সেদিনও জ্যোৎস্না ছিল পর্ব-৩০ শেষ পর্ব

0
6312

#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল

#তানিয়া

পর্ব:৩০

মেহু শাড়ী বদলাচ্ছে ক্লাসে যাওয়ার জন্য। সে যে ঘরটাতে থাকে তার পাশেই একটা ঘর করে সেখানে পড়ানো হয়।অলরেডি অনেকে এসে পড়েছে।মেহু আস্তে ধীরে সে ঘরে গেলো।মেহুকে দেখতেই একজন আধবয়সী মহিলা এগিয়ে এলো।

“আরে ছেমরি আস্তো আও।বেটি বাচ্চা হওয়ার সময় হইছে তুমি এ ক’দিন পড়া বন্ধ রাখলে কি হইতো? ”

“খালা যদি পড়া বন্ধ রাখতাম তবে আমার দিনই পার হতো না।তাছাড়া আপনাদের কাছে আসলেই মনটা ভালো হয়ে যায় তাই বন্ধ রাখার প্রয়োজন নেই। বরং পড়া বন্ধ করলে আমার দমটাই বন্ধ হয়ে যাবে।”

মেহুর কথা শুনে মহিলা আর কিছু বলেনা কারণ এখানে সবাই জানে মেহু কারো কথা শুনার নয়।মেহু তার নিয়ম অনুযায়ী পড়া শুরু করলো।তখনি শফিকের আগমন ঘটে। মেহু শফিককে দেখে হেসে উঠে।

“আরে শফিক ভাই আপনি এলেন যে?এখন শরীর কেমন?”

“ভালোই। তোমাকে বললাম না এখন ক্লাস বন্ধ রাখতে কেনো অসুস্থ শরীর নিয়ে এসব করছো?”

“শফিক ভাই এটা আমার কাজ।আর যতই অসুস্থ হয় কাজে ফাঁকি দেওয়ার মেয়ে আমি নয় বুঝলেন।তা হঠাৎ চলে এলেন যে?’

” আসলে সেই অতিথিকে নিয়ে এসেছি যিনি আামকে বাচিয়েছিলেন।ওনাকে তোমার বাসায় রেখেছি তোমার কি সময় হবে ওনার সাথে আলাপ করার?”

“তাই নাকি?ওকে আমি এক্ষুনি আসছি।”

মেহু খুশী মনে ঘরের দিকে হাঁটা দেয়।কিন্তু ঘরের দৌড় গোড়ায় এসে মেহুর পা থমকে যায়। এটা কি মেহু সত্যি দেখছে নাকি কল্পনা? মেহুর পা টলছে।শফিক মেহুকে দেখে হেসে উঠে। আদ্য শফিকের দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকাতেই তার দৃষ্টিও থমকে যায়।মেহু এগোতে পারছেনা কিন্তু আদ্য এগিয়ে আসছে।আদ্য মেহুর সামনে দাঁড়াতে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠে। মেহুর মনে হচ্ছে কান্না করার শক্তি নেই। সে নিষ্প্রাণ চোখে আদ্যকে দেখছে।অল্প সময়ের বিবর্তনে আদ্যর অবস্থা হয়েছে করুণ।চোখ কোটরে বসে গেছে। কালি পড়েছে চোখের নিচে।চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। সুন্দর চেহারার এ হাল দেখে মেহুর বুকটা চট করে মোচড় দিয়ে উঠলো।মনে হচ্ছে এ মুহুর্তে জ্ঞান হারাবে।

“মেহু তুমি,তুমি এখানে?তুমি কেনো চলে এসেছিলে,তুমি কি জানতে না আমি তোমাকে ছাড়া পাগল হয়ে যাবো।মেহু মা না হয় তোমাকে অপবাদ দিয়েছে কিন্তু তুমি তো পারতে অপেক্ষা করতে কি হতো আমার জন্য একটু অপেক্ষা করলে? ঢাকা শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।সব জায়গায় মানুষ লাগিয়েছি।তুমি কীভাবে পারলে নিরুদ্দেশ হতে? তোমার মনে কি আমার জন্য একটুও মায়া ছিল না।তোমাকে হারিয়ে কতটা বিরহের রাত পার করেছি তুমি কি জানো?”

