নীলকণ্ঠা পর্ব-২২

0
1222

#নীলকণ্ঠা

২২।
জয়দের বাড়ির সামনের উঠানটা বিরাট। উঠানের একপাশে বাশের প্যান্ডেল বসানো হচ্ছে। বৌভাতে সেখানে খাওয়ানো হবে। অন্যপাশে রান্নাবান্নার জায়গা করা হচ্ছে। উঠানটার একপাশে পরপর রাখা দুইটা চেয়ারের একটায় বসে আছে পরী। সে খুব শান্তভাবে বসে গভীর দৃষ্টি ফেলে দেখছে তার সামনে চলা কার্যাবলীকে। তার সামনে ক্ষানিকটা দূরে জয়কে হলুদ দিয়ে গোসল করানো হচ্ছে। পরীর পাশে দুই তিন কদম সামনে বুকে হাত বেধে একই কার্যাবলী দেখছে ফায়াজ। পরীর চোখ মুখ স্থির, অনুভূতি শূন্য হলেও ফায়াজের ঠোঁটে ঝুলছে মৃদু মোলায়েম হাসি। জয়ের আশেপাশে কয়েকজন ছেলেমেয়ে ফোন, ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতে ব্যস্ত। ফায়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে এক নজর পরীকে দেখে নিল। তার দৃষ্টি স্থির। ফায়াজ পরীর থেকে চোখ নামিয়ে ফের সামনে তাকালো। পরীর ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চোখগুলো ঘুমে ঢলে পড়ছে। পরী চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ঘুম ভাঙ্গার চেষ্টা করলো কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। হঠাৎ পুরুষ কন্ঠে হাসির আওয়াজ এলো।

কি ব্যপার ম্যাডাম? বসে বসে ঘুমাচ্ছেন?

পরী ঘুম ঘুম চোখে তাকালো। একজন যুবক পরীর পাশের চেয়ারে এসে বসলো। নিজের চুল ঠিক করতে করতে পরীর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। পরী কোন প্রতিক্রিয়া করলো না। সে ঘুমু চোখে যুবকটার দিকে তাকিয়ে আছে। যুবকটাও ভ্রু নাচানি থামিয়ে ভ্রুদ্বয় লঘু ভাজ করে তাকালো। যুবকটিকে আরো আশ্চর্য করে দিয়ে পরী ঘাড় বাকিয়ে চেয়ারের সাথে হেলে ঘুমিয়ে পড়লো। যুবকটি আশ্চর্যান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে মেয়েটা কি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে গেলো!

যুবকটি এগিয়ে হাত বাড়িয়ে পরীর বাহুতে হাত রাখতে যাবে তখনই পেছন থেকে কেউ এক্সকিউজ মি বলে উঠলো। যুবকটি হকচকিয়ে গেল। থতমত খেয়ে হাত সরিয়ে উঠে দাড়ালো। ফায়াজ এক পলক পরীর দিকে তাকিয়ে যুবকটির দিকে তাকালো। কয়েক কদম এগিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলো,

কি করছেন?

যুবকটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরীর দিকে ইশারা করে বলল,

বসে বসেই মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়লো।

ফায়াজ পরীর দিকে আরো কিছু কদম এগিয়ে বলল,

ওর নাম পরী।

যুবকটি চোখ নামিয়ে নিঃশব্দে নিশ্বাস ফেললো। ফায়াজ এগিয়ে এসে পরীর বাহুতে হাত রেখে মৃদুস্বরে ডাকলো দু-তিনবার। পরী আধো আধো চোখ খুলে ফের বন্ধ করে ফেললো। ফায়াজ হালকাভাবে গলা পরিষ্কার করলো। আশপাশ চোখ বুলিয়ে ভাঁজকরা শার্টের হাতা উঠিয়ে নিচু হয়ে পরীকে কোলে তুলে নিল। এরপর আর কোথাও তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না। সামনের দিকে তাকিয়ে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল পরীকে।

ফায়াজ পরীকে নিয়ে যাওয়ার পর যুবকটি পাশে তাকালো। কয়েকজন তাকিয়ে ছিল ফায়াজ আর পরীর দিকে। যুবকটি তার পাশের এক ছেলেকে জিজ্ঞাস করল,

ওনারা কারা?

জানি না ভাইয়া।

যুথি এসে জিজ্ঞাস করল,

জিসান ভাই, কার কথা জিজ্ঞাস করো?

জিসান চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলল,

এখানে একজন মেয়ে বসে ছিল আর একজন ছেলে। এর আগে দেখি নি এখানে।

যুথি মাথা নাড়িয়ে বলল,

মেয়েটি কি অনেক ফর্সা?

