লোকটা তবুও বললো,
” আচ্ছা আপু, পঞ্চাশটাকা না হয় কমই দিয়েন। ওকে? নো মোর আর্গুমেন্ট। এবার উঠে পড়ুন। ”
অরিন ভ্রু কুচকে বললো, ” আমি যাবো না।”
সে ট্যাক্সিটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য, ট্যাক্সিওয়ালা তার পেছন পেছন আসছে। অরিন হাতের ব্যাগটা ভালোমতো চেপে ধরলো। ভয়ে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিথিল হওয়ার উপক্রম। মাঝরাতে নিরব রাস্তায় এই অপরিচিত ট্যাক্সিওয়ালা কেনো তার পেছনে লেগেছে? অরিন শতভাগ নিশ্চিত, এই লোকটির উদ্দেশ্য ভালো নয়। নাহলে কেনো তাকে ট্যাক্সিতে তোলার জন্য এতো উৎসুক এই লোক? যেখানে রিকশা নিলেও অরিনদের বাসা পর্যন্ত যেতে ভাড়া লাগে কমপক্ষে আশিটাকা। সেইখানে এই ট্যাক্সি ড্রাইভার মাত্র দেড়শো টাকাতে যেতে রাজি হয়ে গেল! ঘাপলা তো আছেই। ফাঁকা ট্যাক্সিতে উঠার চেয়ে পায়ে হেঁটে বাসায় যাওয়া অনেক বেশি নিরাপদ। তাছাড়া অরিন খেয়াল করেছে ট্যাক্সির পেছনে আরও দুইজন ছেলে আছে। অরিন প্রয়োজনে সারারাত রাস্তায় কাটাবে। তাও ওই ট্যাক্সিতে উঠবে না। ট্যাক্সিওয়ালা একদম অরিনের পথ আটকে দাঁড়ালো। অরিন ধমক দিয়ে বললো,
” সমস্যা কি আপনার? বলছি তো আপনার ট্যাক্সিতে আমি যাবো না।”
” তা বললে কিভাবে হয় আপু? আপনি একা একটা মেয়েমানুষ। নির্জন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। কতরকম বিপদ হতে পারে। তার চেয়ে আমরা আপনাকে সেইফলি পৌঁছে দেই। এটাই ভালো নয় কি?”
অরিনের ভোকাল কর্ড কাঁপছে। সে ভীতদৃষ্টিতে ছেলে তিনটিকে একবার দেখলো। তিনজনের মুখেই বিনয়ী হাসি। এই হাসি দেখে অরিনের আরও বেশি ভয় করতে লাগলো। ইশশ, ফোনের চার্জটাও এই সময়ই শেষ হতে হলো! নাহলে ভাইয়াকে একটা ফোন করা যেতো। ট্যাক্সিওয়ালা আবার বললো,
” কি ভাবছেন আপু? আরে উঠুন। ভয় নেই। আমরা আপনার ক্ষতি করবো না। আচ্ছা আপনার কাছে কি টাকা নেই? টাকা লাগবে না। আপনাকে এমনি পৌঁছে দিচ্ছি। আপনি আমাদের ছোটবোনের মতো। আসুন।”
ছেলেটা গাড়ির দরজা খুলে দিল। অরিন দুই কদম পিছিয়ে বিড়বিড় করে বললো,” হুম। টাকা লাগবে না। তোমাদের যে কি লাগবে সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি আমি৷”
অরিন সিদ্ধান্ত নিল খিচে দৌড় দিবে। পাঁচসেকেন্ডের মধ্যে সে তাই করলো। চোখ বন্ধ করে প্রচন্ড গতিতে একটা দৌড় দিল। ওর হাত থেকে ব্যাগটা পড়ে গেল। অরিন ব্যাগের মায়া করলো না। বেঁচে থাকলে টাকা-পয়সা, ব্যাগ, মোবাইল সব পাওয়া যাবে। এতো জোরে দৌড় দিয়েও খুব বেশি একটা লাভ হলো। অরিন বেশি দূরে যেতে পারলো না। ট্যাক্সিটা আবার ওর সামনে চলে এসেছে। এটাই তো স্বাভাবিক। একটা ট্যাক্সির সঙ্গে মানুষ কখনও দৌড়ে পারে? ট্যাক্সিওয়ালা এবার গাড়ি থেকে নেমে প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে বললো,
” আজব মেয়ে তো! আপনাকে বলেছি গাড়িতে উঠতে। তা না করে ছুটাছুটি করছেন কেনো? গাড়িতে উঠুন!”
