মেঘের পরে রংধনু পর্ব-২৩

0
1016

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_২৩
লিখা: Sidratul Muntaz

অরিন মুচকি হাসলো। প্রতি সকালে ইলহানের ঘুমন্ত মুখ দেখে জেগে উঠার স্বপ্ন অরিনের কোনোদিন পূরণ হবে না। এটা সে জানে। কিন্তু ইলহানকে খুন করাও যে তার অনেকদিনের স্বপ্ন! এই স্বপ্নটা নিশ্চয়ই পূরণ হবে। অরিন অবশ্যই ইলহানকে খুন করবে। কিন্তু কিভাবে করবে? বালিশ চাপা দিয়ে? ছুরিকাঘাত করে? নাকি অন্য কোনো উপায়ে? ইলহানের ঘুম ভাঙাতে নিয়েও ভাঙালো না অরিন। ঘর থেকে মোবাইল এনে নৌশিনকে ফোন করলো। এই কাজটা সে ইলহানের অপূর্ব ঘুমন্ত মুখটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে করলো। ইলহানের ঘুম ভেঙে গেলেই তো আর দেখা হবে না এই মুখ। যেটুকু সময় বাকি আছে সেটুকু সময় এই সুন্দর মুখশ্রী উপভোগ করার সুযোগ অরিন একটুও হারাতে চায় না। এতো সুন্দর ছেলেটাকে মেরে ফেলতে তার নিশ্চয়ই মায়া লাগবে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম যে বড্ড নিষ্ঠুর! নৌশিন ফোন ধরে খুব আশ্চর্য হয়ে বললো,
” তোর বারান্দার সামনে মই কেনো রাখতে হবে?আর সেই মই দিয়েই তুই কেনো নিচে নামবি? দরজা দিয়ে বের হতে অসুবিধা কি?”
” অনেক অসুবিধা আছে৷ তোকে যেটা বললাম সেটা কর। ”
” চুরি করতে বের হচ্ছিস নাকি কোথাও? আমাকেও সাথে নে। তোর বিয়েতে শপিং করতে করতে সব টাকা শেষ হয়ে গেছে৷ টাকার আসলেই খুব দরকার। ”
” তুই কি বের হবি নাকি সটান করে চটকানা খাবি?”
” আচ্ছা, পাঁচমিনিট অপেক্ষা কর। বের হচ্ছি।”
অরিন ফোন কেটে ইলহানের কাছে বসলো।আরও পাঁচমিনিট সময় পাওয়া গেছে ইলহানের সৌন্দর্য্য দেখার। সে গালে হাত রেখে মুগ্ধতা নিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। ইলহান ঘুম জড়ানো গলায় বললো,
” প্লিজ এইভাবে তাকিয়ো থেকো না। আমার ভুল হয়ে যাবে।”
অরিন সাথে সাথে চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। কঠিন মুখভঙ্গি করে বললো,
” কে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে?”
ইলহান তড়াক করে উঠে অরিনের মুখের কাছে ঝুঁকে বললো,
” চকলেটের মতো দেখতে একটা মিষ্টি মেয়ে। আমার কাছে সে দুনিয়ার সব চকলেটের চেয়ে মিষ্টি।”
অরিন উঠে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত গলায় বললো,” ঘুমের ভাণ ধরে শুয়ে থাকা একটা অপরাধের মধ্যে পড়ে।”
” তাহলে তো কারো ঘুমের সুযোগ নিয়ে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকা আরও বড় অপরাধ হওয়া উচিৎ। ”
অরিন রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,” আমি মোটেও হা করে তাকাইনি।”
” মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে ছিলে। দাঁত বের হয়েছিল তো।”
অরিন মনে করার চেষ্টা করলো, মুচকি হাসি দিলে কি কারো দাঁত দেখা যায়? তার কি মুচকি হাসি দিলে দাঁত দেখা যায়? একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে এই কথার সত্যতা যাচাই করতে হবে। ইলহান আবার বললো,
” বাই দ্যা ওয়ে, তুমি যখন দরজার লক খুলছিলে তখনি আমার ঘুম ভেঙে গেছে। ইচ্ছে করেই চোখ বন্ধ রেখেছিলাম। কারণ দেখতে চাইছিলাম, তুমি যখন নিজে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে তখন শুনতে কেমনে লাগবে? বউ-বউ লাগবে কি-না।”
ইলহান নচ্ছারের মতো একটা হাসি দিল। অরিন রেগে থাকার ভাণ করে বললো,
” নৌশিনকে ফোন দিয়েছিলাম। সে এসে মই ঠিক করে দিলেই আপনি চলে যাবেন। নো এনি এক্সকিউজ। ”
অরিন এই কথা বলে বারান্দার কার্নিশ ধরে দাঁড়ালো। ইলহানের দিকে একবার তাকানোর জন্য পেছনে ঘুরতেই দেখলো ইলহান একদম ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। খুব সন্তর্পণে অরিনের চুলে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে যেনো অরিন একটুও বুঝতে না পারে। অরিন প্রায় তোতলিয়ে বললো,
” কি করছেন এটা?”
