#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_২৯
লিখা: Sidratul Muntaz
অরিন চোখ খুলেই চমকে উঠলো। মনে হচ্ছে এইমাত্র উঁচু কোনো জায়গা থেকে নিম্নে পতিত হয়েছে সে। মাথাটা চক্কর দিয়েছে মনে হয়! অরিন আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলো সে এখন ইলহানের চলমান গাড়িতে বসে আছে। তার পাশে ইলহান ভাবলেশহীন মুখে ড্রাইভ করছে। তার মুখটা এতো বেশি শান্ত যে অরিনের গা কয়েক মুহুর্তের জন্য ছমছম করে উঠলো! অরিনের মনে পড়ে যাচ্ছে চোখ বন্ধ করার পূর্বে শেষ দৃশ্যটি। ইলহান যে অরিনের কামিজের বামহাতার একাংশ কেটে ফেলছিল.. তারপর যেনো কি হয়েছিল? অরিন লক্ষ্য করলো তার জামা একদম ঠিকাছে। তাহলে কি পুরোটা দুঃস্বপ্ন ছিল? অরিন চকিতে ইলহানের দিকে তাকালো পুনরায়। ইলহান অনুভূতিহীন মানবের মতো শুধুই ড্রাইভ করে যাচ্ছে। তার চোখে-মুখে কোনো হের-ফের নেই। এতোটা নিস্তব্ধ কেনো সে? অরিন নিজের বাহুর বামপাশে চোখ রেখে বুঝতে পারলো তার জামার হাতার অংশটুকু সত্যিই কাঁটা হয়েছে। কিন্তু খুব বেশি না। কনুই হতে তিন ইঞ্চি উপর পর্যন্ত। তারপর আর কোথাও কাঁটা নেই। এরপর কি অরিন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল? অরিন প্রশ্নগুলো নিয়ে বার-বার কৌতুহলী দৃষ্টিতে ইলহানের দিকে তাকাতে লাগলো। মনোযোগ আকর্ষণের জন্য নড়াচড়াও শুরু করলো। কিন্তু ইলহান আগের মতোই নির্বিকার। তার এতো নিস্তব্ধতা অরিনের মনের কৌতুহল আরও দ্বিগুণ করে তুলেছে। অরিন প্রশ্ন করেই ফেললো,
” আমি এখানে কেনো?”
ইলহান অতিশয় অবিচল কণ্ঠে উত্তর দিল,” কোথায় থাকতে চাও তাহলে?”
অরিন থতমত খেয়ে বললো,” মানে আমি জানতে চাইছি আমার কি হয়েছিল? আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি..”
” সেন্সলেস হয়ে গেছিলে তুমি।”
এই কথাটাও ইলহান খুব সুস্থিরভাবে বললো। ওর কণ্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো? যেনো নিষ্প্রাণ, মলিন, অসতেজ! অরিন দীর্ঘক্ষণ চুপ মেরে বসে রইল। ইলহানকে এখন ভয় পাওয়া উচিৎ নাকি অনুচিত সেটুকু নিয়েও দ্বিধায় আছে সে। আচ্ছা, ইলহান ওর কোনো ক্ষতি করলো না কেনো? আর এখনই বা তারা কোথায় যাচ্ছে? এই প্রশ্ন মস্তিষ্কে উদয় হতেই অরিন জিজ্ঞেস করে উঠলো,
” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
ইলহান সেই নিশ্চল অবস্থায় থেকেই বললো,” তোমাদের এলাকায় ঢুকতে আর দশমিনিট লাগবে।”
” আমরা বাসায় চলে এসেছি?”
ইলহান জবাব দিল না। অরিন জানালা খুলে বাহিরে দেখার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ ইলহান সত্যি বলছে৷ এটা অরিনের পরিচিত জায়গা। সামনে একটা বাঁক নেওয়ার পরই ওরা এলাকায় ঢুকে যাবে। অন্ধকার কেটে ভোরের সূর্য দেখা দিলে যতটা আনন্দ হয় অরিনের ঠিক ততটাই আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন তো থেকেই যায়। ইলহানের মতলব কি ছিল? সে কেনোই বা অরিনকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলে ফাঁকা সেই রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল? আর নিয়েই যখন গেল কোনো শাস্তি না দিয়ে নিরাপদে ফিরিয়ে কেনো আনলো? অরিন অচেতন হয়ে পড়েছিল বলে কি ইলহানের দয়া হয়েছিল? অরিন জানালার সাথে কিছুটা লেগে বসতেই বামহাতের বাহুতে প্রচন্ড জ্বলুনির মতো ব্যথা অনুভব করলো। অরিন মনে মনে আঁতকে উঠা কণ্ঠে বললো,” আহ!”
তারপর কাপড় সরিয়ে দেখলো ওর বাম বাহু অর্থাৎ কাঁধ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচের অংশে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। এই জায়গার কাপড়ের অংশই ইলহান কাচি দিয়ে কেঁটেছিল। অরিন ব্যান্ডেজ উঠিয়ে দেখলো তার চামড়ায় ছুড়ি দিয়ে খোদাই করে ইংরেজি অক্ষরে ইলহানের নাম লিখে রাখা হয়েছে। কাঁচা রক্ত এখনও জ্বলজ্বল করছে। অরিন মনে মনে ভয়ংকরভাবে চিৎকার করে উঠলো। ‘সাইকোপ্যাথ এটা কি করেছে?’ চোখেমুখে তুমুল বিস্ময় নিয়ে অরিন ইলহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
” এইটা কি করেছেন আপনি?”