হ্যা। নাম সম্ভাবত পরী।

ওহ হ্যা, হ্যা। জয় ভাইয়ার বন্ধু ওরা।

ওনারা কি স্বামী স্ত্রী?

যুথি ঠোঁট উল্টে বলল,

তা জানি না। কিন্তু মেয়েটার মনে হয় মানসিক সমস্যা আছে। কোন কাজ একা করতে পারে না, কারো সাথে কথা বলে না। আর সাথে যে ছিল ওনার নাম ফায়াজ। উনি সারাক্ষন পরীর পাশেপাশেই থাকে।

জিসানের পাশের ছেলেটা ব্যঙ্গ করে বলল,

পাগল নিয়ে বিয়া খাইতে আসছে কেন? পাগলামি উঠলে যদি মাথায় বাড়ি দেই।

ছেলেটার কথায় যুথি একগাল হাসল। তামাশা করে বলল,

তাহলে বাড়িটা যেন তোকে আগে দেয়।

ছেলেটি হাত পা ছড়িয়ে বলল,

পাগল নাকি? আমি আর ওই পাগলের ত্রিসীমানায় নাই।

_______
বাহির থেকে হাসি ঠাট্টার আওয়ার ভেসে আসছে। আনন্দের আমেজ পুরো বাড়িতে। এতক্ষনে হয়ত জয়কে ঘরে নিয়ে আসা হয়েছে। জয়ের এখন থেকে আগামীকাল মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাহিরে যাওয়া নিষেধ। এটাই এখানের নিয়ম। ফায়াজ বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। তার বাম হাত চালান দিয়েছে পরীর দীঘল কালো চুলের ভাজে। তাকিয়ে আছে পরীর ঘুমন্ত চোখের পাতায়। আজ গাড়িতেও ঘুমালো আবার এখনও ঘুমাচ্ছে। দিনে এত ঘুম হলে রাতে ঘুম হবে দেড়ি করে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ পরীর হাতের দিকে নজর গেল। ব্যথা পাওয়া হাতে ক্ষত শুকিয়ে বাদামী বর্ণ ধারন করেছে। ক্ষত স্থানটা খসখসে হয়ে আছে। ফায়াজ হাত থেকে চোখ সরিয়ে পরীর মুখের দিকে তাকালো। পরীরকে দেখতে মনোহর লাগছে।

ফায়াজ পরীর চুলের ভাজ থেকে হাত সরিয়ে চোখের পাপড়িতে বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে গালে হাত রাখলো। কোমলতা ছেয়ে আছে মুখ জুড়ে। পরীকে কেন মইনুর শেখের বাড়িতেই থাকতে হলো? তার ও তো সুন্দর গোছানো পরিপাটি জীবন হতে পারতো। ফায়জ পরীর গালে আঙ্গুল বুলানো অবস্থায় প্যান্টের পকেটে থাকা ফোনটা কেপে কেপে উঠলো। ফায়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে সামনে ধরলো। রাফসান নামটা ভাসছে। ফায়াজ ফোনটা কানে রাখলো।

হ্যালো।

পৌঁছেছিস?

হ্যা। বেলা একটার দিকে।

তুই কি এখনও নিশ্চিত কাজটা করা ঠিক হবে?

ফায়াজ সোজা হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘরের দরজা খুলে আশেপাশে নজর বুলিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘরে মাঝে দাঁড়ালো। বলল,

জীবনে কিছু কিছু ঝুঁকি না নিলে পরবর্তীতে পস্তাতে হয়।

ফোনের ওপাশ থেকে রাফসানের নিশ্বাস ফেলার শব্দ এলো। রাফসান বলল,

ওষুধ কন্টিনিউ করছিস?

হ্যা। ফায়াজ ছোট্ট শব্দে মিথ্যা বলল।

আচ্ছা, ওটা কন্টিনিউ কর আর কাল কখন যাবি?

বিয়ের জন্য সবাই বের হওয়ার একটু পর। ফায়াজ জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উত্তর দিল।

যেটা ভালো হয়। দেখ।

ফায়াজ কল কেটে তাকালো ঘুমন্ত পরীর দিকে। নিজ মনে বলল, কালকের দিনটার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করেছি। আশা করি আমি যেভাবে ভেবেছি সেভাবেই হবে।

_______
মইনুর শেখ পেছনে হাত বেঁধে ঘরের মধ্যে পায়চারি করে চলছেন। কোন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না। দিনের আলোয় শ্রাবণকে অনেক বার কল করেছেন কিন্তু শ্রাবণ একবারের জন্যও কল ধরে নি। দিনের আলো নিভে চারপাশে আধার নেমেছে। সূর্য ডুবে চাঁদ উঠেছে তবুও শ্রাবণের কোন খবর নেই। যন্ত্রণায় মইনুর শেখের মাথা ফেটে যাচ্ছে। না পারছে ঠিক মতো বসতে, না পারছে খেতে।
খাবেন না?

