#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_২২
লিখা: Sidratul Muntaz
অরিন-ইলহানের বিয়ের প্রস্তুতি এখন পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। শায়িখ সাহেবকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনা হয়েছে। তবে তিনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ হোননি। অসুস্থ মানুষটির দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ইলহানের পরিবার। শায়িখ সাহেব নিজেই বিয়ে নিয়ে খুব আম্ভরিক হয়ে উঠেছেন। তাঁর একমাত্র ছেলের বিয়েতে কোনোরকম কমতি রাখা যাবে না। অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি সব আয়োজন অত্যন্ত যত্নের সাথে করছেন। কাউকে বুঝতে দিচ্ছেন না যে ভেতরে ভেতরে কত বেশি দূর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। এই বিয়েটার প্রতি শায়িখ সাহেবের এতো আগ্রহের মুখ্য কারণটা হলো ইলহানের খুশি দেখা। তিনি খুব ভালো করে জানেন তাঁর ছেলেটা অরিন নামের মেয়েটাকে ছাড়া কখনও সুখে থাকতে পারবে না। একবছর ধরে ছেলেটাকে সদ্য ডাঙায় তোলা মাছের মতোন ছটফট করতে দেখেছেন তিনি। অতি আদরের ছেলেকে রোদে পুড়ে সাইকেল নিয়ে ডেলিভারি বয়ের কাজ করতে দেখেছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে ঝুলে টিউশনিতে যেতে দেখেছেন। ইলহান কখনও বাসে চড়তে পারে না। কারণ বাসে চড়লে ওর পা ব্যথা করে। বাসের সিটগুলো ছোট-ছোট। আর ইলহান অস্বাভাবিক লম্বা। তাই বাসে সবসময় পা গুটিয়ে বসতে হয় তাকে। শুধুমাত্র অরিনের জন্য ইলহান রোজ বাসে যাতায়াত করে টিউশনিতে যেতো। আর শায়িখ সাহেব শর্ত দিয়েছিলেন চুক্তিপত্রের টাকা উপার্জনের ক্ষেত্রে তিনি ইলহানকে কোনো প্রকার সাহায্য করবেন না। তাই বাড়ির গাড়ি ব্যবহার করা থেকে ইলহান বিরত ছিল। কষ্ট করে বাসে চড়তো। নিজের সমস্ত বিলাসিতা বদলে কষ্টময় পরিশ্রমের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সে। শুধুমাত্র একটা মেয়েকে পাওয়ার জন্য। ঠিক কতটুকু ভালোবাসা থাকলে কেউ এমন করতে পারে!ইলহানের বহুল আকাঙ্খিত জিনিসটি হলো অরিন। অনেকদিন আগে ইলহান একবার শায়িখ সাহেবের কাছে এসে বলেছিল, ” বাবা, আমি শেষবারের মতো তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো। তোমাকে দিতেই হবে।”
শায়িখ সাহেব অবাক হয়ে বলেছিলেন,” শেষবারের মতো চাইবে কেনো?”
” কারণ এই জিনিসটি দেখার পর আমার তিনটি কথাই শুধু মনে হয়েছে, চাই, চাই, চাই। যেকোনো মূল্যে চাই। একে পেলেই আমার জীবন ধন্য। ছোট্ট এই জীবনে আর কিছু না পেলেও চলবে বাবা।”
” কি এমন জিনিস শুনি?”