ইলহান আরও একটু কাছে এসে অরিনের কানে মুখ নিয়ে বললো,” হ্যাপি ওয়ান ইয়ার এনিভার্সেরি, প্রিয়তমা!”
অরিন চমকে গেল। জিজ্ঞেস করলো,
” ওয়ান ইয়ার মানে? কিসের এনিভার্সেরি?”
ইলহান মৃদু হাসলো।
” এতো সহজে কিভাবে ভুলে যাও অরিন? আমি তো এক মুহুর্তের জন্যেও ভুলতে পারি না। তোমার লজ্জায় অপ্রস্তুত হওয়া সেই দৃষ্টি, ঠোঁটের নিচের ছোট্ট ভাজ, বার-বার ভয়ে ঠোঁট কামড়ানো, আমার হাত চেপে ধরা, আমার প্রত্যেকটি কথায় কেঁপে উঠা। সেদিন সাদা শাড়িতে তোমাকে একদম আমার নিজস্ব মায়াপরীর মতো লাগছিল, বিশ্বাস করো! যে মায়াপরীকে হয়তো আমার কোনো বিশেষ ভালো কাজের পুরষ্কার হিসেবে করুণাময় স্বর্গ থেকে তৈরী করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।”
অরিন স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে রইল। হয়তো মনে করার চেষ্টা করছিল সেই অদ্ভুত সুন্দর দিনটির কথা। ইলহান অরিনের হাতের দিকে তাকালো। নৌশিন ফোন করেছে। কিন্তু অরিনের সেদিকে একদম হুশ নেই। ইলহান নিচে উঁকি মেরে দেখলো নৌশিন মই ঠিক করে দিয়েছে। ইলহান ওরনা ধরে মই বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। অরিন তখনও কিছু মনে করতে পারেনি। শুধু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ইলহানকে হাত নাড়িয়ে বিদায় দিল। নৌশিন বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে বললো,
” ভাইয়া, আপনি এইসময় এইখানে? অরিনের ঘরে কি করছিলেন?”
শেষ বাক্যটা নৌশিন খুব জোরে চিৎকার করে বললো। ইলহান বললো,
” আস্তে! মুখ বন্ধ রাখলে চকলেট পাবে।”
” আমি বাচ্চা না যে চকলেট দিলেই চুপ হয়ে যাবো। আমি আপনার একমাত্র শালী, আধি ঘরওয়ালী। আমাকে দিতে হবে ঘুষ। অবশ্যই ক্যাশ।”
” তুমি আমার একমাত্র শালী হলে পুচকিটা কি হবে?”
” আরে মিহরীমা তো এখনও কিছু বুঝেই না। সে কি আমার মতো মিষ্টি করে দুলাভাই ডাকতে পারবে আপনাকে?”
” তোমার থেকেও মিষ্টি করে ডাকতে পারবে। শুধু একটু বড় হোক।”
” এই শুনুন, আপনি কিন্তু এতো সহজে পার পাবেন না। এতোবড় কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন। পুরো একরাত অরিনের ঘরে.. ওহহো! আমি যদি এই কথা অর্ণভ ভাইয়া বা ফুপাকে গিয়ে বলে দেই তাহলে কি হবে আপনার দুলাভাই?”
” কি আর হবে? আমাকেও তখন বলতে হবে, একমাত্র শালী প্রথমদিনই দুলাভাইকে দেখে ড্রেনে কাইত। দ্বিতীয় দিন দেখে একদম অজ্ঞান! সবার সামনে এই কথা বললে তোমার কি হবে শালিকা? মান-সম্মানের ফালুদা হয়ে যাবে না?”
নৌশিন সাথে সাথে অন্যদিকে ঘুরে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। এর মানে ইলহান তাকে প্রথমদিনই চিনতে পেরেছিল? ইশশ, কি লজ্জা! ইলহান হেসে বললো,
” আপাতত চকলেট রাখো। আমার কাছে বেশি টাকা নেই। থাকলে ক্যাশই দিতাম, সত্যি!”
নৌশিন দৌড়ে যেতে যেতে বললো,” আমি আর কখনও আপনার সামনে আসতে চাই না দুলাভাই।”
ইলহানের ভীষণ হাসি পেল। চকলেটের প্যাকেট খুলে নিজেই খেতে খেতে গেল। শুধু নৌশিন না, নিশিতার কথাও ইলহানের মনে আছে। তাই যেদিন ইলহান তার পরিবার নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অরিনকে বিয়ের জন্য দেখতে এসেছিল সেদিন নিশিতাকে অরিনদের বাসায় দেখার সাথে সাথেই সে জরুরী কাজের বাহানা দিয়ে পালিয়ে গেছিল। বিয়ে মিটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে একদমই নিশিতার সামনে পরতে চায় না। নিশিতার সামনে গেলে ইলহানের নিজের কাছেই অস্বস্তি লাগবে। কিছু কিছু বিষয় এতো ইরিটেটিং হয়..!
