সেদিনও জ্যোৎস্না ছিল পর্ব-২৮

0
6918

#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল

#তানিয়া

পর্ব:২৮

আদ্য নেই তিনদিন হলো।কিন্তু মেহু আদ্যর সেই একাকীত্বকে কখনো স্মরণ করে না।মেহু সবসময় অনুভব করে আদ্য তার আশেপাশেই আছে। মেহুর এখনো তিনদিন আগের সময়টার কথা মনে পড়ে। দুজনে নিরিবিলি ভাবে কতো সুন্দর একটা সময় কাটালো।ইশশ বেচারা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল আর মেহু তার মাথায় যত্ন করে হাত বুলায়।মেহুর বারবার মনে হতে থাকে এভাবে যদি আদ্যকে কোলে শুয়ে সারাজীবন তাকে নিজের করে পেতে পারতো তাহলে হয়তো খুব একটা ক্ষতি হতো না।মেহু আদ্যকে নিয়ে কতো সব কল্পনা করে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম ভাঙতে মেহু নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে।বুঝতে পারে আদ্য তাকে শুয়ে দিয়ে গেছে। হঠাৎ আমেনা খালার কথা মনে পড়তে মেহু লজ্জা পেয়ে যায় নিশ্চয়ই তাদের কান্ড খালা দেখেছিল ভাবতেই কানটা গরম হয়ে উঠে।ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতে জানতে পারে আদ্য ব্যবসার কাজে ডুবাই গেছে। কতদিন লাগবে জানা নেই। মেহুর মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। এ খবরটা আদ্য তাকে জানালো না।সুন্দর কিছু সময় কাটানোর পর মনে হয় প্রিয় মানুষটা আরেকটু কাছে থাকুক তখন দূরত্বটাকে অনেক বড় শত্রু মনে হয়।এখন মেহুর তাই লাগছে।

আমেনা খালা খুব গুছিয়ে তার সংসার জীবনের গল্প বলছে আর খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনছে মেহু,নীলা আর সূচী।মাঝে মাঝে খালা এমন সব কথা বলে উঠে যেগুলো শুনলে তিনজনি হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়।এরমধ্যে বারকয়েক মেহুর শরীর গুলাতে থাকে কিন্তু তবুও সেটাকে পাত্তা না দিয়ে গল্প শুনছে।আমেনা খালা যেই না খাবারের কথা বললো ওমনি মেহু কি ভেবে সোজা দৌড় দিলো।গলগল করে বমি করে পুরো বেসিন ভাসিয়ে দিলো। মেহুর হঠাৎ এমন অবস্থা দেখে সবাই ঘাবড়ে যায়। নীলা ফ্রিজ থেকে আচার বের করে দিতে মেহু সেটা খাওয়া শুরু করে।পুরো বিষয়টা দূর থেকে লক্ষ্য করলো লুৎফা।তার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছিল তাই সে ঘরোয়া ডাক্তারকে কল করে।মেহু পরিষ্কার হয়ে বসতেই লুৎফা তাকে ডেকে পাঠায়।মেহু লুৎফার ঘরে যেতে তিনি মেহুর দিকে না তাকিয়ে ইশারা দিয়ে বসতে বলে।মেহু বসে আছে কিন্তু লুৎফা কিছু বলছে না।তার ভাবমূর্তি অন্য রকম লাগছে মেহুর কেনো জানি ভয় হতে লাগলো।সে আল্লাহর নাম জপতে লাগলো।

লুৎফা রক্তাভ চোখ নিয়ে বারবার মেহুর দিকে তাকাচ্ছে আর মেহু বিছানায় আড়ষ্ট হয়ে বসে ক্রমাগত চোখের জল ফেলছে।লুৎফা মেহুর দিকে চোখ সরিয়ে বাকিদের দিকে তাকালো।তারা ভয়ে একে অপরকে চাওয়াচাওয়ি করছে।লুৎফা কি করবে বা কি বলবে ভেবে পেলো না।রক্ত চক্ষু থেকে জল পড়ছে আর সেটা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিচ্ছে। নিজেকো শান্ত করার চেষ্টা করছে যদিও জানে সেটা সম্ভব না।ডাক্তার যাওয়ার পর থেকে লুৎফা অস্বাভাবিক আচরণ করছে।যে খবরটায় সে এত বেশি উদ্বিগ্ন অন্য সময় হলে এ খবরে চারপাশি মিষ্টির ছড়াছড়ি হয়ে যেত।কিন্তু এখন সেটা সম্ভব না কারণ সময়টা বা পরিস্থিতি এমন যে চাইলেও স্বাভাবিক হওয়া অসম্ভব।

