নীলকণ্ঠা পর্ব-১৪

0
1733

#নীলকণ্ঠা

১৪।
নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ রাতের শিউরে উঠা অন্ধকার। ঝিঝিপোকার দল তখন ঘুমের বন্দোবস্তে ব্যস্ত। ভারী জঙ্গলের সরু রাস্তায় কুকুরের উচ্চস্বর ভেসে আসছে। অর্ধঘুমন্ত গাছের পাতাদের বিস্ময়কর দৃষ্টি সুর তোলা কুকুরের দিকে। ঘুমে ঢুলুঢুলু শশঙ্কর আঁখিপল্লব। উড়ে চলা ধুসর মেঘের আড়ালে দেহ লুকিয়েছে সে। কাঠের বিশালাকার জানালার পাল্লা টেনে ধরতেই হাত ফসকে ধারাম শব্দে বন্ধ হয়ে এলো। ফায়াজ জানালার ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানায় বসলো। তপ্ত নিশ্বাস ফেলতেই করাঘাতের আওয়াজ এলো। ফায়াজ ভ্রুদ্বয়ের মাঝে সূক্ষ্ম ভাজ তুলে সেদিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। এরপর অলস ভঙ্গিতে উঠে যেয়ে দরজা খুললো। মইনুর শেখকে এসময়ে নিজের ঘরের দরজার সামনে দেখে ফায়াজের ভ্রুদ্বয়ের ভাজ আরো প্রগাঢ় হলো। মইনুর শেখ ফায়াজের দিকে সন্দেহী সৃষ্টি ফেলে কিছুক্ষন পর্যবেক্ষণ করলেন। নিজস্ব গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন,

ভেতরে ঢোকার অনুমতি আছে কি?

ফায়াজ দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। মইনুর শেখ নিঃশব্দে দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ফায়াজের ঘরে এই তার প্রথম আসা। মইনুর শেখ ফায়াজের ঘরটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। এরপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন জানালার পাশে রাখা ছোট টেবিলের কাছে। টেবিলের উপর রাখা সাদা রাঙের ছোট গোল পেপার ওয়েট। মইনুর শেখ পেপার ওয়েটের দিকে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। পেপার ওয়েটের গায়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলাতে বুলাতে বলে উঠলেন। তার ধ্বনি নিস্তব্ধ ঘরে বজ্রপাতের ঝংকার তুললো।

গ্রামের মানুষ আমাকে ভয় করে, সম্মান করে। আমার সামনে উঁচু গলা তো দূরের কথা চোখ তুলে কথা বলে না।

ফায়াজ উৎসুক দৃষ্টি ফেলে মইনুর শেখের বাক্য সমাপ্তির অপেক্ষা করছে।

মইনুর শেখ পেপার ওয়েট থেকে হাত সরালেন। ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালেন ফায়াজের উৎসুক দৃষ্টি ফেলা চোখের দিকে। বললেন,

আর আজ তারা একমাত্র তোমার জন্য আমার বাড়িতে ঢোকার সাহস করেছে এবং আমার বাড়িতে বসার সাহস করেছে। আমি তোমাকে মাত্র কিছুদিনের জন্য পরীর দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছি আমার সম্মানহানীর দেই নি।

ফায়াজ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালো। উৎসুক দৃষ্টি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রূপান্তরিত হলো। সুরে তাচ্ছিল্য ঢেলে বলল,

সম্মান, ভয় নাকি ঘৃণা?

মইনুর শেখের কপালে ভাজ পড়লো। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলেন ফায়াজের দিকে। গ্রাম বাসী তাকে ঘৃণা করে? কিন্তু কেন? মইনুর শেখ সম্পূর্ণ ঘুড়ে দাঁড়ালেন। দু এক কদম এগিয়ে গেলেন ফায়াজের দিকে। রুষ্ট কন্ঠে জিজ্ঞাস করলেন,

কি বলতে চাচ্ছো?

গ্রামের মানুষ আপনাকে ঘৃণা করে। ফায়াজের সোজা সাপ্টা জবাব।

মইনুর শেখ ক্রুদ্ধভাবে তাকালেন। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন,

তুমি বেশি বেশি করছো?