অর্ণভ এতোক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখেছে। ফযরের নামায শেষ করে মসজিদ থেকে মাত্র বাসায় ফিরছিল সে। তখনি একটা দৃশ্য দেখে তার হার্টবিট থেমে গেল। ইলহান মই বেয়ে অরিনের বারান্দা থেকে নামছে। এর অর্থ কি? অর্থটা একদমই মাথায় আনতে চাইলো না অর্ণভ। সে শুধু একটা কথা খুব ভালো করে বুঝলো, তার ছোটবোন এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু এতোটা বড় হতে নেই। যেই বড় হওয়ার কারণে তার প্রতি সকল আস্থা-বিশ্বাস ভেঙে যায়। অর্ণভের বিশ্বাস ভেঙে গেছে অরিনের প্রতি।

অরিন রুমে এসে পড়ার টেবিলে বসলো। তার বুকটা এতো অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে কেনো? অরিন একটু পানি খেয়ে নিল। একবছর আগের সেই ভয়ংকর দিনটি সে কখনও ভুলবে না। কিছু কিছু দিন এমনও হয় যা মানুষের মস্তিষ্কের স্মৃতিপটে খুব গাঢ়ভাবে প্রভাব ফেলে। সেই প্রভাব কখনও আনন্দায়ক বা সুখকর হয় আবার কখনও হয় কষ্টকর বা দুঃখজনক। অরিনের কাছে প্রভাবটা মিশ্র। একইসাথে আনন্দ, লজ্জা, ভয়, অনিশ্চয়তা, দুঃখ,আফসোসময় সকল অনুভূতিরা বেড়াজালের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। এই দিনে ইলহান অরিনকে প্রপোজ করেছিল! অরিন কখনও ভাবতে পারেনি তার মতো অবহেলিত একটা কালো মেয়েকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটি প্রেম নিবেদন করতে আসবে। সত্যিই ভয়ংকর দিন ছিল সেটা। ইলহান তখন অরিনের বন্ধুমহলের সবকয়টি মেয়ের হার্টবিট! অরিন আবারও হারিয়ে গেল অতীতে। শ্যানিনের বড়চাচার ছেলে জোভানের বিয়ে ছিল। ট্রেনে করে চট্টগ্রাম ভ্রমণে গিয়েছিল ছয়বন্ধু। ইলহানের সাথে অরিনের প্রথম দেখা সেখানেই। পাগলামির বশে অরিন সেদিন রাতে ইলহানের কপালে চুমু দিয়ে ফেলেছিল।কাজটা একদম ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি অরিন। ইলহানই প্রথমে তার কপালে চুমু দেয়। অরিন প্রতিশোধ নিতে একই কাজ করলো। তারপর এতো লজ্জা পেল যে আর ইলহানের সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি তার। খুব লুকিয়ে বাঁচিয়ে নিজেকে ইলহানের থেকে আড়াল করে রেখেছিল সে। আর ইলহান যেনো অরিনকে চোখে হারাচ্ছিল। জোভানের বিয়ের পর রিসেপশনের জায়গা ঠিক করা হলো একটা রিসোর্টে। চট্টগ্রাম খুবই সুন্দর শহর।এইখানে এসে প্রত্যেকে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে রিসেপশনের আয়োজন করতে ঢাকায় না গিয়ে এখানেই থেকে গেল। ওই বিয়েটা আসলে অরিনদের জন্য কোনো বিয়ে ছিল না। বিয়ে নামক লম্বা চট্টগ্রাম ট্যুর ছিল! অনেক জায়গায় ঘুরাঘুরি হয়েছে। একদিন অরিনরা গিয়েছিল চট্টগ্রামের সিআরবি হিলে। শুধু বন্ধু-বান্ধব আর শ্যানিনের সমবয়সী ভাই-বোনেরা মিলে বের হয়েছিল। বড়রা তখন রিসেপশনের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কে যেনো পরিকল্পনা করলো বাসায় বসে ক্লান্ত হওয়ার থেকে ঘুরতে যাওয়া ভালো। ব্যস, সবাই সেজেগুজে তৈরী। অরিন তো সব সময় মেকাপ করতে খুব ভালোবাসে। জোভান ভাইয়ের বউ মুক্তি ভাবীর বিয়ের মেকাপটাও অরিন নিজেই করেছিল। শ্যানিন খুব গর্ব করে বলেছিল, আমার বান্ধুবি মেকাপ এক্সপার্ট!সে নিজেই একহাতে দশজনের মেকাপ করতে পারে। তখন থেকে সবাই মেকাপের জন্য অরিনের কাছে ছুটে আসে। সবাইকে সাজাতে গিয়ে অরিনের নিজের ভালো করে সাজা হয় না। কিন্তু সিআরবি’তে যাওয়ার আগে অরিন সময় নিয়ে খুব সুন্দর করে সেজেছিল। সে অবশ্য জানতো না ইলহানও ওদের সাথে যাচ্ছে। যদি আগে জানতো, তাহলে কখনোই সে যেতো না। ইলহানের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে ঘরে শুয়ে ঘুমানোও অনেক ভালো।তাছাড়া কপালে চুমু দেওয়ার ঘটনার পর থেকে অরিন একদম লজ্জামূর্তি হয়ে গেছিল। ইলহানের সামনে পড়লে নিশ্চিত লজ্জায় হার্ট এটাক হবে তার। সাদা রঙের শাড়ির সাথে ছাইরঙা মিশেলের ব্লাউজ পড়ে সেদিন সিআরবি’তে যাওয়ার জন্য সেজেছিল অরিন। শাড়ির সাথে মানিয়ে রূপালী কানের দুল, গলার হার পড়েছিল। শাড়িটা অনেক ভারী আর সুন্দর। অরিনকে এতো চমৎকার দেখাচ্ছিল! তখনও অরিন জানতো না তার এই সাজ একটা নিরীহ ছেলের যখন-তখন বুকে ব্যথা উঠার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সিআরবি’তে পৌঁছে যখন অরিনরা গাড়ি থেকে নামছিল তখন অরিন হিল জুতাসহ পা নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। ইলহান অরিনকে দুইহাতে ধরে ফেললো আর ধীর কণ্ঠে বললো,
” সাবধানে!”
