মম চিত্তে পর্ব_১৯

0
836

#মম_চিত্তে
#পর্ব_১৯
#সাহেদা_আক্তার

মম চা আনার কথা বলতেই রিয়ান বাঁধা দিয়ে বলল, এখন চা খাবো না। আমার মাথাটা টিপে দাও। হাঁচি দিতে দিতে মাথাটা ধরে গেছে। সকালের কথা মনে উঠতেই মুখ লাল হয়ে গেল। বলল, আপনি বালিশে মাথা রাখুন আমি টিপে দিচ্ছি।

– বালিশে কেন? কোথায় বলবা, আসো আমার কোলে মাথা রাখো; তা না।

– যা বলেছি তা করুন না হলে নিনিকে এনে কোলে বসাবো।

রিয়ান মুখ ভার করে বলল, ব্ল্যাকমেইল করছো? হুহ। লাগবে না মাথা টিপে দেওয়া। বলে অপর পাশ ফিরে শুয়ে গেল। মম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর মাথার কাছে এসে বসল। মাথা টিপে দিতে লাগল। রিয়ান তাও যেভাবে ছিল ওভাবেই রইল। ওর দিকে ফিরল না৷ মমর মাথা টিপে দিতে অসুবিধা হচ্ছে। ওর দিকে ফেরার কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই ফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ হলো। মম ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল বৃষ্টি একটা ছবি দিয়েছে। ওর আর রিয়ানের। রিয়ান যে বৃষ্টিতে পেছন থেকে ওকে ধরে ছিল। মাথা টেপা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রিয়ান আড়চোখে মমর দিকে তাকালো। ওকে লজ্জায় ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হুট করে ফোনটা নিয়ে বলল, দেখি কি দেখছো। মম ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু রিয়ানের সাথে পারল না। তার আগেই রিয়ান দেখে ফেলল। দেখে খুশি বলল, বাহ্! আমার শালি তো দারুণ ছবি তোলে! দাঁড়াও ওকে তাহলে ছবি তোলার কাজ দিতে হবে। মম অপর পাশ ফিরে মাথা নিচু করে বসে রইল। হাত দিয়ে শাড়ি নাড়াচাড়া করছে। রিয়ান ওর কাঁধে চিবুক রাখতেই মম নড়ে উঠল খানিকটা। বলল, তোমাকে সুন্দর লাগছে ছবিটায়। মম সাথে সাথে ফোনটা কেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চাটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে নিন। নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রিয়ান মুচকি হেসে আবার শুয়ে পড়ল। তখনই নজর গেল দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবির দিকে।

হাতে হাতে কাজ করায় দুপুরের আগেই রান্না শেষ হয়ে গেল। রুমে যাবে কি যাবে না করতে করতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো মম। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল রিয়ান ঘুমাচ্ছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়াতেই বর্ষার ডাক পড়ল। বর্ষার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি?

– বোস। তোর সাথে আর কবে কথা হয় না হয়।

– কেন?

– দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে যাবো।

– এত তাড়াতাড়ি! আরো ক’টা দিন থাকো।

– না, আমার শাশুড়ী আসবে বিকালে। তার জন্য রান্না করতে হবে।

– এক কাজ করো। এখান থেকে নিয়ে যেও।

– ছিঃ ছিঃ। কি বলিস! আরে আমার বেশি সময় লাগবে না রান্না করতে।

– ধুর বিয়ে জিনিসটাই একটা জ্বালা। কত কিছু মেনে চলতে হয়।

– তা তো যেকোনো পরিবারে থাকলেই চলতে হয়। কোথাও কম কোথাও বেশি। কোথাও নিময়বিহীন জায়গা পাবি না। এখন বল শ্বশুর বাড়ি কেমন।

– ভালোই।

– ভালো হলেই ভালো। আর সে…

– কার কথা বলছো? ও…। আজকে সকালের নাস্তা ছাড়া আর চোখের সামনে আসেনি৷ হয়ত অস্বস্তিতে না হয় অনুশোচনায়। বিয়ের আগে একবার দেখা করেছিল। ক্ষমা চেয়েছে।

– করেছিস ক্ষমা?