ভয়ে অরিনের দম আটকে আসতে নিল। মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়তে চাইলো সে। কিন্তু অদ্ভুত! আয়তুল কুরসির প্রথম লাইনটা কিছুতেই মনে আসছে না। অরিন কোনোপ্রকার দোয়া মনে করতে পারলো না। অতিরিক্ত ভয়ে কি মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পায়? ছেলেটা আবারও চেচিয়ে উঠলো,” ওই ধরতো এটারে। ঝামেলা ভাল্লাগে না। হাত-পা, মুখ শক্ত কইরা বাধ। তারপর গাড়িতে উঠা। জলদি, জলদি! কেউ দেখার আগে।”
অরিন পেছনে তাকিয়েই চমকে উঠলো। বাকি দু’জন ছেলে হাতে দড়ি নিয়ে ওর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অরিন কিছু বলার আগেই পেছন থেকে ছেলেটা ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। যেনো কোনোভাবেই ছুটে পালাতে না পারে সে। আর বাকি দু’জন ওর হাত বাঁধলো। অরিন প্রায় কেঁদে ফেললো।
” প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।”
আর কিছু বলার আগেই অরিনের মুখটাও বেঁধে দেওয়া হলো। চোখে পট্টি পড়ানো হলো। তারপর তিনজন ওকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে বসালো। একজন বললো,
” রাগ করবেন না আপু। আমাদের কিছু করার নেই। আপনি সহজভাবে রাজি হয়ে গেলে আমাদের এই জোর-জবরদস্তিটা করতেই হতো না।”
অরিন কোনো কথা বলতে পারলো না। অন্ধকারে মিহরীমার মুখটা কল্পনায় ভাসছে। আর কখনও কি সে তার তিনবছরের ছোট্টবোন মিহরিমাকে কোলে নিতে পারবে? ভাইয়ার সাথে কি আর কখনও দেখা হবে? মা-বাবা অরিনকে খুঁজে না পেয়ে কি করবে? অরিনের ব্যাগে মিহরিমার জন্য কিনে রাখা একটা উপহার ছিল। সেটা কি আর মিহরিমাকে দেওয়া হবে না? অরিনের বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছে।
গাড়ি থামার শব্দ টের পেয়েই অরিন সিট থেকে মাথা উঠিয়ে গোঙাতে লাগলো। আশেপাশে ফিসফিস শব্দ। অরিন বুঝতে পারছে না তার সাথে আসলে কি ঘটতে চলেছে। তাকে কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে? একটু পরেই অরিন গায়ে শক্ত বাহুর স্পর্শ টের পেল। কেউ তাকে কোলে উঠিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ এখন সে একজন বিশালদেহী, শক্ত-সামর্থ্য পুরুষের কোলে। অরিনের ছটফটানি আরও বেড়ে গেল। আগন্তুকের পারফিউমের সুভাষটা খুব পরিচিত লাগছে। কে যেনো মাখতো এই পারফিউম? এখন কিচ্ছু মনে আসছে না অরিনের। ভেতর থেকে সম্পূর্ণ কাহিল হয়ে পড়েছে সে। কি করবে? কিভাবে বাঁচবে? একটা চেয়ারে অরিনকে বসানো হলো। ঘরের দরজা লক করার আওয়াজও শোনা গেল। অরিন বুঝলো আসন্ন বিপদ হয়তো এখন তার সামনেই। এখনি হয়তো তার চোখ খোলা হবে। যেকোনো দৃশ্য দেখার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করে নিল সে। কিন্তু চোখের পট্টি আর মুখের বাঁধন খোলার পর অরিন যেটা দেখলো তাতে সে সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ। বিস্ময়ে কয়েক সেকেন্ড তব্দা লেগে রইল। তারপর খুব জোরে একটা চিৎকার। ইলহান সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হয়ে অরিনের মুখ চেপে ধরলো এবং বললো,
” চুপ, একদম চুপ।”
অরিন চুপ করলো। কিন্তু আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ইলহান বললো,
” পানি খাও।”
সে একটা পানির বোতল এগিয়ে দিল অরিনের দিকে। কিন্তু অরিনের হাত বাঁধা ছিল। তাই ইলহান গ্লাসে ঢেলে নিজেই পানি খাওয়ালো অরিনকে। তারপর একটা চেয়ার নিয়ে ঠিক অরিনের বরাবর বসলো। বুক ভরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
” এখন বলো, তুমি আমার ফোন কেনো ধরছো না?আমাকে ইগনোর করছো কেনো?”