ইলহান শান্ত ও সুস্থির কণ্ঠে জবাব দিল,
” স্ট্যাম্প দিয়ে রেখেছি। এইবার তুমি যার কাছে খুশি যাও, সবাই জানবে তুমি শুধু ইলহানের।”
অরিন চোয়াল শক্ত করে বললো,” আমাকে কি আপনি ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন? কিনে রেখেছেন? আপনার হাতের পুতুল আমি?”
” তুমিই বাধ্য করেছো এটা করতে। আমার তরফ থেকে তোমার জন্য একটা ছোট্ট শাস্তি। আর কখনও আমার এই চেহারা তোমাকে দেখতে হবে না। তাই নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে পারো। ”
ইলহান এইবার অতিরিক্ত থমথমে গলায় বললো,” আমাদের বিয়েটা হচ্ছে না। আমি অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাচ্ছি। তুমি ভালো থেকো।আর…”
ইলহান একটু থামলো। ভ্রু কুচকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে একদম অরিনের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো,
” আমি কিন্তু তোমাকে সারাজীবন ভালোবাসবো। তাই যদি কখনও আমার কাছে ফিরে আসা সম্ভব হয়, ফিরে আসতে পারো। ইলহান তার মায়াপরীর জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করতেও রাজী।”
অরিনের কেমন যেনো লাগলো। ইলহান কি সত্যি বলছে? সত্যি অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে সে? অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে কোথায় থাকবে? তার ওই গ্যাংস্টার বাবার কাছে? মি. ইভলিনের কাছে? ইলহানের গভীর, শান্ত-শিষ্ট চোখ দু’টোর দিকে তাকিয়ে অরিনের ইচ্ছে করলো হাউমাউ কেঁদে ফেলতে। কেনো খারাপ লাগছে তার? ইলহান স্বেচ্ছায় অরিনের জীবন থেকে চলে যেতে চাইছে। এতে তো অরিনের আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কথা। অথচ তার বুকের বামপাশটা ক্রমান্বয়ে এক অদ্ভুত ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে কেনো?পেছন থেকে আশ্চর্যজনক শব্দ কানে এলো। অরিন জানালায় তাকাতেই দেখলো একটা লাল প্রাইভেট কারে অনেকগুলো মাতাল অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে তাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। অরিনদের গাড়িটাকে হয়তো তারা ওভারটেক করতে চাইছে। ইলহান গম্ভীর গলায় বললো,
” জানালাটা আটকে দাও।”
অরিন সেই কাজটি করার আগেই গাড়িটা তাদের দিকে একদম তেড়ে আসলো এবং একটা লাল জ্যাকেট পরিহিত ছেলে অরিনের কাঁধ খামচে ধরলো। অরিন ভয়ে চমকে উঠে ইলহানের নাম ধরে চিৎকার দিল। ছেলেটা চোখের পলকেই অরিনের কাঁধ থেকে কাপড়ের অংশটুকু ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল। গাড়িটা ওভারস্পিডে তাদের দৃষ্টিসীমার থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। ইলহান গাড়ির স্টেয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরে ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় কণ্ঠে বললো,
” গাড়ি থেকে নামো অরিন।”
অরিন চমকিত স্বরে বললো,” কি?”
” তোমাকে গাড়ি থেকে নামতে বলেছি।”
অরিন কি উত্তর দিবে অথবা কি করবে, সত্যিই গাড়ি থেকে নেমে যাবে কি-না বুঝতে পারলো না। ইলহান চিৎকার করে বললো,” অরিন নামো!”
অরিন এইবার তাড়াহুড়ো করে নামলো। আর ইলহান ঝড়ের চেয়েও দ্রুত গতিতে গাড়ি নিয়ে সাঁই সাঁই শব্দে ছুটে চলে গেল। অরিন দাঁড়িয়ে রইল বোকার মতোন। কাঁধের ব্যথায় ঘাড় নাড়াতেও পারছে না। ছেলেগুলোর গাড়িটা আবারও এই রাস্তার দিকেই আসছে। অরিন ভয়ে দৌড়ে পালাতে চাইলো। কিন্তু পা চলছে না। ইলহান এটা কি করলো আজকে? অরিনকে বিপদের মাঝে একা ফেলে রেখে চলে গেল? অরিন দৌড়াতে দৌড়াতেই খেয়াল করলো ওই ছেলেগুলোর গাড়ির পেছনে ইলহানের গাড়িটাও আছে। অর্থাৎ ইলহান ওদের গাড়ি নিয়ে ধাঁওয়া করছে। অরিনের সাথে একটু অসদাচরণের অপরাধে ইলহান এখন ওদের শাস্তি দেওয়ার জন্য এক্সিডেন্ট করিয়ে দিবে না তো? ও মাই গড! অরিনের পা দুটো নিজস্ব শক্তিতেই থেমে গেল। সে কপালে হাত রেখে বলতে লাগলো,
” হে আল্লাহ, হে মা’বুদ, তুমি রক্ষা করো।”
অরিন কিছু ভাবতে না ভাবতেই চোখের সামনে দু’টো বিস্ফোরণ ঘটে গেল। প্রথমটা সেই মাতালদের গাড়ি। আর দ্বিতীয় গাড়িটা ইলহানের। অরিন খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিকট শব্দে এক ভয়াবহ চিৎকার দিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেল। ইলহান তো সবসময় অরিনকে সাদা পোশাক পড়তে বলতো। এখন থেকে কি তবে এই সাদা পোশাকই অরিনের চিরসঙ্গী হয়ে যাবে!
চলবে
( কিছুই ভালো লাগে না। গল্পটা লিখতেও আর ভালো লাগে না। এই গল্প তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য মনে হয় উঠে-পড়ে লেগেছি আমি। শেষ করেই ছাড়বো দুইদিনে।তাই এতো ঘন ঘন পর্ব দেই। আপনারা কি বিরক্ত হোন? এতোবার করে যে দেই?😑)