“মেহু আমি তোমাকে কিছুই করবো না।আমরা জানি তুমি একটা মারাত্মক ক্রাইসিসের ভেতরে গেছো।তোমার জায়গায় আমরা হলে আরো বেশি ভেঙে পড়তাম।সত্যি বলো তো আজগর তোমার সাথে ঠিক কি কি করেছে?”

মেহু চুপ করে আছে কিন্তু কিছুই বলছে না।

“মেহু তুমি সত্যিটা বলো আমি কথা দিচ্ছি এ বিষয়ে আমি ব্যবস্থা নিবো।আজগর তোমার সাথে কি কি করেছিল?”

“মা আজগর আমার সাথে কিছুই করে নি।আমি ওকে সেই সুযোগ দেইনি।মা বিশ্বাস করুন ও আমার কাছে আসার সুযোগ পায় নি আমার কাছে দা ছিল।”

“মেহু তুমি কি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো?ডাক্তার জানিয়েছেন তুমি প্রেগন্যান্ট। বাচ্চা কি তাহলে আকাশ থেকে পরলো।তোমাকে যখন এ বাড়িতে আনা হয় তখন তোমার পোশাক ছিল সম্পূর্ণ ছেড়া শুধু তাই নয় তোমার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল।তাছাড়া তুমি সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় ছিলে।তুমি কি একটুও টের পাওনি ও তোমার সাথে কি করেছিল?”

“মা আমি সত্যি বলছি ও আমাকে কিছুই করার সাহস পায় নি।মা আমি আপনার পায়ে পড়ছি আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।”

লুৎফা চোখ মুখ শক্ত করে মেহুর কাছে বসে।দুই হাত দিয়ে মেহুর বাহু ঝাকড়াতে থাকে।

“ঠিক আছে আমি ভুল তুমি তাহলে সত্যিটা বলো।কে এই বাচ্চার বাবা?”

মেহু লুৎফা হাত ধরাতে ব্যাথা পায় কিন্তু কিছুই বলেনা।বার কয়েক জিজ্ঞেস করলে মেহু অস্পষ্ট স্বরে আদ্যর নাম উচ্চারণ করে।লুৎফা মেহুর হাত ছেড়ে দেয়।সে আবারও প্রশ্ন করে,

“মেহু স্পষ্ট করে বলো কে এই বাচ্চার বাবা?”

“মা আদ্য স্যার ”

মেহুর মুখ থেকে নামটা বের হওয়ার বাকি লুৎফা সজোরে একটা চড় বসিয়ে দেয় মেহুর গালে।ছিটকে পড়ে খাটের কোণায়।

“অসভ্য মেয়ে এত সাহস তোর তুই অন্যের পাপকে আমার ছেলের ওপর চাপাস।বেয়াদব মেয়ে সত্যি করে বল এটা আজগরের পাপ তাই না?সে তোর অচেতন অবস্থায় সুযোগ নিয়েছে তাই তো?

“না মা দোহাই আপনার। আমি মিথ্যা বলছি না।আদ্য স্যারের সাথে আপনি কথা বলে দেখুন তিনি আপনাকে সবটা জানাবেন।”

“কি জানাবে আমার ছেলে?তোকে বাঁচানোর জন্য হয়তো সে এ পাপ মাথায় নিবে ঠিক আগে যেভাবে তোকে বাঁচিয়েছিল।আমরা সবাই জানি তোর সাথে আদ্যর সম্পর্ক কেমন এমনকি তোদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক হওয়ার সুযোগ ছিলই না তাহলে আদ্য এ বাচ্চার বাবা হয় কীভাবে? মেহু সত্যি বল আসল ঘটনা কি?দরকার পরলে আমি আদ্যর সাথে এ নিয়ে কথা বলবো প্রয়োজনে ঐ জানোয়ারের ফাঁসি হওয়ার ব্যবস্থা করবো তুই শুধু একবার স্বীকার করে নে।”