“আপনি এখানে কেনো?”

আদ্যর মুখটা এবার আরো করুণ হয়ে যায়। মেহুকে দেখে আদ্যর মনে যত কথা ছিল সবটা আবেগ হয়ে বেরিয়ে এসেছে আর মেহু তাকে এ প্রশ্ন করলো?

‘মেহু তুমি কি আমাকে দেখে খুশি হও নি?”

“আপনি এখানে কীভাবে? ”

দূর থেকে শফিক দু’জনর ভাবগতি দেখে এগিয়ে এসে জানায় আদ্যই সেই ছেলে যে কিনা তাকে বাচিয়েছে।শফিক কথা শেষ করার আগেই মেহু দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।আদ্য এতটাই বিস্মিত হলো যে মেহুর ব্যবহারে সে নড়তে পারলো না।যখন বুঝলো তখন মেহুর ঘরের দরজা ধাক্কাতে লাগলো।

“মেহু প্লিজ দরজা খুলো।এভাবে তুমি আড়ালে যেও না।মেহু আমার অনুরোধ রাখো।আমার সব কথা শুনো প্লিজ মেহু দরজা খুলো।”

“শফিক ভাই আপনি ওনাকে চলে যেতে বলেন।আমার এ কন্ডিশনে ওনার সাথে কথা বলা সম্ভব না।’

“মেহু প্লিজ কথা বলো আমার সাথে। তোমাকে অনেক কথা বলার আছে। মেহু একটা সুযোগ দাও আমি তোমাকে সব বলবো।এরপর তোমার যা ভালো মনে হয় করবে প্লিজ।”

মেহু আরকিছুই বলতে পারে না তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। অতিরিক্ত উত্তেজনায় হঠাৎ তার পালস দ্রুত কাজ করে। একদিকে পেটে হাত অন্য দিকে শরীর অবশ হওয়ার উপক্রম। মেহু চোখ মুখ উল্টে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। রিতু পাশেই ছিল।মেহুর অবস্থা দেখে সে আর্তনাদ করে উঠে। বন্ধ দরজার ওপাশে কান্নার আওয়াজ শুনে আদ্যর বুকটা কেঁপে ওঠে। বারবার দরজায় বাড়ি দিলেও হুট করে তার হাত আলগা হয়ে যায়। সে শফিকের দিকে আতঙ্কের দৃষ্টিতে তাকাতে শফিক জোরে জোরে রিতুকে ডাকে।রিতু দৌড়ে এসে দরজা খুলতে আদ্য আর শফিক ভয়ে জমে যায়। মেহু প্রায় অজ্ঞান হবার অবস্থা। আদ্য মেহুর কাছে যেতেই শফিক গাড়ি আনতে যায়।

আইসিইউতে মেহুকে এডমিট করা হয়েছে। ডাক্তার নার্স ছোটাছুটি করছেন।মেহুর অবস্থা ভালো না।হঠাৎ তার ব্লিডিং শুরু হয়েছে। অতিরিক্ত উত্তেজনা আর মানসিক চাপে হঠাৎ করে মেহুর এ দশা।ডাক্তাররা সন্দেহ করছেন মেহুর জীবন নিয়ে। যার কাছে মেহু চিকিৎসা নিতো তিনি আগেই জানিয়েছিলেন মেহুর বাচ্চা সময়ের আগে নিয়ে নিতে হবে কারণ তার বাচ্চা অনেকটা ফুলকার কাছাকাছি। তবে এখন যা অবস্থা তাতে কার কি হয় বলা যায় না?

