#অনুবদ্ধ_আয়াস 💚
#ইফা_আমহদ
পর্ব: ০৮
“আমি জানি আমি দেখতে সুন্দর। মেয়েরা আমার দিকে সবসময় চেয়ে থাকত। আমি তো তোমারই, তুমি কেন চেয়ে আছো?”
ধ্যান ভাঙল আমার। সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। রৌধিক বাহু টেনে ধরলো। ইশারায় প্রখর চাওনি দিলো। থেমে গেলাম আমি। মলম লাগিয়ে দিয়ে সরে বসলেন। জানালা মেলে দিলেন। পর্দাগুলো দুই পাশে গুটিয়ে রাখলেন। হাওয়া প্রবেশ করলো। কাবার্ড থেকে চুড়িদার বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। ঝাঁপসা কন্ঠে বললেন,
“যাও চেঞ্জ করে নাও।”
তখনও ঘোরের ভেতরে রয়েছি আমি। আনমনে বলে ফেললাম,” ভালোবাসেন আমায়?”
রৌধিকের শান্ত চাওনি। কেমন অজানা অচেনা অনুভূতি তার মনে। কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। আমার কথা তার কর্ণপথে পৌঁছেছে কী না জানা নেই। না শোনার মতো করে বললেন,” যাও জামা কাপড় ছেড়ে নাও!”
“আমি কিছু বলছি আপনাকে? ভালোবাসেন আমায়?”
“যদি বলি না!” একরোখা জবাব দিলো রৌধিক।
ভাষাগুলো হারিয়ে গেছে অজানায়। এরুপ কথার জবার হিসেবে কী বলা উচিত, সত্যিই জানা নেই আমার। পায়ের শব্দ শোনা গেল। রৌধিক বড় বড় পা ফেলে প্রস্থান করলো। হতাশা ভরা দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রইলাম। যদি ভালোই না বাসে তাহলে এতো কেয়ারিং কিসের? বেডের উপর রাখা লাল রঙের চুড়িদার টা নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলাম।
.
নিজেকে সংযত করে মিনিট বিশেক পর বেরিয়ে এলাম। রৌধিক খাবার খাচ্ছে। ভেজা পা জোড়া ফেলতেই পানির ছোপ ছোপ শব্দ হচ্ছে। সাথে যোগ হলো নুপুরের শব্দ। মাত্র দু থেকে তিন টা ঝুনঝুনি রয়েছে। পানির ফলে একটু বেশি জোরে বাজছে। পা ভেজানোর পরেই এই শব্দ হয়। আমি সোফার উপর মেলে রাখা টাওয়াল টা চুলে পেঁচিয়ে নিলাম। চুলের তুলনায় অনেক বড়। আমার মতো একজন মানুষকে নিমেষেই কাবু করতে সক্ষম। মিনমিনে স্বরে বললাম,
“আমার এখন ঘরে যাওয়া উচিত।”
“তুমি কি এখন বাইরে আছো!”
“আমি আমার ঘরে যাওয়ার কথা বলছি।”
“এই বাড়িতে, তোমার নিজস্ব ঘর বলতে কোনো ঘরে নেই। আমার ঘরই তোমার ঘর। বুঝতে পেরেছ তুমি?”
“কিন্তু আমার মতে আমার নিজস্ব কোনো ঘর নেই। দু’দিনের জন্য ঐ ঘরটা আমাকে দেওয়া হয়েছে। মাত্র তো ছয়মাস। তারপরে তো চলে যাবো।”
রৌধিক সন্দিহান চোখে চাইলো। আমার হাত ধরে বেডের উপর বসিয়ে দিলো। নিজের প্লেট থেকে এক লোকমা খাবার তুলে আমার মুখে পুড়ে দিল। খাবারটা চিবিয়ে কথা বলতে নিলে আরো এক লোকমা খাবার পুড়ে দিল। গ্লাসের পানি টুকু হাতে না দিয়ে নিজেই খাইয়ে দিল। হাত ধুয়ে নিলো। এঁটো প্লেটটা টেবিলের উপর উপর রাখল। ঝাঁ’টা দিয়ে ঝেড়ে দিল বিছানা। ভেজা ফ্লোরের পানির ধারা মুছতে মুছতে বললেন,
“ভালোবাসি না বলেছি বলে আকাশে মেঘ জমেছে, তাই তো?”