অরিন একইসাথে আশ্চর্য, বাকরুদ্ধ,হতাশ। শুধুমাত্র ফোন না ধরার কারণে ইলহান তাকে কিডন্যাপ করিয়েছে? অরিন ভেবেছিল ইলহানের শুধু মেজাজটা চড়া। তাই রাগের মাথায় মাঝে মাঝে পাগলামি করে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই ছেলে স্রেফ একটা সাইকো। মাথার মধ্যে নিঃসন্দেহে বিরাট গন্ডগোল আছে। অরিন কয়েকবার একাধারে ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করলো। তারপর উচ্চকণ্ঠে বললো,
” আপনি নিজেকে কি মনে করেন হ্যাঁ? ডোনাল্ড ট্রাম্প? আপনি ফোন করলেই ধরতে হবে? ম্যাসেজ দিলেই রিপ্লাই দিতে হবে? আপনাকে সবসময় মাথায় নিয়ে নাচতে হবে? আর তা না করলেই আপনি মানুষকে কিডন্যাপ করবেন?”
” হ্যাঁ করবো। অবশ্যই করবো। তবে সবাইকে না, শুধু তোমাকে। তুমি আমাকে ইগনোর করবে কেনো? যেখানে আমি আমার সব এটেনশন শুধু তোমাকে দিয়ে রেখেছি?”
” আমি কি আপনার কাছে এটেনশন চেয়েছিলাম? কেনো দিচ্ছেন এটেনশন?”
” আমিও তো তোমার কাছে ইগনোরেন্স চাইনি। তাহলে তুমি কেনো করছো ইগনোর?”
” দেখুন, এতোকিছু বুঝি না। আমাকে বাসায় যেতে দিন। নাহলে খুব খারাপ হবে।”
” আগে আমার প্রশ্নের জবাব চাই। কাল রোদে দাঁড়িয়ে পুরো তিনঘণ্টা আঠাইশ মিনিট তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। তুমি আসোনি কেনো?”
” আমি কি একবারও বলেছিলাম যে আসবো? আপনি অপেক্ষা করেছেন কেনো?”
” আমি যখন তোমাকে ম্যাসেজ করে বললাম যে অরিন,কাল দুপুর বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত আমি তোমাদের এলাকার বড়মাঠে তোমার জন্য ওয়েট করবো। তখন তুমি কি বলেছিলে মনে আছে?”
” হ্যাঁ মনে আছে।বলেছিলাম আচ্ছা। কিন্তু তার মানে তো এটা না যে আমি আসবো বলেছি। আপনি ওয়েট করতে চেয়েছেন, ওয়েট করবেন। শুধু তিনঘণ্টা কেনো? চব্বিশঘণ্টা ওয়েট করবেন। আমার তাতে কি?”
ইলহান এবার কাছে এসে অরিনের ফিসফিস করে বললো,
” তুমি নিজেকে ভাবো কি হ্যাঁ? কারো জীবনের সমস্ত সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়ে ভালো থাকার অধিকার তোমার নেই।”
” উল্টো কথা কেনো বলছেন? আপনিই আমার জীবনের সব সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছেন। আপনি আমার লাইফে আসার পর থেকে..”
ইলহান মুখ চেপে ধরলো অরিনের। তারপর বললো,
” তুমি কি আসলেই কিচ্ছু বুঝো না অরিন? তোমার মতো ডজন ডজন মেয়ে আমার পেছনে লাইন লাগায়। কিন্তু আমি সবাইকে উপেক্ষা করে শুধু তোমাকে এটেনশন চাইছি। এরপরেও কি তুমি বুঝবে না?”