” একটি মেয়ে।”
শায়িখ সাহেব এতো অবাক হলেন যে হাতের ম্যাগাজিন বইটি অনায়াসে পড়ে গেল তাঁর হাত থেকে। ইলহান সেই বই তুলে, ধুলো ঝেড়ে বাবার হাতে দিল। শায়িখ সাহেব হা করে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। ইলহান এমনভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো যেনো কিছুই হয়নি। সেদিন ইলহান সরাসরি অরিনের নাম বলেনি। শুধু বলেছিল মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায়। সেই ভাগ্যবতী মেয়েটিকে দেখার জন্য শায়িখ সাহেবের মন অস্থির হয়ে উঠেছিল। তিনি তখন থেকেই খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করেন আর অরিনের ব্যাপারে সব জানতে পারেন। এরপর সত্যিই ইলহান অরিনকে ছাড়া বাবার কাছে আর কখনও কিছু আবদার করেনি। তাহলে অরিনই ইলহানের শেষ আবদার। মৃত্যুর আগে কি শায়িখ সাহেব ছেলের শেষ আবদারটি পুরণ করবেন না? নিশ্চয়ই করবেন। নাহলে যে তাঁর বুড়ো আত্মা মৃত্যুর পরেও অতৃপ্ত থেকে যাবে। তাছাড়া সবথেকে বড় কথা হলো, এই অল্প যে কয়দিন তিনি বেঁচে আছেন অন্তত সেই কয়দিন ছেলেটার মুখে সীমাহীন আনন্দ দেখে যেতে পারবেন।
গত দুইদিনে অরিনদের বাড়িতেও বিয়ের আমেজ লেগে গেছে। এই বাড়ি থেকে ওই বাড়ি শুধু মানুষের আনা-গোণা চলছে। শ্যানিন আর নুসাইবা অরিনকে দেখতে এসেছেন দুইবার করে। ইলহান যেকোনো বাহানায় এ বাড়িতে চলে আসে৷ আর যতবার আসে হালিমা তাকে আদর-যত্ন করে এটা ওটা খেতে দিতে থাকেন। অর্ণভ ইচ্ছে করেই তখন অরিনের ঘরে এসে বসে থাকে। যেনো ইলহান কথা বলতে না পারে। এই দুইজনকে বিরক্ত করতে তার মজাই লাগে। বোনের বিয়ে উপলক্ষে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে সে। অর্ণভ-নিশিতার বিয়ের তারিখটাও পেছানো হয়েছে। একসাথে দু’টো বিয়ের আয়োজন কষ্টসাধ্য। তাছাড়া নিশিতার বাবা ইউসুফ হক দেশে না ফেরা পর্যন্ত বাসন্তী কিছুই শুরু করছেন না। একদিন সকালে হঠাৎ করেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিশিতাকে নিয়ে ইন্ডিয়া যাবেন। সেইখান থেকে বিয়ের শপিং সেরে দেশে আসবেন। অর্ণভকেও নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অর্ণভ বোনের বিয়ে ফেলে কোথাও যাবে না। সুমনাকে কয়েকদিনের জন্য অরিনদের বাসায় রেখে যেতে হবে। কিন্তু ফয়সাল সাহেব অনুমতি দেননি। সুমনা যদি আগুন হয় তাহলে অর্ণভ হলো বারুদ। আগুন আর বারুদ একসঙ্গে রাখা মানেই বিপদ। এরপর ঠিক করা হলো সুমনাকে নৌশিনদের বাসায় রাখা হবে। ফয়সাল সাহেবের সেখানেও আপত্তি। নৌশিনদের বাসায় থাকা যে কথা তাঁদের নিজস্ব বাসায় থাকা একই কথা। এদিকে সুমনাকে ইন্ডিয়াতেও নেওয়া যাচ্ছে না৷ তার পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই নেই। তারপর অরিন বুদ্ধি করে সুমনাকে শ্যানিনদের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। নিশিতা আর বাসন্তী তখন বিনা দ্বিধায় ইন্ডিয়া চলে গেলেন। কিন্তু এতে আরেক ঝামেলা শুরু হলো। সুমনা যেদিন প্রথম ইলহানকে দেখেছে সেদিন থেকেই কান্নাকাটি শুরু করেছে। সে নাকি শ্যানিনদের বাসায় ভাতও খায় না। তাঁকে খাওয়ার জন্য ডাকা হলে দরজা আটকে বসে থাকে আর প্রায়ই কাঁদে। বার-বার শুধু অরিনের সাথে দেখা করতে চাইছে। কিন্তু অরিন বিয়ের ঝামেলায় মহাব্যস্ত৷ আর অর্ণভও নিষেধ করে দিয়েছে বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি না যেতে। মাত্র তো কয়েকদিনের ব্যাপার। তারপর তো সারাজীবনের জন্যই চলে যাবে। সুমনা শ্যানিনদের বাড়ি গেছে আড়াইদিন হয়। এর মধ্যে নাকি আড়াইশোবার সুমনা একটা কথাই বলেছে,
” অরিন আপুরে ডাকেন। নাইলে আমি খামু না।”
শ্যানিন সুমনার সাথে অরিনকে ফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছে। তাও সুমনা মানছে না। সে সরাসরি দেখা করতে চায়। অরিনের খুবই বিরক্ত লাগছে এসব। মেয়েটার কি হয়েছে?