আদ্য ফ্লোরে বসে হিচকি তুলে কাঁদছে। লুৎফা ছেলের পিঠে হাত রেখে বসে আছে সেও কাঁদছে।এমন অবস্থায় মেহুকে পাওয়া যাবে লুৎফা সেটা কল্পনাও করেনি।

আদ্য দরজা ভেঙে মেহুকে অর্ধ জ্ঞান অবস্থায় পেলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসার তোরজোর চালায়।ডাক্তার মেহুকে দেখে আইসিইউতে এডমিট করাতেই চিকিৎসা শুরু করে দেন।এরমধ্যে নীলার ফোন আসে কারণ দুপুর থেকে আদ্যর খোঁজ পায় নি তারা তাই চিন্তায় ছিল।তাছাড়া আদ্যকে কল করলেও আদ্য ফোন ধরছে না।বার বার রিং পড়লে অবশেষে আদ্য কল রিসিভ করে।কল রিসিভ হতেই আদ্যর কান্নামিশ্রিত গলা শুনে ঘাবড়ে যায় নীলা।

“আদ্য কি হয়েছে? ”

আদ্য কিছু বলতে পারেনা শুধু কান্না করেই যাচ্ছে। নীলা যখন আদ্যর উত্তর পায় না তখন লুৎফাকে ডাকে।লুৎফা ছেলের অবস্থা দেখে শিউরে ওঠে। আদ্য শুধু কয়েকটা শব্দ বলে,

“মা মেহু হাসপাতালে তোমরা তাড়াতাড়ি চলে আসো।”

কথাটা শুনেই লুৎফা স্তব্ধ হয়ে যায়। সে কি ভুল শুনছে?মেহু কোত্থেকে এখানে হবে? কিন্তু আদ্যই বা এভাবে কাঁদছে কেনো?

লুৎফা সবাইকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হয় আর সেখানে গিয়ে দেখে আদ্যর করুণ অবস্থা। আদ্যর কাছে যেতেই আদ্য মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।লুৎফা তখনো জানে না তার জন্য সামনে কি অপেক্ষা করছিল।শফিক লুৎফার কাছে আসে কারণ আদ্যর যা অবস্থা মুখ দিয়ে কোনো স্বর আসছে না কান্না ছাড়া।

“আদ্য আপনি যদি এভাবে কান্না করেন তাহলে তো সব সমাধান হবে না।আপনি একটু শান্ত হোন।”

“বাবা কে তুমি?আদ্যর এ অবস্থা কেনো?”

“আন্টি আমার নাম শফিক।আপনারা আমাকে চিনবেন না তবে আন্দাজ করছি আপনারা মেহুকে চিনেন?”

মেহু নামটা শুনে আঁতকে উঠে লুৎফা তার মানে ফোনে আদ্য ভুল নাম উচ্চারণ করেনি।লুৎফা অস্থিরতা নিয়ে শফিককে বিষয়টা জিজ্ঞেস করে।শফিক আদ্যর সাথে তার আলাপ,মেহুর সাথে দেখা তারপর দুজনের কথোপকথন সবটা এক এক করে জানায়। লুৎফা মেহুর ফিজিক্যাল কন্ডিশন শুনেই চোখের জল ছেড়ে দেয়।সে নিজেও অস্থির হয়ে যায় মেহুর সাথে দেখা করতে।কিন্তু তাকে দেখার সুযোগ মিলে না।ডাক্তাররা অলরেডি অপারেশন শুরু করে দিয়েছে।জরুরি ভিত্তিতে রক্ত জোগাড় করে রাখতে বলেছে।যে হারে ব্লিডিং হচ্ছে তাতে রক্তের প্রয়োজন বেশি।আদ্য ডাক্তারের কথা শুনেই বেরিয়ে পড়ে রক্ত সংগ্রহে।প্রয়োজনের অতিরিক্ত রক্ত সংগ্রহ করে রাখে আদ্য।

প্রায় দুই ঘন্টা হলো ডাক্তাররা আইসিউতে এখনো অবধি কোনে খবরাখবর দেয় নি।আদ্য শুরু থেকে সমানে কেঁদে চলেছে।লুৎফা বারবার ছেলেকে সাত্বনা দিচ্ছে কিন্তু সেগুলো আদ্যর কানে যায় না।একজন ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই আদ্য হামলে পড়ে তার ওপর।ডাক্তার জানান,

