#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা – জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৬.
~
‘ নৈরিথকে কি তুই পছন্দ করিস মা?’
মিথি হকচকিয়ে উঠলো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ কথা হারিয়ে ফেলেছে সে। বাবার মুখে এমন কোনো কথা কখনো আশা করেনি। ভাবলেশহীন ভাবে মেয়ের দিকে চেয়ে আছেন আতাউর সাহেব। তিনি বড্ড স্বাভাবিক। মিথি ভেবে পাচ্ছে না তার বাবাকে কি উত্তর দিবে। ভীষণ রকম অসহ্য বিরক্তকর মুহূর্ত বোধ হয় এটাকেই বলে। বাবা কেন তাকে এয় প্রশ্ন করলো? উনি কি তবে কিছু সন্দেহ করেছেন? মিথির ভাবনার সুতো কাটলো বাবার কণ্ঠস্বরে। তিনি গম্ভীর সুরে বললেন,
‘ আমাকে ভুল বুঝিস না মা। আমি তোকে যথেষ্ঠ বিশ্বাস করি। আমি শুধু আমার মনের সন্দেহটা দূর করতে চেয়েছিলাম এর থেকে বেশী আর কিছু না। আমার কথায় তোর খারাপ লেগে থাকলে তাহলে এই বাবাটাকে তুই ক্ষমা করে দিস।’
মিথি জোরে একটা নিঃশ্বাস নিল। বাবার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো,
‘ আমাকে তুমি ক্ষমা করো বাবা। আমি হয়তো তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারিনি।’
কথাটা বলেই মিথি বাবার রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
দরজা আটকিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো সে। বুকের মধ্যে ভীষণ চাপ অনুভব করছে সে। সে কি সত্যিই তার বাবার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে? নৈরিথের সাথে তো তার কোনো সম্পর্ক নেই, হ্যাঁ পছন্দ করে সে হয়তো ভালোও বসে। এটাতেও কি বিশ্বাস ভেঙে যায়? নিজের প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পেলো না মিথি। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। চোখের পাতা এক করলেও ঘুমের কোনো দেখা পেলো না সে। আবার উঠে বসলো। আলমারি খুলে একটা ডাইরি বের করলো। বেশ পুরনো একটা ডাইরি। সামনের কাভারটা খানিকটা ছেঁড়া। ডাইরিটা বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো সে। মস্তিষ্কে তখন হানা দিল কিছু পুরনো স্মৃতি।
_____________
তখন বাইরে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ্দুর। লাইব্রেরী রুমে বইয়ের মাঝে মুখ গুঁজে কেউ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পাতা উলটাচ্ছে। হুট করেই সেই মানুষটির পাশে এসে বসলো আরেকটি মানুষ। চোখে তার মোটা ফ্রেমের এক চশমা। মাথায় এক ঝাঁক কোকড়ানো চুল। মুখে চমৎকার হাসি। সে এসেই বললো,
‘ এই মিঠু, পড়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকা।’
উপন্যাস পড়ার মাঝখানে কেউ এসে বিরক্ত করাটা মিথির মোটেও পছন্দ না। এই ছেলেটাও জানে সেটা, তাও সে ইচ্ছে করে এমন করে। যেনো এই পৃথিবীতে তার জন্মই হয়েছে কেবল মিথিকে জ্বালানোর জন্য। মিথি দাঁতে দাঁত চেপে সিফাতের দিকে তাকালো। কর্কশ কণ্ঠে বললো,
‘ কি সমস্যা তোর?’
সিফাত দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘ কোনো সমস্যা না তো। শুধু তোকে বিরক্ত করতে ভালো লাগে।’
মিথির রাগে যেনো ঘি পড়লো। লাইব্রেরী বলে চেঁচাতে পারছে না, নয়তো এতক্ষণে চেঁচিয়ে সব মাথায় তুলতো। মিথি জোরে একটা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করে বললো,
‘ এখান থেকে যা সিফাতের বাচ্চা। নয়তো আমি তোকে মেরে ভর্তা বানাবো।’
সিফাত বরাবরের মতই হাসলো। বললো,
‘ কি ভর্তা বানাবি? আলু না শুঁটকি? কোনটা?’
মিথি দাঁত কিড়মিড় করে সিফাতের দিকে তাকালো। সিফাত ঠোঁট চেপে হাসলো। মিথিকে রাগানোর মত আনন্দ বোধ হয় আর কিছুই হতে পারে না। সিফাত হঠাৎ হাসি থামিয়ে মিথির দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
‘ তোর জন্য একটা গিফট এনেছি মিঠু।’
মিথি হঠাৎ চমকে গেল। সিফাত সচারাচর তাকে কোনো গিফট টিফট দেয় না। আজ হঠাৎ কি ভেবে? মিথির রাগ নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো। সে সিফাতের হাত থেকে গিফটটা নিল। আন্তাজ করে মিথির মনে হলো এটা কোনো বই অথবা ডাইরি। মিথি উৎফুল্ল মন নিয়ে রেপিং করা গিফট টা খুললো। একটা হালকা বাদামি রঙের ডাইরি। মিথি ডাইরিটা উল্টে পাল্টে দেখে বেশ কৌতূহল নিয়ে বললো,
‘ হঠাৎ ডাইরি কেন?’
