মম চিত্তে পর্ব_১৭

0
740

#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৭
#সাহেদা_আক্তার

মম ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল রিয়ান সোফায় বসে আরাম করে ল্যাপটপে কাজ করছে। ও এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা মুছতে লাগল। ভারি গয়না শাড়ি শরীর থেকে নামতে যেন সারা শরীর পালকের মতো হালকা হয়ে গেল। মম মাথার উপর টাওয়াল রেখে মাথা মুছতে গিয়ে দেখল রিয়ান ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ও পেছন ফিরতেই রিয়ান বলল, তোমাকে মানিয়েছে শাড়িটায়। মাথা এভাবে ঘষতে হবে না। বাইরে বারান্দায় চলো। সুন্দর একটা ঠান্ডা বাতাস। এমনিই চুল শুকিয়ে যাবে। রিয়ান ওর হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে এল। আসলেই বাইরে অনেক বাতাস। আকাশ যে ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে তা বেশ ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে আকাশের শেষ সীমানায়। মম ঐ দিকে তাকিয়ে রইল। রিয়ান ওকে খেয়াল করে বলল, আচ্ছা তুমি কি বিদ্যুত চমকানোতে ভয় পাও?

– কেন বলুন তো।

– প্রথম দিন যেদিন তোমার সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন তুমি ভয়ে কুঁকড়ে ছিলে।

– প্রথমদিন? কই নাতো। আপনিই তো আমাকে খেতে ডাকলেন। ভয়ে ছিলাম কখন?

– তোমার মনে নেই?

– না তো। আপনি কবেকার কথা বলছেন?

রিয়ান দুলটা পকেট থেকে বের করল। মম অবাক হয়ে বলল, এই দুলটা আমি খুঁজেছিলাম। পাই নি। আপনার কাছে কি করে গেল? ও মজা করে বলল, তোমাকে বিয়ে করব বলে হয়তো দুলটা আমার কাছে চলে এসেছে। রিয়ান মজা করছে দেখে মম বলল, আমি ভেতরে যাচ্ছি। আমার এস্ট্রোফোবিয়া আছে। তাই এই বিদ্যুত চমকানোর মধ্যে দাঁড়িয়ে ভয়ে মরার ইচ্ছে নেই। মম চলে যেতে লাগলে পেছন থেকে রিয়ান ওর হাত ধরে এক টান মারল৷ সাথে সাথে মম ওর বুকের উপর এসে পড়ল। রিয়ান বলল, ভয় পেলে এই বুকটা আছে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। সাথে সাথে মেঘ গর্জে উঠতে মম ওর পাঞ্জাবি খাঁমচে ধরল। পরমুহুর্তে ভেতরে একটা শান্তি লাগল৷ আসলে এতদিন পর একটা আশ্রয় পাওয়া গেল যা সকল ঝড় ঝাপটা থেকে ওকে দূরে রাখবে।

ওর শান্তিটা বেশিক্ষণ থাকল না। রিয়ান বলল, তোমার চুলগুলো উড়ে এসে চোখে মুখে ঢুকছে যে মম। মম মাথা তুলে বোকার মতো ওর দিকে তাকাল। তারপর বলল, তাহলে এক কাজ করি। মাথা ন্যাড়া করে ফেলি। রিয়ান সাথে সাথে বলল, এই না না। সব বাতাসের দোষ। আমার লম্বা চুল ভাল্লাগে। তুমি আমার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকো। আর কিছু বলব না। রিয়ান ওর মাথাটা হাত দিয়ে বুকের উপর রাখল। মম মুচকি হেসে মিথ্যা অভিমান করে বলল, আমি ঘুমাবো। রাত হচ্ছে। কালকে অফিস যেতে হবে।

– আমি ছুটি দিয়ে দিলাম। যাওয়া লাগবে না। চুপচাপ এভাবে থাকো। এখানে আরাম লাগছে। প্রাকৃতিক বাতাসের থেকে আরাম আর কিছুতে পাবে?

– ধুর বাবা আমি গেলাম।

মম রিয়ানের বাঁধন ছেড়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। রিয়ান পেছন থেকে বলল, বাবা না জামাই। তবে বাবুর বাবা বলতে পারো। মাইন্ড করবো না। মম ওর কথা শুনে দ্রুত বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল৷ মনে মনে ভাবল, কি একটা অবস্থা। বিয়ে হতে না হতে যেন ওর অন্যরূপ দেখছে। হঠাৎ মনে হলো, এতক্ষণ এত বজ্রপাত হলো অথচ ও ভয় পেল না। এমনকি খেয়ালই করল না। এত মোহে যে বাঁধছে ছেড়ে যাবে না তো!

