মেঘের পরে রংধনু পর্ব-৩৬ ২

0
1561

#মেঘের_পরে_রংধনু
#পর্ব_৩৬(দ্বিতীয় অংশ)
লিখা: Sidratul Muntaz

“কিরে বেটা, আন্টি বললো তুই নাকি অরিনকে বিয়ে করতে না করে দিয়েছিস? সমস্যা কি? যার জন্য এতোকিছু করলি এখন তাকেই রিজেক্ট করছিস?”
নাসির ইলহানের স্টাডি রুমে বসে আয়েশ করে চানাচুর চিবুতে চিবুতে প্রশ্ন করলো। ইলহান হাতের বইটা উল্টে-পাল্টে দায়সারাভাবে বললো,
” আমি কাউকে রিজেক্ট করিনি। অরিন নিজেই আমাকে বিয়ে করতে চায় না। তো এখানে আমার কি করার আছে?”
” সে তো তোকে কোনোদিনই বিয়ে করতে চায়নি। তখন তো কিডন্যাপ করবি, তুলে আনবি, জোর করে হলেও বিয়ে করবি… কত কিছু। আর এখন ও চাইছে না বলে তুইও চাইবি না? মাত্র দুইদিনে কি এমন হয়ে গেল?”
” ওর সাথে আমার ভয়ানক লেভেলের ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার সমস্ত ভুল ওর ছিল। সেজন্য এখন পর্যন্ত স্যরি তো বলেইনি এমনকি আমাকে ফোনও দিচ্ছে না। গতরাতে আমি নিজেই ফোন দিয়েছিলাম। তাও ধরেনি। আবার বিয়েতেও রিজেক্ট করে দিল। এতো ইগো কিসের ওর?”
” ভাই, মেয়ে মানুষের ইগো থাকেই। আমাকে দেখ, বিয়ে করে বউয়ের চাকর হয়ে গেছি।”
” আমি কি তুই? তোর মতো ছাগল? আর তুই বিয়েটাও তো করেছিস আমার সাহায্য নিয়ে। আমার নাম ব্যবহার করে কথা না বললে সাত জনমেও নিশিতাকে পটাতে পারতি তুই?”
” হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক। সেজন্য তোর কাছে আমি অবশ্যই কৃতজ্ঞ।”
” তোর নতুন শ্বশুরবাড়ির কি অবস্থা?”
” অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ। আমার শ্বশুরমশাই তো আমাকে সেইরকম আদর-যত্নে রেখেছে। আমি তো ভেবেছিলাম ধরা খাওয়ার পরই জেলে ঢুকিয়ে দিবে। বড়লোকের মেয়ে নিয়ে পালানোর মজা বুঝবো পুলিশের ডান্ডার বারি খেয়ে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপারটা কি জানিস? কিছুই হয়নি। বরং আমার শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনই সব মেনে নিয়েছে। শ্বশুর তো আমার চাকরির ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে৷ নতুন ফ্ল্যাটও দিবে বলেছে। দুইদিন পর বউকে নিয়ে ফ্ল্যাটে উঠে যাবো। আমার তো লাইফ সেট। দোয়া রাখিস।”
” হাহা, ভালোই তো। এক বলে ছক্কা মেরে দিলি।”
” হ্যাঁ, এবার তুইও বিয়ে করে ছক্কা মেরে দে। আরে বিয়ে জিনিসটাই এমন। স্বাধীন জীবনের অব্যাহতি, পরাধীন জীবনের শুরু।”
” বিয়েও করতে চাই না পরাধীনও হতে চাই না।”
” আরে ধূর, বিয়ে করে ফেল। যত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবি ততই ভালো। আমাকে দেখছিস না পরাধীন হয়েও কত সুখে আছি? আর এখন তুই কোন হিসেবে বিয়েতে নিষেধ করিস? নিজেই তো গুষ্টি শুদ্ধো মানুষকে নাকানিচুবানি খাইয়ে রাজি করালি৷ এখন আবার তুই-ই রিজেক্ট করছিস?”
” আমি আগে রিজেক্ট করতাম না। যদি অরিন না করতো।”
” বাচ্চা মেয়ে, ছেড়ে দে ভাই। ওর উপর রাগ করার মানে আছে? চকলেট, ফুল নিয়ে যা। একটু মিষ্টি করে কথা বল। প্রয়োজনে কানে ধরে উঠ-বস কর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।”
” আমি কানে ধরে উঠ-বস করবো?”
