তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব-২৪

0
1168

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৪.
~
‘সবকিছু যখন ঠিক ঠাক তখন আর অপেক্ষা করে কি হবে? আজই বরং ওদের কাবিনটা করিয়ে ফেলি? কি বলেন ভাই?’

আতাউর সাহেব খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠলেন কথাটা শুনে। বললেন,

‘অবশ্যই অবশ্যই আপা। আমার তো কোনো আপত্তি নেই। তবে আমাদের ছেলে মেয়ের সিদ্ধান্তটাও তো জানতে হবে। নেহা মা যাও তো ওদের একটু এই রুমে নিয়ে এসো।’

‘ঠিক আছে আংকেল, যাচ্ছি।’

নেহা মিথির রুমে গেল। নেহাকে দেখা মাত্রই মিথি ছুটে গিয়ে তার হাতটা চেপে ধরল। কর্কশ গলায় বললো,

‘খুব বড়ো বড়ো কথা বলছিলি তাই না? কুত্তি, এক আছাড় মেরে তোকে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলব। অসভ্য কোথাকার। কিচ্ছু বলেনি আমাকে, আর আমি এইদিকে টেনশন করতে করতে শেষ।’

নেহা দাঁত বের করে হাসল। বললো,

‘আগে থেকে বলে দিলে কি আর সারপ্রাইজ থাকতো, হু? আর এখন আরো একটা সারপ্রাইজ আছে। ঐরুমে চলো তাড়াতাড়ি। ভাই তুইও চল।’

মিথি ব্রু কুঁচকে বললো,

‘আগে বল কি সারপ্রাইজ তারপর যাবো।’

নেহা তার দুই হাত মিথির কাঁধের উপর রেখে মিহি কন্ঠে বললো,

‘তোমাদের এখন কাবিন হবে। মা আর আংকেল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তাই তোমাদের মতামত জানতেই ডাকা হয়েছে। চলো চলো।’

মিথি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। মানে আজই কাবিন? প্রথম সারপ্রাইজটা সামলে উঠতে পারলেও এটাতে সে আটকে গেছে। উদ্ভুত লাগছে সবকিছু। সে নৈরিথের দিকে তাকাল। নৈরিথ স্বাভাবিক। মিথি কিছু একটা ভাবল। নেহাকে বললো,

‘তুই যা নেহু। আমরা এখনই আসছি।’

‘কেন, আমার সাথে আয়?’

‘না আমার একটু উনার সাথে কথা আছে। তুই যা আমরা আসছি।’

নেহা চোখ মেরে বললো,

‘ওহহো উনি! ঠিক আছে ঠিক আছে তুমি তোমার উনার সাথে কথা শেষ করে জলদি এসো। আমি গেলাম।’

নেহা চলে যেতেই মিথি নৈরিথের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নৈরিথের কপালে ভাঁজ পড়ল। মিথির মুখ দেখেই সে বুঝতে পারছে মেয়েটা কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ধ। নৈরিথ তাই জিগ্যেস করলো,

‘কি হয়েছে?’

মিথি মাথা নিচু করে নিশ্বাস নিল। ক্ষীণ সুরে বললো,

‘আমি শারীরিক ভাবে সুস্থ নয়। আমার একটা কিডনী নেই। আমি জানি বেঁচে থাকার জন্য কেবল একটা কিডনীই যথেষ্ঠ। কিন্তু, সেক্ষেত্রে আমাকে অনেক কিছু বেছে চলতে হবে। সবসময় ডক্টরের কাছে দৌঁড়াতে হবে। কারি কারি ঔষধকে আগলে ধরে বাঁচতে হবে। আর এইসব কিছু আপনিও জানেন। একটা অসুস্থ মানুষকে নিয়ে সারাজীবন কিভাবে পার করবেন? এক সময় হাঁপিয়ে উঠবেন। মনে হবে সবকিছু অসহ্য লাগছে, মনে হবে আর পারছেন না। কিন্তু তখন চাইলেও সবকিছু থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না। একটা কিছু আটকে দিবে আপনাকে। আপনি জোর করে নিজেকে মানিয়ে নিবেন। কষ্ট হলেও সহ্য করে নিবেন। তবুও কিছু বলবেন না। হয়তো আমার কষ্টের কথা ভেবে। একদিন তো এমনটাই হবে, তাই না?’