ঘুমে চোখটা লেগে গিয়েছিল। রিয়ানের ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল। পেছন ফিরে বলল, কি? রিয়ান ওকে উঠিয়ে ওর কোলে শুয়ে বলল, মাথা টিপে দাও। একটু কাজ করেছি ল্যাপটপে আর মাথা ধরেছে। দিদুন তোমাকে আমার মাথা টেপানোর জন্য আনিয়েছে। আর তুমি ঘুমাচ্ছো।

– মানে কি?

– মানে এখন তুমি আমার মাথা টিপে দেবে। আমি না তোমাকে বুকে মাথা রাখতে দিয়েছিলাম?

– আমি বলেছিলাম নাকি!?

– না বললে নাই। এখন তুমি মাথা টিপ দিবা না হলে…

– না হলে কি?

রিয়ান এমন ভাব করল যেন ওর মতিগতি ভালো না। মম জানে রিয়ান ফাজলামি করছে ওর সাথে কিন্তু ও চাইলেও এখন মাথাটা সরাতে পারবে না কোল থেকে। বাধ্য হয়ে মাথা টিপা শুরু করল। রিয়ান চোখ বন্ধ করে বলল, আসলে দিদুন ঠিকই বলেছে মাথা টেপানোর জন্য হলেও বিয়েটা করা দরকার। কথাটা শুনে মম জোরে একটা টিপ মারল সাথে সাথে রিয়ান ব্যাথা পেয়ে বলল, আউ, এভাবে কেউ মাথা টিপে? টিপে তো মাথার হাড় ভেঙে দেবে।

– ভাঙুক। ভাঙলে শিক্ষা হবে।

– উহু মরে যাবো। তখন…

মম ওর মুখ চেপে ধরে বলল, হয়েছে আর বাকিটা না বললেও চলবে। মম চুপচাপ ওর মাথা টিপতে লাগল। রিয়ানের কথা শুনে অন্য একজনের কথা মনে পড়ে গেল। সেও এভাবে বলেছিল মরে যাওয়ার কথা তাই আজ সে মম থেকে বহুদূরে।

আদ্রিতা গল্প শেষে রুমে আসলো। আলিফ তখনো জেগে প্রিয়ান্তুকে ঘুম পাড়াচ্ছে। মেয়েটা দেশে এসে যা দুষ্ট হয়েছে! সহজে ঘুমাতে চায় না এখন। এখনো হাত পা নেড়ে জানান দিচ্ছে যে সে জেগে আছে। আদ্রিতা হেসে পোশাক বদলে এল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, তোমার কি হয়েছে বলতো? আজকে সারাদিনে তোমার কোনো দেখাই পেলাম না। এমন না যে খুব মানুষের ভীড় ছিল। আমরা আমরাই ছিলাম। তাও তোমাকে চোখে দেখতে পাইনি। আলিফ প্রিয়ান্তুর বুকে হাত দিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, বিয়ে মানে তো কাজ। আমিই তো বাড়িতে ছেলে মানুষ ছিলাম৷ আদ্রিতা মিথ্যা অভিমান করে ওর দিকে ফিরে বসে বলল, কাজ না কচু? কি এমন কাজ? কত করে বললাম চলো চলো। গেলে না যে গেলেই না। আলিফ চুপ করে রইল। আদ্রিতা মাথা বেঁধে ওর কাছে এসে বলল, কি হয়েছে বলো না। তোমাকে কেমন যেন অন্য রকম লাগছে আমার। কেমন যেন বদলে গেছো। আজকে নিচে খেতেও নামলে না। রুমে খেলে। আমরা কত গল্প করলাম। তুমি গেলেও না।

– কাজ করেছি তো তাই শরীরটা ভালো লাগছিল না। আদ্রি…

– হুম?

– চলো আমরা ফিরে যাই।

– হঠাৎ? এই তো সবেমাত্র ভাইয়ের বিয়েটা হলো। এর মধ্যে কি করে যাওয়া যায়?