– আদ্রিতা আর বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে করে দিয়েছি। কিন্তু যদি আমার জীবনে ফের অশান্তি ডেকে আনে ক্ষমা তো দূর থাকুক মুখও দেখবো না।

বৃষ্টি দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, আমাকে ছাড়া গল্প করে ফেলছো? মম হেসে বলল, আরে না। মাত্র বসলাম। আয় বোস। তা কি খবর? পড়ালেখার কি অবস্থা? অনার্স তো শেষ। বৃষ্টি মুখে হাতাশা এনে বলল, তা তো শেষ।

– শেষ তো চেহারা এমন করে আছিস কেন?

বর্ষা মুখ টিপে হেসে বলল, বিয়ের প্রস্তাব আসছে যে তাই। বৃষ্টি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমাকেও তোমাদের দলে ফেলার জন্য পিড়াপিড়ি চলছে। মম বলল, তাহলে তো ভালোই। আমি দেখবো নাকি ছেলে? আমার শ্বশুর বাড়ির ঐ দিকে কেউ আছে কি না।

– খোঁজ খোঁজ। জামাইবিহীন আমি একেবারে মরে যাচ্ছি।

দুইজনে ওর কথা শুনে হাসতে লাগল। হাসি শেষে মম বলল, ওকে, ডিল ডান। আজই খোঁজা শুরু করব। বৃষ্টি বলল, ওখে। খোঁজ। ঠিক তোর জামাই টাইপ। রোমান্টিক হবে। মম ওর কথা শুনে কিছু না বলে চুপ করে গেল। বৃষ্টি ওকে গুঁতো দিয়ে বলল, হয়েছে, আর লজ্জা পেতে হবে না। আপু সব গুছিয়ে নিয়েছো?

– হ্যাঁ।

– ওকে, চলো চলো। দুটো বাজে; খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। মম, যা, ভাইয়াকে ডেকে তোল। আসার সময় তো দেখলাম উল্টে পরে ঘুমাচ্ছে। নিনি গিয়ে উপস্থিত হলে খবর হয়ে যাবে।

মম উঠে গেল। আসলেই ঠিক কথা। নিনিটাকে কোনো বিশ্বাস নেই। যাকে পছন্দ হবে তার পায়ে পায়ে ঘুরবে সবসময়। মম রুম বেরিয়ে দেখল নিনি ওর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিছানায় ওঠার জন্য। মম দ্রুত গিয়ে ওকে ধরতে ম্যাঁও করে করুণসুরে ডাক দিল। ও ফিসফিস করে বলল, ওখানে যাওয়া নিষেধ তোর। বুঝলি? যা আব্বুর কাছে যা। নিনিকে রায়হান সাহেবের রুমে ছেড়ে দিয়ে আবার রুমে আসল। রিয়ান এখনো ঘুমাচ্ছে। কি নিষ্পাপ লাগছে! চুলগুলো একটু বড় হয়ে গেছে। কাটতে বলতে হবে৷ এখন পুরো কপাল ডেকে আছে। ও হাত দিয়ে আলতো করে চুল সরিয়ে দিল। সাথে সাথে রিয়ান পিটপিট করে তাকালো। মম বোকার মতো বলল, ঘুমাননি?

– তোমার বিড়ালটা আসতেই তো নাকটা চুলকানো শুরু করে ঘুমটা ভেঙে দিল। ভালোই হয়েছে। তুমি যে নিজ থেকে এসে আমাকে ছুঁয়েছো তাতো আমার ভাগ্য।

– মজা না করে উঠুন। খেতে হবে।

– উফ! উঠতে ইচ্ছে করছে না। আরো ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। বিছানায় তোমার ঘ্রাণ পাচ্ছি।

মম চোখ সরু করে বলল, মশকরা করছেন আমার সাথে? আজকে নতুন বিছানার চাদর পেতেছে খালা। আর মজা করলে নিনিকে এনে কোলে বসিয়ে দেবো৷ উঠুন। রিয়ান গড়িমসি করে বলল, এমন করো কেন? সত্যিই ঘুম পাচ্ছে। মম ডাক পাড়ল, নিনি…। রিয়ান দ্রুত উঠে বসে বলল, পেয়েছো একটা। বাড়িতে চলো না। তখন জ্বালানি কাকে বলে দেখাবো। মম ভেংচি কেটে বলল, নিয়ে যাবো নিনিকে। সারাদিন রুমে বসে থাকবো ওকে নিয়ে। তখন দেখবো জ্বালান কি করে। ও বেরিয়ে গেল রুম থেকে। রিয়ান হেসে ফ্রেশ হতে গেল।