মেহু জানে এ মুহুর্তে হাজারবার বললেও আরকিছু হবে না।তাই সে চুপ হয়ে গেলো।আমেনা অস্ফুট স্বরে বললো,

“বড় আপা যদি কিছু মনে না করেন তাইলে একটা কথা কইতাম।আপনি আগে সব কথা শুনেন আমার মনে হয় এইডা মিথ্যা নাও হইতে পারে।আপনি আদ্য বাবা আওন অবধি অপেক্ষা করেন তয় সবডা পরিষ্কার হইবো।”

“চুপ একদম চুপ।কোনো সাফাই গাইবে না।তুমি এই তুমিই ওকে শুরু থেকে সবরকম সাহায্য করেছো তাতে আমি তোমার ওপর রাগ করি নি।কিন্তু এখানে আমার ছেলের জীবন নিয়ে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে আর আমি মা হয়ে সেটা মেনে নিবো।অসম্ভব। মেহু হয় সত্যিটা বলো নাহলে আমাকে কঠোর হতে হবে।’

“মা আমি যা বলার বলে ফেলেছি এবার আপনি আমাকে যা শাস্তি দিবেন আমি মেনে নিবো।’

লুৎফা বেশ কিছুটা সময় ঝিম মেরে রইলো।তারপর আমেনার দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমেনা এ মেয়েকে এক্ষুনি এ মুহুর্তে এ বাড়ি ছাড়তে বলো।আমি এ মেয়ের মুখ দ্বিতীয় বার দেখতে চাই না।”

মেহু কান্না বন্ধ করে লুৎফার দিকে তাকায়।কি বলছে তিনি?এটা ভুল এভাবে তিনি মেহুকে বের করতে পারেন না?

“মা আমি চলে যাবো আপনি শুধু আমাকে আদ্য স্যার আসা অবধি থাকার সুযোগ দিন।আমি অনাগত বাচ্চার কসম কেটে বলছি ওনি যদি নিজেই বলেন না থাকতে আমি স্বেচ্ছায় বের হয়ে যাবো।আর কখনো এ বাড়ি বা আপনাদের মুখোমুখি হবো না প্লিজ মা আমার প্রতি দয়া করুন।”

“আমেনা আমি যা বলার বলেছি।ও নিজের পাপ আমার ছেলের ওপর চাপাবে আমি সেটা দেখতে পারবো না।আমি বড় ভুল করেছি এ মেয়েকে ছেলের বউ করে।আমার জানা উচিত ছিল এতিম সন্তানরা স্বেচ্ছাচারী হয় তারা নিজেদের মতো জীবন সাজাতে ব্যস্ত। কারো জীবন নিয়ে পরোয়া করে না।আমি একবার আমার ছেলের জীবন ছারখার করেছি দ্বিতীয় বার সুযোগ দিয়ে সেটা বাড়াতে চাই না।আমার ছেলে এ বাড়িতে পা দেওয়ার আগে এ কলঙ্কিনীর এ বাড়ি থেকে বিদায় হওয়া চায় নাহলে সে স্বামীর মৃত্যুর কামনা করবে।অবশ্যই তার ভেতর যদি পতি শ্রদ্ধা বলে কিছু থাকে।”

লুৎফা এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে মেহুর সামনে থেকে চলে যায়। মেহু পাথরের মতো বসে থাকে।

একলা পথিকের মতো মেহু ঘর ছাড়লো।কাউকে জানালো না কেউ জানলো না রাতের আধারে চোরের মতো সে এ বাড়ি ছাড়লো।নিষ্কলঙ্ক হয়েও তার শরীরে যে কলঙ্কের চাপ পড়েছে এরপর সবার সামনে মুখ নিয়ে বের হওয়ার মতো সাহস মেহুর হলো না।তবে মেহু বিশ্বাস করে আজকের এ দিনটার জন্য এ পরিবারের প্রতিটা মানুষ ভুগবে কিন্তু মেহু সেটা দেখবে না।মেহু চোখের জল ফেলে রওনা হয় অজানা পথের দিকে।