– আব্বুকে দেখতে যাবো কাল। সেখান থেকে সোজা চলে যাবো। আমারও তো ছুটি শেষ হয়ে এসেছে।

– আর ক’টা দিন থাকি না।

– তাহলে তুমি থাকো। আমি না হয় চলে যাই।

আদ্রিতা মুখ গোমড়া করে বলল, তুমি গেলে আমিও চলে যাবো। আচ্ছা, কালকে সকাল সকাল ব্যাগ গুছিয়ে রাখব। যখন বলবে রওনা দিবো। আলিফ ওর দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিল। আসলেই ও প্রিয়ান্তু আর আদ্রিতাকে নিয়ে সুখে আছে। ওদের হারাতে চায় না। মমর নতুন জীবনেও বাঁধা হতে চায় না। অনেক তো কষ্ট দিয়েছে মেয়েটাকে। এখন একটু সুখের মুখ দেখুক।
.
.
.
.
অভ্যাস করে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকেই ঘুম ভেঙে গেল মমর। সারারাত বসে ঘুমিয়েছে ও। কোলের কাছে ভারি লাগতেই তাকাল। এখনো রিয়ানের মাথা ওর কোলে। রিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চোখ খোলা। সাথে সাথে একটা ছোট চিৎকার দিয়ে ওকে ঠেলে সরাতে গিয়ে ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠল। রিয়ান আকস্মিক এমন হওয়ায় বলে উঠল, এভাবে কেউ কোল থেকে মাথা নামায়?

– নামাবো না? আপনি কোথায় তাকিয়ে ছিলেন?

– কোথায় তাকাবো। চোখ খুললে যা দেখা যাবে সেদিকেই তো তাকিয়ে থাকবো।

মম দুই হাত দিয়ে ওর পেট ঢেকে মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। রিয়ান উঠে আড়মোড়া ভেঙে বলল, বাবারে, মনে হয় যেন অন্য কোনো মেয়ের পেট দেখে ফেলেছি। বউই তো।

– হ্যাঁ, বউ বলেই আরাম করে সারারাত আমার পায়ে ঘুমিয়ে বারোটা বাজিয়েছেন।

– কাটাকাটি হয়ে গেছে। হাসপাতালে আমার পায়ের উপর তুমি ঘুমিয়েছিলে আর এখন আমি। হিসাব কমপ্লিট।

মমর কান্না চলে আসছে। পা এমন অবশ হয়েছে যেন সেন্স পাচ্ছে না। মনে মনে বলল, আমার মাথা আর আপনার মাথা সমান নাকি! কি ভারি বাবা! কয় কেজি কে জানে। কিভাবে এই ভারি মাথা নিয়ে ঘোরে!? মমর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বলল, আমি আগে যাবো না তুমি আগে? মম কিছু বলছে না দেখে বলল, ওকে, আমিই যাচ্ছি। রিয়ান ওয়াশরুমে চলে গেল। মম সাবধানে পা নামাতে গিয়ে দেখল আসলেই কোনো সেন্স পাচ্ছে না। দু মিনিট পর পুরো দুই পায়ে এমন ঝি ঝি ধরল যে ও নিচের ঠোঁট কামড়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে রইল। ফ্লোরে পা রাখতেই মনে হল অসংখ্য কাঁটা ফুটছে পায়ে। মনে মনে বলল, আসুক আর কোলে মাথা রাখতে। মাথা দিয়ে আমি ফুটবল খেলবো।

দশ মিনিট পর রিয়ান ফ্রেশ হয়ে দেখল মম আলমারি খুলে তাকিয়ে আছে। ও পেছন থেকে এসে উপরের তাক থেকে একটা শাড়ি নামিয়ে দিল। ও এত কাছে ছিল যে সদ্য গোসল করে আসা শরীরের ঘ্রাণ ওর নাকে লাগছিল। রিয়ান শাড়িটা ওর হাতে দিয়ে বলল, এটা পরো৷ আজকে তো বাড়ি যাবে। আসবে কবে? মম শাড়িটা নিয়ে আলামরি মারতে মারতে বলল, যদি না আসি? পেছন ফিরতে রিয়ান আলমারিতে বাম হাত রেখে ওর দিকে ঝুঁকে গেল। এই প্রথম মম রিয়ানকে খুব কাছ থেকে দেখছে। ও বলল, না আসলে তুলে নিয়ে আসবো। মম রিয়ানের কপালে সজোরে একটা টোকা দিয়ে বলল, তোমার স্বপ্নে। টোকা পেয়ে রিয়ান সরে গেল খানিকটা৷ সেই সুবাদে মম ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। রিয়ান পেছন থেকে বলল, তুমিতে এসেছো তাহলে। মম কিছু না বলে সোজা ওয়াশরুম ঢুকে গেল। ঢোকার সময় ফিসফিস করে বলল, বাচ্চা একটা বিয়ে করেছ।