অরিন ইলহানকে দেখে এতো চমকে গেল যে ভয়ে দ্রুত একটা দৌড় দিল। ইলহান হয়তো পেছন থেকে ডেকেছিল। অরিনের মনে পড়ছে না সত্যিই ডেকেছিল কি-না? মেয়েদের আর ছেলেদের গাড়ি আলাদা ছিল। তাই গাড়িতে উঠার আগে ইলহানের সাথে অরিনের দেখা হয়নি। কিন্তু নামার পর দেখা হয়েছে। অরিন এক দৌড়ে শ্যানিনের কাছে ছুটে গিয়ে আতঙ্কিত গলায় বললো,
” শ্যানুর বাচ্চা, তুই আমাকে বলিসনি কেনো তোর বিদেশী ভাইটাও যে আমাদের সাথে এখানে চলে আসবে?”
” কেনো? বললে কি হতো? তুইও কি অন্বেষার মতো বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ করে ফেলতি?”
অরিন ভ্রু কুচকে বললো,” মানে?”
শ্যানিন হাত ভাজ করে বললো,” মানে অন্বেষা ইলহান ভাইয়ের উপর ক্রাশ খেয়ে নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ করে ফেলেছে। তুই ভাবতে পারছিস?”
” কি বলিস এসব? সত্যি নাকি?”
” একদম সত্যি কথা বলছি। মেয়েটা কত বলদ তাই না? আচ্ছা তুই-ই বল, ইলহান ভাইয়া কি বলেছে বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ করলে সে অন্বেষার সাথে প্রেম করবে? তাহলে কোন আশায় এই কাজ করলো মেয়েটা? পাগল নাকি? যাই, ওকে গিয়ে একটু সান্ত্বনা দিয়ে আসি।”
শ্যানিন চলে গেল। অরিন মনে মনে ভাবলো, কি এমন আছে ওই ইলহানের মধ্যে? যাকে পাওয়ার জন্য বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ করতে হয়? অরিন কি কখনও পারবে একটা সুন্দর ছেলের জন্য রায়হানকে ভুলে যেতে? ইশশ, কখনও পারবে না। রায়হান শুধু রায়হানই। ওর মতো কেউ না। যে যতই সুন্দর হোক, অরিনের কাছে সবাই শূন্য। আর রায়হান একশোতে একশো!
সন্ধ্যা পর্যন্ত সিআরবি পার্কে ঘুরাঘুরি করেছিল সবাই। অরিন পুরোটা সময় যথাসম্ভব চেষ্টা করেছে যেনো ইলহানের সামনে পড়তে না হয়। কিন্তু যেকোনো বাহানায় ইলহান শুধু তার সামনেই চলে আসছিল। আর অরিন ক্রমাগত অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছিল। ফিরে আসার সময় সবাই যখন একসাথে গাড়িতে উঠবে তখন ইলহান হঠাৎ অরিনকে জোর- জবরদস্তি ধরে কোথায় যেনো নিয়ে গেলো। অন্ধকারে ঢাকা নিরব একটা জায়গা। সেখানে কেউ ছিল না। অরিন ভয়ের চোটে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
” আমাকে এখানে কেনো এনেছেন? কিসের প্রতিশোধ নিবেন? চড়ের না চুমুর?”
ইলহান অরিনের ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বললো,” একদম চুপ! তোমার তো অন্যায়ের শেষ নেই। সবচেয়ে বড় অন্যায় হলো লুকিয়ে থাকা। আমাকে দেখলেই শামুকের মতো খোলসে ঢুকে যেতে চাও কেনো? প্রবলেম কি?”