” আগে তো হামাগুড়ি দিতে বললে সেটাও রাজি হয়ে যেতি। এখন হঠাৎ এতো ইগো আসলো কোত্থেকে তোর? নাকি আসল জিনিস পেয়ে গেছিস? সত্যি করে বলতো।”
ইলহান রাগে বইটা বন্ধ করে বললো,” তুই আমার সামনে থেকে যা৷ এইসব ফালতু কথা বলার জন্য এইখানে এসেছিস?”
” আরে আন্টি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বললেন তুই নাকি বিয়ে করতে চাস না। আবার আমারও সদ্য বিয়ে হয়েছে। তাই বলেছেন আমি যেনো তোকে একটু বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করাই। বিয়ে-শাদির গুরুত্ব বুঝাই।”
” তোকে দেখে আমার এখন লেজকাটা শেয়ালের গল্প মনে পড়ছে। বিয়ে করে নিজের লেজ তো কেটেছিস। এখন আমারটাও কাটার জন্য উঠে-পরে লেগেছিস।”
” আচ্ছা ইলহান, আমাকে আগে একটু বলতো তোদের মধ্যে ভয়ানক লেভেলের ঝগড়াটা কি নিয়ে হয়েছিল? মানে তাহলে একটু বুঝতে পারতাম বিয়ে না করার পেছনের যুক্তিটা কি?”

সেদিন ইলহান অরিনকে বিয়ের জন্য নিয়ে গেছিল জোভান ভাইদের ফ্ল্যাটে। জোভান আর মুক্তি বিয়ের পর চাকরির সুবাদে গুলশানের একটা বিশাল ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে একাকী থাকে। সেখানে ইলহান-অরিন যাওয়ার পর ওরা বিশাল আয়োজনে বিয়ের ব্যবস্থা করে। অরিনকে বউ সাজানো হয়, ইলহানকে মাথায় পাগড়ী পড়ানো হয়। আবার রান্না-বান্নাও মুক্তি আর জোভান মিলে একসাথে করে। ইলহান শুধু একটা কথাই বলেছিল। যেনো বাসায় কেউ কিছু জানতে না পারে। জোভান আশ্বস্ত করে বলেছে, কেউ কিছু জানবে না। সন্ধ্যায় বিয়ের সব ফরমালিটি শেষ করে নতুন দম্পতিরূপে অরিন-ইলহান তাদের বিদায় জানিয়ে বাসা থেকে হয়। গাড়িতে উঠেই ইলহান অরিনকে অনুরোধ করেছিল গাজীপুরের একটা খুব সুন্দর রিসোর্টে যাওয়ার জন্য। অরিন চাইলে এখনি সে ব্যবস্থা করবে। কিন্তু অরিন এই কথা শুনে খুব রেগে গেল। আর বাসায় যাওয়ার জন্য তাড়া দিল। তখনি অর্ণভকে ফোন করে জানা গেল দুইদিনের আগে অরিনের বাসায় ঢোকা নিষেধ। নাহলে সবাই বিপদে পড়বে। অরিন এই কথা ইলহানকে জানানোর পর ইলহান খুব জোরে একটা উল্লাসী চিৎকার দিয়ে অরিনকে জড়িয়ে ধরলো৷ কিন্তু ইলহানের খুশিতে জল ঢেলে অরিন বললো,
” এইটা ঠিক হবে না ইলহান। আমি তোমার সাথে রিসোর্টে যাবো না।”
ইলহান থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলো,” কেনো?”
” এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। মন সায় দিচ্ছে না।”
” তাহলে কি করবে?”
” ভাইয়াকে যেটা বলেছিলাম। মারিয়াদের বাসায় চলে যাই।”
” ঠিকাছে, যেমন তোমার ইচ্ছা।”
” তুমি রাগ করবে না তো?”