“বাচ্চা সিজারিয়ান করে নেওয়া হয়েছে। বাচ্চা মা দু’জনে বেশ দূর্বল।অতিরিক্ত ব্লিডিং হওয়ায় শরীরে রক্তশূণ্যতা দেখা দিয়েছে। তবে খুব তাড়াতাড়ি তারা সুস্থ হবেন যদি ভালো সেবা পায়।আপাতত বাচ্চা আর মাকে আলাদা রাখা হয়েছে। বাচ্চাকে সেইফ জোনে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় ওজন কম তাই উপযুক্ত ওজনে হলে তবেই বাচ্চাকে মায়ের কাছে দেওয়া হবে।”

ডাক্তার আরো কিছু কথা শেষ করে চলে যায়। আদ্যর ইচ্ছে করছে মেহুকে চোখের দেখা দেখতে কিন্তু সেটা সম্ভব না।মেহুকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে রাখা হয়েছে। কোনোভাবে তাকে উত্তেজিত করা যাবে না।

২৪ ঘন্টা পর মেহুর হুশ আসলে মেহু দেখে একজন নার্স তার রুমে বসে আছেন।মেহু নার্সকে দেখে নিঃশ্বাস ফেলে। সে কথা বলতে গেলে মনে হয় তার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। নার্স বুঝতে পারে মেহু কি জানতে চায় তাই সে হাসিমুখে এসে জানায় বাচ্চা ভালো আছে। তাকে প্রটক্টে রাখা হয়েছে। ওজন বরাবর আসলেই তবে তাকে দিবে।মেহু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।এ মুহুর্তে তার চিন্তা জুড়ে শুধু বাচ্চার কল্পনা। সে ভুলেই গেছে তার জন্য কতগুলো মানুষ বাইরে আহাজারি করছে।

আদ্য খবর পেয়েছে মেহুর জ্ঞান এসেছে কিন্তু বাচ্চা ছাড়া সে আর কারো কথা জানতে চায় নি।আদ্য সেসবে কান দিলো না মেহুর জ্ঞান ফিরেছে এই বেশি।

মেহু যখন দ্বিতীয় বার চোখ খুলে তখন তার মাথার পাশে লুৎফাকে দেখে চমকে যায়।সে আবারও চোখ বন্ধ করে ভাবে এটা সত্যি নাকি কল্পনা? সে চোখ খুলে দেখে ঠিকই তার শ্বাশুড়ি তার মাথার পাশে বসে আছে। চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

“মা তোমার শরীর কেমন?”

মেহু ক্ষীণ স্বরে জবাব দেয় ভালো!

“মা তুমি ভালো আছো এই আমাদের জন্য বেশি।মা তোমাকে বলার মতো কথা আমার নেই। তবুও একটাই কথা বলবো আমাকে ক্ষমা করো।আমার জন্য তোমার আজ এ অবস্থা। আমি ভুল করেছি শুধু ভুল না অনেক বড় অপরাধ।মা তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ বা সাহস কোনোটাই আমার নেই তবুও আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তুমি এ অধম মাকে ক্ষমা করো।”

মেহু কিছু বললো না শুধু তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো।

অনেক্ক্ষণ পর আদ্য মেহুর কেবিনে ঢুকলো আর ঢুকেই লজ্জা পেয়ে গেলো।মেহু বাচ্চাকে ফিড করাচ্ছে হুট করে আদ্য ঢুকবে ভাবে নি।সে নিজেও লজ্জায় এতটুকু হয়ে গেলো। আদ্য কি করবে বুঝলো না সামনে যাবে নাকি পিছবে সিদ্ধান্ত নিলো।তার আগেই মেহু নিজেকে গুছিয়ে নিলো।আদ্য দেখলো মেহু ওড়না মুড়ে বসেছে।আদ্য এগিয়ে যেতেই বাচ্চা তারস্বরে কান্না জুড়ে দিলো।আদ্য বুঝলো মেহু ফিডিং বন্ধ করে দিয়েছে তাই বাচ্চা কাঁদছে।

“মেহু আমি যাচ্ছি তুমি ফিড করাও।”

মেহু ছোট করে জবাব দিলো লাগবে না যার অর্থ আপনি থাকতে পারেন।আদ্য একটা টুল নিয়ে কিছু দূরে গিয়ে বসলো।যেখান থেকে মেহু তার কথাগুলো শুনতে পারবে।

“মেহু তোমার শরীর এখন কেমন?”