গায়ে হলুদের আগের রাতের ঘটনা। অরিন পড়ার টেবিলে বসে হিসাব-নিকাশ করছিল অনুষ্ঠানে কতজন মানুষ আসবে, কি কি পদ রান্না হবে, মঞ্চ অলংকরণ ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে। অরিনের ঘরের বারান্দার জানালাটা কাঁচের। আর অরিনরা থাকে দুইতলায়। হঠাৎ বারান্দার কাঁচের জানালায় কারো টোকা দেওয়ার শব্দ হলো। তখন রাত বারোটা বাজে। অরিন ছোট্ট কলিজা নিয়ে ভয়ে ভয়ে বারান্দার সামনে গিয়ে দেখলো ইলহান দড়ি বেয়ে তার বারান্দায় চলে এসেছে। সে এতো চমকে উঠলো যে ভয়ে একটা চিৎকার দিয়ে ফেললো। চিৎকার শুনে অন্যঘর থেকে হালিমা, ফয়সাল ছুটে এলেন। ইলহান ততক্ষণে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে গেছে। অরিনের পায়ের আঙুল অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে লাগলো। কণ্ঠনালী থেমে থেমে যাচ্ছিল। এই ছেলে একটা অঘটন না ঘটিয়ে থামবে না দেখা যায়। এতোরাতে তার এ বাড়িতে আসার কি দরকার? হালিমা জিজ্ঞেস করলেন,
” অরিন কি হয়েছে? চিৎকার দিলি কেনো?”
অরিন উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলো না। মনে মনে দোয়া করছিল ইলহান যাতে ধরা না পড়ে। তাহলে সবচেয়ে বেশি লজ্জা অরিন নিজেই পাবে। ফয়সাল বললেন,
” কিছু দেখে ভয় পেয়েছিস মা?”
অরিন মাথা নেড়ে বললো,” হ্যাঁ, জানালার বাহিরে কি যেনো একটা নড়ছিল। তাই দেখেই ভয় লেগেছে।”
হালিমা দ্রুত বারান্দায় ঢুকতে নিলেন।
” কই দেখি তো।”
অরিন মাকে থামিয়ে বললো,” আরে তেমন কিছু না। পর্দা নড়ছিল। আমি হঠাৎ করে দেখে ভয় পেয়ে গেছি।”
ফয়সাল বললেন,” সেজন্য এতো জোরে চিৎকার করবি? আচ্ছা, বেশি ভয় লাগলে লাইট জ্বালানো থাক।”
ফয়সাল সাহেব অরিনের ঘরের আলো জ্বালাতে গেলেন। অরিনের অন্ধকার ভীতি আছে। আবার অতিরিক্ত আলোতেও সে ঘুমাতে পারে না। তাই তার ঘরে সবসময় রং-বেরঙের মৃদু আলো জ্বালানো থাকে। ফয়সাল সাহেব ঘরের মেইন লাইটের সুইচ অন করতে যাচ্ছিলেন। অরিন বাঁধা দিয়ে বললো,
” বাবা প্লিজ, লাইট জ্বালিয়ো না৷ লাইট জ্বালানো থাকলে আমার ঘুম আসবে না।”
হালিমা বললেন,” তাহলে দরজা খোলা থাক। আমরা পাশের রুমেই আছি। ভয় কিসের?”
” হ্যাঁ, এখন আর ভয় লাগছে না। তোমরা চলে যাও।”
” ভয় পেলে ডাকিস কিন্তু।”
” আচ্ছা ডাকবো।”
হালিমা আর ফয়সাল সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার পর অরিন দরজা আটকে দিল। যদিও হালিমা বলেছিলেন দরজা খুলে রাখতে। অরিন বারান্দায় ঢুকে বললো,
” এই, আপনার সমস্যা কি বলুন তো? এতোরাতে আসার কি দরকার ছিল?”
” দিনে এলে তো তোমার খবিশ ভাইয়ের জন্য কথাই বলা যায় না। তাই রাতে এসেছি। শান্তিতে একটু কথা বলার জন্য। ”
” ফোনে কথা বলেও আপনার মন ভরে না? তাছাড়া মাত্র তিনদিনেরই তো ব্যাপার। কালকে গায়ে হলুদ হলে পরশুই আমাদের বিয়ে। তারপর দিন-রাত সময় থাকবে কথা বলার। এখন কেনো আপনার এতো রিস্ক নিয়ে রাত-বিরাতে আমার বারান্দায় এসে কথা বলতে হবে? তারপর একটা অঘটন ঘটলে..”