ড্রইংরুমে ছোট খাটো একটা জটলা হয়ে গেছে।পুরো বসার রুমের যা তা অবস্থা। কাঁচ,ফুলদানি, গ্লাসের ভাঙা টুকরো যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার মধ্যে মূর্তির মতো বসে আছে আদ্য।আদ্যকে ঘিরে আছে বাকিরা।লুৎফার চোখেমুখে আতঙ্ক। ছেলের সামনে যেতে এখন সে বিরাট ভয় পাচ্ছে। ভয় পাওয়ারই কথা যে সত্যের মুখোমুখি তারা উপস্থিত তার কাছে তো তারা আর নিরপরাধ নয়।বড় ধরনের অপরাধ হয়ে গেছে আর সেই অপরাধের মাশুল কীভাবে দিবে তা জানা নেই কারোর।

মেহু যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তার তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে ফোন আসে।ডা.অর্ণা জানায় মেহুর রিপোর্ট গুলো তৈরি হয়েছে সে যেন এসে নিয়ে যায়। হাসপাতালের বিষয়টা নীলার মাথা থেকে প্রায় বের হয়ে গেছিলো।লুৎফা জানতে চায় কীসের রিপোর্ট। নীলা সেই দিনের বিষয়টা জানালে লুৎফার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কি মনে করে লুৎফা নিজেও যায় নীলার সাথে রিপোর্ট আনতে।

ডা.অর্নার সামনে বসে আছে দুজন।দুজনের চেহারায় যতটা বিস্ময় তারচেয়ে বেশি ভয়।তারা বুঝতে পারছে না রিপোর্ট ভুল নাকি তাদের করা কাজটা।মেহু প্রেগন্যান্ট আর এটা নিয়েই আহসান ভিলায় যতসব সমস্যা ছিল।এখন মনে হচ্ছে সেটা সমস্যা না আসল সমস্যা আহসান ভিলার মানুষের।লুৎফা কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। তার বারবার তৃষ্ণা লাগছে কিন্তু এ নিয়ে এক বোতল ঠান্ডা পানি প্রায় শেষ। তবুও যেন তৃষ্ণা মেটার নাম নেই বরং আরো বাড়ছে।ডা.অর্ণা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে লুৎফাকে দেখছেন।

“আন্টি আপনার কি হয়েছে আপনি এমন করছেন কেন?”

“না মা আমার কিছু হয় নি।তবে তুমি কি দয়া করে বলবে এ রিপোর্টে যা আছে তা ঠিক মানে তোমাদের মেশিনের সমস্যা হয়নি তো?”

“না আন্টি আমি ভালো করে চেকআপ করেছি এমনকি মেশিনও ভালো। আপনি কি কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত? ”

লুৎফা জবাব দেয় না সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।তার শরীর কাঁপছে মনে হচ্ছে এমুহূর্তে মাথা ঘুরে সে পড়ে যাবে।নীলা তাকে ধরলো শক্ত করে।

লুৎফা বিছানায় একপাশ করে শুয়ে আছে। তার ঘর অন্ধকার। সে ভেবে কূল পাচ্ছে না কি করবে?এত বড় সত্যি আর সেই কিনা মিথ্যা অপবাদ দিলো মেহুকে?

নীলা ফোন করে জানতে পারার পর লুৎফাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। সেখানে ডা. অর্ণা তাকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে বসতে বলে।

“এ যে মিসেস নীলা কেমন আছেন?আর জা কই?”

নীলা কি বলবে বুঝলো না। হাসি দিয়ে বললো ও বাসায় অসুস্থ। ডা অর্ণা জানায়

“অসুস্থ তো হবেই।এখন তো সেই সময়ই চলছে।আপনারা ওনার বিশেষ যত্ন নিবেন।কেননা এ সময়টাতে মা আর বাচ্চার দুজনের অনেক কেয়ারের দরকার পড়ে। ”

নীলা আর লুৎফা দুজনে চমকে যায়।মেহুর কোন সময়ের কথা বলছে এ ডাক্তারই বা কেমনে জানলো?লুৎফার বুকটা ধ্বক করে উঠলো।

“মা তুমি কিসের কথা বলছো একটু পরিষ্কার করে বলো?”

“আন্টি আপনি রোগীর কি হোন?”

“আমি তার শ্বাশুড়ি হয় এবার বলো তো বিষয় কি?”