মম ফ্রেশ হয়ে বের হলো। রুমে রিয়ানকে দেখা গেল না। ও মাথাটা মুছে সুন্দর পরিপাটি হয়ে নিচে চলে এল। বিয়ের পরদিন শ্বশুরবাড়ির সবাই চায় নতুন বউয়ের হাতের রান্না খেতে। কিন্তু সকালের নাস্তা করেই তো ও বেরিয়ে যাবে। তারপর রায়হান সাহেব সুস্থ হলে তারপর আসবে। এমনই তো কথা ছিল। ও রান্নাঘরে ঢুকে দেখতে লাগল কোথায় কি আছে। ফুলি হামি তুলতে তুলতে এসে বলল, কি খুঁজো গো নতুন ভাবি?

– নাস্তা বানাবো ভাবছিলাম। কি বানানো যায় বলো তো।

– দাদীআম্মা তো সকালে রুটি খায় আলুভাজি দিয়া।

– আচ্ছা, আর বাকিরা?

– খালাম্মা যা বানায় তাই খায়। এক একদিন এক এক জিনিস বানায়।

– আচ্ছা।

মম ভাবতে বসল কি বানাবে। আগে রুটিটাই বানাবে চিন্তা করল। বাকিটা পরে দেখা যাবে। আলুর খোসা ছাড়িয়ে কুঁচি কুঁচি করে কেটে ভাজতে দিয়ে রুটি বানাতে বসল। ফুলি আলুটা দেখছে আর ও রুটি বানাচ্ছে। এমন সময় ফেরদৌসী রান্নাঘরে ঢুকলেন। ওকে দেখে বললেন, ওমা! উঠে গেছো! মম ভদ্রভাবে উত্তর দিল, জ্বি।

– ভালো করেছো। আম্মার খাবার তো তৈরী করেও ফেলেছো দেখছি। এক কাজ করো তুমি রুটি আর ভাজি নিয়ে আম্মাকে দিয়ে দিও।

– বাকি নাস্তা?

– আমরা আছি তো।

কথা বলতে বলতে নাহার আর কনক চাচিও চলে এলেন। তুলি ভাবিও একটু পরে নেমে এল। সবাই মিলে হাতে হাতে নাস্তা তৈরী হয়ে গেল। আটটা বাজতেই সবাই নাস্তার টেবিলে হাজির। মম সবাইকে খাবার বেড়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসলে ফেরদৌসী বাঁধা দিয়ে বললেন, তুমি বসে খেয়ে নাও। রিয়ানের সাথে বের হবে তো?

– তা হবো। কিন্তু …

– বেড়ে দেওয়ার অনেক সময় পাবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও আজ।

মম চুপচাপ বসে পড়ল। চাইলেও কেউ কাজ করতে দিচ্ছে না। এই প্রথম আলিফের সাথে নাস্তার টেবিলে দেখা। একবার চোখাচোখি হতেই কেউ কারো দিকে আর তাকালো না। কালকে আসার পর থেকে একবারও মুখ দেখায়নি আলিফ৷ আজকেও খাবার খেতে না আসলে বাজে দেখাবে বিধায় নিচে নাস্তা করতে আসা। সে চুপচাপ খেয়ে উঠে গেল। সবাই নিজের মতো গল্প করে খাওয়া শেষ করল।

মম রুমে এসে চটপট তৈরি হয়ে নিল। কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে বলল, চলুন। রিয়ান একটু অবাকের সুরে বলল, শাড়ি নেবে না? মম আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বলল, শাড়ি নিয়ে কি করব? আর ওখানে তো আমার জামা আছে। রিয়ান খানিকটা রাগের সুরে বলল, কি করবে মানে? যাচ্ছো তো আমাকে ফেলে কত দিনের জন্য। আমি মাঝে মধ্যে গেলে শাড়ি পরবে না?

– আপনি গেলে শাড়ি পরতে হবে কেন?

– কারণ তোমাকে শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here