আমি নিজেই জানি না, কেন আমার মন খারাপ। মৃদু স্বরে বললাম,
“না! হয়তো বা তাই। আপনি আমাকে ভালো না বাসলে এতো কেয়ারিং কেন দেখান। শুভের সাথে দেখার পর, আমার গায়ে হাত তুলছেন। আমি মেনে নিয়েছি। সেদিন রাতে আমাকে বউ বলে সম্বোধন করেছেন, সেটাও মেনে নিয়েছি। এখন বলছেন ভালোবাসি না। আবার বলছেন, আমার উপর অভিমান করেছেন। মানুষ তো তার উপরই অভিমান করে, যাকে সে ভালোবাসে। আমি গিরগিটি দেখেছি, কিন্তু আপনার মতো গিরগিটি দেখি নি।”
রৌধিক সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। জানালার পর্দার সরিয়ে বাইরে অদূরে। শক্ত গলায় বললেন,
“তুমি আমার ওয়াইফ। এই কেয়ার টুকু করা আমার দায়িত্ব। তোমাকে আমি ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করবে, এটা আমি মানতে পারি না। অহেতুক তোমার উপর অভিমান করে বসে ছিলাম।”
নিজেকে কেমন ছোট মনে হলো। শুধু ওয়াইফ বলেই তিনি আমার যত্ন করছেন। আমি যেটাকে ভালোবাসা মনে করেছিলাম, সেটা শুধু দায়িত্ব। মৃদু স্বরে আওড়ালাম,
” আমি শুধুই আপনার ওয়াইফ।”
“জোনাকি তোমার সাথে আমার পরিচয় মাত্র কয়েক দিনের। এই কয়েকদিনে কাউকে ভালোবাসা কী আদোও সম্ভব? তাহলে? আমি কর্তব্য থেকে সবকিছু করছি, জোনাকি।
শেফা আমার ভালোবাসা হলেও ওর প্রতি আমার কোনোদিন তেমন ফিলিং ছিলো না। শেফার থুতনিতে জায়গায় তিল ছিল কাকতালীয় ভাবে তোমারও সেম জায়গায় তিল রয়েছে..
আমার হাত গিয়ে ঠেকলো থুতনিতে। আমি বসে আছি। রৌধিক বলেই চলেছে। তার কন্ঠস্বর আমার কানে যাচ্ছে না। আমি বালিশ টেনে শুয়ে পড়লাম এক কোণে। সত্যি তো একটা ছেলে ডিপ্রেশনে ছিল, সে কিভাবে আরেকজনকে ভালোবাসতে পারে। তাহলে যে তার ভালোবাসা টাই মিথ্যা। রাজ্যের ঘুম এসে তলিয়ে দিলো নিদ্রার অতলে।
ভোরের দিকে তাপমাত্রা হ্রাস পেয়েছে। শিশিরের বিন্দু বিন্দু জলকণা ঘাসের উপর পড়ছে। আবার জমাট বেঁধে তুষার ন্যায় শূন্যতায় ভেসে বেড়াচ্ছে। আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে চারদিকে। নিজেকে দৃঢ় বাঁধনে আবিষ্কার করলাম। নিভু নিভু চোখ মেলে তাকাতেই নজরে এলো ফর্সা পুরুষালী লোমহীন বুক। তীব্র পারফিউমের গন্ধ। মাথা তুলতেই কপালে আঘাত পেলাম। ধরে উঠলো মাথা। মাথায় হাত দিয়ে ধীরে ধীরে সরে আসার চেষ্টা করলাম। রৌধিক আমাকে নিজের সাথে পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মুখে তৈলাক্ত আভা ফুটে উঠেছে। ঘুমের মাঝেও ভ্রু নড়ছে। এই বাড়িতে এসে আর কিছু পারি আর না পারি ভ্রু নাচাতে পারি। বামটা। ডানটাও শিখতে হবে। রৌধিক নড়েচড়ে আরো দৃঢ় করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন আমায়। অতিবাহিত হলো আরো কিয়ৎক্ষণ। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে রৌধিকের। মুখের সামনে শূন্যতায় হাত দেখিয়ে সরে গেলাম। অজু করে জায়নামাজে এসে দাঁড়ালাম। নামাজ আদায় করে বেলকেনিতে গিয়ে একটু দাঁড়ালাম। অনেকদিন ভোরের উষ্ণ আকাশ দেখা হয় না।