খাবার টেবিলে হরেক রকম পদ। নতুন জামাই এসেছে বলে কথা। খেতে খেতে সবাই গল্প জুড়ে দিয়েছে। রায়হান সাহেব পেয়েছেন মন মতো একজন গল্পের সঙ্গী। সারাক্ষণ এটা ওটা নিয়ে রিয়ানের সাথে আলোচনা সমালোচনা চলছে। খাওয়া শেষ হতেই দুইজন সোফায় গিয়ে বসল। মাধুরী খালা রান্নাঘরে চলে গেলে সব পরিষ্কার করতে। জাবেদ খালু খেয়ে নিচে চলে গেছেন। মম বৃষ্টি আর বর্ষার সাথে রুমে এল। ওরা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগল। মম জিজ্ঞেস করল, আবার কবে আসবে? বর্ষা হেসে বলল, দেখি। এখন তো তোর সাথে হুটহাট দেখা করা যাবে না। বৃষ্টি বলল, দেখবি আমি হুট করে একদিন তোর বাসায় চলে গিয়ে সারপ্রাইজ দিয়ে দিয়েছি। মম হাসল। লাগেজ নিয়ে রুম থেকে বের হতেই রায়হান সাহেব বললেন, কি হল? চলে যাচ্ছো!? আরো ক’টা দিন থেকে যাও।

– না খালু। বাসায় কাজ আছে। বৃষ্টিরও মাস্টার্স পরীক্ষা সামনে।

– আচ্ছা, সময় সুযোগ করে আবার এসো।

– আচ্ছা।

দুইজনে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। মম ভাবল বিছানায় একটু পিঠ লাগাবে তার আগেই রিয়ান হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে বলল, তৈরী হও। মম জিজ্ঞেস করল, কেন? কোথায় যাবো? রিয়ান আলমারি খুলে শার্ট নিতে নিতে বলল, আদ্রিতারা বিদেশে চলে যাচ্ছে। মম অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ?

– আলিফ ভাইয়ের নাকি কি জরুরি কাজ পড়ে গেছে তাই আজই চলে যাচ্ছে।

মম কিছু বলল না। রিয়ান ওকে ডেকে বলল, দেখো তো কোনটা পরব। মম প্রতিউত্তরে বলল, যেটা ভালো লাগে। ও একটা সাদা শার্ট বের করে বলল, এটা? মম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সায় পেয়ে ও একটা সাদা শাড়ি বের করে দিয়ে বলল, এটা পরে নাও। মম প্রশ্নসূচক মুখ করে বলল, একই দেখতে পোশাক পরতেই হবে!?

– আমার ভালো লাগে। তোমার লাগে না?

মম বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। রিয়ান ওর সামনে পোশাক পরিবর্তন করতে লাগলে মম হালকা চেঁচিয়ে উঠে বলল, কি করছেন? এখানে শার্ট খুলছেন কেন? রিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তো কি হয়েছে? আমার বউয়ের সমানেই তো। মম পড়ল বিপদে। সবসময় আমার বউ আমার বউ করে। শুনতে ভালো লাগে আবার লজ্জাও লাগে। কিন্তু তাই বলে এমন করবে? মম শাড়ি হাতে নিয়ে ওয়াশরুম রওনা দিল আর মনে মনে বলল, বিয়ের পর লোকটা আসলেই বাচ্চা হয়ে গেছে।

মম শাড়ি পরে বের হয়ে দেখল রিয়ান তৈরী হয়ে গেছে। সবই ঠিক ছিল। শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া। ঐদিনের পাওয়া কোটটা পরে আছে রিয়ান। মম জিজ্ঞেস করল, আপনি এই কোটটা পরেছেন কেন?

– কোটটা সুন্দর না?

