#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_৫
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
অফিসের গেটের কাছে আসতেই একটা পিচ্চি মেয়ে প্রিয়ার ওড়না টেনে ধরলো। প্রিয়া চমকে গেলো। বললো,
“আরে কি করছো? ওড়না ছাড়ো।”
মেয়েটা কিছু বললো না। প্রিয়ার হাত ধরে টানতে লাগলো। প্রিয়া বিরক্ত হয়ে বললো,
“একটার পর একটা ঝামেলা তো দেখি লেগেই আছে।”
টানতে টানতে একটা দোকানের সামনে নিয়ে গেলো এবং খাবার দেখাতে লাগলো। এবার প্রিয়া ভালো করে তাকালো মেয়েটার দিকে। পড়নে একটা পুরাতন ফ্রক। তাও হাতার এক পাশ ছেঁড়া। মাথার চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। প্রিয়ার মায়া লাগলো। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কিছু খাবে?”
মেয়েটা কথা না বলে মাথা উপর নিচ করলো। প্রিয়া দোকানদারকে বললো,
“আংকেল এক প্যাকেট পাউরুটি, চারটা কলা আর এক বোতল পানি দিনতো।”
খাবারগুলো পিচ্চিটার হাতে দেওয়ার পর খুশিতে মেয়েটার চোখমুখ উজ্জল হয়ে গেলো। খাবারগুলো নিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো। দোকানদারকে টাকা দিয়ে প্রিয়া অফিসে চলে গেলো।
হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো ১০:১০ বাজে। ১০টার মধ্যে উপস্থিত থাকার কথা সেখানে ১০ মিনিট লেট। না জানি, কপালে কি আছে। চাকরীর মুখ দেখার আগেই বোধ হয় চাকরীটা যাবে।
.
তিন তলায় গিয়ে এদিক সেদিক ঘুরছিলো প্রিয়া। একটা ছেলে এসে বললো,
“কাজ বাদ দিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
“একচুয়ালি আমি আজ নতুন জয়েন করেছি।”
“আপনি এখানে কেন তাহলে? নতুনদের নিয়ে তো মিটিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনি জানেন না?”
“জানি। কিন্তু আসলে আমার দেড়ি হয়ে গিয়েছে।”
“প্রথম দিনই লেট। আসুন আমার সাথে।”
প্রিয়াকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“নক করে ভেতরে যান।”
“আচ্ছা।”
ছেলেটা চলে গেলো। প্রিয়া দরজায় নক করে বললো,
“মে আই কাম ইন?”
একটা মেয়ে মিষ্টি স্বরে বললো,
“ইয়েস কাম ইন।”
সম্ভবত মেয়েটা স্যারের পিএ হবে। প্রিয়া এক পা বাড়াতেই স্যার বললো,
“আউট!”
প্রিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। এটা তো সেই বাসের ছেলেটা ফাহাদ। প্রিয়া হা করে তাকিয়ে রইলো। ফাহাদ ধমক দিয়ে বললো,
“কি হলো? কথা কানে যাচ্ছে না? বের হতে বলেছি আমি। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে।”
প্রিয়া মুখটা কালো করে বেড়িয়ে এলো। বাহিরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। মিটিং শেষে সবাই বেড়িয়ে এলো। ফাহাদও। একবার প্রিয়ার দিকে তাকালো তারপর তার পিএ কে বললো,
“উনাকে আমার রুমে পাঠিয়ে দাও।”
“আচ্ছা।”
ফাহাদের কথা মত প্রিয়াকে পাঠিয়ে দিলো তার কেবিনে। প্রিয়া দরজায় নক করে বললো,
“আসতে পারি স্যার?”
“আসুন আসুন। আপনার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম লেট লতিফ।”
প্রিয়া মুখটা মলিন করে ভেতরে প্রবেশ করলো। কয়েক মিনিট নিরবতা চললো। মনে হয় বড় কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস। হলোও তাই! ফাহাদ ধমক দিয়ে বললো,
“কয়টা বাজে?”
ফাহাদের ধমকে প্রিয়া কেঁপে উঠলো। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
“এ..এ..এগারোটা পাঁচ।”
” এ এ কি? আপনি কি তোতলা?”
“জ্বী না।”
“প্রথমদিনেই অফিসে লেট করে আসলেন। জানেন এর শাস্তি কি দিতে পারি আমি?”
“জ্বী না।”
“জানেন না?”
“না।
“কেন জানেন না?”
“আজব তো! আপনি কি শাস্তি দিবেন সেটা আমি কি করে বলবো?”
“আমার মুখে মুখে তর্ক? আমি আপনার বস হই বস!”
“উদ্ধার করেছেন আমায় বস হয়ে। মুখে তো একটুসখানিও মধু নেই আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে বস হই বস!”