” অরিন, যেটা করলে তুমি মন থেকে শান্তি পাবে সেটাই করো। আমি তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু পেতে চাই না। আমার নিজের সিদ্ধান্তও তোমার উপর চাপিয়ে দিতে চাই না। আর আজকে বিয়েটা করার একটাই রিজন ছিল। তোমাকে মানসিকভাবে স্বস্তি দেওয়া। আমার কেনো যেনো মনে হতো তুমি আমার সাথে বিয়ের আগে মেলা-মেশা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করো না৷ এজন্যই আমি বিয়েটা করেছি। যেনো তোমার কোনো প্রবলেম না হয়। আর বিয়ে করেছি বলেই যে তোমার উপর অধিকার ফলানোর চেষ্টা করবো এমনটাও ভেবো না। তোমাকে আমি নিজের অধিকার মনে করি না, দায়িত্ব মনে করি। আর এখন সেই দায়িত্ব আরও বেড়েছে।”
অরিন ইলহানের উত্তর শুনে খুব খুশি হলো। তারপর ইলহানের কাঁধে মুখ রেখে বললো,
” আচ্ছা থাক, মারিয়াদের বাসায় যাবো না। চলো অন্যকোথাও যাই।”
” কোথায়?”
” আমার ছোটখালামণির বাড়ি। টাঙ্গাইল।”
” কি বলো এইসব? এতোদূরে?”
” গাড়ি আছে না। প্রবলেম কি?”
” তাই বলে ছোটখালামণির বাসায় কেনো?”
” রিসোর্টে যাওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেনো লাগে। তাই ভাবলাম কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যাই৷”
” সেটা হলে তো আমরা জোভান ভাইদের বাসাতেই থাকতে পারতাম। কিন্তু আমরা তো থাকিনি। কারণ আমি তোমাকে নিয়ে একা সময় কাটাতে চাই অরিন। এইটা আমাদের বিয়ের প্রথম রাত। অবশ্যই অনেক স্পেশাল।”
” হ্যাঁ জানি। সেজন্যই তো বলছি, ছোট খালামণির বাসায় যাই।”
” সেখানে গেলে কি হবে? এর থেকে রিসোর্ট বেটার।”
” আরে বাবা, আমার ছোটখালামণিকে তুমি চেনো না। তিনি খুব ফ্রেন্ডলি। আর তার বাসাটা এতোবড় আর সুন্দর। তুমি গেলেই বুঝবে। সবচেয়ে মজার কথা হলো সেই বাসায় ছোটখালামণি আর তার হাসব্যান্ড ছাড়া কেউই থাকে না। সম্পূর্ণ বাড়ি ফাঁকা থাকে।”
” জোভান ভাইয়ের বাসাটাও তো এমনি৷ কষ্ট করে টাঙ্গাইল যাওয়ার কি দরকার? এখানে থাকলেই হতো।”
” আহা, ওদের সামনে আমার লজ্জা লাগে।”
” খালামণির সামনে লজ্জা লাগবে না?”
” প্লিজ চলো না ইলহান।”
ইলহানকে অবশেষে টাঙ্গাইল যাওয়ার জন্য রাজি করানো গেল। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর ইলহান যেটা দেখলো তার জন্য ইলহানের মন মোটেও প্রস্তুত ছিল না। অরিন ইলহানকে মারাত্মক একটা ঢপ দিয়েছে। ছোটখালামণিদের মোটেও কোনো বিশাল বাড়ি না। দুইতলার আটসাঁট ছোট-ছোট রুমের একটা ভাঙাচোরা পুরনো বাড়ি৷ আর সেই বাড়িতে পিঁপড়ের মতো মানুষের বিচরণ। পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চাদের চিৎকার-চেঁচামেচির যন্ত্রণায় কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। বাড়িতে প্রবেশ করার পর প্রথমেই ইলহানকে পাকা পেঁপের শরবত খেতে দেওয়া হয়েছিল। ইলহান শরবতে পোকা দেখে শরবত খেতে চাইলো না। কিন্তু আশেপাশের সব মানুষ ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। তাই চক্ষুলজ্জায় পড়ে শরবত খেতে হলো। পোকাওয়ালা শরবত। ইলহানরা যাওয়ার পর ভীড় আরও অনেক বেড়ে গেল। অন্য বাসা থেকেও মানুষ আসতে লাগলো জামাই দেখতে। বাচ্চারা ইলহানকে সালাম দিয়ে সালামি নিতে লাগলো। ইলহানের পকেট পাঁচমিনিটেই অর্ধেক ফাঁকা হয়ে গেল। বাথরুমের অবস্থা নাজেহাল। কোনো দরজা নেই। টিন দিয়ে দরজা বানিয়ে নিতে হয়। খুবই হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতি। আর এই বাড়িতে প্রবেশ করার পর ইলহান অরিনকে চোখেই দেখেনি। মেয়েটা যেনো বাতাসের সাথে মিশে গেছে। সর্বক্ষণ বাচ্চারা ইলহানকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে রাখছে। না উঠতে দিচ্ছে আর না শান্তিমতো বসতে দিচ্ছে। আবার একটু পর পর অচেনা মানুষজন এসে দরজা,জানালায় উঁকি মেরে ইলহানকে দেখে যাচ্ছে। ‘অরিনের খুব সুন্দর জামাই হয়েছে’ বলে মুখে ফেণা তুলে ফেলছে৷ ইলহান তখন মনে মনে ভাবছে,’ যার জামাই তার খবর নাই, পাড়া-পড়শীর অভাব নাই।’ সারাবাড়ি অরিনকে খুঁজতে খুঁজতে ইলহানের কাহিল দশা হলো। রাত যখন বারোটা বাজে তখন অরিনের ষোল বছর বয়সী কাজিন জাফরিন এসে ইলহানকে কাঁথা আর বালিশ দিয়ে বললো,
” নিন দুলাভাই। শুয়ে পড়ুন।”
” আমি এইখানে শুবো?”