“আন্টি তাহলে তো ভালো খবর। আপনি দাদী হতে যাচ্ছেন।তাড়াতাড়ি মিষ্টি খাওয়ান।”

লুৎফা হতবাক হয়ে যায়। তারা তো জেনেছে এ কদিন হলো তাহলে এ ডাক্তার বিষয়টা কীভাবে জানলো।

“মা বুঝলাম না।মেহু প্রেগন্যান্ট সেটা তুমি কীভাবে জানলে?”

আন্টি কি বলছেন আপনার বউমা প্রায় ২০ দিন আগে এসে এখানে চেকআপ করাই।এতো এ ভদ্রমহিলাও ছিলেন।আমি ওনাকে দেখেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারি তবুও কিছু পরীক্ষা করেছিলাম সেখান থেকে জানা যায় আপনার বউমা প্রায় একমাস ধরে প্রেগন্যান্ট। ‘

ডা.অর্ণার কথা শুনেই দুজনে চোখ বড় করে ফেলে।একমাসের প্রেগন্যান্ট মেহু কিন্তু তারা তো জেনেছে কিছুদিন আগে। তার মানে কি কিডন্যাপ হওয়ার আগেই মেহু প্রেগন্যান্ট ছিল,তার মানে কি মেহু যা বলেছে তাই সত্যি, তার মানে….।লুৎফা আর ভাবতে পারে না সে ভীতি দৃষ্টি নিয়ে নীলাকে দেখে। নীলা আগে থেকেই শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল।লুৎফা কি বলবে ভেবে পেলো না।তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বাসায় এসে রুম অন্ধকার করে শুয়ে পড়ে।

দরজায় হালকা টোকা পরতে লুৎফা চমকে উঠে। কে কে বলে আওয়াজ করতে আমেনা জবাব দেয়।আমেনা দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকে মাথা নিচু করে থাকে।বাড়ির সকলে মেহুর প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট সম্পর্কে জানে।তাদের সবার মধ্যে উদ্বেগ।

“আমেনা তুমি এখানে? আমি তো বলেছি আমি অসুস্থ তবুও কেনো এলে?”

“আপা আফনারে কিছু কওনের ছিল?”

“আমি কিছু শুনতে চাই না।”

‘আফনারে কন খুব জরুরি।মেহু রে নিয়া কিছু কথা। ”

মেহুকে নিয়ে বলতে লুৎফা উঠে বসলো।এ মুহুর্তে মেহু নামটা শুনলেই তার কলিজা শুকিয়ে যায়।

“কি বলবে আমেনা?”

“আপা মাফ কইরেন। আফনা গো নিমোক খাইছি তাই আফনা গো লাইগা বেঈমানি করনের কোনো সুযোগ বা ইচ্ছে নাই কিন্তু এহোন যদি কিছু কথা না কয় তয় সত্যি বেঈমান হইয়া যামু।আপা আফনারে হেদিন মেহু যা কইছিল সবই সত্যি। মেহুর বাচ্চা আর কারো না আফনার পোলার।’

“আমেনা তুমি কি বলছো জানো? হয়তো রিপোর্ট ভুলও হতে পারে?”

“না আপা আমি গ্যারান্টি দিয়া কমু এ রিপোর্ট ঠিক। আমি আফনারে কইছিলাম ঐ মাইয়ার কথা হুনেন আফনি আমারে ধমক দিয়া চুপ করাইছিলেন।তয় অহোন চুপ থাকলে আমার ওপর ঠাডা পরবো।আপা গো আমি সাক্ষী এসবের । হেইদিন যখন আদ্য বাবার আংটি পরনের কাম শেষ হইলো আমি খুব ডরাই গেছিলাম না জানি মেহু কি করে?তাই আমি ঘন ঘন হের ঘরে উঁকি দিতাছিলাম যাতে হেই কিছু না কইরা বসে।এমন কইরা আমি যহোন শেষ সময়ে গেলাম তহোন….”

“থামলে কেনো বলো আমেনদ তখন কি?”

লুৎফার কন্ঠে উত্তেজনা সাথে আগ্রহ।

“এরপর আমি আর কইতে পারুম না।আফনে বুইঝা লন।তয় আফনে বিরাট ভুল করছেন। আফনি বিশ্বাস করেন না করেন হেই রাতে আদ্য বাবা সারারাত মেহুর ঘরে ছিল।”

“তুমি আমাকে আগে বললে না কেনো আমেনা?”