” টাকার গরম দেখাচ্ছেন? নাকি চেহারার? গরম যেটারই হোক, অরিন পুড়বে না।”
ইলহান হতাশভঙ্গিতে চেয়ারে বসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
” পুড়ছি তো আমি অরিন। জ্বলে-পুড়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। সেই জ্বলন সবাই টের পাচ্ছে। শুধু তুমি ছাড়া।”
” আমায় যেতে হবে। অনেক রাত হয়েছে। বাসার সবাই চিন্তা করছে।”
” এতো সহজে তো তুমি বাড়ি যেতে পারবে না অরিন! আমার তিনঘণ্টার অপেক্ষা ফিরিয়ে দাও আগে। বলেছিলাম না? ইচ্ছে করলে হাত-পা বেঁধে সারাদিন সামনে বসিয়ে রাখতে পারি? আজকে তুমি সারারাত আমার সামনে বসে থাকবে। আর আমি দেখবো।”
অরিনের কপাল ঘামতে লাগলো। সাইকোটা এসব কি শুরু করেছে? সত্যিই কি সারারাত সামনে বসিয়ে রাখবে? ওইদিকে বাসার কি অবস্থা আল্লাহ মা’বুদ জানেন। ভাইয়া কি মারিয়াদের বাসায় গিয়ে অরিনের খোঁজ করেছে? আজরাতে মারিয়ার বাসাতেই থাকার কথা ছিল অরিনের। দু’জন ঠিক করেছিল রাত জেগে মুভি দেখবে, চিল করবে। ওরা চিপস,জুস নিয়ে মুভি দেখার আয়োজন করছিল। সুন্দর সময়। তখনি হঠাৎ খবর এলো মারিয়ার ছোট চাচা বাইক এক্সিডেন্ট করেছেন। সবাই হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে ছুটে গেল। অরিন তো আর বাসায় একা থাকতে পারে না। তাই সে ভাবলো বাড়ি ফিরে আসবে। অরিন তার ভাইয়াকে ফোন করেছিল তাকে এসে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ভাইয়া ফোন ধরেনি। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিল।কারণ তখন অনেক রাত। তাছাড়া মারিয়ার বাসার সবাই এমনভাবে কান্নাকাটি করছিল যে অরিন কাউকে কিছু বলতেও পারেনি। একাই বেরিয়ে এসেছে।এখন ভাইয়া যদি ঘুম ভেঙে অরিনের মিসড কল দেখতে পায় দেখে আর কল ব্যাক করতে গিয়ে যদি ফোন বন্ধ পায় তাহলেই তো দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে!মারিয়াদের বাসাতেও চলে যেতে পারে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তো ভাইয়া কাউকে পাবে না। ওদের বাড়িতে তালা ঝুলছে। ভাইয়া আরও ভয় পেয়ে যাবে। উফফ, এতো টেনশন অরিনের ছোট্ট মস্তিষ্ক আর নিতে পারছে না। এই সাইকোপ্যাথ যেদিন থেকে অরিনের জীবনে এসেছে সেদিন থেকেই ওর ঝামেলাময় জীবনের শুরু। কিন্তু মজার বিষয় হলো, ইলহান নামক ঝামেলাটি না থাকলে অরিন আজকে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারতো না। অরিনের খুব ভালো করে সেইদিনটির কথা মনে আছে।
সেদিন ছিল সোমবার। এইচএসসি পরীক্ষার শেষ দিন। বন্ধুরা হৈচৈ করে যাচ্ছিল শ্যানিনের কাজিনের বিয়ে খেতে। ট্রেনে করে চট্টগ্রাম ভ্রমণ। অরিন, শ্যানিন, মারিয়া, ইতি, তানিশা আর অন্বেষা মিলে মোট ছয়জন বান্ধুবির একটা মোটামুটি বড় গ্রুপ তাদের। এই ছয়জন সেই স্কুল লাইফ থেকে একসঙ্গে আছে। কখনও আলাদা হয়নি৷ তাই ওদের মধ্যে বন্ধনটাও খুব জোরালো। ছয়বন্ধু ছাড়া তাদের কখনোই জমে না। অরিনরা নিজেদের জন্য আলাদাই একটা বগী নিয়েছিল। ট্রেনের পরিবেশ যখন আনন্দে মুখরিত ঠিক তখনি অরিন কারো কাছে তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ খবরটা শুনতে পেল। তার মাথায় যেনো গোটা পৃথিবী ভেঙে পড়েছিল তখন। শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছিল। হাঁটাচলার শক্তি পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছিল না। অরিনের মাথাটা এতোই ফাঁকা হয়ে গেছিল যে সে কি করছে না করছে তার কোনো হুশ ছিল না। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দুইহাত মেলে ধরে অরিন ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিতে নিচ্ছিল। তখনই আইফেল টাওয়ারের মতো লম্বা বিশাদেহী একটা ছেলে এসে অরিনের হাত টেনে ধরলো। তাকে ভেতরে নিয়ে এসে ধমক দিয়ে বললো,
” পাগল নাকি আপনি? আরেকটু হলেই তো পড়ে যাচ্ছিলেন। চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গেলে বাঁচতেন?”
