নীলকণ্ঠা পর্ব-২৮

0
1760

#নীলকণ্ঠা

২৮|
মইনুর শেখ ভরকালেন, থমকালেন, স্তব্ধ হলেন। এভাবে রক্তাক্ত, বিশ্রীভাবে রাস্তার ধারে শ্রাবণকে নিহত দেখবে তা ছিল কল্পনাতীত। মইনুর শেখ আশপাশ বেমালুম ভুলে গেলেন। হাটুর নিচ থেকে পা দুটো কাঁপছে। শ্রাবণ তার দীর্ঘদিনের পরিচিত। ভরসার মানুষ। যেমন ছিল প্রাণবন্ত তেমন ছিল কর্মঠ। মইনুর শেখ চলনের বিন্দুমাত্র শক্তি হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। শরীরের প্রতি লোম কূপে কাঁপন ধরেছে। বুক কাঁপছে বিকট শব্দ তুলে। মাহবুবুর রহমান মইনুর শেখের বিদ্ধস্ত মুখপানে চেয়ে রইলেন। মইনুর শেখের বার্ধক্যে নুইয়ে যাওয়া প্রশস্ত কাঁধে হাত রাখতেই সহসা ছিটকে দূরে সরে গেলেন। মাহবুবুর রহমান হকচকালেন। মইনুর শেখের দিকে এগিয়ে যেয়ে সন্দেহী কণ্ঠে জিজ্ঞাস করলেন,

মইনুর সাহেব? মইনুর সাহেব আপনি ঠিক আছেন?

মইনুর শেখ হাতের উল্টো পিঠে ঘর্মাক্ত কপাল মুছলেন। চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস টেনে ফুলিয়ে ফেললেন ফুসফুস। চোখ খুলে নিজেকে ধাতস্থ করে ঢোক গিলে ক্ষিণ শব্দ উচ্চারণ করলেন,

পানি আছে?

মাহবুবুর রহমান পেছনে তাকিয়ে একজনকে পানি আনতে বললেন। বোতলের মুখ খুলে মাহবুবুর রহমান মইনুর শেখের দিকে এগিয়ে দিলেন পানির বোতল। বললেন,

নিন।

মইনুর শেখ ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি শেষ করে দম নিলেন। মাহবুবুর রহমান বেশ মনোযোগ দিয়ে মইনুর শেখকে লক্ষ করছেন। মইনুর শেখ প্রচুর ঘামছেন। কেমন যেন হাসফাস করছেন। মাহবুবুর রহমান মইনুর শেখের হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে জিজ্ঞাস করলেন,

এখন ঠিক লাগছে?

মইনুর শেখ নিরবে মাথা দোলালেন। মাহবুবুর রহমান গলা পরিষ্কার করলেন শব্দ করে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লা/সের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞাস করলেন,

লা/সটা কি কি/ড/ন্যাপারের?

মইনুর শেখ ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে ছোট শব্দে বললেন, না।

তাহলে কার?

শ্রাবণ। আমার ইনফর্মার।

মাহবুবুর রহমান ভ্রুযুগল উঁচু করে নজর ফেরালেন লা/সের দিকে। মুখে বললেন,

ও আই সি। এরপর মইনুর শেখের দিকে তাকিয়ে আরো কিছু জিজ্ঞাস করার আগেই একজন পুলিশ এসে বলল,

স্যার, লা/সকে ময়না তদন্তে পাঠাতে হবে।

মাহবুবুর রহমান লা/সের দিকে তাকালেন একবার। এরপর বললেন, আচ্ছা, ব্যবস্থা করুন।

শ্রাবণের লা/স এম্বুলেন্সে তোলা হলো। মাহবুবুর রহমান মইনুর শেখকে একটা ফাকা জায়গায় নিয়ে গেলেন। মাহবুবুর রহমানের সাথে দুজন পুলিশ অফিসার গেলেন। মাহবুবুর রহমান সরু চোখে তাকালেন। জিজ্ঞাস করলেন,

আপনার সাথে লা/স আই মিন শ্রাবনের শেষ কথা হয়েছিল কবে?

