নীলকণ্ঠা পর্ব-২৯

0
1671

#নীলকণ্ঠা

২৯|
এসব কি বলছেন অফিসার? আমি পরীকে কি/ড/ন্যাপ কেন করবো?

কন্ঠে অপার বিস্ময় ঢেলে ফায়াজ প্রশ্ন করলো।মাহবুবুর রহমান শিতল কন্ঠে বললেন,

সেটা তো আপনিই ভালো বলতে পারবেন। তাই না?

ফায়াজ নিশ্বাস ফেললো। তাকে উত্তেজিত না হয়ে শান্ত থাকতে হবে। উত্তেজনায় ঘটনা বিগড়ে যাবে। তাকে নিজের পক্ষের যুক্তি প্রদর্শন করতে হবে। মইনুর শেখ তাকে অন্য মাধ্যমে এখান থেকে সরানোর চিন্তা ভাবনেয় মত্ত্ব। ফায়াজ মইনুর শেখের দিকে তাকালো। খানিকক্ষণ আগের ক্রুদ্ধ ব্যক্তি কেমন শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ ঢোক গিলে মাহবুবুর রহমানের দিকে তাকাল। বলল,

আমি যদি পরীকে কি/ড/ন্যাপ করি তাহলে এখানে ফিরে আসবো কেন? আর তাছাড়া একটা যুক্তিহীন কথার ভিত্তিতে আপনি আমাকে দোষারোপ করতে পারেন না অফিসার। আপনাদের কাছে কোন প্রমাণ আছে আমি পরীকে কি/ড/ন্যাপ করেছি?

মইনুর শেখ ফায়াজকে পরীকে নিয়ে ফিরে আসতে দেখে হকচকিয়েছিলেন বেশ ভালো ভাবেই। শ্রাবনের কথা মতে ফায়াজ পরীকে নিয়ে ফিরে আসার কথা ছিল না। মইনুর শেখ তার চমকে যাওয়া প্রকাশ করেন নি। তাই ফায়াজের কথার পিঠে জোরদার কিছু বলতে পারছেন না।

ফায়াজের কথা শুনে মাহবুবুর রহমান মইনুর শেখের দিকে তাকালেন। ফায়াজ বলল,

কিন্তু আমি যে নিরপরাধ তার অনেক প্রমাণ আমার কাছে আছে।

মাহবুবুর রহমান ক্ষীণ শব্দে গলা পরিষ্কার করলেন। পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাওয়ার আগেই তিনি ফায়াজকে বললেন,

দেখুন, আমরা আপনার নাম্বার ট্রেস করে আপনাকে খুঁজে বের করেছি।

ফায়াজ হাসলো যেন। সেই হাসিতে তাচ্ছিল্যতার পরিমান শতকরা একশত ভাগ। ফায়াজ বলল,

আচ্ছা তাই? আমি যদি ফোন খোলা না রাখতাম তাহলে আপনারা নাম্বার ট্রেস করতেন কিভাবে? আর তাছাড়া আমাকে বলুন তো এমন কোন কি/ড/ন্যাপার দেখেছেন যে কিনা কি/ড/ন্যাপ করে ফোন খোলা রাখবে কখন পুলিশ এসে তাকে ধরবে সেই আশায় আর তাও বাড়ির কাছে এসে।

ফায়াজের কথার যুক্তিতে মাহবুবুর রহমান চুপ রইলেন।মাহবুবুর রহমানে পাশ থেকে একজন পুলিশ অফিসার বললেন,

মইনুর সাহেবের ইনফর্মার তাকে বলেছে।

ইনফর্মার? ফায়াজ ভ্রু কুঁচকে মইনুর শেখের দিকে তাকালো। কে ইনফর্মার?

মাহবুবুর রহমান বললেন,

মিস্টার শ্রাবণ। যাকে কিনা খুন করা হয়েছে এবং এর জন্য মইনুর সাহেব আপনাকে সন্দেহ করছেন।

ফায়াজ এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। ফায়াজকে এভাবে হাসতে দেখে উপস্থিত সবাই ভড়কালো। ফায়াজ হাসতে হাসতে চোখে জল চলে এলো। বৃদ্ধাঙ্গুলে জল মুছে মইনুর শেখকে বলল,

বাহ! বাহ! দারুন খেলা খেললেন মইনুর সাহেব বাহ!

এরপর পরীর দিকে ইশারা করে মাহবুবুর রহমানকে বললেন,

ওকে দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে? ও আমাদের মতো স্বাভাবিক?

পরী তখনও ফায়াজের বাহু জড়িয়ে ফায়াজের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে। ভীতিকর চোখে সবার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে। মাহবুবুর রহমান পরীর থেকে চোখ সরিয়ে ফায়াজের দিকে তাকালেন। ফায়াজ বলল,

এবার মূল কথায় আসি।

প্রথমদিন গ্রামে আসার পর থেকে সব ঘটনা ফায়াজ মাহবুবুর রহমানকে খুলে বলল। ততক্ষনে আব্দুল্লাহ এসে পরেছে ভ্যান নিয়ে। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনছে। ফায়াজ তার কথা শেষে বলল,

এবার আপনি বলুন।

মাহবুবুর রহমান বললেন,

কিন্তু মইনুর শেখ নিজের মেয়ের সাথে এমনটা করবেন কেন?