সিফাত তখন চমৎকার হেসে বললো,
‘ লেখার জন্য?’
‘ কি লিখবো?’
‘ তোর প্রিয় সুখগুলো।’
মিথি কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
‘ প্রিয় সুখ?’
সিফাত মাথা হেলিয়ে বললো,
‘ হুম।’
মিথি তখন মুচকি হেসে ডাইরিটা খুলে। ডাইরির প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো করে লিখে,
‘ সিফাত ‘
সিফাত চোখ মুখ কুঁচকে অবাক কণ্ঠে বললো,
‘ তুই আমার নাম লিখলি কেন?’
মিথি তখন মুচকি হেসে জবাব দিল,
‘ কারণ তুই আমার সবথেকে বড়ো সুখ।’
মিথির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কিছু স্বচ্ছ জল। সিফাতকে এই মুহূর্তে ভীষণ মিস করছে সে। যদি পারতো একবার… শুধু একবার তাকে ফিরিয়ে আনতে। যদি পারতো…
,
,
চোখ খুলতেই দেখলো বাইরে ফকফকা রোদ। মিথি ঘুম থেকে উঠে বসলো। ঘড়ির দিকে তাকাতেই হকচকিয়ে উঠলো সে। এগারোটা বাজতে চললো অথচ এখনও কেউ ওকে ঘুম থেকে জাগায়নি। আজব, মানুষগুলো গেলো কই? মিথি রুমের দরজা খুলে ‘ মা ‘ বলে জোরে ডেকে উঠলো। মাহি মিথির রুমে ছুটে এসে বললো,
‘ কি হয়েছে বুবু?’
মিথি ব্রু কুঁচকে বললো,
‘ কি হয়েছে মানে? এগারোটা বাজে, তোরা আমাকে ডাকিসনি কেন? এখন যে আমার কলেজের লেইট হয়ে গেলো সেটার কি হবে?’
মাহি বললো,
‘ বাবা ডাকতে বারণ করেছে। বলেছে আজ তোমার কলেজ যেতে হবে না?’
মিথি অবাক হলো। বুঝতে পারলো না বাবার এই কথার মানে। সে বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
‘ কেন?’
মাহি ঠোঁট উল্টে বললো,
‘ কি জানি।’
মিথি চিন্তায় পড়ে গেল। মাহিকে যেতে বলে সে উঠে ফ্রেশ হলো।
তারপর সে গেলো রান্নাঘরে। আমিরা বেগম তখন সবজি কাটছিলেন। মিথি গিয়ে তার পাশে বসলো। অনুনয়ের সুরে বললো,
‘ মা, বাবা আমাকে কলেজ যেতে বারণ করেছে কেন?’
আমিরা বেগম সবজি কাটাতেই মনোযোগ রেখে বললেন,
‘ আমাকেও এই ব্যাপারে তোর বাবা কিছু বলেনি ।’
মিথির চিন্তাটা এবার আরো বেড়ে গেলো। নিজের মনকে প্রশ্ন করে জানতে চাইলো। কিন্তু মন তার সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারলো না। বাবাকে একবার ফোন দিবে ভেবেও দিল না, অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকবে এই ভেবে।
মিথি সবেই নাস্তা সেরেছে। চায়ের কাপটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো। আবারও তার চোখ গেল ঐ পাশের ফ্ল্যাটের দিকে। বারান্দার দোলনাটার উপর আজও সেই গিটারটা রাখা। সিফাত এর ও এমন একটা গিটার ছিল। গিটার বাজিয়ে মিথিকে যে সে কত গান শুনিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই তার মনে পড়লো আবারও সেই কথা, কেন বাবা তাকে কলেজ যেতে বারণ করেছে।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিতেই মিথির মনে হলো দরজার বেলটা যেনো বেজে উঠল। সে উঠে তাদের লিভিং রুমে গেল। মাহি দরজা খুলে দিলে আতাউর সাহেব বাসার ভেতর আসেন। বাবাকে দেখে মিথি ভাবলো, এখনি সুযোগ বাবাকে জিগ্যেস করতে হবে কেন তিনি তাকে কলেজ যেতে বারণ করেছেন। তবে মিথি কিছু বলার সুযোগ পেলো না। তার আগেই আতাউর সাহেব গম্ভীর সুরে বললেন,
‘ মিথি, আমার সাথে আমার রুমে এসো। কথা আছে।’
মিথির দুশ্চিন্তা ক্রমে ক্রমে বেড়ে চলছে। মাথায় তার হাজারো চিন্তা ভাবনা এসে হানা দিচ্ছে। হাত কচলাতে কচলাতে মিথি তার বাবার পেছন পেছন তার রুমে গেল। মিথির চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। আতাউর সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ নৈরিথের সাথে আমার কথা হয়েছে মিথি।’
মিথি চমকে উঠে। বড়ো বড়ো চোখ করে বাবার দিকে তাকায়। এক রাশ প্রশ্নের দানা এসে বিঁধল মিথির মস্তিষ্কে। সে জোরে একটা শ্বাস টেনে নিজেকে কিছুটা ধাতস্ত করে বললো,
‘ কি কথা বাবা?’
চলবে…