শুধু সত্যিটা জানালাম আপনাকে।

মইনুর শেখ ভীষণ রেগে গেলেন। সাদা দাড়িগোঁফের মাঝে ছোট্ট মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারন করেছে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ফুসফাস আওয়াজ হচ্ছে। ফায়াজের দিকে আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বললেন,

আমি তোমাকে ছাড়বো না। আমার সাথে লাগা মানে নিজের ক্ষতি করা।

ফায়াজ প্যান্টের দুপকেটে হাত গুঁজে আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়ালো। ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

কি করবেন? মেরে ফেলবেন?

মইনুর শেখ ভ্রু কুঁচকালেন। ফায়াজ আবার বলল,

কিভাবে মারবেন? গুলি করে নাকি পুকুরঘাটে পেটে ছুড়ি মেরে?

মইনুর শেখের পুরো শরীর কেপে উঠালো। স্থির দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে গেলো। এদিক সেদিক তাকিয়েও দৃষ্টি স্থির করার স্থান খুঁজে পেলেন না।

ক-কি বলছো এসব?

শব্দ উচ্চারণ করতে কন্ঠ কেপে উঠলো মইনুর শেখের। ফায়াজ ক্ষীণ হেসে তা হাওয়ায় মিলিয়ে দিল। আগের মতো করেই বলল,

মেরে ফেলতেই পাড়েন। যেহেতু আপনার মনে হচ্ছে আমি আপনার সাথে লাগতে এসেছি।

মইনুর শেখ বারবার পলক ফেলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলেন। তার শিরদাঁড়া এখনও কাঁপছে। ফায়াজের কথার জবাব না দিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন। ফায়াজ ফিরে তাকালো না সেদিকে।

_______
দিনের কোন এক বেলায়। পরী তার প্রাণপ্রিয় পুকুরঘাটে বসে পা নাড়াচ্ছে। কালচে গাঢ় সবুজ বর্নের শ্যাওলা পড়া সিমেন্টের ব্যাঞ্চ। তার এক পাশে জায়গা হয়েছে পরীর। তার অবুঝ দৃষ্টি হঠাৎ করেই বুঝদার হয়ে উঠেছে। দৃষ্টি ফেলেছে অদূরে অদৃশ্য মেঘের ভাজে। আদুরে আলো গায়ে মাখছে। অবিন্যস্ত রেশমি চুলের বাহার পিঠের মধ্যিখানে। ফায়াজের কন্ঠে নিজের নাম শুনতেই ঘাড় ঘুড়ালো পরী। পাতলা গড়ানের পেয়ারা গাছটার শাখা দু দিকে মেলেছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফায়াজ। বাদামি আর কালো রঙের চেক শার্ট আর জিন্স পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাশ পাতার একটা খাম। অধর জোড়ে মসৃন হাসি টেনে এগিয়ে এলো পরীর দিকে।

বেশি সময় লাগলো না ফায়াজের। এগিয়ে এসে পরীর সামনে দাঁড়ালো। পরীর নজর ফায়াজে। সরল দৃষ্টি তার। এ দৃষ্টিতে না আছে জিজ্ঞাসু, না আছে প্রশ্ন। শুধু আছে একরাশ সরলতাময় চকচকে অক্ষিদ্বয়। ফায়াজ হাটু গেড়ে পরীর সামনে বসলো। চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস নিয়ে ফের চোখ খুললো। ঠোঁট এলিয়ে জিজ্ঞাস করল,

পরী? মায়ের কথা মনে আছে?

পরী নিশ্চুপ, নিরুত্তর। ফায়াজ আবার বললো,

মা। মায়ের কথা মনে আছে তোমার? সোফিয়াকে খানম তোমার মায়ের নাম। মনে আছে?

এবার পরীর কপালে ভাজ পরলো। গুনে গুনে তিনটি ভাজ। ভ্রুদ্বয় প্রায় কাছাকাছি এসে গেলো। ফায়াজ পরীর দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে ফের বলল,

হ্যা। মা। মায়ের কথা মনে পড়ছে? মা তোমাকে খুব ভালোবাসতেন। মা।

পরীর কি যে হলো। মাথা ঝিমঝিম করে চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো। পরী বার বার পলক ফেলছে। ফায়াজ খামের ভেতর থেকে একজনের ছবি বের করে পরীর সামনে ধরলো। পরী দু হাতে চোখ ডলে ছবির দিকে তাকালো। ফায়াজ মাথা হেলিয়ে বলল,

চিনতে পেরেছো পরী?