” অবশ্যই। আমাদের বাড়িতে তো এটাই সবচেয়ে ভালো রুম।”
ইলহান রুমটার দিকে চোখ বুলালো। দেয়াল খসে রঙ উঠে গেছে। একটা কেমন যেনো গন্ধ চারদিকে। বিছানাও নড়বড়ে। আর প্রচুর মশা। ইলহান বললো,
” এই রুমে তো প্রচুর মশা।”
” মশারি আছে তো। টানিয়ে নিন। নাকি আমি টানিয়ে দিবো?”
” আমি মশারীর নিচে ঘুমাতে পারি না। তোমাদের এখানে এরোসল আছে?”
” কি যে বললেন না দুলাভাই। এইসব এইখানে কোথায় পাবেন? আচ্ছা আমি আপনাকে আরেকটা স্পেশাল জিনিস দিচ্ছি।”
জাফরিন এক দৌড়ে গেল তারপর এক দৌড়ে ফিরে আসলো হাতে একটা ব্যাট নিয়ে। ইলহান বললো,
” এটা কি?”
” চিনেন না? মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাট৷ এইটা দিয়ে ঠাস-ঠুস মশা মারবেন। সারারাত ডিশুম-ডিশুম। নিন।”
” ওয়াও, সারারাত ডিশুম-ডিশুম তাই না? ভেরি গুড। আচ্ছা তোমার আপু কোথায়?”
” অরিন আপুর কথা জিজ্ঞেস করছেন?”
” হুম।”
” আপু তো আজকে আমাদের সাথে থাকবে। এতোদিন পর আপুকে পেয়েছি। আপনি তো সারাজীবনই পাবেন। আজকে আমাদের সাথে থাকতে দিন প্লিজ।”
” তোমার আপুও রাজি?”
” হ্যাঁ। আপুই তো আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে যেনো বুঝিয়ে বলি যে আজকে আপু আমাদের সাথে থাকবে।”
” বাঃ, খুব ভালো। তাহলে তো আমার আর কিছু বলারই নেই। ”
” হুম। কোনো অসুবিধা হলে বলবেন দুলাভাই। আর মশার ব্যাটটা সাথে রাখবেন। গুড নাইট।”
” ওকে। গুড নাইট।”
জাফরিন দরজার বাহিরে যেতেই ইলহান মশার ব্যাটটা দিয়ে নিজের কপালে একটা বারি মারলো। জাফরিন ফিরে এসে বললো,
” এইটা কি হলো দুলাভাই? ব্যাট তো দিয়েছি মশা মারতে। আপনি কপালে মারছেন কেনো?”