রেনুকা এসেছে। মইনুর শেখ হাত ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। রেনুকা জিজ্ঞাস করল,
কিছু নিয়ে চিন্তা করছেন?

সকালের পর থেকে শ্রাবণের সাথে কোন যোগাযোগ হচ্ছে না। আমি ওকে কি কাজে এনেছি আর ও কি কাজ করছে?

মইনুর শেখের ব্যথিত কন্ঠে রেনুকা চুপ করে রইলো। মইনুর শেখ দাড়িতে হাতের উল্টো পিঠ ঠেকিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। বিনা কারণেই তার বুক ধুকপুক করছে। শ্রাবণকে কাজের দায়িত্ব দিয়ে এখন আফসোস হচ্ছে। মইনুর শেখের ফোন বেজে উঠলো। তিনি নড়চড় না করেই রেনুকাকে বলল,

দেখো তো কে কল দিয়েছে?

রেনুকা মইনুর শেখের দিকে ফোন এগিয়ে বলল,
শ্রাবণ।

শ্রাবণের নাম শুনে তিনি চটজলদি মাথা তুললেন। রেনুকার হাত থেকে ফোন নিলেন।
হ্যালো শ্রাবণ, কোথায় তুমি?

শ্রাবণের কথা কেটে কেটে আসছে। কিছু বুঝা যাচ্ছে না। মইনুর শেখ উঠে জানালার কাছে গেলেন। বললেন,

কিছু বুঝতে পারছি না। কোথায় তুমি? তুমি কি পরীর কাছে গিয়েছো? হ্যালো

স্যার, আমি

হ্যা বলো শুনতে পাচ্ছি।

স্যার, আমি একটু গ্রামের বাহিরে আছি। নেটওয়ার্ক সমস্যা এখানে।

কোথায় গিয়েছো তুমি? মইনুর শেখ গম্ভীর কন্ঠে বললেন।

স্যার, আপনাকে একটা কথা জানানোর আছে।

বলো।

মিস্টার ফায়াজ পরীর জন্য আপনাদের বাড়ি গিয়েছে।

মইনুর শেখের হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠলো। তিনি নিজেকে বুঝাতে প্রাণপণে চেষ্টা করলেন যে তিনি ভুল শুনেছেন। কাঠের জানালার লম্বা কপাটে হাত রেখে বললেন,

কি বললে বুঝতে পাড়ি নি।

স্যার, হ্যালো স্যার?

হ্যাঁ, আমি শুনছি। তুমি বলো।

স্যার, ফায়াজ আহমেদ কোন লেখালেখির কাজে গ্রামে যায় নি। তিনি তিনি পরীর জন্য গিয়েছে।

পুনরায় একই বাক্য শুনে মইনুর শেখের হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। ফায়াজ পরীর জন্য এখানে এসেছে তার মানে এতদিন সব তার নাটক ছিল? পরীকে সুস্থ্য করে তোলা কোন কাকতালীয় না বরং পরিকল্পিত? তিনি শক্ত হাতে জানালার কপাট ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই লুটিয়ে পড়বে মেঝেতে। শ্রাবণের কন্ঠ আবার কানে এলো। সে বলছে,

স্যার চিন্তা করবেন না। কাল সকালের মধ্যে আমি পরীর ওখানে থাকবো। ওহ স্যার আর একটা কথা হ

এরপর আর শ্রাবণের কথা শোনা গেল না। কথা আটকে এক সময় লাইন কেটে গেল। মইনুর শেখের শরীর কাঁপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মোবাইল হাতে মইনুর শেখকে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রেনুকা এগিয়ে এলো। মইনুর শেখের কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,

শ্রাবণ কি বলল?

মইনুর শেখ ধীরে পেছনে ঘুড়লেন। তার আহত মুখ দেখে রেনুকা এগিয়ে এলো।
আপনি ঘামছেন কেন কি হয়েছে? কি বলেছে শ্রাবণ?

রেনুকা মইনুর শেখের বাহু ধরে তাকে বিছানায় বসালো। তার পায়ের কাছে বসে আবার জিজ্ঞাস করল,
কি হয়েছে?

মইনুর শেখ ফাঁপা ঢোক গিললেন। কম্পিত চোখে তাকিয়ে বললেন,
সব শেষ হয়ে আমার।

রেনুকা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। জিজ্ঞাস করল,
মানে? কি হয়েছে?

ফায়াজ পরীর জন্য এখানে এসেছে।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here