অরিন উত্তর খুঁজে পেল না। কি বলবে? ইলহানকে দেখলেই তো তার লজ্জা করে। ইলহান ধমক দিল,
” এই মেয়ে, কথা বলো।”
অরিন চোখ-মুখ খিচে বললো,” আমার লজ্জা লাগে।”
ইলহানের মুখের প্রতিক্রিয়া তখন কেমন হয়েছিল অরিন জানে না। কারণ সে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। ইলহান হঠাৎ বললো,
” এতো লজ্জা লাগলে ব্ল্যাক-সী ওপেন করে রাখো কেনো? মাথা খারাপ করার জন্য?”
অরিন চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই বললো,” ব্ল্যাক-সী কি?”
ইলহান সরু কণ্ঠে বললো,
” অসম্ভব সুন্দর একটা কালো সমুদ্র!”
অরিন তাকিয়ে বললো,” কালো সমুদ্র? কোথায়?”
অরিন আশে-পাশে খুঁজতে লাগলো। ইলহান অরিনের তলপেটে হাত রেখে বললো,” এইতো!”
অরিন ভয়ংকরভাবে লাফিয়ে উঠলো। সাথে সাথে শাড়ি ঠিক করলো। ইলহান হাত সরিয়ে হেসে দিল। হাসতেই থাকলো। আর অরিনের মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেল। সে কালো বলেই কি ছেলেটা বার-বার তাকে অপমান করবে? তাও এতো বাজেভাবে! ছি! অরিন বললো,
” আপনার চেহারাটা যে সাদা মূলার মতো সেটা কি আপনি জানেন?”
ইলহানের মুখ থমথমে হয়ে গেল। কপালে ভাজ ফেলে বললো,” হোয়াট? সাদা মূলা?”
” হ্যাঁ, আপনি দেখতে যেমন সাদা মূলা আপনার কথা-বার্তাও সাদা মূলার মতো জঘন্য। ছি! আই হেইট সাদা মূলা। আই অলসো হেইট ইউ।”
অরিন কথাটা বলে চলে যেতে নিলেই ইলহান হাত ধরে বললো,
” এই, শুধু বলে দিলেই হলো হেইট ইউ?এতো সহজ নাকি সবকিছু?”
” ভাইয়া, আমার হাত ছাড়ুন।”
ইলহান আরও রেগে তপ্ত মেজাজ নিয়ে বললো,
” আরেকবার ভাইয়া বললে কিন্তু জোর করে কিস করবো তোমাকে।”
অরিনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল কথাটা শুনে। সে মনে মনে ভাবলো, ছি! এই ছেলের শুধু মুখের ভাষা খারাপ না। চরিত্রও জঘন্যতম খারাপ! অরিন জোর করে হাত ছাড়িয়ে একটা দৌড়ে দিল। এক দৌড়ে গাড়ির সামনে আসতেই তানিশা বললো,
” এই, তোর সমস্যা কিরে? কোথায় হারিয়ে গেছিলি? তোকে খুঁজে খুঁজে আমরা হয়রান!”
অরিন কোনো জবাব দিল না। তানিশা পুনরায় বললো,” আয়, গাড়িতে উঠ এবার।”
অরিন হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,” সবাই কি এসে গেছে?”
” হুম, সবাই-ই তো গাড়িতে উঠে গেছে। শুধু তুই-ই বাকি। আয় জলদি উঠে যা। ”
” গরুটাও কি এসেছে?”
অরিন এই কথা বলেই জিভ কাটলো। ভুল করে মুখ দিয়ে ‘গরু’ শব্দটা বের হয়ে গেছে। কারণ মনে মনে তো সে ইলহানকে গরুই ডাকে। শ্যানিন গাড়ির ভেতর থেকে মাথা বের করে বললো,
” গরু মানে?”
” মানে তোর ওই অস্ট্রেলিয়ান ভাই!”
এইটা ছিল অরিনের দ্বিতীয় বোকামি। এই কথার পরেও সে জীভ কাটলো। গরু বলেছে সেটা ঠিকাছে। কিন্তু ইলহানের নাম কেনো উচ্চারণ করলো? নামটা না বললেই তো আর কেউ বুঝতো না। শ্যানিন প্রায় তেড়ে এসে বললো,
” ফাজিল! তুই আমার ভাইকে গরু বলিস? এত্তোবড় সাহস?”
” স্যরি, স্যরি। আর গরু বলবো না। দুষ্টুমি করেছি।”
” এইটাকে দুষ্টুমি বলে না, বেয়াদবি বলে। সুন্দর করে ভাইয়া ডাক। বল, ইলহান ভাইয়া।”
অরিন বলতে নিয়ে দেখলো ইলহান তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন চমকে উঠলো। কানের গোড়ায় সেই আগের কথাটি বেজে উঠলো,” আরেকবার ভাইয়া বললে কিন্তু জোর করে কিস করবো তোমাকে।” অরিনের গলা শুকাতে লাগলো। এদিকে শ্যানিন ধমক দিচ্ছে,
” এই, ভাইয়া ডাকতে বললাম না?”