অরিন জবাবে একটা চড় দিল ইলহানকে। ইলহান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ঠিক ওইসময় মারিয়ার আগমন হলো। সে অপরাধী কণ্ঠে ইলহানের কাছে ক্ষমা চাইল।
” স্যরি ভাইয়া। কিছু মনে করবেন না। ওর মাথা ঠিক নেই।”
ইলহান জবাব দিল না। সে বিস্ময় নিয়ে অরিনের দিকে তাকিয়ে রইল। মারিয়া অরিনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য হাত ধরে টানতে টানতে বললো,
” কি করলি এটা? পাগল নাকি তুই? নিজের ভাইয়ের বয়সী আরেকটা ভাইয়াকে চড় মারলি?”
অরিন নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল ইলহানের দিকে। ইলহান তখনও বুঝতে পারছিল না মেয়েটা তাকে চড় কেনো মারলো? মারিয়া অরিনকে নিয়ে ওদের কেবিনে আসলো। অরিন পুতুলের মতো থম মেরে রইল। মুখে কোনো রা নেই। চোখের দৃষ্টি শূন্য। এই অবস্থায় মারিয়া ওকে অনেক বকলো ইলহানকে চড় মারার জন্য। কিন্তু অরিন কিছুই শুনতে পেল না। একটু পরেই শ্যানিন এসে চেচামেচি শুরু করলো,
” এই স্কাউন্ড্রেল। তুই আমার ভাইয়াকে চড় মেরেছিস? আমার ভাইয়াকে? কোন সাহসে মারলি?”
মারিয়া অবাক হয়ে বললো,” কি? ওই দৈত্য টাইপ লম্বা মানুষটা তোর ভাই?”
” হ্যাঁ। কেনো?”
” অনেক হ্যান্ডসাম রে। হাইট কত?”
শ্যানিন খুব ভাব নিয়ে বললো,” ছ’ফুট চার।”
অরিন বাদে সবকয়টি মেয়ে মুখে হাত দিয়ে ফেললো। একটা গুঞ্জন শুরু হলো,” ও মাই গড!”
তানিশা বললো,” এতো লম্বা ছেলে বাংলাদেশে আছে? কিভাবে সম্ভব?”
শ্যানিন বললো,” আমার ভাইয়া অস্ট্রেলিয়ান।”
মারিয়া প্রশ্ন করলো,” অস্ট্রেলিয়ান হলে তোর ভাইয়া কিভাবে হয়?”
শ্যানিন এই কথার জবাব দিতে পারলো না। ব্যক্তিগত পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে বন্ধুদের সাথে আলাপ করা তার পছন্দ নয়। তাই সে আগ বাড়িয়ে এইটা বলতে পারলো না যে ইলহান তার আপন ভাই না। শ্যানিন কথা ঘুরানোর জন্য বললো,
” বেয়াদবটাকে ডাক আগে। ওর প্রবলেম কি জিজ্ঞেস কর। আমার ভাইয়াকে ও কি বুঝে চড় দিয়েছে?”
মারিয়া বললো,” প্লিজ ঠান্ডা হো। ওর তো মাথা ঠিক নেই। ”
” মাথা কেনো ঠিক নেই? কি এমন হয়েছে যার জন্য আমার ভাইকে চড় মারতে গেল?”