কারন পরী তার নিজের মেয়েই না।

ফায়াজ। গর্জে উঠলেন মইনুর শেখ। যেসব কথা সে মাহবুবুর রহমানের কাছ থেকে ইচ্ছে করে লুকিয়েছে ফায়াজ সেগুলো মাহবুবুর রহমানকে জানিয়ে দিয়েছে।মইনুর শেখের সম্মানে আঘাত হেনেছে। সে এভাবে বাহিরের একজনের সাথে পারিবারিক বিষয়ে আলাপ আলোচনায় অসন্তুষ্ট। রাগত স্বরে ফায়াজকে শাসিয়ে বললেন,

এটা আমার পরিবারের ব্যক্তিগত ব্যপার।

ফায়াজ ভাবলেশহীন বলল,

এখন আর ব্যক্তিগত বলতে কিছু বাকি নেই। আপনার কার্যকলাপ গুলো সবার জানা উচিত। আপনি কিভাবে পরীর উপর অত্মাচার করেছেন এদেরও তো জানা উচিত তাই না?

রাগে মইনুর শেখের নাক ফুলে উঠেছে। তিনি সহ্য করতে পারছেন না। মাহবুবুর রহমান অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,

তাহলে আপনার ঘর থেকে ওষুধের পাতা পরীর জন্য ছিল?

ফায়াজ সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে বলল, জ্বি হ্যা।

মাহবুবুর রহমান বললেন,

আচ্ছা আমাকে বলুন তো মইনুর সাহেব যে পরীর আসল বাবা না এটা আপনি কি করে জানলেন?

আমি বলছি সাহেবরে। আব্দুল্লাহ এগিয়ে এসে বলল।

মাহবুবুর রহমান আব্দুল্লাহর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বললেন,

আপনার পরিচয়?

এই চায়ের দোকান আমার।

আপনি কি করে জানলেন?

কি কন স্যার? এই গ্রামের মানুষ আমি। এহেনে জন্ম। গ্রামের খবর জানমু না?

তাহলে পরীর আসল বাবা কে? মিস্টার ফায়াজ আপনি কি জানেন সেটা?

জ্বি। ছোট্ট শব্দে উত্তর দিল ফায়াজ। এরপর ব্যাগ থেকে পরীর বাবা মায়ের ছবি বের করে মাহবুবুর রহমানের হাতে দিল। মাহবুবুর রহমান ছবির দিকে তাকাতেই চমকে উঠলেন। আড়চোখে তাকালেন মইনুর শেখের দিকে। তিনি হাসফাস করছেন। মাহবুবুর রহমান ফটোফ্রেম মইনুর শেখের দিকে তাক করে গম্ভীর কৌতুকস্বরে জিজ্ঞাস করলেন,

চিনতে পেরেছেন মইনুর সাহেব?

মইনুর শেখ ছবির দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে ফেললেন। তিনি ভাবতেও পারেন নি এমন এক অযাচিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তাকে। এখন না পারছেন কিছু বলতে আর না পারছেন পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে। নিরবে সব সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই কোন।

মাহবুবুর রহমান নিরবে শ্বাস ফেললেন। ফায়াজকে বললেন,

এটা তো গেলো পরীর কথা। আর শ্রাবণের সম্পর্কে মতামত কি?

আমি তাকে ওতটা ভালো করে চিনি না।

শেষ কবে দেখেছিলেন?

এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়।

মিথ্যে কথা। শ্রাবণ বলেছে গত কাল সে পরীর কাছে যাবে। মইনুর শেখ উঁচু গলায় বলে উঠলেন।

মাহবুবুর রহমান ছোট ছোট চোখ করে মইনুর শেখের দিকে তাকালেন। কপালে তার বলিরেখা দৃশ্যমান। মইনুর শেখকে বলেন,

আপনি তো বলেছিলেন শ্রাবণ এদের সাথে গিয়েছে।

মাহবুবুর রহমানের কথা শেষ হতেই ফায়াজ চট করে বলে উঠলো,

না। আমাদের সাথে যায় নি। আমি আর পরী একা গিয়েছিলাম এবং শ্রাবনের সাথে দেখেও হয় নি। আপনি চাইলে খোঁজ খবর নিতে পারেন।

মাহবুবুর রহমান এবার অবাকই হলেন এবং মইনুর শেখের কার্যকলাপে বিরক্তও হলেন। মইনুর শেখকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