গত পরশু রাতে।

মাহবুবুর রহমান আগ্রহী কন্ঠে জিজ্ঞাস করলেন,

কি কথা হয়েছিল?

সে বলেছিল ফায়াজ পরীর জন্যই এখানে এসেছে।

মাহবুবুর রহমান বাকি অফিসারদের দিকে তাকালেন। তর্জনীতে থুতনি চুলকে জিজ্ঞাস করলেন,

আচ্ছা, এর মানে সর্বশেষ আপনি শ্রাবণকে দিয়ে ফায়াজ সম্পর্কে খোঁজ করাচ্ছিলেন?

জ্বি না। আমি শুধু কি/ড/ন্যাপার আর পরীর সাথে পাঠিয়েছিলাম। যাতে সে পরীর সকল খবরাখবর আমাকে দিতে পাড়ে।

শ্রাবণ ওদের সাথেই গিয়েছল?

হ্যা।

আপনার এই বিষয়ে কাকে সন্দেহ হয়?

মইনুর শেখ যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষায়ই এতগুলো প্রশ্নের জবাব দিলেন। কাঙ্খিত প্রশ্ন পেয়ে ঝটপট লুফে নিলেন।

এই কাজ ফায়াজই করেছে। এছাড়া কেউ করে নি। শ্রাবণ ওর সত্যটা জেনে আমাকে বলতো এ জন্যই ওকে মেরে আমার মেয়ে নিয়ে গেছে। আপনারা যে ভাবেই হোক আমার মেয়েকে উদ্ধার করুন। ওই খু/নি আমার মেয়েকেও ছাড়বে না। ছাড়বে না।

একদমে কথাগুলো বলে নিশ্বাস ছাড়লেন মইনুর শেখ। মাহবুবুর রহমান শিতল চোখে তাকিয়ে আছেন মইনুর শেখের দিকে। আগ্রহী কন্ঠে জিজ্ঞাস করলেন,

আর কাউকে সন্দেহ করেন?

এই মুহূর্তে মইনুর শেখের মাথায় গেঁথে আছে শুধু ফায়াজের নাম। পূর্ব শত্রু বা অন্যকারো নাম মনে করার চেষ্টাও করলেন না। দ্রুত সত্ত্বর জবাব দিলেন।

সন্দেহ না আমি নিশ্চিত এটা ফায়াজেরই কাজ। সে-ই খু/ন করেছে শ্রাবণকে। আপনারা দয়া করে ওকে খুঁজে বের করুন।

মাহবুবুর রহমান তপ্ত নিশ্বাস ফেললেন। মইনুর শেখ ঘোরের মধ্যে এসব কথা বলছেন বুঝতে দেড়ি হলো না মাহবুবুর রহমানে। প্রাত্যহিক নানান মানুষের সঙ্গে উঠা বসা তার, কত শত অপ/রাধির মুখ খুলতে বেদম পিটিয়েছে। কতকের আবার চোখের ভাষায় বুঝে গিয়েছে সে কি বলতে চায়। মাহবুবুর রহমান তার অফিসারদের সাথে একনজর দৃষ্টি বিনিময় করে মইনুর শেখকে বললেন,

আচ্ছা, আমরা দেখছি।

মাহবুবুর রহমানের বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ফোন বেজে উঠলো। থানা থেকে ফোন এসেছে। মাহবুবুর রহমান পাশ থেকে কথা বলে এলেন। মইনুর শেখের উদ্দেশ্যে বললেন,

মইনুর সাহেব কি/ড/ন্যাপারের নাম্বার ট্রেস করা হয়েছে। নাম্বার আপনার গ্রামে দেখাচ্ছে।

মইনুর শেখ আশ্চর্য হলেন। তার মস্তিষ্ক থেমে নেই। চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনিও। মাহবুবুর রহমান বললেন,

ইয়ে মইনুর সাহেব, আপনি এক কাজ করুন। আপনি বাড়ি যান। আমরা নাম্বারের কারেক্ট লোকেশনে যাবো।

মইনুর শেখ অনুনয়ের সুরে বললেন,

আমার মেয়ে?