– আমি সেটা বলিনি। অন্য কারো কোট আপনি পরেছেন কেন?

রিয়ান কোটের দিকে তাকিয়ে বলল, অন্য কারো!? কার হতে পারে বলো তো। বলে রিয়ান মমকে জড়িয়ে ধরে বলল, বলতে পারো কার কোট হতে পারে? মমর নাকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ লাগল। ঘ্রাণটা রিয়ান থেকে আসছে। এই ঘ্রাণ আগে কোথাও পেয়েছে ও। হুট করে মনে পড়ল এই ঘ্রাণই কোটটাতে পেয়েছিল। ভাবতে ভাবতে মম ওর বুকে মুখ গুঁজে দিল। কেন যেন ভালো লাগছে এভাবে থাকতে। অন্য রকম শান্তি। রিয়ান মাথা নিচু করে ওর কানে ফিসফিস করে বলল, এভাবে থাকলে আদ্রিতাদের বিদায় জানাতে পারব না। মম কথাটা শুনে ওর থেকে সরে এল। রিয়ান দুইপাশে হাত উঠিয়ে বলল, তোমার যদি এভাবে থাকতে ভালো লাগে তাহলে রোজ এভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকব। মম কিছু না বলে ড্রেসিং টেবিলের কাছে চলে গেল। ও যে লজ্জা পাচ্ছে তা দেখানো যাবে না। তা নাহলে আবার কিছু না কিছু বলে বসবে। বিয়ের পর থেকে কেবল লজ্জায় সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে ও। কেন যে হঠাৎ এত লজ্জায় ধরল ওকে বুঝতে পারছে না।

মম চিরুনির দিকে হাত বাড়াতে রিয়ান এসে চিরুনিটা নিয়ে বলল, বসো, আমি বেঁধে দেই। মম ওর দিকে না তাকিয়ে বলল, আপনি পারবেন? ও জোর করে মমকে টুলে বসিয়ে বলল, দেখো না কি পারি। না পরলে শিখিয়ে দিও। রিয়ান ওর চুলের জট ছাড়িয়ে মাথা বাঁধার চেষ্টা করতে লাগল। খোঁপা বাঁধা হচ্ছে না ওর। তাই বেণী করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোনদিক থেকে কোন প্যাঁচ দিবে বুঝতে পারছে না। রিয়ান মন দিয়ে ওর চুল বাঁধার চেষ্টা করছে আর মম আয়নায় একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওর অজান্তেই ওর ছোট ছোট স্বপ্নগুলো এক এক করে পুরণ করে দিচ্ছে রিয়ান। ওর ভাবনার মাঝে রিয়ান বলল, শেষ। মম বেণীটা দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। চুলকে তিন ভাগ করে কোনো রকমে পেঁচিয়ে দিয়েছে ও। হাসিটাই বেশি পেল মমর। সেই বেণীকে ঘুরিয়ে খোঁপা করে কাঁটা আটকে দিল। রিয়ান কোমরে দুই হাত দিয়ে মাথা উঁচু করে বলল, কেমন করলাম? মম হেসে বলল, খুব ভালো করেছেন।

– দেখতে না কে করেছে।

মম কোটটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, এটা তাহলে আপনার কোট। ঐদিন আপনার সাথে দেখা হয়েছিল তাহলে। কোথায় বলুন তো? মনে পড়ছে না আমার। রিয়ান আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, তুমি বিদ্যুৎ চমকানোয় ভয়ে একটা হোটেলের সামনে কুঁকড়ে ছিলে। আমার ঐদিন মিটিং ছিল ওখানে। বিড়ালের এলার্জির কারণে বেরিয়ে এসেছিলাম বাড়ি যাবো বলে। তখন তোমাকে দেখলাম ভিজে অবস্থায় মাথা নিচু করে ভয়ে কাঁপছো। তাই কি ভেবে কোটটা তোমার উপর দিয়েছিলাম। রিয়ান ওর দিকে ফিরে বলল, দেখো তো তোমার জামাইকে হ্যান্ডসাম লাগছে কি না। মম হ্যাঁ বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ‘তোমার জামাই’ শব্দটাতে এত লজ্জা আগে জানতো না মম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here