“জ্বি ভালো।”

“মেহু তুমি কি আমাকে দেখে অস্বস্তি বোধ করছো?”

মেহু জবাব দিলো না।আদ্য কিছুক্ষণ পীড়াপীড়ি করে উঠে গেলো।মেহু তখনো তাকে কিছু বলে নি।আদ্য দরজার কাছে গিয়ে একবার পেছনে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো।আদ্য তখনো জানতো না উল্টো পিঠ করে বসা মানুষটা কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে তাই তার কথার উত্তর বা তাকে আটকায় নি।যদি আদ্য টের পেয়ে যেতো মেহু কাঁদছে তাহলে ব্যাপারটা অন্য রকম হতো।অনেকদিন পর প্রিয় মানুষটাকে দেখে মেহু নিজেই তাল হারিয়ে ফেলেছিল তাই হঠাৎ উত্তেজনায় তার জীবন সংশয় ছিল।বাচ্চার দিকে তাকাতে মেহুর চোখটা জ্বলজ্বল করছে।চিবুকটা পুরোই আদ্য কিন্তু মেহু একবারের জন্য সেটা আদ্যকে দেখাতে পারলো না।

আহসান ভিলায় জমজমাট অবস্থা। ঘরদোর সাজিয়ে নতুন পরিবেশ।আজ বাড়ির বৌ আর নাতি আসবে সে খুশীতে চারদিক আলোয় ঝলমল করছে। আমেনা মনের আনন্দ নিয়ে ফুল,গোলাপ জল,আতর সাজাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়ে নাইওর করতে আসছে তাই মা সবকিছু তৈরি করছে।আদ্য আগেই ঢাকায় খবর দিয়ে রেখেছে যে তারা মেহুকে নিয়ে ফিরবে।আরাফ আর শরিফ খবর পেয়েই তোরজোর লাগিয়ে দিলো কাজের।

লুৎফারা সবাই আগেই চলে এসেছে। আদ্য মেহুকে নিয়ে আসবে দুদিন পর কারণ মেহুর শরীর এখনো দূর্বল তাকে নাড়াচাড়া করতে মানা।তাই আদ্য ঠিক করেছে মেহুকে প্লেনে করে ঢাকায় আনবে।টিকিটের পুরো কাজটা করেছে শফিক।বলা বাহুল্য শফিক সবটা জানার পর নিজেও আদ্য আর মেহুর সম্পর্ক ঠিক করতে উঠে পড়ে লেগেছে। মেহু আর আদ্য যখন এয়ারপোর্টে গেলো তখন শফিক তাদের সব কাগজ পত্র নিয়ে সেখানে ছিল।দুজনকে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে আসে।

“কি কপোত-কপোতী দু’জনের মধ্যে ভাব হলো?আমি তো ভাবছিলাম তোমরা মনে হয় মুখ কালো করে প্লেনে উঠবে।এখন তো দেখছি বেশ হেসে হেসে আসছো।বাচ্চাটা তাহলে তোমাদের মধ্যে ভাব সৃষ্টি করলো কি বলো?”