মিথির কন্ঠ শেষে ধরে আসছিল। এখন তার মনে হচ্ছে সে নিজেকে নৈরিথের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে না তো? তার জন্য নৈরিথের স্বাভাবিক জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে না তো? আপাত দৃষ্টিতে সবকিছু যতটা সহজ বাস্তবে ঠিক ততটাই কঠিন।
নৈরিথ অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। চেয়ে রইল তার সামনে দণ্ডায়মান এই নিখুঁত সুন্দর মানবীটার দিকে। নৈরিথ জিভ দিয়ে তার ঠোঁট ভিজিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর সে মিথির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোতে নিল। মিথি অবাক হয়ে তাকাল। চোখ দুটি বিস্ময়ে তার চিক চিক করছে। নৈরিথ নরম সুরে বললো,

‘একটা মানুষ বিয়ে কেন করে বলতে পারো? আচ্ছা, একটা পুরুষ মানুষ কেন বিয়ে করে? নিজের শারিরীক চাহিদা মেটানোর জন্য? নিজের মানসিক শান্তির জন্য? নাকি এই দুটোর জন্যই? আচ্ছা এই দুটো জিনিস কি বিয়ে ছাড়া পাওয়া যায় না? যায় তো, এই যে আজকালকার সো কলড গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডরা তারা কিন্তু বিয়ে না করেও এই দুটো জিনিসই উপভোগ করতে পারছে। তবে মানুষ বিয়ে কেন করে?(একটু থেমে) মানুষ বিয়ে করে একটা বন্ধু পাওয়ার জন্য। যেই বন্ধু বিনা স্বার্থে আজীবন তার পাশে থাকবে। যেই বন্ধু তার সবথেকে খারাপ সময়েও তাকে ছেড়ে যাবে না। যেই বন্ধু এটা ভাববে না যে এই মানুষটা অসুস্থ তার সাথে কিভাবে সারাজীবন পার করবো। বরংচো সে এটা ভাববে এই মানুষটাকে সারাজীবন কিভাবে আগলে রাখবে, কিভাবে ভালো রাখবে। তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে থাকবে তার এই বিয়ে করা বন্ধু। যাকে নিয়ে সে দিব্যি তার জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। তো এখন বলো, বউ না বন্ধু হবে আমার? আমি জানি আমাকে তোমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার তোমাকে প্রয়োজন। বন্ধু হিসেবে প্রয়োজন। যখন জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে সবকিছু অসহ্য লাগবে তখন যেন তোমাকে পাশে পায়। যখন মনে হবে আর পারছি না তখন যেন তোমাকে পাশে পায়। পাশে থাকবে তো আমার?’

মিথি কেঁদে ফেলল। লজ্জায় আর সংকোচে মাথা নুইয়ে ফেলল। নৈরিথ মুচকি হেসে বললো,

‘কাঁদতে হবে না। আমি জানি তোমার সম্মতি আছে। তবে চলো আমাদের বন্ধুত্বকে পাকাপাকি করার জন্য এগ্রিমেন্টে সই করা যাক।’

মিথি চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানলো। নিজেকে শক্ত করে বললো,

‘ঠিক আছে, চলুন।’
.
.

কিছুক্ষণ আগেই মিথি আর নৈরিথের কাবিন সম্পন্ন হয়েছে। মিথি কেঁদে কেটে এখন পড়ে ঘুমাচ্ছে। ঐদিকে টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। নৈরিথের জামাই আদর চলছে। বেচারা লজ্জায় লাল। নতুন জামাই বলে কথা।
.
জীবন বড় অদ্ভুত! কখন কার সাথে কি ঘটে তার কোনো ঠিক ঠিকানা পাওয়া যায় না। এই যেমন আজ সকালেও কি মিথি জানতো তার আজ বিয়ে হয়ে যাবে? জানতো না। এমন অনেক কিছুই প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে। হুট করেই এমন কিছু হয়ে যাচ্ছে যেটা আমরা কোনোদিন কল্পনাও করেনি। এই বাড়ির মেয়েটা এখন সময়ের ব্যবধানে অন্য বাড়ির বউ। আসলেই জীবন বড়ই অদ্ভুত!
.
ঘুমের মাঝেই মিথি টের পায় তার পা টা সিড়সিড় করছে। বিরক্ত হয়ে নড়ে উঠে সে। তবুও সেই সুড়সুড়ানিটা কমছে না। বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে তাকায় সে। পায়ের সামনে নেহাকে দেখে লাথি মারে। নেহা বড়ো বড়ো চোখ করে চেঁচিয়ে উঠে বলে,

‘কত বড় বেয়াদব মেয়ে! নিজের একমাত্র ননদকে লাথি মারে? ও মাই গড! এ কার সাথে আমি আমার ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছি? হায় খোদা, আমি জেনে বুঝে এই বেয়াদব মেয়েটার সাথে আমি আমার ভাইয়ের বিয়ে কি করে দিতে পারলাম?’