” ও রায়হানের বিয়ের খবর শুনেছে।”
কথাটা শুনেই চুপ হয়ে গেল শ্যানিন। রায়হান অরিনের এক্স বয়ফ্রেন্ড। অরিন প্রচন্ড ভালোবাসে ছেলেটাকে। তাই ওর বিয়ের খবর পেয়ে অস্বাভাবিক হয়ে পড়াটাই অরিনের জন্য স্বাভাবিক। কিন্তু ইলহান ভাইকে এটা কে বুঝাবে? সে তো মনে মনে অরিনকে বেয়াদব ভাবছে। শ্যানিন ভাবলো ভাইয়াকে ডেকে এনে অরিনের মুখ দিয়ে স্যরি বলানো হলেই ঝামেলাটা মিটে যাবে। শ্যানিন যেটা ভেবেছিল সেটাই করলো। ইলহানকে অনেক অনুরোধ করে নিয়ে এলো অরিনদের কেবিনে। যখন ইলহান ভেতরে ঢুকলো, অরিন ছাড়া প্রত্যেকে অনায়াসে দাঁড়িয়ে যেতে লাগলো। সবাই একদৃষ্টিতে চোখে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল ইলহানের মুখের দিকে। অন্বেষার তো রীতিমতো মাথা চক্কর দিচ্ছিল। তানিশা চোখের পলক ফেলতে পারছিল না এক মুহুর্তের জন্যেও। সবার মধ্যে পিনপতন নিরবতার সৃষ্টি হলো। ইলহান এমন একজন মানুষ যার দিকে ছেলেরা পর্যন্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আর মেয়েদের তো অচেতন হওয়ার মতো অবস্থা হয়। ইলহানের সৌন্দর্য্যের বর্ণনা যদি দিতে গেলে তাহলে বলা যায় তার ধবধবে ফরসা চামড়ায় হালকা গোলাপী আভা, ঠোঁটগুলো রক্তলাল, সিল্কি হালকা ব্রাউনিশ চুল, ধারালো চোখ, চোখের দৃষ্টি তো নয় যেনো জ্বলন্ত তীর। ধিকধিক করে বুকে আগুন জ্বালানোর জন্য ওই দৃষ্টিই যথেষ্ট। আর ইলহান যখন হাসে, গালের দুই সাইডেই টোল পড়ে। বামসাইডের টোলটা বেশি গাঢ়। বডি ফিটনেস বিদেশীদের মতোই। সব মিলিয়ে সে একটা পিওর বিদেশী হয়েও বাংলাদেশী পরিবারের ছেলে। শ্যানিন ইলহানকে নিয়ে অরিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো,
” অরিন দ্যাখ, এটা আমার ভাইয়া। ইলহান মাহদী। ওকে একটু আগে তুই চড় মেরেছিস। এখন স্যরি বল।”
অরিন কিছুই বললো না। শ্যানিন বললো,
” আসলে ভাইয়া, ওর মনটা আজকে খুবই খারাপ। নাহলে ও কখনও এমন করতো না বিশ্বাস কর। তুই রাগ করিস না ভাইয়া।”
ইলহান কৌতুহল প্রকাশ করলো,” মনখারাপ কেনো? কি হয়েছে?”
শ্যানিন বিড়বিড় করে বললো,
” ও ছ্যাকা খেয়েছে ভাইয়া।”
ইলহান হাত ভাজ করে বললো,” ইটস ভেরি স্যাড। নাম কি তোমার?”
” অরিন তাবাসসুম মিষ্টি।”
” মিষ্টি! কি মিষ্টি? রসগোল্লা না জিলাপি?”
সবাই হেসে উঠলো ইলহানের রসিকতায়। ঠিক তখনি অরিন উঠে ইলহানকে আবার একটা চড় মারলো। পরিবেশ সসম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে গেল এই অতি অপ্রত্যাশিত ঘটনায়।
চলবে ইনশাল্লাহ।
#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_১
লিখা: Sidratul Muntaz
( আগের গল্পের টপিক নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবেন না প্লিজ। আর শুনতে ভালো লাগে না। কিছু গল্প কয়েক পর্ব লিখে আমি লেখা স্টপ করে দিয়েছিলাম। সেগুলোর কথা প্লিজ জিজ্ঞেস করবেন না। আর অপেক্ষাও করবেন না। আপাতত আমি এই গল্পটাই লিখবো। তাই এটা পড়তে ভালো লাগলে পড়ুন। নাহলে অন্য লেখক-লেখিকাদের গল্প পড়ুন। ধন্যবাদ সবাইকে। ভালোবাসা।)