মেহু আর আদ্য দুজনে হেসে দেয়।শফিক তাদের দুজনকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে তাদের সাথে এয়ারপোর্টের ভিতরে যায়। সেখানে বাকি ফর্মালিটি শেষ করে অনেক্ক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে।শফিক বেশ মজার মানুষ সেটা আদ্য এ কদিনে বুঝে গেছে। শুধু মজারই নয় অনেক বড় মনের মানুষ না হলে কি এভাবে দিনরাত তাদের জন্য কাজ করতো।

প্লেনে উঠার সময় মেহু বারবার বলেছে যেন এদিকের ব্যবস্থা করে তাদের বাসায় বেড়াতে যায়। শফিক বেশ আনন্দে সম্মতি জানালো।প্লেনে উঠার মুহুর্তে মেহু পেছনে তাকালো শফিক হাসি হাসি মুখ নিয়ে খুব গভীর দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদের হালকা আলো শফিকের মুখে পড়তে বুঝতে পারলো শফিক কাঁদছে।মেহুর ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো।মেহু আর না তাকিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো।

দুজনে পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।আদ্য বাবুকে নিয়ে বিভিন্ন কথা বলছে বাবুও মিষ্টি করে হেসে বাবার কথায় দুলছে।আদ্য দেখলো মেহু জানলা দিয়ে আকাশ দেখছে।আদ্য জিজ্ঞেস করলো,

“মেহু তোমার কি মন খারাপ? ”

“হুম সামান্য।এতদিন ঐ মানুষগুলোর সাথে ছিলাম হঠাৎ তাদের ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছে।”

“হুমম ওনারা সবাই তোমাকে কতো ভালোবাসে।তুমি চিন্তা করো না আমরা খুব তাড়াতাড়ি ওখানে আবার বেড়াতে যাবো।”

মেহু কিছু বললো না।আদ্য একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মেহুকে আবারও বললো,

“মেহু শফিক মানুষটা অনেক ভালো তাই না।কতো সহজে সবার সাথে মিশে যায়। এ যে আমি কদিনের চেনা কিন্তু যা করলেন তার জন্য কৃতজ্ঞ ছাড়া আর কিছু বলার ভাষা থাকে না।”

মেহু চুপ করে আছে। হা হু কিছু বলছে না।হঠাৎ আদ্য আরেকটা প্রশ্ন করলো,

“মেহু শফিক কি তোমাকে পছন্দ করে?”

আদ্যর প্রশ্নটা শুনেই মেহু হকচকিয়ে যায়। হুট করে আদ্য এমন প্রশ্ন করবে সেটা মেহু ভাবে নি।আদ্যও মনে মনে নিজেকে গালি দেয়।এসব অবান্তর প্রশ্নের মানে হয় না।তবুও মনের আনাচে-কানাচে এমন অনেক কথা উঁকি দেয় যা মানুষের মনে না চাইতেও ভয় ঢুকিয়ে দেয়।আদ্য আরকিছু না বলে বাবুর সাথে খেলায় মেতে উঠে।মেহু জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে, আপনাআপনি তার চোখ ঝাপসা হয়ে যায়।

আদ্য মেহুকে নিয়ে ঘরে আসতেই আমেনা মেহুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।মেহুও যেন নিজের মাকে পেয়েছে সেই ভাবে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।মা বাবার মৃত্যুর পর মেহু যদি আর কাউকে আপন মনে করে নিজের মায়ের স্থানে জায়গা দেয় সেটা হলো আমেনা।এ মানুষটা নিঃস্বার্থ ভাবে তাকে আশ্রয় দিয়েছে তার সব কাজে সাপোর্ট করেছে।তার সব বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।আমেনাও যেন মেহুকে নিজের মেয়ে ভেবে সবটা করেছে।মেহু এ জীবনে একজন অনবদ্য আর অনন্য মানুষ পেয়েছেন আমেনার মতো।

মেহুর আসার খবরে চারদিকে হইচই হলেও একমাত্র শাহেদকে দেখা যায় নি। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। যে অন্যায় সে করেছে তারপর মেহুর মুখোমুখি হওয়ার মতো ইচ্ছে তার নেই। তবুও মেহু একবার আসলো শাহেদের কাছে।মেহুকে দেখেই পাথর ন্যায় শাহেদ হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।মেহু কিছু বললো না কারণ পিতা সমতুল্য মানুষটা যে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে সেও অনেক।শাহেদ আনন্দ ভরা হৃদয় নিয়ে নাতিকে দেখলো।আর নিজের গলার চেইন খুলে নাতির মুখ দর্শন করলো।