নেহা ন্যাকা কান্না জুড়ে বসলো। মিথি তখন চেঁচিয়ে উঠে বললো,

‘উফফ, নেহু। আমার প্রচন্ড পেটে ব্যাথা করছে। আমাকে একটু উঠে বসা প্লীজ, আমি উঠতে পারছি না।’

নেহা লাফিয়ে মিথির কাছে গিয়ে তাকে ধরে উঠে বসায়। তারপর অস্থির হয়ে বলতে থাকে,

‘হঠাৎ পেটে কেন ব্যাথা করছে? সেলাইটাতে কোনো সমস্যা হয়েছে? ঔষধ খাসনি আজকে? দাঁড়া, আমি ভাইকে ডেকে নিয়ে আসছি।’

নেহা উঠতে নিলেই মিথি তার হাত ধরে ফেলে। তারপর দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

‘আরে বেবি এত হাইপার হচ্ছো কেন? এসব কিছু আমার এক্টিং ছিল তোমার ন্যাকামো থেকে বাঁচার জন্য।’

নেহা মিথির বাহুতে চড় মেরে বললো,

‘শয়তান মেয়ে, আমি তো সত্যি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’

মিথি হাসে। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে, আরে তার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কাবিন নামাতে সাক্ষর করতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একেবারে ঘুম। এমন অদ্ভুত কাজ আজ পর্যন্ত কোনো বউ করেছে কিনা সন্দেহ। মিথি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলে,

‘এই নেহু, তোর ভাই কই? আর আমার শ্বাশুড়ি মা, উনি আবার রেগে টেগে যাননি তো আমি এইভাবে ঘুমিয়ে পড়াতে?’

নেহা বিরক্ত হয়ে বললো,

‘না কেউ রাগে নি কারণ সবাই জানে তুমি যে ঘুম ছাড়া আর কিছু পারো না। মা আর ভাই লিভিং রুমে। খাওয়া শেষ করে এখন মিষ্টি খাচ্ছে বোধ হয়। আর আমাকে আন্টি পাঠিয়েছে তোকে ডাকার জন্য। কিছুক্ষণ পরেই আমরা চলে যাবো তাই।’

মিথি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে। এইভাবে কেউ ঘুমিয়ে পড়ে? তার শ্বাশুড়ি মা কি ভাবল তাকে নিয়ে কে জানে? মিথিকে কিছু ভাবতে দেখে নেহা ফিসফিসিয়ে বললো,

‘কি রে কি ভাবছিস, বাসরের কথা? ভাবছিস বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে এবার বাসরের পালা। কিন্তু শোন, কাবিনের পরে কিন্তু ছেলে তার বাড়ি ব্যাক করে ওসব বাসর টাসর তখন হয় না। সেসব হয় একদম অনুষ্ঠানের পর। তবে তুই যদি বলিস আমি কিছু একটা করে দেখতে পারি। আই মিন আমাকে শুধু পাঁচশ টাকা ঘুষ দিয়ে দে আমি এক্ষুণি তোর বাসরের ব্যবস্থা করে ফেলছি।’

মিথি তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

‘থাক বেবি তোমার কোনো কষ্ট করতে হবে না। আমার না বাসর করার কোনো ইচ্ছে নেই। আর আমার মনে হয় তোমার ভাইয়েরও সেই ইচ্ছে নেই। তাই অযথা তোমার কোনো কষ্ট করতে হবে না। জাস্ট চিল বেবি।’

নেহা নাক মুখ কুঁচকে বললো,

‘যা ফকিন্নি। আমার কথার দাম দিলি না তো, ওকে ফাইন। আমিও আর যেচে পড়ে কাউকে সাহায্য করতে যাবো না।চললাম আমি।’

নেহা উঠে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে গেল। আবার কি ভেবে পেছনে তাকিয়ে বললো,

‘ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি লিভিং রুমে আয়। আমার ভাইটা তার বউকে দেখতে না পেয়ে কষ্টে মরে যাচ্ছে।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here