আপনি কি করেছেন বুঝতে পারছেন? একের পর এক মিথ্যা এবং আমাদের কাছে কথা লুকিয়ে গেছেন। নিজেদের ব্যক্তিগত মনমালিন্যে পুলিশকে জড়িয়েছেন। আপনার মতো একজনের থেকে এসব আশা করি নি।

লজ্জায়, অপমান মইনুর শেখের মাথা নুয়ে গেল। নিজের পক্ষে যুক্তি দাড় করানোর মতো কোন কথা খুঁজে পাচ্ছেন না।

শ্রাবণকে যে খু/ন করা হয়েছে সেটা তো আর মিথ্যা না। রেনুকার হঠাৎ বলা কথায় মইনুর শেখ মাথা তুলে তাকালেন। মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন রেনুকার। সঠিক সময়ে সঠিক কথা বলেছে রেনুকা। মাহবুবুর রহমান বললেন,

আমরা সে বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করবো এবং খু/নিকে বা খু/নিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। তবে আমরা ফায়াজ সাহেবের গত দুদিনের খবর ও খুঁজে বের করবো। আপনার সম্পর্কে সন্দেরজনক কিছু পেলে আপনি আর বাচবেন না। আপত্তি আছে কি মিস্টার ফায়াজ আহমেদ?

জ্বি না। ক্ষীণ শব্দে বলল ফায়াজ।

_______
আকস্মিক বজ্রপাতের মতো আওয়াজ তুলে মইনুর শেখ চড় বসালেন ফায়াজের গালে। ফরসা গাল মুহূর্তের মাঝে লাল হয়ে গেল। মইনুর শেখ ক্রোধে ফেটে পড়ছেন। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাহিরের মানুষের সামনে তার সম্মান হানী হয়েছে। ফায়াজকে এই মুহূর্তে খু/ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মইনুর শেখ ফায়াজের কলার চেপে ধরলেন। মইনুর শেখের চোখে আগুনের ফুলকি ঝরছে। তবে ফায়াজ একে পুরোদমে অগ্রাহ্য করছে। মইনুর শেখ ফায়াজের কলার চেপে নিজের কাছে টেনে চোয়াল শক্ত করে বলল,

তোমাকে এত সাহস কে দিয়েছে? কে তুমি? কেন এসেছো এখানে?

ফায়াজ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। হেলদুল নেই কোন। মইনুর শেখ ফায়াজের কলার ঝাঁকিয়ে দাঁতে দাতঁ চেপে বললেন,

কথা বলছো না কেন? আর মিথ্যে বলার চেষ্টা করবে না।

ফায়াজকে চুপ থাকতে দেখে মইনুর শেখ কলার ছেড়ে আবার চ/ড় বসালো। দীর্ঘ চ/ড়ের তোপে ফায়াজ দু পা পিছিয়ে গেল। দাঁতে ঠোঁট লেগে ঠোঁটের এককোণে কেটে সামান্য রক্ত বের হলো। তৎক্ষণাৎ জ্বলে উঠলো ঠোঁটের কাটা জায়গাটা। এতেও জন্ত্রণার বিন্দু মাত্র রেশ নেই ফায়াজের মুখশ্রীতে। ফায়াজ বৃদ্ধাঙ্গুলে ঠোঁটের কাটা অংশ চেপে ধরল। মইনুর শেখ আবার এগিয়ে আসতে নিলেই ফায়াজ হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিল। ঠোঁটের কাটা অংশ থেকে বৃদ্ধাঙ্গুল সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বলল,

এত তাড়া কিসের মইনুর সাহেব?

এই…

মইনুর শেখ গর্জে উঠতেই ফায়াজ থামিয়ে দিল তাকে। আয়েসি ভঙ্গিতে বলল,

আচ্ছা বলুন। বলুন কি জানতে চান?

তুমি কে? কেন এসেছো? মইনুর শেখের রুষ্ট কন্ঠস্বর।

ফায়াজ হেয়ালি কন্ঠে বলল,

আমার নাম ফায়াজ আহমেদ। পেশায় একজন লেখক। আপনাকে তো প্রথম দিন এসেই বলেছিলাম ভুলে গেলেন?

মইনুর শেখ চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে। তার নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। ধমক দিয়ে বলল,

আমার সাথে একদম হেয়ালি করবে না। যেটা জিজ্ঞাস করেছি সেটার উত্তর দাও।

ফায়াজ কলার ঠিক করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মুখে অদ্ভুত হাসি টেনে মইনুর শেখের কাছাকাছি যেয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

হ্যা, আমি পরীর জন্যই এখানে এসেছি। পরীকে নিতে এসেছি।

বিস্ময়ে মইনুর শেখের চোখ বড়বড় হয়ে গেল। স্পন্দন থেমে গেলো। একটা মৃদু কম্পন শরীরে বয়ে গেল। শ্বাস প্রশ্বাস কেমন দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে আওরাতে লাগলেন, এটা হতে দিব না। কিছুতেই না।

চলবে…
®উম্মে কুমকুম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here