ছাদের চিলেকোঠা ঘরটা খুব সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেখানেই মেহুদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেহু বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে ছাদে আসতেই দেখে আদ্য একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিকোটিন নিচ্ছে। মেহু দরজাটা ভেজিয়ে আদ্যর পাশে গেলো।মেহু লক্ষ্য করলো সেই রাতের মতো আজও ছাদে চাদর বিছানো।আদ্য মেহুর আসা টের পেয়ে নিজেই এগিয়ে আসে।মেহুর হাত ধরে বিছানো চাদরে গিয়ে বসে।

“মেহু আকাশটা দেখো আজ পূর্ণ চন্দ্র উঠেছে।চাঁদটা অনেক সুন্দর কিন্তু তার চেয়ে আজকে বেশি সুন্দর এ রাতটা! কেনো জানো,কারণ আজ আমি একা নয় আমি বা আমাদের মাঝে একজন নতুন অতিথি আছেন আর সেই অতিথির আগমনে আজ বিশাল আকাশ জুড়ে কিন্তু তারার মেলা। ”

আদ্য আঙুল উঁচিয়ে আকাশের দিকে নির্দেশ করে।মেহু সেদিকে তাকায় ঠিকই কিন্তু তার চেয়ে বেশি তাকায় আদ্যর দিকে।হঠাৎ করে যেন আদ্যর চোখ মুখে অন্য উজ্জ্বলতা খেলে উঠে। মেহুর দেখা সেই অসুস্থ, উষ্কখুষ্ক ছেলের সাথে আজকের এ মুহুর্তের আদ্যর যেন কোনো মিল নেই। এর কারণ কি,মেহু আর সেই আগত নবজাতক।মেহু এক দৃষ্টিতে আদ্যকে দেখছে।হঠাৎ আদ্য মেহুকে বলে যেন বাচ্চাকে নিয়ে আসে।মেহু নিরব ভঙ্গিতে গিয়ে বাবুকে কোলে করে নিয়ে আসে।আদ্যর কোলে দিতে আদ্য প্রজ্জ্বলিত হয়ে বাবুকে আদর করে।মেহু অবাক নয়নে পিতা পুত্রের সুন্দর দৃশ্য দেখে।মেহুর চোখে চোখ পড়তে আদ্য ভুবন বুলানো হাসি দেয়। আদ্যর চোখ চিকচিক করছে। মেহু বুঝতে পারে আদ্য অশ্রুসিক্ত নয়নে একবার বাবুকে একবার মেহুকে দেখে।

“মেহু জানো আমার এখনো বিশ্বাস হয় না এ বাবুটা আমার।জানো মেহু বিদেশ থেকে এসে যখন আমি তোমাকে খুজছিলাম তখনি তোমার খবর মা আমাকে জানায়।সেদিন আমার পা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল।কি বলছে মা মেহু চলে গেছে? আমার কাছে পুরো পৃথিবীটা তখন বিষাক্ত মনে হচ্ছিল। আমি তখন এতটাই পাগল হয়ে গেছিলাম যে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু করিনি কেনো জানো এ বাচ্চাটার জন্য। কারণ আমি জানতাম এ গোল পৃথিবীতে তোমার সাথে যখন আমার আবার দেখা হবে তখনি আমি এ বাচ্চাকে দেখবো।সেই আশা নিয়ে আমি বেঁচেছিলাম।আল্লাহর কুদরত দেখো ঠিকই দেখা হলো তবে খুব বেশি সময় না হলেও খুব কম সময় কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া পার করি নি।তোমাকে ছাড়া এক মুহুর্তে এক যুগ সমান ছিল।সেদিন যখন তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখলাম সবার আগে তোমার পেটে নজর পড়েছিল।আমার বারবার মনে হচ্ছিল এ ছোট পেটে আমার বাবুটা আছে। তার মায়ের সাথে সাথে সেও নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে। মেহু মা বাবা ভুল করে কিন্তু সব অর্থে সেগুলো মনে রাখতে নেই। মা যেমন তোমাকে ভালোবাসেন তেমনি আমাকেও ভালোবাসেন তাই ছোট একটা ভুলে তোমাকে এত কষ্ট পেতে হলো।এ দূরত্বে আমি বুঝেছি তোমাকে ছাড়া আমার বাঁচা সম্ভব না।এখন তো একদমি না কারণ এ বাবুটার মধ্যে আমার প্রাণ শক্তি ঢুকে গেছে। তোমরা দুজন আমার প্রাণ যার সম্পূর্ণ জুড়ে রয়েছো তোমরা।মেহু আমি যতটা না অপরাধী তার চেয়েও পাপী।আমার করা ভুলে তোমাকে এতগুলো সময় কষ্ট পেতে হয়েছে। আমি তোমার কাছে অনেক ক্ষমা চাইছি মেহু।”