“আউট।গেট আউট।”
“হ্যাঁ যচ্ছি যাচ্ছি। এখানে বসে থাকতে আসিনি আমি।”
প্রিয়া চলে যাওয়ার সময় পেছন থেকে আবার ফাহদ ডাক দিলো,
“দাঁড়ান।”
প্রিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
“জ্বী।”
ফাহাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে প্রিয়ার হাতে ১০ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“এইযে আপনার ১০ টাকা। আয়মান চৌধুরী ফাহাদ কারো কাছে ঋণ থাকেনা।”
প্রিয়া রাগে গজগজ করতে করতে বেড়িয়ে এলো।
“ইশ! কি ঢং এর নাম গো! সেটা আবার ঢং করে বারবার রিপিট করা লাগে। এমন বসই কি কপালে জুটতে হলো আমার? কিভাবে সহ্য করে চাকরী করবো আল্লাহ্!”
৫টার দিকে অফিস ছুটি হয়ে যায়। সবার সাথে সাথে প্রিয়াও বের হয়ে আসে। বাহিরে এসেই ফাহাদের মুখোমুখি হয়। প্রিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আর ফাহাদ গম্ভীর হয়ে গাড়িতে উঠে চলে যায়।
.
.
বাড়িতে এসেই প্রিয়া ফ্যান ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মা রুমে এসে বললো,
“কিরে এসেই শুয়ে পড়লি যে?”
“ক্লান্ত লাগছে মা।”
“যা ফ্রেশ হয়ে আয়।”
“একটুপর যাই মা?”
“না, এখনই যাবি। উঠ তাড়াতাড়ি।”
প্রিয়া উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ততক্ষণে মা কফি বানিয়ে আনে। প্রিয়া তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসে। কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে মা বললো,
“অফিসের প্রথম দিন কেমন কাটলো?”
অফিসের কথা মনে হতেই প্রিয়ার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু এসব মা বা ভাইয়ারা কেউ জানলে কখনোই এই চাকরীটা করতে দিবে না এটা প্রিয়া ভালো করেই জানে। আর অতীত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রিয়ার ব্যস্ত থাকাটা খুব জরুরী। বস রাগী তো কি হয়েছে? হোক রাগী! তার সাথে ঠিকমত কথা বললেই হয়। সে রেগে যায় এমন কাজ করবে না। ব্যস হয়ে গেলো। চাকরী করতে করতে একটা অভিজ্ঞতাও হয়ে যাবে। তখন ভালো কোনো চাকরী পেলে এটা ছেড়ে দিবে। মনে মনে এসব ছক কষে নিচ্ছিলো প্রিয়া। মা হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
“কিরে? কোথায় হারিয়ে গেলি?”
“এ্যা? হারাইনি তো।”
“জিজ্ঞেস করলাম কেমন কাটলো আজকের দিন?”
প্রিয়া কফির মগে চুমুক দিয়ে বললো,
“ভালো।”
“ভালোমত কাজ করবি।”
“আচ্ছা।”
মাগরিবের নামাজ পড়ে প্রিয়া সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে। কারো হাতের ঠান্ডা স্পর্শে প্রিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখে ছোট ভাইয়া ভেজা হাত দিয়ে প্রিয়ার দুই গাল চেপে ধরেছে। প্রিয়া হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা কি হলো?”
“ঘুম ভাঙ্গানো হলো। এখনো ঘুমাচ্ছিস তুই?”
“ঘুমাবো না তো কি করবো?”
“উঠ তাড়াতাড়ি সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
“কেন?”
“কেন আবার কি? খাওয়ার জন্য।”
“আমি খাবো না।”
“তুই খাবি, তোর ভাইও খাবে।”
“তাহলে ভাই’ই খাক। আমি খাবো না।”
“খাবিনা?”
“না, না, না।”
“ওকে।”
ছোট ভাইয়া প্রিয়াকে কোলে করে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেলো। প্রিয়া চেঁচামেচি করতে করতে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগলো। ছোট ভাইয়া বললো,
“খবরদার প্রিয়ু। এমন করলে কিন্তু ঠাস করে ফ্লোরে ফেলে দিবো।”
ছোট ভাইয়া প্রিয়াকে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। প্রিয়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
“আমার ঘুম, তোমাদের কারো সহ্য হয়না আমি জানি তো।”
বড় ভাইয়া হাসতে হাসতে বললো,
“জানিস প্রিয়ু তুই এভাবে কথা বললে তোকে না অনেক কিউট লাগে। এমন করে থাকিস না, তাহলে কিন্তু আমিই তোকে কাঁদাবো।”
প্রিয়া চেঁচিয়ে বললো,
“মা, তোমার এই বাঁদর দুই ছেলেকে কিছু বলবা নাকি আমিই দুইটার ঘাড় মটকাবো বলো?”
ছোট ভাইয়া বললো,
“সে কি রে প্রিয়ু? তুই রাক্ষসী নাকি?”
বড় ভাইয়া বললো,
“ও তো রাক্ষসীই। দেখিস না হাতের নোখ কি বড় বড়।”
“মাআআআআআ।”
এবার বড় ভাবী বললো,
“কি শুরু করলে তোমরা? রাগাচ্ছো কেন ওকে?”