“আপা আমি আফনারে হেইদিন কইছিলাম।আফনি মনে কইরা দেহান হেইদিন আমি যহোন আফনারে একটু খানি কইছিলাম মেহুরে বিশ্বাস করেন আফনে আমারে যা নয় তা কইছিলেন।আমি আফনারে কইছিলাম আদ্য বাবা আহোন অবধি সবটা মাইন্না লন কিন্তু আফনে আমারে কইছিলেন আমি মেহুরে সাপোর্ট করতাছি।আমার কোনো প্রমাণ ছিল না।তবুও মুখ দিয়া কইছিলাম বিশ্বাস করেন নাই এর লাইগা আর জোর দিলাম না।অহোন কি করবেন?মাইয়া তো চইল্লা গেছে আদ্য বাবা রে কি কইবেন?”

“আমেনা তুমি এখন যাও আমার কথা বলতে ভালো লাগছেনা।যাওয়ার সময় দরজাটা ভালো করে আটকে দিয়ে যেও আলোটা বড্ড চোখে লাগছে।”

আমেনা নিঃশব্দে লুৎফার কথামতো কাজ করে চলে যায় লুৎফা ঘুমানোর চেষ্টা করে কিন্তু তার মাথার ভেতর মেহু আদ্য বাচ্চা যাবতীয় চিন্তা এসে জট পাকিয়ে ফেলে।

আদ্য এসেই খুশী খুশী মাকে ডাক দেয়।আদ্যর চিৎকার এতটা বড় যে মনে হচ্ছিল বাড়ি ছেড়ে সেটা আশেপাশের এলাকাতেও পৌঁছে গেছে। মূলত আদ্যর লক্ষ্য ছিল তার চিৎকারে যেন মেহু চলে আসে।নিচে থাকলেও দেখা যাবে কিন্তু ছাদে থাকলে তো আর ডেকে আনা সম্ভব না।তাছাড়া বাড়ির সবার সামনে মেহুকে ডেকে আনাটাও লজ্জার ব্যাপার তাই মেহুর কান অবধি আওয়াজ পৌঁছানোর ট্রিকস হিসেবে আদ্য প্ল্যান টা করে।নিশ্চয়ই মেহু আওয়াজ শুনলে চলে আসবে।এক এক করে বাড়ির সবাই নামছে সবার চেহারা থমথমে আদ্য হাসিমুখে সবার দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখ এখনো চিকচিক করছে মনে হচ্ছে আরো কেউ বাকি আছে সেই কেউ টা কে সবাই জানে আদ্যও জানে তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার আগমনে।কিন্তু সবাই এলো মেহু এলো না আদ্যর মুখরা পাংশু হয়ে গেছে।লুৎফার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে ব্যবসার বিষয়ে হেসে হেসে কথা বলে।মায়ের সাথে কথা বলছে ঠিকই তবে আদ্যর নজর চারদিক।আদ্য মাকে মেহুর কথা জিজ্ঞেস করবে ভেবে আবার করলো না।সে হাসতে হাসতে উপরে চলে গেলো আর জানালো তার খিদে পেয়েছে যেন খাবার ব্যবস্থা হয়।

আদ্য ভাবছে মেহু হয়তো লুকিয়ে আছে তার সামনে আসছে না তাই আদ্য নিচে এসে খেতে বসে যদি খাওয়ার সময় মেয়েটা থাকে।আদ্য খেতে এলেও মেহুকে পায় না।এবার তার খানিকটা ঘটকা লাগে।সে ভাবছে মেহু কি এখনো তার আসার খবর পায় নি?আদ্যর অবস্থা সবাই বুঝতে পারছে সে মেহুকে খুঁজছে কিন্তু সাহস করে কেউ কথা বলতে পারছেনা।আদ্য সামান্য খাবার মুখে নিয়ে এবার মেহুর কথা জিজ্ঞেস করে। তখনি সবার মুখ শুকিয়ে যায় বিশেষ করে লুৎফার।

“বাবা তুমি খেয়ে নাও মেহুর বিষয়ে পরে কথা বলবো।”

আদ্য খাওয়া থামিয়ে দেয়।মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“মেহুর বিষয় কথা বলবে মানে,কি হয়েছে মেহুর কোথায় সে?’

