#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৮.
~
‘এতদিন তো জানতাম তোমার শুধু আমার প্রেমিকা হওয়ার ইচ্ছা, কিন্তু এখন তো দেখছি তোমার চিন্তা ভাবনা আরো অনেক উপরে। রীতিমতো আমার সন্তানের মা হওয়ার ফন্দি আঁটছো। কি সাংঘাতিক তোমার চিন্তা ভাবনা! ভাবা যায়..?’
মিথির এবার মনে হচ্ছে তার মরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কোন দুঃখে সে নৈরিথকে এই কথাটা বলতে গিয়েছিল? কেন সে লাগামহীন ভাবে কথা বলে? উফফ, এবার বুঝো ঢেলা। মিথি অসহায় দৃষ্টিতে নৈরিথের দিকে তাকায়। নৈরিথ ঠোঁট কামড়ে হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঐ রুমে আমিরা বেগম চলে আসেন। একটা ট্রে তে চা আর কিছু নাস্তা নিয়ে এলেন। নাস্তার ট্রে টা তাদের সামনে রেখে বললেন,
‘চা নাও বাবা। আর মিথি তোর জন্য স্যুপ করে আনছি। তুই উঠে ফ্রেশ হয়ে নে।’
মিথি আলতো হেসে বললো,
‘ঠিক আছে মা।’
আমিরা বেগম চলে গেলেন। মিথি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। নৈরিথ তখন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো,
‘পারবে নাকি সাহায্য করবো?’
মিথি বললো,
‘না পারবো। আপনি চা খান।’
ফ্রেশ হয়ে এসে মিথি দেখল, নৈরিথ তার রুমে নেই। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চুলগুলো প্রথমে ঠিক করলো তারপর ড্রয়িং রুমের কাছে গেল দেখার জন্য নৈরিথ আছে কিনা? সেখানে গিয়েও সে নৈরিথকে পেল না। তাই রান্নাঘরে গিয়ে মাকে জিগ্যেস করলো,
‘মা, স্যার কি চলে গিয়েছে?’
‘হ্যাঁ, এখনি তো বেরিয়ে গেল। কি একটা জরুরি কাজ পড়েছে বললো।’
মিথি মন খারাপ করে বললো,
‘ওহহ।’
সে তার রুমে চলে এল। মন খারাপটা আকাশ ছুঁলো। এইভাবে না বলে কেউ চলে যায় বুঝি? একটু তো তার জন্য অপেক্ষা করতে পারতো। কি এমন জরুরি কাজ যে একদম সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে এখনই তাকে বেরিয়ে যেতে হলো? রাগ হয় মিথির। সঙ্গে অভিমানও। সে মুখ কালো করে বিছানায় বসে। কিছুক্ষণ ওভাবেই চুপচাপ বসে থাকে। তারপর কি ভেবে নৈরিথ যে উপন্যাসের বইটা তখন পড়েছিল সেটা সে হাতে নেয়। বইটার খসখসে পাতাগুলো অযথাই সে উল্টে যায়। হঠাৎ সে থমকে যায়, বইয়ের মাঝখানে পাতাটা থেকে একটা সাদা কাগজ পায় সে। কাগজটা হাতে নিয়ে সে ভাবতে থাকে যে এটা কোথ থেকে এল। অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারে না সে। তাই আস্তে আস্তে সে কাগজটা খুলে। কাগজটা খুলে রীতিমত শকড সে। কাগজটাতে নৈরিথের হাতের লেখা। মিথি অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে কাগজটাতে। সে খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা পড়তে থাকে,
‘এই মেয়ে, বাচ্চাদের মতো একদম কথায় কথায় গাল ফুলাবে না। খুব তো আমার বাচ্চার মা হওয়ার স্বপ্ন দেখ, আমার বাচ্চার মা হতে হলে তোমাকে যথেষ্ট ম্যাচিউর হতে হবে। নয়তো নিজে এক বাচ্চা হয়ে আরেক বাচ্চার মা জীবনেও হতে পারবে না, বুঝেছো?’
