার থেকে আলাদা নয় এটা প্রমাণ করার এই সুযোগ। অযথায় চটে গিয়ে বললাম,
” কেন দেখাব? আমার জিনিস দেখে আপনার কী কাজ? দেখেই তো বলবেন, এটা খুব সুন্দর। ওটা খুব সুন্দর। বলতে বলতে সব হাতিয়ে নেবেন, তাই না? এসব আমার জানা। কিছু দেখাব না আমি। ”

আমি খেয়াল করলাম আপুর মুখের রঙ পালটে গেছে। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। আমি আরও বললাম,
” আপনি অনুমতি ছাড়া আমার রুমে ঢুকেছেন কেন? ভাইয়ের রুম হলেই যখন-তখন ঢুকে পড়তে হবে? ভাই ছাড়াও যে এ রুমে অন্য কেউ থাকতে পারে এইটুকু আপনার জানা নেই? সে কী ভাববে এইটুকু বুঝ আপনার নেই? ”

আমি একটু দম নিয়ে আবার বললাম,
” আমি এখন সাজব। আপনি বের হোন। আপনি থাকলে আমার অসুবিধা হবে। ”

আপু বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অমিতের দিকে চাইতে আমি অন্যদিকে মুখ করে আঁটসাঁট হয়ে দাঁড়ালাম।

চলবে

[] রমজান উপলক্ষে আমার লিখিত দ্বিতীয় বই ‘বউ সোহাগি’ পাওয়া যাবে মাত্র ২০০ টাকায় []

বিস্তারিত: https://www.facebook.com/102175672032505/posts/300117108905026/?app=fbl

বর্ণলিপিতে নক করলে ওনারা অর্ডার প্রসেস বলে দেবেন।

পেজ লিংক,

https://www.facebook.com/bornolipi.prokashoni/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here