ইলহান অরিনের মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বললো,
” এই মায়াপরী, ফোনে কথা বলা আর সরাসরি কথা বলা কি এক হলো বলো? তাছাড়া কথা বলার আসল সময় তো এটাই। বিয়ের পর নিশ্চয়ই আমরা শুধু কথা বলে সময় নষ্ট করবো না। তখন আরও কত কাজ আছে।”
লজ্জায় অরিনের শরীরে শিরহরণ সৃষ্টি হলো। ইলহান উত্তর শোনার জন্য অরিনের মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিল। অরিন ধরে আসা কণ্ঠে বললো,
” তাহলে কি বিয়ের পর আমরা কোনো কথাই বলবো না?”
” উমম..সেটা বিয়ের পর দেখা যাবে। তখনের কথা আর এখনের কথার মধ্যে পার্থক্য আছে না?”
অরিন লজ্জারাঙা কণ্ঠে বললো,
” কি পার্থক্য?”
ইলহান প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আশে-পাশে তাকিয়ে বললো,
” আচ্ছা, তোমার বারান্দায় ফুল গাছ নেই কেনো?”
” মা লাগাতে দেয় না। কারণ গাছ মরে গেলে আমি খুব কষ্ট পাই। আগের বাসায় থাকতে আমার একটা শখের ফুলগাছ মরে গেছিল। তখন আমি হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। টানা এক সপ্তাহ লেগেছে গাছের শোক কাটিয়ে উঠতে। তাই এ বাসায় আসার পর মা আর গাছ লাগাতে দেয়নি।”
” আমি আজকেই বাসায় গিয়ে আমার বারান্দার সব ফুল গাছ ফেলে দিবো।”
অরিন অবাক হয়ে বললো,
” কেনো?”
” যেই ফুলগাছের জন্য আমার ফুল কাঁদবে সেই ফুলগাছ আমি কেনো রাখবো? তাছাড়া আমার ঘরেই যদি ফুলের সুভাষ থাকে তাহলে আলাদা করে বারান্দায় ফুল রাখার দরকার কি?”
” ইশশ, আপনি এতো ঢং করে কথা বলেন কেনো? এসব কথায় অস্ট্রেলিয়ার মেয়ে পটানো যেতে পারে কিন্তু বাংলাদেশী মেয়ে না। ঠিকাছে?”
” যার সাথে তিনদিন পর আমার বিয়ে তাকে পটানোর মতো বৃথা কাজ আমি করি না। তুমি পটলেও আমার না পটলেও আমার।”
” সকালে জলদি উঠতে হবে। তাই এখন আমি ঘুমাবো। আপনার কথা শেষ হলে চলে যান।”
” কথা তো শেষ হয়নি।”
” এসব আজাইরা প্রলাপ জীবনেও শেষ হবে না। যান তো! ঘুমাতে দিন।”
” তুমি ঘুমাতে চলে গেলে আমার ঘুমের কি হবে? গত তিন থেকে চার রাত আমি একদমই ঘুমাতে পারছি না অরিন, বিশ্বাস করো।”
” কেনো পারছেন না?”
” চোখ বন্ধ করলেই তুমি সামনে চলে আসো। তখন ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আর ছুঁতে না পারলে ঘুম আসে না। অতৃপ্ত লাগে। পানির তৃষ্ণা পায়। পানি খেলে শুধু গলাটুকু ভেজে। মন ভেজে না তো।”
” উফফ আল্লাহ, আপনি কি পাগল বানাতে এসেছেন আমায়?”
” আমি নিজেই পাগল হয়ে গেছি। আচ্ছা আমাকে টাইট করে একবার জড়িয়ে ধরো তো। যদি মন ভরে তাহলে চলে যাবো।”
” আর যদি মন না ভরে?”
” তাহলে..”
ইলহান আর কিছু বলার আগেই দুরুম দুরুম দরজায় করাঘাতের শব্দ হলো। ওইপাশ থেকে হালিমা বললেন,
” এই অরিন, আবার দরজা বন্ধ করলি কেনো?”
তোর না বলে ভয় লাগে? দরজা খোল।”
অরিন আতঙ্কিত হয়ে বললো,” প্লিজ চলে যান। দ্রুত যান। মা এসে গেছে।”
” আরে, এতো জলদি কিভাবে যাবো? আমি কি বারান্দা থেকে এখন লাফ দিবো? তুমি কি চাও বিয়ের আগে পড়ে আমার হাত-পা ভেঙে যাক?”