অরিন অসহায় দৃষ্টিতে একবার শ্যানিনের দিকে, একবার ইলহানের দিকে তাকালো। বলা তো যায় না, যদি সত্যিই ভাইয়া ডাকলে সবার সামনে কিস করে ফেলে! মান-ইজ্জত সব ধুলোয় মিশে যাবেরে!
শ্যানিন কড়া ধমক দিল,” তুই ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়েও বেয়াদবি করছিস? দ্যাখ অরিন, আমি এক থেকে পাঁচ অবধি গুণবো। এর মধ্যে যদি সুন্দর করে ইলহান ভাইয়া না ডাকিস তাহলে পিঠ বরাবর ঘুষি খাবি। একাধারে তিন-চারটা!”
অরিন বিরবির করে বললো,” কিস খাওয়ার চেয়ে ঘুষি খাওয়া ভালো।”
শ্যানিন মেঘের মতো গর্জন করলো,” ভাইয়া বলবি না? এক, দুই, তিন..”
অরিন দুইকানে হাত দিয়ে জোরে উচ্চারণ করলো,” ইলহান ভাইয়া।”
তারপর এক মুহুর্তও অপেক্ষা করলো না। একলাফে গাড়িতে উঠে ধড়াম করে দরজা আটকে দিল। অরিনের আচমকা দরজা আটকানোর ফলে তানিশা পায়ের উরুতে আর শ্যানিন মাথায় বারি খেল। দু’জনেই রাগান্বিত হয়ে অরিনের দিকে তাকালো। তানিশা বললো,
” তুই এতো অদ্ভুত কেনো?”
শ্যানিন বললো,” তুই এতো ঘাড়ত্যাড়া কেনো?”
অরিন কারো প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না। সে গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরে ইলহানের হাস্যরত চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল। সে আরও অবাক হলো যখন দেখলো ইলহান তাদের গাড়িতেই উঠে বসছে। ওই সিটে শ্যানিনের একটা ছোট্ট কাজিন বসেছিল। ছেলেটার বয়স ছয় কিংবা সাত হবে। ইলহান বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ওই সিটেই বসলো। ড্রাইভারের পাশের সিট ছিল সেটা। ইলহান তাদের সাথে বসায় প্রত্যেকের সে কি আনন্দ! তানিশা আর অন্বেষা তো অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসে হাত-তালি দিতে লাগলো। আর অরিনের অবস্থা ছিল দেখার মতো।কাউকে কিছু বলতেও পারছিল না আবার সহ্য করতেও পারছিল না। অরিনদের গাড়িটা মাইক্রোবাস। তাই অরিন ইলহানের থেকে তিন ধাপ পেছনে ছিল। এজন্য অরিন নিজেকে এই ভেবে সান্ত্বনা দিল যে, এতোদূর থেকে নিশ্চয়ই ইলহান তাকে চুমু দিতে আসবে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই অরিন মোবাইলে একটা ম্যাসেজ পেল,” ভুলেও এইটা ভেবে না যে তুমি বেঁচে গেছো। ভাইয়া ডাকার অপরাধে সুযোগ পেলেই তোমাকে কিস করবো। টেনশন নট। ”
সাথে কিসের ইমোজি। অচেনা নাম্বার থেকে এসেছে ম্যাসেজটা। অরিন ভীত আত্মা নিয়ে সামনে তাকালো। দেখলো ইলহান আঁড়চোখে তাকিয়ে আছে। অরিন তাকাতেই সে হাসলো। এই গরুটা অরিনের ফোন নাম্বার পেলো কোথায়?