আমরা দেখছি ব্যপারটা।

_______
সূর্য ঠিক মাথার উপরে। এসিডে ঝলসে যাওয়া উত্তাপ। সূর্যের উত্তপ্ত রশ্নি আজ যন্ত্রণার সকল বাধ ভেঙ্গে ফেলেছে। জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে মহাশয় আজ পরম আনন্দিত। ফায়াজ পরীকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। এরপর তাদের জঙ্গলের সরু পথ পাড়ি দিতে হবে। ফায়াজ ড্রাইভারকে সৌজন্য হেসে বিদায় জানালো। শরীরের প্রতিটি লোম কূপে ঘর্ম তার খাটি বেধেছে। চুলের গোড়া থেকে ঘর্ম বিন্দু গড়িয়ে ঘাড় ছাড়িয়ে শরীর বেয়ে নামছে। শার্ট ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। ফায়াজ শার্টের হাতা গুটিয়ে নিল। তবে এসে বিশেষ কাজ হলো বলে মনে হচ্ছে না। আপাদমস্তক ঘেমে নেয়ে উঠা অবস্থা। পরীরও ঠিক একই অবস্থা কিন্তু সে তা প্রকাশে অক্ষম। সূর্য যেন তার এহেম অক্ষমতার সুযোগ নিচ্ছে।

এই ভরদুপুরে ভ্যানের বিন্দু মাত্র দেখা না পাওয়ায় হতাশ হলো ফায়াজ। ডানে বামে খা খা রৌদ্রে রাস্তার উপর যেন বাষ্প উড়ছে। ফায়াজ তর্জনী আঙ্গুলে কপালের ঘাম ঝেড়ে ফেললো। একহাতে পরী হাত আর অন্য হাতে নিজের ও পরীর ব্যাগ নিয়ে পা বাড়ালো গন্তব্যের দিকে। প্রগাঢ় রৌদ্রে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরের চামড়া ঝলসানো ছাড়া বিশেষ কোন লাভ হবে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফায়াজ এগিয়ে চলছে। তার মূলত নিজের প্রতি রাগ লাগছে। কেন যে অসময়ে রওনা দিতে গেল কে জানে? নিজের উপর রাগ হয়েও বেশি একটা উপকার হচ্ছে এমনটা নয়। তাকে সেই হেটেই পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। তবে ফায়াজের ভাগ্য সাথে ছিল। কিছুদূর যেতেই দেখা হলো আব্দুল্লার সাথে। আব্দুল্লা দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিল। দূর থেকে ফায়াজকে এভাবে নাস্তানাবুদ দেখেই দৌড়ে কাছে এলো। সালাম দিয়ে ফায়াজের হাত থেকে এক প্রকার টেনে ব্যাগ দুটো হাতে নিল।

মাথা ঘুড়িয়ে আশপাশ দেখে হতাশ কন্ঠে বলল,

সাহেব, এইখানে ভ্যান পাওন যাইবো না। আপনেরা এক কাম করেন আমার দোকানে বহেন। আমি ভ্যান নিয়া আসি।

ফায়াজ আব্দুল্লাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

না না। আপনার এত কষ্ট করতে হবে না। দেখি কিছুটা সামনে যেয়ে।

আব্দুল্লা পরীর দিকে ইশারা করে বলল,

সাহেব, হের অবস্থাও ভালো না। এই রৈদের মধ্যে কতক্ষন দাঁড়ায় থাকবেন?

আব্দুল্লাহর কথা শুনে ফায়াজ পরীর দিকে তাকালো। প্রখর রোদের ধারালো তাপে পরীর মুখ লাল হয়ে আছে। পরী থেমে থেমে হাতের তালুতে মুখের ঘর্ম নিরাময়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। এলোমেলো চুলগুলো ঘর্মাক্ত গলায় এমনভাবে আটকে আছে যেন কোন আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মাঝে আব্দুল্লাহ আবার বলল,