বাবাকে আজকে রিলিজ করে দেওয়া হবে। দশটায় অফিসে যেতে হবে। আটটার দিকে বাড়ি থেকে বের হতে হবে। ছোট বেলার স্মৃতি হিসেবে, একটা লকেট ছিল। সেটা বিক্রি করে হসপিটালের বিশ পে করতে হবে। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে পা বাড়ালাম। পায়ের সাথে কিছু বেঁধে পড়ে যেতে নিলাম। মাঝপথে থেমে গেলাম। নিজেকে সামলে নিচের দিকে তাকালাম। রৌধিকের টি শার্ট পড়ে আছে। এটা গতকাল রৌধিকের পড়নে ছিলো। একবার রৌধিকের দিকে অবলোকন করলাম। গুটি শুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। আমি আর কারো দয়া চাই না। মুক্ত হয়ে বাঁচতে চাই। পায়ের কাছে গুটিয়ে রাখা ব্লাঙ্কেট টা গলা পর্যন্ত টেনে দিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলো।
________________
সময় নয়টা বিশ। হসপিটালের ঝামেলা মিটিয়ে মিনিট বিশেক হয়েছে বাড়িতে এসে পৌঁছেছি। নিজের প্রিয় লকেট টা পয়ত্রিশ হাজারে বিক্রি করেছি। বাবা হসপিটালে বিলের ত্রিশ হাজার চারশো নব্বই টাকা শেষ। এখনো কয়েকটা দিন বাকি।
দুই রুমের ঘর। একটাতে আমি আর জয়া থাকতাম। অপর টাতে বাবা একা।
এসেই সকালের নাস্তা তৈরি করেছি। জয়ার আবার পরীক্ষা দুদিন পর। বাবার শুয়ে আছে। নাস্তা নিয়ে টেবিলের উপর রাখলাম। বাবার পাশে বসে ধীরে ধীরে ডাক দিলাম,
“বাবা, ঘুমিয়ে গেছো। ওঠ। ওঠে নাস্তা খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও।”
বাবা এক চোখ মেললেন। বেশ গম্ভীর তার চাওনি। জয়া রেডি হয়ে এসেছে। স্কুলের টাই বাঁধতে বাঁধতে এসে বলল,
” আপু, আমার লেট হয়ে যাচ্ছে। এটা একটু বেঁধে দে তো?”
টাই বেঁধে গাল ধরে টান দিলাম। অতঃপর দু’জনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম। হুট করেই জয়া আমাকে জ’ড়িয়ে ধরে বলল,
“তোকে খুব মিস্ করছিলাম রে আপু।”
জয়ার চোখে পানি। আলতো করে মুছে দিয়ে বললাম,
“আমিও মিস্ করছিলাম।”
জয়া সবে ক্লাস ফাইভে পড়ে। পড়াশোনায় বেশ মেধাবী।
বাবা উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলল,
“আমি তোদের দুজনকে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছি, তাই না?”
জয়া তেঁতে উঠলো। বিরাগী কন্ঠে বলল,
” লে, শুরু হয়ে গেছে।”
“এটা কোন ধরনের কথা জয়া।”
ধমকে বললাম আমি। বাবার পাশে বসলাম। নাস্তা খাইয়ে দিলাম। মেডিসিন খাইয়ে দিলাম। বাবার চোখে অশ্রু চিকচিক করছে। হতাশা ভরা কন্ঠে বললেন,
“আমি বেঁচে থেকে তোদের খুব বিপদে ফেলেছি। বোঝা হয়ে আছি। আমি ম’রে যাওয়ার জন্য ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু খরচ আরো বেড়ে গেল।
তোদের দুইবোনের বিয়ে হয়ে গেলে আমি শান্তি পাবো। তোদের মায়ের কাছে চলে যাবো।”
এদিকে জয়া রাগে ফুঁসছে। বাবা মাঝে মাঝেই এভাবে কথা বলে, জয়া প্রতিবারই রেগে যায়। ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলে গেল। বলছে,
“দেখেছিস আপু, একটু সুস্থ হয়ে শুরু হয়ে গেছে। হসপিটালে বসেও এগুলো বলছিলো। তাই যতক্ষন বাবা ঘুমিয়ে থাকতো ততক্ষণ সেখানে থাকতাম। ঘুম ভাঙলেই বাড়িতে।”
প্রবেশ ঘটল চতুর্থ ও পঞ্চম ব্যক্তির। শুভ আর তার মা এসেছে। শুভ এসেই বাবাকে সালাম জানিয়ে বসে বসে বাবার খবর নিচ্ছে। ভয়ে ক্রমাগত ঘামচি আমি। বাবাকে এখনো কিছু জানাইনি। আর কয়েকটা দিন পরে জানাতে চেয়েছি। হুট করে ধা’ক্কা সহ্য করতে পারবে না।
[চলবে..ইনশাআল্লাহ]