চিরকুটটা পেয়ে মিথি যতটা না শকড হয়েছে তার থেকে বেশি শকড হয়েছে চিরকুটের এই লাইনগুলো পড়ে। কি ভয়ানক কথা বার্তা! নৈরিথ ভয়ংকর ছেলে, যাকে সহজ ভাষায় বলে মিচকা শয়তান। যার শয়তানি ধরা যায় না আরকি। কি ভদ্র সেজে বসে থাকে, যেন কিচ্ছু বুঝে না আর কথা বলার সময় পুরো দাবানলের উপর ছিটকে এসে শরীরে পড়ে। সাংঘাতিক সব ব্যাপার স্যাপার। মিথির বুক ধুকধুক করছে। চুপচাপ বইটা বন্ধ করে সে বিছানায় শুয়ে পড়ে। শুয়েও শান্তি পেল না সে। তাই নেহাকে ভিডিও কল দিল। একটা রিং হওয়ার সাথে সাথেই নেহা কলটা রিসিভ করলো। নেহা হেসে বললো,
‘কি করছিস?’
‘ভাবছি?’
নেহা ব্রু কুঁচকালো। বললো,
‘কি ভাবছিস?’
‘তোর ভাইয়ের কথা।’
‘ওহহ। ভাব..যত খুশি ভাব। কে তোকে বাঁধা দিল।’
‘জানিস নেহু তোর ভাই কিন্তু অতটাও ভোলা ভালা না যতটা সে সেজে থাকে। উনি কিন্তু মিচকা শয়তান।’
নেহা নাকের পাল্লা ফুলিয়ে বললো,
‘ঐ কি করেছে আমার ভাই, যে তুই ওকে মিচকা শয়তান বলছিস?’
মিথি বলতে গিয়েও থেমে গেল। মনে মনে ভাবল নেহাকে এত কিছু বলা যাবে না। নয়তো এই মেয়েও নিজের ভাইয়ের মতো তাকে লজ্জা দেওয়া শুরু করবে। মিথি কথাটা ইগনোর করে বললো,
‘তোর ভাই আমাকে কি একটা বলবে বলবে বলেও বলছে না।’
নেহা বললো,
‘কি কথা বলবে?’
‘আমি কি জানি। তোর ভাইকে গিয়ে জিগ্যেস কর।’
নেহা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
‘মনে হচ্ছে যেন আমি জিগ্যেস করলেই ভাই আমাকে গড়গড়িয়ে সব বলে দিবে।’
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘তাও ঠিক। তোর যা ভাই, দুনিয়ার সবকিছু পেটের মধ্যে হজম করে ফেলতে পারে।’
আরো কিছুক্ষণ দুজনে কথা বললো। পরশু আবার তাদের প্রেকটিকেল পরীক্ষা। মিথি এই অবস্থাতে কিভাবে পরীক্ষাটা দিবে সেটাই ভাবছে। নেহা তাকে বুঝাচ্ছে এত টেনশন না নিতে। আগে থেকেই তারা হলের স্যার মেমদের সাথে কথা বলে রাখবে।
.
.
রাত পেরিয়ে সকাল হলো। বাইরে চৈত্রের খা খা রোদ্দুর। সেদিকে দিকে যেন তাকানো মুশকিল। ঘরে ফ্যানের নিচে থেমে ঘামে ভিজে উঠে শরীর। আর যারা রোদে পুড়ে, রিক্সা চালায় বা ক্ষেতে খামারে কাজ করে তাদের যে কেমন বেহাল দশা হয় এক খোদাই জানে। এই কাঠফাটা রোদ্দুরে অক্লান্ত পরিশ্রমে শরীর থেকে ঝড়ে পড়া তরল পানীয়গুলোই বলে দেয় এই মানুষগুলো কতটা শ্রান্ত পরিশ্রান্ত।
মিথি বারান্দায় বসে আছে। সামনের রাস্তায় এক বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালাকে দেখতে পাচ্ছে তিনি তার লুঙ্গির প্যাঁচানো পুটলিটা খুলে জমানো টাকাগুলো গুনছে। কতটাকা হবে এখানে? একশো, দুশো কিংবা এক হাজার, দু’হাজার। কোটি কোটি টাকা তো আর নেই। হয়তো এই টাকা দিয়েই ছেলেকে পড়ার জন্য একটা খাতা একটা কলম কিনে দিবেন। হয়তো এই টাকাতেই নিজের অসুস্থ বউটার চিকিৎসা করাবেন। আবার এই টাকাতেই বাসায় এক মুড ডাল ভাত কিনে নিয়ে যাবেন। এই কিঞ্চিত টাকাতেই তারা তাদের সব আয়েশ আবদার পূরণ করে। কিন্তু যাদের হাজার হাজার টাকা আছে, ব্যাংক ব্যালেন্স আছে তারা সেই টাকাতেও সুখী থাকতে পারে না। তাদের খালি একটাই চিন্তা থাকে, আরও লাগবে, আরও লাগবে। অল্পতে সন্তুষ্টি থাকতে পারলে তারাও পারতো এই ক্লান্ত শ্রমিকগুলোর মতো সুখী হতে। কিন্ত আফসোস, তারা পারেনা..
মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। কত ভাবনা তার মাথায়। মায়া হয় এই বৃদ্ধ লোকগুলোকে এইভাবে কষ্ট করতে দেখলে। কিন্তু কি করার পেটের দায়ে তাদের কষ্ট করতেই হবে। নয়তো তো তারা না খেয়ে মরবে।
চা খাওয়া শেষ হলে মিথি তার ভাইয়ের রুমে যায়। মাহি তখন শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল। মিথি আস্তে করে তার পাশে বসে। মাহি টিভি দেখা বন্ধ করে তার বোনের দিকে তাকায়। বাচ্চা বাচ্চা চোখ গুলোতে ছেয়ে আছে একরাশ কৌতুহল। সে তাকিয়েই থাকে। মিথি এবার কিছুটা অবাক হয়ে মাহিকে বলে,
‘কি হয়েছে? কি দেখছিস এমন করে?’
মাহি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে উত্তর দিল,
‘বুবু একটা সত্যি কথা বলবে?’
মিথি আবারও অবাক হলো। বললো,
‘কি সত্যি কথা?’
মাহি ব্রু বাঁকাল। তার দু ব্রুর মাঝখানে আড়াআড়ি দাগ পড়ল। সে বললো,
‘তোমার কি হয়েছে বলতো? মা আমাকে যে খাবার দেয় তোমাকেও কেন সেই খাবার দেয়? তারপর তুমি এত কিসের ঔষধ খাও? আর তুমি এখন সবসময় এমন চুপচাপ হয়ে থাকো কেন? আগে তো কত লাফালাফি করতে। আমার অপারেশন হয়েছে বলে ডক্টর আমাকে একদম লাফালাফি করতে এখন সাফ বারণ করে দিয়েছে সব সময় রেস্টে থাকতে বলেছে। কিন্তু তোমার কি হয়েছে? তুমি কেন আমার মতো চলছো?’
মিথি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। কি জবাব দিবে এখন তার ভাইকে? বাচ্চাটা এত কিছু খেয়াল করে? মিথি একটু সময় নিয়ে ভাবল। তারপর দুটো নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বললো,
‘তুই এত কিছু খেয়াল করিস? আমি তো ভেবেছি তুই কার্টুন ছাড়া দুনিয়ার আর কিছু নিয়েই ভাবিস না। যাক শুনে ভালো লাগল, আমাকে নিয়েও যে তুই এত ভাবিস। আচ্ছা, এখন আসল কথায় আসা যাক। আমি কোথায় তোর মতো চলছি বলতো? আমি তো আগের মতোই আছি। যখন যা মন চাচ্ছে খেয়ে চলছি। তুই তো এই রুমে থাকিস তাই দেখিস না। আর তুই অসুস্থ বলে মনটাও একটু খারাপ তাই হয়তো তোর মনে হচ্ছে আমি আর আগের মতো নেই। কিন্তু সত্যিটা হলো আমার কিচ্ছু হয়নি, আমি একদম সুস্থ। বুঝেছিস?’
মাহির চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে যেন ঠিক তার বোনের কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না। তাও নিজের বাচ্চা মনকে সে বুঝিয়ে নিল। মুচকি হেসে বললো,
‘হ্যাঁ, বুঝেছি।’
চলবে..