” না, না, তাহলে খাটের নিচে ঢুকুন।”
” এইটুকু জায়গায় কি আমি আঁটবো?”
হালিমা আরও জোরে দরজা ধাক্কা দিলেন।
” অরিন, দরজা খুলবি না?”
অরিন মিনতির স্বরে বললো,” কিচ্ছু করার নেই। প্লিজ ঢুকুন।”
ইলহান বাধ্য হয়ে খাটের নিচে ঢুকলো। কিন্তু ওর পা ঢুকছে না। অরিন সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলেও ইলহানের লম্বা পা জোড়া ঢুকাতে পারছিল না। তারপর বাধ্য হয়ে বললো,
” দয়া করে আপনি পা গুলো গুটিয়ে রাখুন৷”
” পা ব্যথা হয়ে যাবে।”
” মাত্র পাঁচমিনিটের ব্যাপার। আমি মাকে জলদি বিদায় করছি।”
ইলহান খুব কষ্টে পা দু’টো গুটিয়ে রাখলো। কিন্তু এইভাবে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব না। অরিন দরজা খুলতেই হালিমা বললেন,
” সমস্যা কি তোর? ভয়ে না মরে যাচ্ছিস? তাহলে আবার দরজা বন্ধ করলি কেনো?”
অরিন কাঁপা-কাঁপা গলায় বললো,
” মা, তোমার হাতে বালিশ কেনো? ”
” তোর বাবা বলেছে বিয়ের আগে মেয়েদের একা ঘরে রাখতে নেই৷ তারপর তুই আবার পাচ্ছিস ভয়। তাই চিন্তা করলাম আজ তোর ঘরেই থাকি।”
হালিমা অরিনের বিছানায় নিজের বালিশ রাখতে রাখতে বললেন,
” আয় মা, শুয়ে পড়ি। কাল তো হলুদ। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে না?”
হালিমা হাই তুললেন এমনভাবে যেনো এখনি ঘুমিয়ে যাবেন। অরিন বললো,
” মা, কারো সাথে আমি ঘুমাতে পারি না। একা বিছানায় থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে গেছে।”
” বিয়ের পরেও কি একা বিছানায় থাকবি নাকি? এই বদভ্যাস বদলাতে হবে না? এখন থেকে প্রত্যেক রাত আমি তোর সঙ্গেই থাকবো। তোর অভ্যাস ঠিক করবো। এদিকে আয়, তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।”
অরিন উপায়ন্তর না পেয়ে মায়ের পাশে এসে বালিশে মাথা রাখলো। মা অরিনের চুলে হাত বুলাতে লাগলেন। অরিন মনে মনে ভাবছে, ইলহান খাটের নিচে না জানি কিভাবে আছে? হালিমা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের বিষয়ে নানান কথা বলতে লাগলেন। অরিনের মনোযোগ সেদিকে নেই। সে ভাবছে খাটের নিচে অবস্থানরত মানুষটিকে নিয়ে। হঠাৎ করে সম্পূর্ণ খাট নড়ে উঠলো। হালিমা বললেন,
” ও বাবা, অরিন টের পেয়েছিস কিছু?”
অরিনের কলিজায় তখন পানির অভাব। সে বুঝেও না বুঝার ভাণ করে বললো,
” কি হয়েছে মা?”
” ভূমিকম্প। ভূমিকম্প হচ্ছে!”
হালিমা চিৎকার করতে করতে বিছানা থেকে নেমে গেলেন। অরিনকেও টেনে নামালেন। পাঁচমিনিটের মাথায় বাড়ির সবাইকে ঘর থেকে বের করে আনলেন। ড্রয়িংরুমে সবাই এসে জড়ো হলো। মিহরীমা ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। অর্ণভ ঘুম জড়ানো গলায় বললো,” কোথায় ভূমিকম্প হচ্ছে মা? আন্দাজি।”
হালিমা বললেন,” আমি স্পষ্ট টের পেয়েছি ভুমিকম্প। অরিনের খাট ভয়ংকরভাবে কাঁপছিল।”
অরিন তখন মাকে কিছুতেই এটা বুঝাতে পারলো না যে এই ভূমিকম্প সেই ভূমিকম্প নয়।
চলবে