ইলহান অপ্রস্তুত হয়ে বললো,” কপালে মশা বসেছিল তাই।”
জাফরিন ঠোঁট টিপে হেসে বললো,” ও আচ্ছা। আপনি অনেক কিউট দুলাভাই। যাই।”
ইলহান হাতের সবকিছু বিছানায় ফেলে শান্ত হয়ে বসলো। ফ্যানের ঘটর ঘটর শব্দটা বিরক্ত লাগছে। ফ্যান বন্ধ করতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু গরমেও টেকা যাবে না। তার উপর প্রচুর মশা। পাঁচমিনিটের মাথায় হুট করেই কারেন্টটা চলে গেল।এখন তো মশাগুলো পাগলের মতো কানের সামনে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে৷ এই রাত কাটবে কিভাবে?অরিন এ কেমন ঝামেলায় ফেলে গেল ইলহানকে! হঠাৎ কোথা থেকে যেনো ঝনঝন শব্দ এলো। ইলহান আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো এই রুমেই আরেকটা দরজা আছে। আওয়াজটা আসছে সেই আরেকটা দরজা থেকেই। ইলহান কৌতুহল বশত দরজা খুলেই দেখলো সে বাহিরে উঠানে চলে এসেছে। উঠানের ঠিক মাঝখানে কলপাড়। মাথার উপরে কি সুন্দর আলোকিত জোৎস্না! আজকের রাতটা জোৎস্নাময়। চারদিকে মৃদু বাতাস। ঝনঝন শব্দটা এখনও শোনা যাচ্ছে। ইলহান আরও খুঁজে দেখলো ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অরিন হাতের চুরি নাচাচ্ছে৷ ঝনঝন শব্দের উৎস সেখান থেকেই। ইলহান আরও এগিয়ে গেল। অরিন এবার ঘুরে তাকালো। ইলহানের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো অরিনকে দেখে। সে মারাত্মক সাজ-গোজ করেছে। কালো আর সাদা পাথরের মিশেলের একটা শাড়ি পড়েছে। চুড়িগুলো রূপালি রঙের। মাথায় টিকলি, কানে দুল, পায়ে নুপুর, মানে কিছুই বাদ নেই৷ ইলহান বিস্মিত গলায় বললো,
” অরিন তুমি?”
অরিন খিলখিল করে হেসে বললো,” কি ভেবেছো? আমি সত্যি তোমাকে একা ফেলে ওদের সাথে ঘুমাতে চলে যাবো? এতো সেলফিশ মনে হয় আমাকে?”
ইলহান অবাক হয়ে কয়েক মিনিট তাকিয়েই রইল। অরিন কাছে এসে লাজুক মুখে জিজ্ঞেস করলো,
” বলবে না কেমন লাগছে?”
ইলহান সাথে সাথেই অরিনকে কোলে নিয়ে বললো,
” চলো শুয়ে শুয়ে বলি কেমন লাগছে?”
অরিন দুইহাতে মুখ ঢেকে বললো,” উফফ, এখন আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। প্লিজ ঘরে যাওয়ার দরকার নেই। চলো আমরা এখানে বসে সারারাত জোৎস্না দেখি।”
” জোৎস্নার আলো আজকে আমার ঘরেই আছে৷ বাহিরের জোৎস্না দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। অরিন, আজকে আমি তোমার অন্ধকারভীতি কাটিয়েই ছাড়বো। এমন ব্যবস্থা করবো যে তুমি চব্বিশ ঘণ্টা অন্ধকারেই থাকতে চাইবে।”

পরদিন সকালে ইলহান খাবার টেবিলে বসেছিল।তখন অনেক ভোর। তেমন কেউই ঘুম থেকে উঠেনি। শুধু ছোট খালামণি উঠেছেন। তিনি রান্নাঘরে বসে অরিন আর ইলহানের জন্য নাস্তা বানাচ্ছিলেন। রুটি গরম ছিল দেখে ইলহান না খেয়ে মোবাইল দেখছিল। তখন হঠাৎ অরিন ছোটখালামণিকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
” আমার অনেক লজ্জা লাগছে আন্টি। আমি ওর কাছে নাস্তা নিয়ে যেতে পারবো না। তুমি যাও প্লিজ।”
” এখানে এতো লজ্জার কি আছে? তুই এমন কাঁপছিস কেনো অরিন?”