“ইশ! ননদের জন্য কি দরদ।”
“দরদ তো হবেই। চুপচাপ খাও।”
প্রিয়া ভাত নিতে যাবে তখন ছোট ভাইয়া বললো,
“তুই না বললি তুই খাবিনা?”
প্রিয়া দাঁত কটমট করে বললো,
“তো আমি কি এখানে এখন নৃত্য করবো?”
“না বোন। বাতাসে কখন উড়ে যাবি কে জানে।”
“খাবো না। ওকে খাবো না।”
বড় ভাইয়া বললো,
“আমি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি।”
ছোটভাইয়া বললো,
“সবসময় ও কেন আদর পাবে? আমায় খাইয়ে দাও না কেন?”
“ছোট ভাইয়া তুমি খুব হিংসুটে।”
“একদম তোর মত। তাই না?”
“কচু।”
দুই ভাই মিলে প্রিয়াকে খাইয়ে দিলো। ছোট ভাবী বিছানা ঠিক করে দিলো,মশারী টানিয়ে দিলো। বড় ভাবী প্রিয়ার চুলে বেণী করে দিলো। রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো,
“পরিবারের প্রতিটা মানুষই আমাকে কতটা ভালোবাসে। অথচ আমি যাদের ভালোবাসি তাদের কাছেই প্রতারিত হই। আমার পরিবারের মত কেউ আমায় কখনো বুঝবে না। আর ভালোও বাসতে পারবে না। আল্লাহ্, তুমি আমার পরিবারকে এভাবেই হাসিখুশি রেখো। ভালো রেখো।”
প্রিয়া শান্তির একটা ঘুম দিলো।
সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে অফিসে চলে গেলো। আজ পাক্কা ৩০ মিনিট আগেই অফিসে পৌঁছে গেলো। অফিসে গিয়েই খেলো এক ধাক্কা। বিড়বিড় করে বললো,
“বাবারে দেওয়াল নাকি আইফেল টাওয়ার! গেলো রে মাথাটা।”
সামনে তাকিয়ে দেখলো এটা কোনো দেয়াল না আবার কোনো আইফেল টাওয়ারও না। সাক্ষাত বস! ফাহাদ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রিয়া মিনমিন করে বললো,
“প্রিয়ারে আজ তুই শেষ! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যো হয়। এর চেয়ে যদি, আমি তিন তলা থেকে নিচে পড়ে যেতাম তাও ভালো ছিল। নয়তো কলার খোসায় পা পিছলে ফ্লোরে পড়ে কোমড় ভাঙ্গতাম তাও ভালো ছিল। এখন তো জম সামনে দাঁড়িয়ে।”
ফাহাদ রাগী কণ্ঠে বললো,
“চশমায় পাওয়ার আছে?”
“হ্যাঁ।”
“তবুও দেখে চলতে পারেন না? চোখ কি কপালে তুলে রাখেন? আমি তো ব্লাক সানগ্লাস পড়েও সব ঝকঝকা তকতকা দেখি।”
প্রিয়ার ইচ্ছে হলো একবার জিজ্ঞেস করতে, তাহলে আপনি ধাক্কা খেলেন কেন? আপনি দেখে চললেই তো আর ধাক্কা লাগতো না। কিন্তু মুখে এটা বলা যাবেনা। মুখে বললো,
“স্যরি স্যার।”
“স্যরি? স্যরি বললেই সব সমাধান হয়ে গেলো তাই না?”
“তাহলে কি করবো?”
“কিচ্ছু করতে হবে না। চশমাটা দেন।”
কোনো প্রশ্ন ছাড়াই প্রিয়া চশমা খুলে দিলো। ফাহাদ চশমাটা চোখে দিতে দিতে বললো,
“দেখেন আমি কিভাবে পাওয়ারের চশমা পড়ে হাঁটি।”
চশমা পড়ে দুই কদম যেতেই ধপাস করে এক শব্দ হলো। অন্যকিছু নয়! ফাহাদই পড়ে গেছে। প্রিয়া আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। এগিয়ে গিয়ে বললো,
“উঠুন উঠুন। ব্যথা পেয়েছেন?”
“ইশরে! সবই কেমন উঁচুনিচু লাগছিলো আর তাই ধপাস করে পড়ে গেলাম।”
প্রিয়া মিটমিট করে হাসতে লাগলো।
“আসলে স্যার, আপনার অভ্যাস নেই তো তাই পড়ে গিয়েছেন।”
“আপনি তো মনে মনে এটাই চেয়েছেন।”
“এমন কেন চাইবো আমি?”
“না চাইলে প্রথমে বললেন না কেন?”
“আপনার মুখে মুখে কি আর তর্ক করা যায় স্যার? হাজার হলেও আমার বস আপনি।”
ফাহাদ রাগে দাঁত কটমট করতে লাগলো। মনে মনে বললো,
“আমার কথাই আমায় ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেখে নিবো আমিও।”..
চলবে….