গাড়িতে উঠার পাঁচমিনিটের মাথায় তুমুল ঝড় নেমেছিল। দুনিয়া অন্ধকার করা ঝড়। চারিদিকে বাতাসের তোলপাড়। এটা-সেটা ভেঙে পড়ার শব্দ। আর ঝুম বৃষ্টি! বৃষ্টির থেকেও বাতাস আর ধুলোবালির উৎপাত অনেক বেশি চারিদিকে। অরিন তখনি আবিষ্কার করলো, তার কানের একটা দুল নেই। রূপার দুল ছিল সেটা। অনেক দামী! আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এই দুল মা বিয়েতে একজনের থেকে উপহার পেয়েছিলেন। তিনি এখন মারা গেছেন। মা এই দুলের কথা সবসময় বলেন আর কাঁদেন। অরিন শাড়ির সাথে পড়ার জন্য দুল জোড়া মায়ের আলমারি থেকে চুরি করেছিল। ভেবেছিল পরে স্যরি বলে ফিরিয়ে দিবে। কিন্তু ফিরিয়ে দেওয়া আর সম্ভব না। দুলটা সে হারিয়ে ফেলেছে! অরিন সবাইকে অনুরোধ করলো তার দুলটা একটু খুঁজে দিতে। সবাই গাড়িতে ভালো করে খুঁজলো। সবচেয়ে বেশি খুঁজলো ইলহান। কিন্তু দুল পাওয়া গেল না। মারিয়া বার-বার বললো, দুলটা মনে হয় স্পটেই পড়ে গেছে। মানে তারা যে জায়গায় ঘুরতে এসেছিল সেখানে। অরিন কাঁদতে কাঁদতে বললো,” তোরা আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দে। আমি দুল না নিয়ে ফিরতে পারবো না। মা জবাই করে ফেলবে।”
ইতি চোখ বড় করে বললো,” আরে কাঁদিস না। কিচ্ছু হবে না। আমরা আন্টিকে বুঝিয়ে বলবো। আর তুই কি পাগল? এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে তোকে নামিয়ে দিলে তুই দুল তো খুঁজে পাবিই না বরং নিজেই হারিয়ে যাবি।”
ইতির কথার মাঝখানেই গাড়ি থেমে গেল। শ্যানিন বললো,” আরে ড্রাইভার চাচা কি করেন? ওর কথা শুনে কি আপনি গাড়ি থামিয়ে দিলেন? ও তো একটা পাগল।”
ড্রাইভার ইলহানের দিকে ইশারা করে বললো,” উনি আমাকে গাড়ি থামাতে বলেছেন।”
কেউ আর কিছু বুঝার আগেই ইলহান ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে গেল। শ্যানিন বললো,
” ভাইয়া তুই কই যাচ্ছিস?”
ইলহান তাড়াহুড়ো করে বললো,” তোর ফ্রেন্ডকে কাঁদতে নিষেধ কর। দুল না পেলে ডুপ্লিকেট কেনা যাবে তো! তাও আমি চেষ্টা করছি। দেখি পাই কি-না।”
ইলহান আর দাঁড়ালো না। দৌড়ে চলে গেল। ঝড়ের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। সবাই অবাক হয়ে চেয়ে দেখলো। সবচেয়ে বেশি হতভম্ব হলো অরিন। ভয়ংকর এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে এতো ঝক্কি-ঝামেলা মাথায় নিয়ে বিপদের তোয়াক্কা না করে ছেলেটা অরিনের হারিয়ে যাওয়া দুল খুঁজতে চলে গেল?কেনো?
মায়ের চিৎকারে অরিন বাস্তবে ফিরলো। আজ যে তার গায়ে হলুদ! মা চেঁচিয়ে অর্ণভের সাথে কি যেনো কথা বলছেন। অরিনের এখন আর অতীত নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না। পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে ইলহানের একটা ছবি বের করে অরিন তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। ভাবতেই অবাক লাগে, যে ছেলেটি অরিনের জন্য এতো এতো পাগলামি করেছে অরিন কি-না তাকেই খুন করতে চাইছে? শয়তানী দৃষ্টি নিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে অরিন বিরবির করে বললো,” তুই কেনো এতো খারাপ অরিন? তোর মধ্যে কি দয়া-মায়ার লেশটুকুও নেই? নিষ্ঠুর, পিশাচিনী, ডাইনি তুই!”
অরিন হাসতে হাসতে ইলহানের ছবিতে লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিল। অর্ণভ জোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। অরিন আগুন নিভিয়ে আধপোড়া ছবিটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে দরজা খুললো। অর্ণভ তাড়াহুড়ো করে বললো,
” তোর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি তত্ত্ব নিয়ে। ইলহানের জন্য কিনে রাখা শেরোয়ানী আর স্বর্ণের ঘড়িটা তোর ক্লোজেটে আছে না? জলদি বের করে দে।”
” ভাইয়া, আমিও তোমার সাথে যাই?”
” মেরে মুখ ভোতা করে দিবো। তুই কেনো যাবি? আজ না তোর গায়ে হলুদ?”
” গেলে কি হয় ভাইয়া? প্লিজ।”
” মাথাগরম করিস না তো। মা-বাবা কেউই রাজি হবে না। তুই ঘরে থাক। কোনো দরকার থাকলে আমাকে বল। আমি তো যাচ্ছিই।”
” সুমনা কয়দিন ধরে আমার সাথে জরুরী কথা বলতে চাইছে। তাই আমি ভাবলাম গিয়ে একটু শুনে আসি কি বলে?”
” সুমনাকে ফোন করলেই তো হয়। ওর নাম্বার নেই তোর কাছে?”
” নাম্বার আছে। কিন্তু ও ফোনে কিছু বলতে চায় না। সরাসরিই নাকি বলতে হবে।”
” তাহলে শ্যানিনকে বল সুমনাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসতে।”
” সুমনা এ বাড়িতে এলেই তো বাবা রাগারাগি করবে।”
” ও, আচ্ছা তাহলে আমিই তোর হয়ে শুনে আসবো সুমনা কি বলতে চায়। তারপর তোকে এসে বলবো। চলবে?”