সাহেব, চলেন। দোকান খুইলা দেই বসেন। আমি ভ্যান নিয়া আইতাছি।

ফায়াজ আর অমত করলো না। খা খা রোদে দাঁড়িয়ে ভোতা চাকু দিয়ে অঙ্গ ক্ষতর মতো জ্বালা দিচ্ছে শরীরে। মাথা ঝিমঝিম করছে। আব্দুল্লাহ দোকান খুলে দিল। নতুন একটা পানির বোতলের মুখ খুলে ফায়াজের দিকে এগিয়ে বলল,

সাহেব পানি নেন। পানি খাইলে দেখবেন ভালো লাগবো।

কিছু মানুষ টাকা পয়সার দিক থেকে বড় হয় না কিন্তু মনের দিক দিয়ে হয় অতুলনীয়। এই গ্রামে ফায়াজের আর কতদিন হলো। কিন্তু এই আব্দুল্লাহ, গ্রামের বাকি মানুষগুলা কত আপন করে নিল তাকে। আব্দুল্লাহ ভরসা করে তাকে দোকানের মধ্যে বসিয়ে গেল। এরকম আব্দুল্লাহরা কখনও অর্থ সম্পদ চায় না। এরা চায় ক্ষানিকটা ভালো ব্যবহার, ক্ষানিকটা ভালোবাসা। শ্যাম বর্নের আব্দুল্লাহ ফায়াজের দৃষ্টির বাহিরে চলে গেছে অনেক্ষন। মাথার উপর একটা ছাউনি পেয়ে কিছুটা শান্তি লাগছে। পরী ফায়াজের কাঁধে মাথা এলিয়ে বসে আছে।

_______
কি খবর লেখক সাহেব?

ফায়াজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। চার-পাচঁজন হবে। প্রশ্নকারী বাদে সবাই পুলিশের পোষাক পরিহিত। তাদের ঠোঁটে হাসি। ফায়াজ সবার দিকে একবার নজর বুলিয়ে প্রশ্নকারীর দিকে তাকালো। সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করল,

আপনারা?

মাহবুবুর রহমান দীর্ঘ হাসলেন। শিতল কন্ঠে বললেন,

জ্বি আমরা। তো বিয়ে কেমন খেলেন?

ফায়াজ পরীকে সোজা করে বসিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। মাহবুবুর রহমানের দিকে এগিয়ে দাঁড়ালো। মাথা নাড়িয়ে বলল,

জ্বি ভালো ভাবেই খেয়েছি।

মাহবুবুর রহমান পরীর দিকে ইশারা করে জিজ্ঞাস করলেন,

তো ওকে নিয়ে ফিরে এলেন যে?

ফিরে আসার কথা ছিল না? ফায়াজ পাল্টা প্রশ্ন করলো। এরমাঝেই মইনুর শেখ উপস্থিত হলেন। সাথে এসেছে রেনুকা। ফায়াজকে এক পলক দেখে অস্থির হয়ে মাহবুবুর রহমানকে জিজ্ঞাস করলেন,

অফিসার, আমার মেয়ে কোথায়? আমার মেয়ে?

ফায়াজের কপালে বলিরেখা সৃষ্টি হয়েছে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মইনুর শেখের দিকে তাজালো। মইনুর শেখের হঠাৎ পরিবর্তন ভাবনায় ফেলে দিচ্ছে ফায়াজকে। পরীর জন্য এত অস্থিরতা? মইনুর শেখ কিছু না কিছু ফন্দি নিশ্চই আঁটছে। মাহবুবুর রহমান শান্ত কন্ঠে বললেন,

আছে আপনার মেয়ে।

কোথায় আমার মেয়ে? সে কোথায়?

মাহবুবুর রহমান দোকানের দিকে ইশারা করে বললেন,

ওখানে বসে আছে।

মইনুর শেখ আর রেনুকা দোকানের দিকে উকি দিলেন। পরী দোকানের ভেতর বসে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। রেনুকা দৌড়ে যেয়ে পরীকে ধরতে কাছে যেতেই পরী ভয়ে জড়সড়ভাবে পিছিয়ে গেল। দোকানের পাশ দিয়ে দ্রুত বেড়িয়ে এসে ফায়াজের বাহু দু হাতে জড়িয়ে ধরলো।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here