” জানি না, আমার মনে হচ্ছে আবার জ্বর আসবে।”
” দেখো কান্ড। আচ্ছা থাক, তোকে কিছু করতে হবে না। তুই ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক।”
” বিছানা দেখলে আমার আরও লজ্জা লাগে।”
ইলহান এইসব দূর থেকে শুনে চট করে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। অরিন সেটা খেয়াল করলো। ইলহান মোবাইল নিয়ে একদম ছাদে চলে এলো। তারপর নাসিরকে একটা ফোন দিল। নাসির ফোন ধরেই তার বিয়ের রাতের মজার ঘটনাগুলো ইলহানকে শোনাতে লাগলো। ইলহানের কাছে ব্যাপারটা তখন কাটা ঘাঁয়ে নূনের ছিঁটা দেওয়ার মতো। সে রেগেমেগে বললো,
” প্লিজ চুপ থাক। নয়তো আমি কি করবো নিজেও জানি না। শুধু শুধু নকল বিয়ের নাটকটা করলাম। ছাতার মাথা কোনো লাভই হলো না।”
” লাভ হলো না কেনো? কি হয়েছিল?”
” কি আর হবে? অরিনের তো অন্ধকারভীতি আছে। আবার ওদের বাড়িতে গতরাতে কারেন্টও ছিল না। কিছু হওয়ার আগেই সে কাঁপতে কাঁপতে জ্বর বাঁধিয়ে ফেললো। এরপর আমি সারারাত ঘুম হারাম করে কলপাড় থেকে বেডরুমে দৌড়াদৌড়ি করলাম। মাথায় জ্বর পট্টি দিলাম। আর এখন সে খালামণির সামনে এমন ঢং করছে যেনো কত কি হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। মেয়ে মানুষ এতো ঢংগী কিভাবে হয় ভাই? আমার তো ইচ্ছে করছিল চটকানা লাগাতে। ঢংগী জানি কোথাকার!”
নাসির হাসতে হাসতে বললো,” আরে ধৈর্য্য ধর। এতো তাড়া কিসের? আরও রাত তো আছেই। ”
” বাল আছে।”
ইলহান কথা বলতে বলতে পেছনে ঘুরতেই অরিনকে দেখে চমকে উঠলো। অরিন রক্তিম দৃষ্টিতে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর আচমকা এসে চড় দিল ইলহানের গালে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,
” জঘন্যভাবে বিয়ের এই নকল নাটকটা না করলেও পারতেন। ছিঃ! বিশ্বাস করেছিলাম আপনাকে। কিন্তু আপনি এতো খারাপ?”
ইলহান সাথে সাথেই বললো,” আর তুমি কোন পানি দিয়ে ধোঁয়া তুলসীপাতা শুনি? রায়হানের মতো আরও কয়টাকে ঘোল খাইয়ে রেখেছো আল্লাহ জানে। আমি যেনো তোমার কয় নম্বর বয়ফ্রেন্ড? ”
অরিন স্তব্ধ হয়ে গেল ইলহানের কথা। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,” তুমি আমাকে অতীত নিয়ে কথা শোনাচ্ছো?”
” না শুনানোর কি আছে? তুমি আমাকে কথা শুনাতে পারলে আমিও পারি। তুমি অনেস্টলি বলতে পারবে আমার আগে তোমার জীবনে অন্যকেউ ছিল না? তুমি সারাজীবন আমার প্রতি লয়্যাল থাকবে তার কি গ্যারান্টি আছে? ”
” চমৎকার। প্রতিটি ছেলেই চায় তার গার্লফ্রেন্ডের জীবনে শুধু সে-ই ফার্স্ট লাভ হোক। অথচ একটা মেয়ে কি চায় জানো? তার বয়ফ্রেন্ডের লাইফে আগে যত মেয়েই আসুক না কেনো, সবাইকে ভুলিয়ে সে নিজে যেনো তার বয়ফ্রেন্ডের লাস্ট লাভ হয়ে থাকতে পারে। এইখানে ছেলেদের আর মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য। তাছাড়া আমি তো আমার লাইফে তোমাকে ইনভাইট করে আনিনি ইলহান। তুমি নিজে এসেছো। সবকিছু জেনেই এসেছো। তাহলে এখন আবার আমাকে অতীত নিয়ে খোঁটা দাও কোন সাহসে? কিভাবে রায়হানের কথা বলতে পারলে?”
অরিন মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। ইলহান কিছুটা নরম হয়ে অরিনের কাঁধে হাত রেখে বললো,” স্যরি।”
অরিন সাথে সাথে সেই হাত সরিয়ে দিল। অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,” খবরদার। তোমার মতো প্রতারকের সাথে আমি আর এক মুহুর্ত সম্পর্ক রাখতে চাই না। আজকের পর থেকে আমাদের মধ্যে সব শেষ। দিস ইজ দ্যা এন্ড অফ আউয়ার স্টোরি।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here