পরী ঠোঁট চেপে ঢোক গিলে ফায়াজের হাতে থাকা ছবিতে মনোযোগ দিল। ফায়াজ পরীর দিকে ক্ষানিকাটা এগিয়ে গেল। হাতে থাকা ছবিটি পরীর দিকে আরো এগিয়ে বলল,

চিনতে পেরেছো পরী? ইনি তোমার মা।

ফায়াজের শেষের বাক্য শ্রাবণমাত্র পরী ফায়াজের দিকে তাকালো। ফায়াজ পরীকে আশ্বস্ত করে বলল,

তোমার মা। ভালো করে দেখো।

পরী ফায়াজের থেকে চোখ সরিয়ে ছবির দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তাকে বিভ্রান্ত লাগছে। পরীর হৃদস্পন্দন তড়তড় করে বেড়ে গেল। পরীর শ্বাস প্রশ্বাসে ফুসফাস শব্দ হচ্ছে। ছবি থেকে চোখ সরে গিয়েছে পরীর। ফায়াজের হাত নিজের দুহাতে ঠেলে উঠে দাঁড়ালো। পায়চারি করতে করতে দু হাতে নিজের চুল খামচে ধরলো। ফায়াজ ছবি খামে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পরী নিজের চুল খামচে ধরে এলো বিড়বিড় করছে। ফায়াজ উঠে পরীর কাছে গেল। চুল থেকে পরীর হাত সরিয়ে নিতে গেলে পরী আরো জোরে খামচে ধরে নিজের চুল। নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলাই যেন পরীর একমাত্র কাজ। ফায়াজ পরীর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,

পরী শান্ত হও। চুল ছাড়ো। আমার কথা শোন।

ফায়াজের কথা কানে তুললো না সে। হাতের পাঁচ আঙ্গুলে খামচে ধরেছে নিজের মাথার চুল। ফায়াজ জোড় করে পরীর হাত সরিয়ে নিল। কোমল হাতে সরিয়ে দিল মুখশ্রীতে বিছিয়ে থাকা অবিন্তস্ত চুলগুলো। ফায়াজের প্রশস্ত বক্ষে পরীর মাথা চেপে ধরলো। বড্ড আদুরে কন্ঠে বলল,

শান্ত হও পরী। শান্ত হও।

পরী ফায়াজের উদরের শার্ট খামচে ধরলো। কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে উচ্চ স্বরে বলে উঠলো, মা।

ফায়াজ মাথা নামিয়ে পরীর দিকে তাকালো। বিজয়ের হাসি দিয়ে পরীরে মাথায় হাত বুলালো।

_______
বেলা ফুরানোর সময় হয়ে এলো। পরিবেশে রক্তিম কমলা মিশ্রিত এক অমায়িক আভার ধারন করেছে। শুনশান বাড়িতে হাটাহাটি করছে ফায়াজ। পরী ঘুমাচ্ছে উল্টে পাল্টে। ফায়াজ পরীকে দেখে খাবার ঘরে গেল। গ্লাসে পানি ঢালার মধ্যিখানে বাহিরে গাড়ির আওয়াজ এলো। ফায়াজ জগ টেবিলের ওপর রেখে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। তিন চাকার পদচালিত ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যান চালক টাকা গুনে পকেটে রেখে ভ্যান ঘুড়ালো বাড়ির বাহিরের দিকে। ফায়াজ গ্লাস হাতে পানি পান করে দরজার দিকে কৌতুহলীদৃষ্টিতে তাকালো। ভ্যান নিশ্চই একা আসে নি। অবশ্যই সাথে কাউকে নিয়ে এসেছে। ক্ষানিকবাদেই ফায়াজের অপেক্ষার সমাপন ঘটলো বাড়ির কাঠের দরজার করাঘাতে।

ফায়াজ আশেপাশে তাকালো। আতর আলীকে দেখতে না পেয়ে আধ খাওয়া পানিসহ গ্লাস খাবার টেবিলে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে যেয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলে তাকাতেই ফায়াজের কপালে সূক্ষ্মতম ভাজের রেখা ফুটে এলো তবে ফায়াজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তির মুখশ্রী স্বাভাবিক।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here