আদ্য সমানে কথা বলার সাথে সাথে চোখের জল ফেলো।শেষের কথাগুলোতে আদ্যর গলা জড়িয়ে আসে তবুও আদ্য মায়া আর মমতা নিয়ে কথাগুলো বলে।আর হু হু করে কাঁদতে থাকে।আদ্যকে দেখে মেহুর অনেক কষ্ট হয় মেহু এগিয়ে সন্তর্পণে আদ্যর অশ্রুতে মুখ ঘষতে থাকে।আদ্য মেহুর ছোঁয়া পেয়ে যেন অভিভূত হয়ে পড়ে।

নিশিরাতে বাবুর ঠান্ডা লাগবে সেই জন্য বাবুকে বাসায় রেখে আসা হয়।আদ্য আর মেহু এখন ছাদে শুয়ে আছে। আদ্যর বুকে মাথা রেখে গভীর শান্তিতে সুখ নিচ্ছে মেহু।আদ্য বলেছিল তার সব সুখের মুহুর্তগুলো সবসময় জ্যোৎস্নাকে ঘিরে গড়ে উঠে। মেহু বুঝলো শুধু আদ্যর না তার সুখের মুহুর্তগুলো সবসময় পূর্ণ জ্যোৎস্নায় হচ্ছে। আদ্য মেহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বলে,

“মেহু তোমার সাথে প্রথম দেখা আমার জ্যোৎস্না রাতে ছিল,তোমার প্রেমে পড়া জ্যোৎস্না রাতে ছিল,তোমার ভালোবাসায় পূর্ণতা জ্যোৎস্না রাতে ছিল আজ আমার আরেকটা আনন্দের দিন দেখো সেটাও জ্যোৎস্না রাতে।আজো বিশাল আকাশে যেমন পূর্ণ জ্যোৎস্না আছে সেদিনও কিন্তু জ্যোৎস্না ছিল!”
,
,
,
সমাপ্ত

(আসসালামু আলাইকুম। অবশেষে শেষ হলো গল্পটি।অনেক সময় নিয়ে গল্পটা শেষ করলাম।আমি অবাক হয়েছিলাম যে এটা ভেবে আপনারা অনেকে আমার এ গল্পের জন্য অপেক্ষা করতেন।তবে আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার যে আমি এটা শেষ করতে পারলাম।অনেকে গল্পের বিভিন্ন পার্টে ছোট ছোট কমেন্ট করতেন দেখে খুব ভালো লাগতো।আজকে গল্প শেষ চাইলেও আগামীকাল হয়তো আর কোনো পর্ব হবে না।তাই অযথা নাইচ,বিউটিফুল না বলে গল্প নিয়ে ছোট একটা রিভিউ কমেন্ট বক্সে দিয়ে দিন।এতদিন অপেক্ষার ফল হিসেবে এটা আপনাদের কাছে আশা রাখতে পারি।ধন্যবাদ আর অগ্রিম ঈদ মোবারক!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here