” ঠিকাছে।”
অরিন ইলহানের জন্য কিনে রাখা জিনিসপত্র বের করে অর্ণভের হাতে দিয়ে দিল। অর্ণভ চলে যেতেই অরিন দরজা আটকে হাফ ছাড়লো। সে অবশ্য খুব ভালো করেই জানে সুমনা কি বলতে চায়? আর মজার বিষয় হচ্ছে, অরিন এই নাটকটা ইচ্ছে করেই করেছে। যেনো অর্ণভ নিজেই সুমনার থেকে কথা আদায় করে। এইবার অর্ণভ এমনিই সবকিছু জানতে পারবে। অরিনের কষ্ট করে কাউকে কিছু বুঝাতেও হবে না। এমনও হতে পারে অর্ণভ সব জানার পর নিজে থেকেই বিয়েটা ভেঙে দিল!

অর্ণভের মাথায় এখন পাহাড়সম ভার। সে বুকে প্রখর এক ব্যথা অনুভব করছে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। ঠিক করে হাঁটতেও পারছে না। আর না পারছে দাঁড়িয়ে থাকতে। শ্যানিনদের বাড়িতে যাওয়ার পর সুমনার সাথে একাকী আধঘণ্টা কথা বলার কুফল এইসব। এই আধঘণ্টায় সুমনা অর্ণভকে যা জানিয়েছে তাতে অর্ণভের সম্পূর্ণ দুনিয়া বদলে গেছে! সুমনা জানিয়েছে, নিশিতার সেই বিখ্যাত ডেলিভারি বয় অরিনের হবু বর ইলহান। এতটুকু পর্যন্ত বিষয়টা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সুমনা আরও বলেছে, ইলহান নিশিতার সাথে প্রায় একমাস ধরে ফোনে কথা বলে। তাদের মধ্যে গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। এমনকি তাদের পরিকল্পনা পালিয়ে বিয়ে করা অবধি পৌঁছে গেছে। যে ছেলেটা অরিনকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে সে নিশিতার মতো আরেকটা মেয়েকে নাকের ডগায় দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে! আবার তাকেও বিয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছে! মানে দু’জনকে একসাথেই খুব কৌশলে সামলে রেখেছে। শুধু দুইজন কেনো? হয়তো ইলহানের স্বীকারে আরও অনেক মেয়ে আছে। তাদের কথা অর্ণভ জানতেও পারছে না। নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে অর্ণভের। সে আগে কেনো বুঝলো না? অতি সুন্দর মানুষের চরিত্র সবসময় তাদের চেহারার মতো সুন্দর হয় না। ছেলেটাকে দেখতে কত নিষ্পাপ মনে হয় অথচ হৃদয়টা কত কলুষিত! হায়রে মানুষ! এজন্যই নিশিতাকে দেখে ইলহান সেদিন পালিয়ে গেছিল। অর্ণভ বিষয়টা খেয়াল করেছিল। কিন্তু সে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। নিশিতা ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে খুব করে দেখতে চেয়েছিল অরিনের হবু বরের ছবি। অর্ণভ তখন ইচ্ছে করেই ইলহানের ছবি নিশিতাকে দেখায়নি। কারণ নিশিতা প্রায়ই অরিনের গায়ের রঙ নিয়ে খুব কটাক্ষ করে কথা বলে। নিশিতার ওইসব কথা শুনলে অর্ণভের রাগে গায়ের রক্ত টগবগিয়ে উঠে। ইলহানের ছবি দেখার পর যদি নিশিতা আবার অরিনের গায়ের রং নিয়ে অপমানসূচক কোনো মন্তব্য করতো তাহলে অর্ণভ সেটা মেনে নিতে পারতো না। নির্ঘাত একটা বড়সড় ঝগড়া বেঁধে যেতো। তাই সে নিশিতাকে ইলহানের ছবি দেখাতে চায়নি। কিন্তু এখন খুব আফসোস হচ্ছে। কেনো নিশিতাকে ছবিটা দেখালো না সে? তাহলে অনেক আগেই ইলহানের আসল মুখোশ উন্মোচিত হতো। উফফ! এখন তো অর্ণভের মনে হচ্ছে, এই বিয়ে ভাঙা অসম্ভব। কারণ আজ সকালে ইলহানকে অরিনের বারান্দা থেকে মই বেয়ে নামতে দেখেছে অর্ণভ। ওদের সম্পর্ক কতটুকু গভীরে পৌঁছেছে কে জানে? এখন বিয়ে ভাঙতে গেলে অরিনের জীবনটা শেষ হয়ে যাবে না তো? অরিনটা এখনও আগের মতো বোকাই রয়ে গেল। মানুষ চেনার ক্ষমতা তার নেই। থাকবে কি করে? যেখানে অর্ণভ নিজেই ইলহানের মতো নরপশুকে চিনতে ব্যর্থ!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here