লুৎফার গলা শুকিয়ে আসছে।তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।আদ্য বাকি সবার দিকে তাকায় সবার চোখ মুখে ভীতি।আদ্য খাবার প্লেটে হাত ধুয়ে মাকে আবারও প্রশ্ন করে।লুৎফা আগে থেকে ভেবে রেখেছে কীভাবে উত্তর দিবে কিন্তু আদ্যর অস্থিরতায় সবটা তালগোল পাকিয়ে গেছে। অনেক কষ্টে লুৎফা মেহুর সাথে হয়ে যাওয়া সবটা জানায়।একদম এ টু জেট সব।কোনোকিছু বাদ পড়ে নি।নীলা রিপোর্টটা কাঁপা কাঁপা হাতে আদ্যকে দিতেই আদ্য আস্তে আস্তে সেটা বের করে যেন সে কাগজ নয় এরমধ্যে থাকা নিজের অস্তিত্বকে ধরছে।

লুৎফা ক্ষীণ আশা নিয়ে ছেলেকে দেখছে যদি আদ্য সবটা বুঝতে পারে। কিন্তু হঠাৎ করে আদ্য যা করলো তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না।একটানে টেবিল ক্লথসহ পুরো জিনিসপত্র ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। তারপর মায়ের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে,

“মা তুমি কীভাবে পারলে মেহুকে তাড়াতে মা তুমি কি একটিবারের জন্য আমার অপেক্ষা করতে পারলে না।”

“বাবা আদ্য ঐ সময়টা এমনি ছিল যে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করার মতো চিন্তা করি নি।আমি ভেবেছিলাম হয়তো তুমি ওর সবটা জানলে ওকে বাঁচাতে মেনে নিবে।তাছাড়া তোমাদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল তা তো আমরা জানতাম তাই আমার বিশ্বাস ছিল তুমি এমন কিছু করবে না।ঐ মেয়ে তোমাকে ফাঁসাচ্ছে কিন্তু…… ”

“মা প্লিজ বন্ধ রাখো তোমার যুক্তি।মা আমি মেহুকে ভালোবাসি।হ্যাঁ মা আমি ওকে অনেক ভালোবাসি।ভুলে যেও না ও আমার বিবাহিতা স্ত্রী। ওর কাছে যেতে নিশ্চয়ই আমার তোমাদের পারমিশন নিতে হবে না।প্রতিটা স্বামী তার স্ত্রীর কাছে যেতে হলে কি অন্য কারো পারমিশন নেয়? মা তুমি কি করেছো তুমি জানো?তুমি মেহুকে কলঙ্ক দিয়েছো তুমি মেহুর নিষ্পাপ চরিত্র দাগ দিয়েছো। মা তুমি যখন একবার ওকে বিয়ে করতে বলেছিলে আমি এককথায় রাজি হলাম।ধীরে ধীরে ঐ মেয়ের প্রেমে পরলাম।মা আমি যদি তোমার কথায় তোমার মান রাখতে ওকে বিয়ে করতে পারি তাহলে একবার তুমি কেনো অপেক্ষা করতে পারলেনা?মা তুমি মেহুকে বিশ্বাস করতে বলেই ওর মুখের কথার ওপর ভিত্তি করে ওকে এ বাড়ির বৌ করেছিলে তাহলে আরেকটু কেনো ভরসা করলে না।সত্যি যদি মেহু এমন কিছু করতো তাহলে আমি তোমার এক কথায় ওকে ছেড়ে দিতাম তুমি কেনো আমার আসা অবধি অপেক্ষা করলে না।কেনো তুমি এত বড় অন্যায় করলে কেনো মা?”

আদ্য আকাশ পাতাল কাপিয়া কাঁদছে তাকে ঘিরে আছে আমেনা লুৎফা নীলা।সবার চোখ অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে কিন্তু কেউ সাত্বনা দেবার সাহস বা ভাষা পাচ্ছে না।আদ্য পাগলের মতো যা সামনে পেলো সবটা ভাঙতে থাকে।একপর্যায়ে সে টি টেবিল ভাঙতে যেতে লুৎফা দৌড়ে যায় কিন্তু আদ্যর সাথে না পেরে ধাক্কা খায় যার কারণে কাচের সাথে লেগে তার মাথা কেটে যায়। আদ্য সেদিকে খেয়াল না করে ধপধপ করে সিড়ি দিয়ে ওপরে চলে যায়। সবাই লুৎফাকে ধরতে গেলে সে কাঁদতে কাঁদতে আদ্যর দিকে চেয়ে থাকে।আমেনা তাড়াতাড়ি ফার্স্ট এইড বাক্স আনলে সুজাতা আর নীলা সেটা দিয়ে লুৎফার কপাল ঠিক করতে থাকে।

আদ্য ছাদে উঠেই মেহুর রুমটা ভালো করে চেক করে।তার মনে সন্দেহ হয়তো মেহু লুকিয়ে আছে তাকে দেখলে বের হবে।আদ্য পুরো রুম খুঁজে ছাদের সবটা থোকায়, কাঁদতে কাদতে রুমে ফিরে এসে খাটে বসে পড়ে। চিৎকার করে আর্তনাদ করে।তখনি নজর পড়ে বালিশের নিচের দিকে।সেখানে হাত দিতেই দেখে একটা চিরকুট। কম্পিত হস্তে সেটা নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করে।

…….আপনি কেমন আছেন সেটা হয়তো জানা যাবে না কিন্তু আমি আজ থেকে হয়তো আর ভালো থাকবো না।তবুও আমাকে চেষ্টা করতে হবে ভালো থাকার কারণ আমার ভালো থাকার ওপর নির্ভর করছে একটা ছোট প্রাণের অস্তিত্ব যেটা আপনার দেওয়া আমার জীবনের বড় উপহার। আপনাকে স্যার বলতাম বলে আপনি আমাকে শাস্তি দিতেন বিশ্বাস করুন সেই শাস্তিটা আমার কাছে বড়ই সুখের হতো কিন্তু আজ আপনাকে আর স্যার ডাকবো না কারণ আপনি তো আর আমাকে শাস্তি দিতে পারবেন না?তবে আমি সবচেয়ে বড় শাস্তিটা পেয়েছি আপনাকে ভালোবেসে আর সেই শাস্তির বিধান হিসেবে আমাকে ত্যাগ করতে হচ্ছে এ আহসান ভিলা।আদ্য আর কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক আপনি বিশ্বাস করবেন আমি কলঙ্কিত নয়।বুঝতে পারছেন না তো, এ চিঠি পাওয়ার আগেই হয়তো আপনি অনেক কিছু জেনে যাবেন তবুও সত্যিটা আপনার জানা দরকার।আপনি কি জানেন আপনি বাবা হচ্ছেন?অনেক ভালো খবর কিন্তু সেটা মুখ দিয়ে আপনাকে দেওয়ার সুযোগ পেলাম না।মা ভাবছেন আমি আপনার ওপর অন্যের পাপ তুলে দিচ্ছি কিন্তু আপনি জানেন আমি জানি আমাদের মাঝে কি হয়েছিল?আমি যে প্রেগন্যান্ট সেটা জানতাম একমাস আগে কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না।তবুও বারবার মনে হয়েছিল আমার ধারণা ঠিক। আমার মায়ের থেকে শোনা,নানিদের পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী যখনি কোনো মেয়ে প্রেগন্যান্ট হতো সে মোটা হয়ে যেত আর সুন্দর হয়ে শরীর ভার হয়ে যেত।অনেকদিন ধরে আমার মধ্যে আমি সেসব লক্ষণ গুলো টের পাচ্ছিলাম কিন্তু টেস্ট করবো ভেবে করা হয়নি।এরমধ্যে এমন একটা ঘটনা ঘটলো তারপর আমার জীবন হয়ে উঠলো কলঙ্কের।হাজারবার বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না আমি নিরপরাধ কিন্তু আমি আর কিছু প্রমাণ করতে চাই না।আপনি অন্তত আমাকে বিশ্বাস করবেন আদ্য।রাতের আধারে বাড়ি ছাড়ছি কারণ দিনের আলোতে আমাকে এ বাড়ির কেউ ঘৃণার চোখে দেখুক সেটা আমি চাই না।আপনি ভালো থাকুন আর আমার জন্য দোয়া করুন যেন আপনার বাচ্চাকে সুস্থভাবে এ পৃথিবীতে আনতে পারি।

ইতি নিষ্পাপ
মেহু
,
,
,
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here